Advertisement
  • খাস-কলম প্রচ্ছদ রচনা
  • জুন ২, ২০২২

ইউক্রেনে ভয়ঙ্করের পদধ্বনি। দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ চায় অপশক্তি। অস্ত্র বাজারে উদ্দীপনা ।

বাহার উদ্দিন
ইউক্রেনে ভয়ঙ্করের পদধ্বনি। দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ চায় অপশক্তি। অস্ত্র বাজারে উদ্দীপনা ।

ডনবাসে রুশ আক্রমন অব্যাহত। ইউক্রেন যুদ্ধের অবসানের লক্ষ্মণ নেই।  বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, রাশিয়ার আগ্রাসী মনোভাব থমকে যাবে। অধিকৃত এলাকা ছেড়ে মস্কো তার সেনা সরিয়ে নেবে। বিশ্ব জনমতের চাপে সাধারণত যা হয়ে থাকে, ইউক্রেনেও সেরকম ঘটবে। আদপে কি এরকম হতে পারে? কী বলছে বিশ্বাসের বাস্তব আর তথ্য।গত কয়েক মাসে যুদ্ধের সর্বনাশা অভিমুখ ভিন্ন ভিন্ন চিত্র তুলে ধরছে। আমেরিকা তলে তলে ইউক্রেনকে অস্ত্র জোগাচ্ছে। পূর্ব ইউরোপে ন্যাটো বাহিনীর তৎপরতাও থামেনি। এর মানে কী? দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ এবং অস্ত্রব্যবসায়ীদের মুনাফা বৃদ্ধির লাগাতার প্রচেষ্টা!

মাস-খানেকেরও বেশি সময় জুড়ে, রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে এবং অন্যন্য সূত্রেও আমেরিকাকে সতর্ক করে বলেছে, দূরপাল্লার রকেটের মতো অত্যাধুনিক অস্ত্র ইউক্রেনে পাঠানো বন্ধ হোক । না হলে, ‘অপ্রত্যাশিত পরিণতি’-র সম্মুখীন হতে হবে। আমেরিকা আমল দেয় নি । যুদ্ধে সরাসরি না জড়িয়েও নিজের লক্ষ্য থেকে সরে যায়নি।গত সপ্তাহে জার্মান চ্যান্সেলর শোলৎজ এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁর সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন প্রেসিডেন্ট পুতিন । এই ত্রিপাক্ষিক বৈঠকেও  রুশ প্রেসিডেন্ট আমেরিকাকে স্পষ্ট ভাষায় জনিয়ে দেন, ইউক্রেনকে অত্যাধুনিক, মারাত্মক অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করা দরকার। না হলে, পরিস্থিতি নতুন সঙ্কটের দিকে মোড় নেবে।

২০২১ । মরক্কোর সামরিক মহড়ায় এম ১৪২ আর্টিলারি সিস্টেম থেকে আকাশে রকেট ।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন রাশিয়ার সর্বশেষ হুমকিও গ্রাহ্য করেন নি। বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, এপর্যন্ত আমেরিকা ও নেটো থেকে ইউক্রেন যেসব অস্ত্র পেয়েছে, সেগুলোর তুলনায় আমেরিকায় নির্মিত এম-১৪২ হাই মবিলিটি আর্টিলারি সিস্টেম রাশিয়াকে চূড়ান্ত হুমকির দিকে ঠেলে দেবে এবং রাশিয়াও নতুন অস্ত্র সম্ভার নিয়ে পাল্টা আঘাত হানবে। আমেরিকার এম১৪২ রকেটকে প্রতিরোধ করতে বা গুড়িয়ে দিতে পারে— এরকম অস্ত্রে মস্কোর ভান্ডারও সমূদ্ধ । যা, বিধ্বংসী আর আত্মরক্ষক । জিপিএস নিয়ন্ত্রিত মার্কিন রকেটের শক্তিও অপরিসীম । ৫০ মাইল দূরের নিশানায় অতি দ্রুত ঝাঁপিয়ে পড়তে সক্ষম। অস্ত্র বিশেষজ্ঞেদের বিশ্বাস আর  অনুমান, রুশ রকেটও একইভাবে শক্তিমান, অব্যর্থ।

