Advertisement
  • খাস-কলম পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
  • ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৩

রেডিও‌ থেকে আকাশবাণী,ইথার তরঙ্গের উত্থানের কাহিনী

সঞ্জীব দেবলস্কর
রেডিও‌ থেকে আকাশবাণী,ইথার তরঙ্গের উত্থানের কাহিনী

আলোকচিত্র : নিউইয়র্ক, ১০ নভেম্বর ১৯৩১। রেডিও সাক্ষাৎকারে আমেরিকার জাতীয় ছাত্র সংগঠনের সচিব চেস্টার উইলিয়ামসের মুখোমুখি রবীন্দ্রনাথ । বিষয় বিশ্বগঠনে যুব সমাজের ভূমিকা ।

শৈশবে শুনতাম আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুই নাকি সর্বপ্রথম বেতার সম্প্রচারের মূলতত্ত্বটি আবিষ্কার করেন। সেই থেকেই ইটালিয়ান বিজ্ঞানী মার্কনি সাহেবকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভেবে বিস্তর উষ্মাপ্রকাশ করতাম। আত্মপ্রসাদও লাভ করতাম এ ভেবে যে আসলে এ কৃতিত্বটাই ভারতবাসীর, যে যা’ই বলুক না কেন। তবে আমাদের বিজ্ঞান বইতে এ নিয়ে তেমন কোনও কিছু খুঁজে পাইনি। কলেজে উঠে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রদের জিজ্ঞেস করে জানলাম, জগদীশচন্দ্র বসুর কৃতিত্ব নিয়ে আমাদের মা মাসিরা যতটুকু সরব এর কণাও আমাদের পাঠ্যপুস্তক রচয়িতারা নন। মাধ্যমিক থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর স্তরে কিংবা প্রাগ্রসর পাঠক্রমে পদার্থবিদ্যা, বা উদ্ভিদবিদ্যায় জগদীশচন্দ্রের কোনও উল্লেখ নেই। এ সত্যিই আশ্চর্য। সাহিত্যের বইতে ‘ভগিরথীর উৎস সন্ধানে’ শীর্ষক একটা পাঠ নিয়েই আমাদের তৃপ্ত থাকতে হচ্ছে অদ্যাবধি। অবশ্য রবীন্দ্র প্রসঙ্গে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর কৃতিত্বের অনেক কথাই উঠে এসেছে। এখনও প্রৌঢ়দের ঘরে সাজানো অ্যান্টিকপিস হিসেবে সাজানো রেডিওটির দিকে তাকিয়ে জগদীশচন্দ্র বসুর জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলতে দেখা যায়।
আজকের দিনটিতে যে কথা বলা খুবই প্রাসঙ্গিক তা হল, ১৮৯৫ সালে কলকাতায় আমাদের বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুই সফলভাবে বেতার সম্প্রচার করে এ দেশে শ্রুতি মাধ্যমের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা সৃষ্টি করলেন। এরপর ১৯১২ সালে এক বিদেশি কোম্পানি, নাম ‘মার্কনি’ কলকাতার হেস্টিংস স্ট্রিট থেকে একটি সম্প্রচার শুরু করেন। আবার ১৯২৩ সালে ‘রেডিও ক্লাব অব বেঙ্গল’ প্রাথমিক ভাবে প্রচার শুরু করার দুই বছর পর ১৯২৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েরখ্যাতিমান অধ্যাপক ড. শিশিরকুমার মিত্র পদার্থবিদ্যা বিভাগে ট্র্যন্সমটার বসিয়ে ওয়ারলেসের মাধ্যমে অনুষ্ঠান প্রচার করেন। সেই সম্প্রচারে ভেসে উঠেছিল অমর সংগীত ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কী সংগীত ভেসে আসে’। গায়ক হীরেন বসু।

ষাটের শেষে ভারতের প্রান্তিক শহর শিলচর গুরুচরণ কলেজের বিজ্ঞান শিক্ষক কান্তিভূষণ সেন স্বল্পক্ষমতা সম্পন্ন সম্প্রচার করে শ্রুতি মাধ্যমের ইতিহাসে একটি পদক্ষেপ রেখেছিলেন, এ কথাটরও এখানে উল্লেখ থাকুক। কলেজের ‘সামাজিক সপ্তাহ’ উপলক্ষেএ সম্প্রচার ভারতে ‘কমিউনিটি রেডিও স্টেশন’ এর প্রাথমিক প্রয়াস বলেও চিহ্নিত হতে পারে।

স্বাধীন ভারতে তিনটি যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে উত্তরপূর্বাঞ্চলে, বিশেষ করে কাছাড়কে ভিত্তি করে বেতার সম্প্রচারের প্রয়োজনীয়তার উপর সর্বপ্রথম বিশেষ গুরুত্ব দেন এ ভূমির সন্তান, বিশিষ্ট কথাকার, বহুভাষাবিদ, আকাশবাণীর এক সময়ের অধিকর্তা সৈয়দ মুজতবা আলী। বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের অব্যবহিত পর প্রতিষ্ঠিত হয় আকাশবাণীর শিলচর কেন্দ্র, ১৯৭২ সালের ১১ আগস্ট তারিখে। এও এক ইতিহাস।

ফিরে যাই পুরোনো দিনের কথায়। তখন রেডিও শোনা হত কানে হেডফোন লাগিয়ে। ১৯২৬ থেকে ২৭ সালের মাঝামাঝি বেতার যন্ত্র, হেডফোন ইত্যাদি বিক্রির জন্য চালু হল ক্ষুদে রেডিও স্টেশন, আর ১৯২৭ সালের ২৬ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত হল কলকাতা বেতার কেন্দ্র। ইতিপূর্বে ইউরোপীয় এবং ভারতীয় উদ্যোগে বেতারকেন্দ্র চালু করতে মুম্বইয়ের কয়েকজন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি’। বিবিসির কর্মরত জনৈক বিশেষজ্ঞকেও আনা হয় জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে। এ বছরেরই ২৩ জুলাই ভারতের ভাইসরয় লর্ড আরউইনের হাত দিয়ে বোম্বাই বেতার কেন্দ্রের উদ্বোধন হয়। এই দিনটিকেই এ দেশে ‘বেতার সম্প্রচার প্রতিষ্ঠা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়।
১৯২৮ থেকে বেতার সম্প্রচারে আসে বৈচিত্র্য। কলকাতা কেন্দ্রে সংবাদ বুলেটিন ছাড়াও ছাএদের অনুষ্টান, শিশুদের অনুষ্ঠান, নাটক, ফুটবল, ক্রিকেট, ছাড়াও সংগীত শিক্ষার বৈঠক, মহিলা মজলিশ নিয়ে বসল জমজমাট রেডিওর আসর।

১৯৩০ সালের পয়লা এপ্রিল রেডিও আসে সরকারি নিয়ন্ত্রণে, নাম হয় ‘ইন্ডিয়ান স্টেট ব্রডকাস্টিং সার্ভিস’। ক্রমে কেন্দ্রীয় বেতার মন্ত্রণালয় এবং এরপর ‘বিবিধ ভারতী’, অতঃপর ‘প্রসার ভারতী’ আওতায় এসে আকাশবাণী আসমুদ্র হিমাচলে ইথার তরঙ্গে বিস্তার করল শ্রুতি সাম্রাজ্য। একান্তভাবে অ্যামেচার সৌখিন চর্চা থেকে বাণিজ্যিক, এরপর সরকার নিয়ন্ত্রিত স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান আকাশবাণী প্রাচারের নেটওয়ার্ক আজ দেশজুড়ে, সে সঙ্গে রয়েছে বিদেশ সম্প্রচারও। কিন্তু তবু সর্বত্রগামী হতে রেডিওর আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হল।

গত শতকের ষাট দশকে সারা বিশ্বের সঙ্গে এ দেশে পোর্টেবল ট্র্যানজিস্টারের আত্মপ্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাজার জাঁকিয়ে বসল ছোট, মাঝারি আকারের রেডিও সেট। অভিজাত ঘরের শোভাবর্ধক ঢাউস সাইজের মারফি, ফিলিপসের দিন শেষ হতে চলল। সূচিত হল ট্র্যনজিস্টার রেডিওর স্বর্ণযুগ। রেডিও সত্যিই পৌঁছে গেল সবার ঘরে ঘরে।
ওদিকে ১৯০২ সালে লন্ডন থেকে দ্যা গ্রামোফোন অ্যন্ড টাইপ রাইটার লিমিটেডের প্রতিনিধি হয়ে আসা জন ওয়টসন হড কলকাতায় ক্লাসিক থিয়েটারের অমরনাথ দত্ত এবং অপর আরেকজন বিদেশি, ফ্রেড গেইন্সবার্গ মিলে ৮ নভেম্বর শশীমুখী আর মিস ফণিবালা, এ দুই নাটকের অভিনেত্রী কণ্ঠে একখানা গান রেকর্ডিং করে শ্রুতি মাধ্যমে এক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটিয়ে ফেললেন। সিলিনড্রিক্যাল রেকর্ডের যুগ পেরিয়ে লাক্ষা বা গালার চকচকে কালো কালো ডিস্ক রেকর্ড উৎপাদন শুরু হলে নানা বর্গের দিস্তে দিস্তে গানের রেকর্ড মুদ্রিত হয়ে বাজারে ছড়িয়ে পড়ল। সে সঙ্গে এল টিন বা শক্ত ধাতুর চুঙিওয়ালা কলের গান, গ্রামোফোন যন্ত্র। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল এদের বিজ্ঞাপনের বয়ান, ‘সুখী গৃহকোণ শোভে গ্রামোফোন’।

এই বাণিজ্যিক সংগীত উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রেডিওতে যোগ হল হল আরেকটি অধ্যায়। এর হাত ধরে ত্রিশের দশক পেরিয়ে শুরু হল রেডিওর সগৌরব বিস্তার। স্বাধীনতার আগেই দেশে পাঁচ ছয়টি শক্তিশালী ট্র্যানসমিটার তার জাল বিস্তার করে ফেলেছে। আর বাংলা অনুষ্ঠানের জন্য ১৯৩৯ সালে শুরু হল ঢাকা বেতার কেন্দ্র।
এরই মধ্যে দেশে অবসান হল ঔপনিবেশিক শাসনে্র। রেডিও সরব হল নতুন প্রত্যয়ে। সাতচল্লিশের সেই মধ্যরাতে– সারা বিশ্ব ঘুমে অচতন, এমনই মুহূর্তে স্বাধীন ভারতের আত্মপ্রকাশের ঘোষণা—প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর কণ্ঠে ‘ট্রিসট উইথ ডেস্টিনি’ ভাষণ। ইথার তরঙ্গে ছড়িয়ে দেওয়া এ বাণী আজও ভরতবাসীর স্মৃতিতে অটুট।

সেদিন দেশের কতজনের ঘরে রেডিও মজুত ছিল তা আমরা জানি না, তবে সংখ্যাটি যে মোট জনসংখ্যার অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ ছিল তা অনুমেয়। কিন্তু বেতার তরঙ্গে উৎসারিত এ কথাগুলো আজ পঁচাত্তর বছর ধরেই স্মৃতিবাহিত হয়ে অনুরণিত হয়ে চলেছে দেশের আনাচে কানাচে। এমনই ছিল রেডিও মাহাত্ম্য। এখানে স্মরণ করা প্রয়োজন, ইতিপূর্বে ১৯৪২ সালের ৭ জানুয়ারিতে ‘আজাদ হিন্দ রেডিও’ থেকে নেতাজির সেই উদাত্ত কণ্ঠে উচ্চারিত বাক্যগুলোও: ‘আমি সুভাষ বলছি’। নেতাজি এ বেতার সম্প্রচার শুরু করলেন মিত্রশক্তির অপপ্রচারের বিরুদ্ধাচরণ করতে। ক্রমে জার্মান থেকে শর্ট ওয়েবের এ বেতারকেন্দ্র রেঙ্গুন এবং পরে সিঙ্গাপু্রে স্থানান্তরিত হল এবং পুরো দক্ষিণ-এশিয়াসহ সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশটিকে বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, মারাঠি, তামিল, পুস্তু, পাঞ্জাবি, গুজরাটি ভাষায় নিয়মিত নিউজ বুলেটিন প্রচারের আওতায় নিয়ে আসা হয়। ভাবলে আশ্চর্য লাগে অতি অকিঞ্চিৎকর প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে সেদিনের ওই প্রচারিত বাক্যগুলো আজও আমাদের শ্রুতি এবং স্মৃতির ভাণ্ডারে সঞ্চিত রয়েছে।
আমাদের রেডিও শুরু থেকেই সংবাদ প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রচারে বিশেষ যত্নবান ছিল। মুদ্রণ মাধ্যমের মতো রেডিওর তখনও সর্বত্রগামী হয়ে ওঠার বাকি ছিল। দীর্ঘ অ্যারিয়েল টাঙানো, বড় আকারের ব্যাটারি চালিত রেডিওর স্থান জুড়ে নিল সস্তা দরের ট্র্যানিজিস্টার, দু ইঞ্চি সাইজের তিনটে বা চারটে ব্যাটারি চালিত এ রেডিও দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল। মহানগরী থেকে জেলা শহর, শহরতলি, গ্রামগঞ্জে, ঘিঞ্জিবস্তি, শিল্পনগরীর কলোনি, চা বাগিচার শ্রমিক লাইন– সর্বত্র রেডিওবাহিত নিউজ, গ্রামোফোন রেকর্ডে সংগীতানুষ্ঠান, সরাসরি সম্প্রচারিত শাস্ত্রীয়সংগীত, লোকগীতি, প্রাদেশিক গান, রেডিওনাটক, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান পৌঁছে গেল। একই সঙ্গে এতে যুক্ত হল চাষ আবাদের কথা, কৃষি সমাচার, শিক্ষা বিষয়ক এবং সরকারি প্রচার।

এল ১৯৬২ সালে ভারত-চিন যুদ্ধ, ১৯৬৫ ভারত-পাক এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের দিন। রেডিওর সেদিন ছিল বিশেষ ভূমিকা। শক্তিশালী প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে কী করে দিন কে রাত, রাত কে দিন করা যায়, বিশ্বের জনমত গড়ে কী করে পৃথিবীকে যুদ্ধ-পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে নেওয়া যায়, অথবা কী করে শান্তির বাণী প্রচার করে যুদ্ধ পরিস্থিতিকে সংহত করা যায় তাও আমরা প্রত্যক্ষ করলাম।

রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, বেতার সম্প্রচার একটি জাতির সঙ্গে আরেকটি জাতির সম্পর্ক তৈরীতে এবং মানবজাতির একাত্মবোধ জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে ।

২০২৩ সালের বিশ্ব রেডিও দিবসের মূল কথা হল—শান্তির জন্য রেডিও। তেরোটি ঘোষিত কর্মসূচির সব ক’টির মধ্যেই বিশ্বশান্তির বার্তা নিহীত। তাই ভারতীয় উপমাহাদেশে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে রেডিওর প্রসঙ্গ উত্থাপন বিশেষ প্রাসঙ্গিক।

সেদিনের আকাশবাণীর শ্রোতারা অনুভব করেছেন নিরন্তর প্রচারের মাধ্যমে কী করে একটা বিশাল দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করা যায়, দেশবাসীকে উদ্দীপ্ত করা যায় এক অখণ্ড জাতীয়তাবোধে। ইথার তরঙ্গে ভেসে আসা শহিদ সেনাদের উদ্দেশে নিবেদিত স্বর্ণকণ্ঠী লতা মঙ্গেশকরের গান শুনে দেশের প্রাধানমন্ত্রী থেকে সাধারণ জনগণ, শিশু বৃদ্ধ যুবক এবং সিপাই যে অশ্রুবর্ষণ করেছেন তা আজ ইতিহাস—‘ইয়ে মেরি ওয়াতন কি লোগো জরা আঁখোমে ভরলো পানি’। স্মরণ করা যেতে পারে নেফা সীমান্তে চিনা আগ্রাসনের মুহূর্তে সুধাকণ্ঠ ভূপেন হাজারিকার সেই গান যা ওই রেডিওই আমাদের ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল—
কত জোয়ানর মৃত্যু হল
আজি কামেঙ সীমান্ত দেখিলোঁ
দেখি শত্রুর পশুত্ব চিনিলোঁ
আর মৃত মৌন শত জোয়াননে
মোর অশ্রু-অঞ্জলি যাচিলোঁ।। (ভাষা অসমিয়া, হরফ বাংলা)

একাত্তরে পশ্চিম সীমান্ত, পূর্ব সীমান্তে যত কামান গর্জেছে, গোলা বারুদ পুড়েছে, আকাশে উড়েছে যত বোমারু বিমান– এর চাইতে অনেক আনেকগুণ শব্দ-বাক্য-ধ্বনি উৎসারিত হয়েছে আকাশবাণী থেকে। এর বিপরীতে রেডিও পাকিস্তান-ঢাকাও ওই সময় নেমেছিল বাক্যুদ্ধে। ওদের প্রচার কিংবা অপপ্রচার এদিকের শ্রোতার কানেও আসছে। সাধারণ মানুষ বুঝছেন যুদ্ধ লাগছে, কিন্তু কা’র বিরুদ্ধে কে লড়ছে, কেন লড়ছে, এটা বোঝানোর দায়িত্ব নিল আকাশবাণী। এরকম মুহূর্তেই হঠাৎ একদিন ইথার তরঙ্গে ভেসে উঠল ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। জনগণ যা বোঝার বুঝে নিলেন।

অনেকেই মনে করতে পারেন, যুদ্ধের দামামায় সেই দিনগুলোতে রাত দশটায় ‘আকাশবাণী’তে সরব হতেন প্রণবেশ সেন আর দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়। মাত্র পাঁচ মিনিটের এক একটি সংবাদ পরিক্রমায়ই এরা যেন শেষ করতেন যুদ্ধের এক একটা অধ্যায়।
ইতিমধ্যে শ্রোতাদের চেনা হয়ে গেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের কণ্ঠও।

‘আকাশবাণী’ আর ‘স্বাধীনবাংলা বেতার’ থেকে অবিরাম উৎসারিত হত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’, উচ্চারিত হত ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’, ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়’। তখনও জীবনানন্দকে চেনা হয়নি, কিন্তু অংশুমান রায়ের গান এসে এ পরিচিতিটি সম্পূর্ণ করে দিল—‘বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, রূপের যে তার নাইকো শেষ’। এ শাব্দিক প্রতিযোগিতায় আসামও পিছিয়ে ছিল না। (তখনও আকাশবাণীর শিলচর কেন্দ্র স্থাপিত হয়নি।) লুহিতের পার থেকে উৎসারিত ভূপেন হাজারিকার ‘গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা’ এপার ওপার দুইপারই কাঁপিয়ে দিয়েছিল। নবজাত বাংলাদেশ আর মুক্তিবাহিনীর জয়গান গৌহাটি বেতার কেন্দ্র থেকে উচ্চারিত হয়েছিল সুধাকণ্ঠের গায়নে—
ধর্মান্ধতার বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষতা
বিভেদকামী শক্তির সলনি
গঙ্গা পদ্মার একতা…
আমার ভারত এক প্রচণ্ড শক্তিরে
মেলিথোয়া জাগ্রত নেত্র…
…বিশাল ভল্গা গঙ্গা পদ্মার
পার ভাঙি এক হ’ল পানী।। (বাংলা হরফে অসমিয়া গীত)

শুধুকি এই? ইতিমধ্যে শক্তিশালী প্রাচারতরঙ্গে আমাদের ঘরে ঘরে হাজির হচ্ছেন ভয়েস অব আমেরিকা, আর বিবিসির ভাষ্যকারের দল। একেবারে সরাসরি বাংলাভাষায়। কামনাশিস চক্রবর্তী, বিজন বোস ছাড়াও তদানীন্তনন পূর্ব বাংলার ভাষ্যকাদের কণ্ঠ আকাশ বাতাসকে মুখরিত করে রেখেছিল। হেনরি কিসিঞ্জার যে এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারতের উপর এখানে ওখানে উষ্মা প্রকাশ করছেন, ইনি যে পাকিস্তানকে ভারতের বিরুদ্ধে উসকে দিচ্ছেন তাও বেশ বোঝা যেত। একই সঙ্গে সরব ছিল বিবিসির বাংলা বিভাগও। সব সময় এটা ঠিক বোঝাও যেত না কে কা’কে সমর্থন করছে। আসলে এ দুটো প্রচার মাধ্যম যে ছিল স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। কিছুটা স্বাধীনতা ওরা ভোগ করতেন, যথেষ্ট নিরপেক্ষতাও ওরা রক্ষা করতেন। তবে চাইনিজ উচ্চারণে রেডিও পিকিং তাদের বাংলা অনুষ্ঠানে সরাসরি উদীয়মান স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ এবং মিত্রশক্তির বিপক্ষে, এটা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিত। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সান্ধ্য অনুষ্ঠান বিশ্বের কাছে যুদ্ধের চিত্র তুলে ধরত। পশ্চিমী শাসকদের অকথ্য অত্যাচার, মায়েদের উপর মেয়েদের উপর নির্যাতনের কাহিনি, স্পট রেকর্ডিং, আর্তনাদ, শরণার্থী শিবিরের কান্না, সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত আহ্বান, অজস্র দেশাত্মবোধক গান ভারতীয় উপমহাদেশকে একদিকে ভাসিয়ে দিয়েছিল দেশপ্রেমের জোয়ারে, অপর দিকে প্রয়াস পেয়েছিল এ উপমহাদেশে এক অসাম্প্রদায়িক চেতনা সঞ্চারিত করার। পৃথিবীর অন্যকোথায় এমন নজির আর কি আছে?
রাষ্ট্রসংঘের উদ্যোগে ১৩ ফেব্রুয়ারি তারিখটিকে ‘বিশ্ব রেডিও দিবস’ হিসেবে উদযাপন করা শুরু হয়েছে। বিশ্বের বৈচিত্রকে সবাই মিলে উদ্যাপনের শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে রেডিও আজও অদ্বিতীয়। সম্প্রতি ভিস্যুয়েল মাধ্যম ছাড়াও সামাজিক মাধ্যমের ব্যাপক জয়জয়কারের মুহূর্তে রেডিওর সেই স্বর্ণযুগ অবশ্য কিছুটা অস্তমিত। বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক বিস্তার করা পশ্চিমী রেডিও ভয়েস অব আমেরিকা, ইংল্যন্ডের বিবিসি কিংবা জার্মান, অস্ট্রেলীয়, নেদারল্যান্ড রেডিও তাদের সম্প্রচার সংকুচিত করে এনেছে। এশীয় দেশের আঞ্চলিক ভাষার অনুষ্ঠান আর শোনা যাচ্ছে না, শোনা যাবে না।

এখনও কানে বাজে বিদেশি রেডিওর সংবাদভাষ্য, সমীক্ষা, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, কমল বসুর বিশ্ব সংবাদ, বিজন বসুর আসর। বিবিসির ‘ব্রেন অব ব্রিটেন’, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ‘দ্যা স্টরি অব দ্যা উইক’ এবং সাপ্তাহিক নাটক –কোথায় গেল সেই সব অনুষ্ঠানের উন্মাদনা?
ঘরে স্থির বসে থাকা রেডিও-সেটের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে আমাদের মোবাইল ফোন, যার অধিষ্ঠান পকেটে পকেটে। আর আমাদের ইথার তরঙ্গে এখন সহস্রকণ্ঠের উৎসারণ। কানে শোনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চোখে দেখা, অডিও ভিস্যুয়েল মাধ্যম। এত হৈহট্টরোলে সত্যিই আমাদের শ্রবণ আজ বিক্ষত, দৃষ্টিও আজ ঝাপসা। এত শব্দ এত ধ্বনির মধ্যে যেন এক বিরাট শূন্যতা, এক না শোনার অধ্যায়ে আমরা পৌঁছেছি।

রেডিওর গৌরবের সেই দিনের স্মৃতি মাঝে মাঝে একবিংশ শতকেও আমাদের উদাস করে তোলে বই কি। ভাবুন তো সেদিনের কথা। রেডিও না থাকলে আমাদের জীবনটা কেমন হত? রেডিও না থাকলে আমাদের নীরব, মূক নিসর্গ কি পেত উজ্জীবনের ভাষা? রেডিও না থাকলে কী আমাদের ঘরে উপচে পড়ত ভোরের রাই জাগা গান, প্রভাতী বৈদিক মন্ত্র, দেশবন্দনা? দেশবিদেশের শিল্পীরাই বা কী আসতেন আমাদের ঘরে গান শোনাতে? আমাদের সঙ্গে আন্তরঙ্গ আলাপে বসতে? আলী আকবর-ববিশঙ্কর-ভীমসেন যোশী-সুনন্দা পট্টনায়ক কিংবা বব ডিলান, পিট সিগার, ইয়াহুদি মেনউইনই কী পৌঁছোতেন আমাদের প্রাণের কাছে? মিসিসিপি থেকে সুরমা, গঙ্গা আর পদ্মা নদীর মাঝির গান, ভারতের বিচিত্র জনজাতি সাওতালি, মুণ্ডারি, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মিজো, নাগা, গারো কিংবা অসমিয়া বিহু, পশ্চিম ভারতের বিনোদন জগৎ, পাঞ্জাবি ভাংড়া, বেনারসি ঠুংরি কিংবা দক্ষিণী বিচিত্রবীণার ঝঙ্কার, রেডিও সিলোন হয়ে বোম্বাই সিনেমা জগতের গানের অফুরান ভাণ্ডার –এ সবকিছুই তো আমাদের কাছে পৌঁছোছে এই মুখর চৌকো বাক্সটিকে অবলম্বন করেই।

একটা সময় ভোরের সানাই, চেলো আর তানপুরার ঐকতানে সোহিনীতে ‘আকাশবাণী’র আহ্বান যেন ছিল আমাদের অসীম নৈঃশব্দ্যের মধ্যে অমৃতময় বাণী। আজও বৈদ্যুতিন মাধ্যমের বিপুল হৈহট্টগোলে এ সুর পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে যায়নি। এ ধ্বনি আজও ভেসে বেড়ায় আমাদের গ্রামের পথে, ব্যস্ততম নগরীর নিভৃততম প্রকোষ্টে। ইথার তরঙ্গে ভেসে আসা নিরবয়ব সুর টেলিভিশনের কায়াবিশ্বের বিপুল আগ্রাসনের মধ্যেও আজ কোনক্রমে বেঁচে আছে আমাদের প্রাণের গভীরে। এর উপরই যে রয়েছে জনরুচির নিয়ন্ত্রণ ভার। সকাল সন্ধ্যা তার ভৈরবী পুরবীর স্নিগ্ধ স্পর্শ আজ মানুষের সমস্ত অবসাদ, দিন যাপনের গ্লানি মুছে দেয়। হোক্ না এ দৃশ্যসুখশূন্য, এ রেডিওতেই মানুষ খুঁজে পেয়েছে তার অন্তরের ভাষা। এটাই অনেকদিন আগে উপলব্ধি করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯৩৮ সালে ১৬ আগস্ট কলকাতা বেতার কেন্দ্রের ট্র্যান্সমিশন শক্তি বৃদ্ধি উপলক্ষে একটি আশীর্বাণী প্রার্থনা করা হয়েছিল। কবি প্রেরণ করে ছিলেন একটি ছোট্ট কবিতা যেখানে উচ্চারিত হয়েছিল এই ‘আকাশবাণী’ শব্দটি:
ধরার আঙিনা হতে ওই শোনো
উঠিল আকাশবাণী
অমরলোকের মহিমা দিল যে
মর্ত্যলোকেরে আনি।।
১৯৫৭ সালের ১ এপ্রিল থেকে ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’র পাশাপাশি সরকারি ভাবে উচ্চারিত হয়ে আসছে শব্দটি—‘আকাশবাণী’। এই একটি শব্দেই যেন আমাদের প্রাণের কথা ধ্বনিত হয় আসমুদ্র হিমাচল ব্যাপী।

♦♦♦  ♦♦♦♦  ♦♦♦


  • Tags:
❤ Support Us
গুম গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
ধারাবাহিক: একদিন প্রতিদিন । পর্ব ৫ পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
পথ ভুবনের দিনলিপি । পর্ব এক ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
error: Content is protected !!