পশ্চিমি সংবাদমাধ্যম রাশিয়ার সামরিক শক্তিকে যথা সম্ভব খাটো করে দেখছে। রটিয়ে বেড়াচ্ছে, ডনবাসে রাশিয়া কোনঠাসা। তার ঘনঘন হামলায় জনক্ষয় ঘটলেও, ইউক্রেনের শক্তিক্ষয় যৎসামান্য। রুশ  সেনারা প্রবল চাপে আছে। মার্কিন আর্টিলারি সিস্টেম ইউক্রেনের হাতে পৌঁছলে যুদ্ধচিত্র বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা বিস্তর।

যে সব সেন্টার থেকে রাশিয়া ডনবাসে যুদ্ধ পরিচালনা করছে, সেসব জায়গা থেকেই সমরাস্ত্র রণাঙ্গনে নিয়ে যাচ্ছে। সেখানেই মোতায়েন করেছে দূরপাল্লার কামান আর ক্ষেপণাস্ত্র।অর্থাৎ প্রস্তুতি আর প্রতিরোধে মস্কো কোনো ধরনের ত্রূটি রাখছে না ।তার মানে ইউক্রেনের হাতে অত্যাধুনিক মার্কিন অস্ত্রের সমাগম মানেই সমশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর আঘাত পাল্টা আঘাত অনিবার্য। দীর্ঘস্থায়ি যুদ্ধও অবশ্যম্ভাবী। যদিও বাইডেন বার বার বলছেন, তাঁর লক্ষ্য দীর্ঘকালীন যুদ্ধ নয়। রাশিয়ার সঙ্গে আপোষ মীমাংসা করে ইউক্রেনকে অত্যধিক শক্তিমান করে তোলা। যুদ্ধ বিশেষজ্ঞরা মার্কিন প্রেসিডেন্টের মতলবকে সুনজরে দেখছেন না। তাঁদের ধারনা, যুদ্ধের আয়তন বাড়বে। মীমাংসা  ত্বরান্বিত হবে না

আমেরিকার এম-১৪২ । ৫০ মাইল দূরের টার্গেটেও অর্বথ্য ।

এরকম অনাগত পরিস্থিতিতে দ্বিধাবিভক্ত ইউরোপ নানা ভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে । তারা তাদের অস্ত্র ব্যবসা বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা চালাবে। প্রথম আর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মাঝামাঝি পর্বে যে সঙ্কট  তৈরি হয়েছিল, এখন তার ক্ষমতা, ধ্বংসশক্তি এবং নেপথ্যের অর্থশক্তির ভূমিকা বহু বেশি প্রকট ও আগ্রাসী । অর্থশালী প্রতিটি রাষ্ট্র নতুন নতুন অস্ত্র তৈরিতে মত্ত । এসব অস্ত্র উৎপাদনের লক্ষ্য কী ? আত্মরক্ষা না দুর্বল দেশগুলোতে অস্ত্র রপ্তানি ? বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীও কি ধনী দেশগুলির অস্ত্র সরবরাহের আওতায় পড়ে না ? রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের পাল্টা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সন্ত্রাসবাদ কি বিদেশি অস্ত্রের উপর নির্ভরশীল নয় ? এরকম প্রশ্নের মধ্যেই জড়িয়ে আছে বাড়তি অস্ত্র তৈরির, অস্ত্র সরবরাহের ব্যবহারিক মনস্তত্ত্ব ।

 

নিরাপত্তার চাইতে ক্ষমতা বিস্তারের মোহ আর উদগ্র আকাঙ্খাই সমরাস্ত্র উৎপাদনের অভিপ্রায়কে ক্রমাগত বড়ো করতে থাকে। নিরন্তর নতুন বাজার গড়ে তোলে। সে বাজারের স্থায়িত্ব তৈরিতেও বূহৎশক্তি মরিয়া হয়ে ওঠে । আমেরিকা, জার্মান, ফ্রান্স, রাশিয়া কেউই অস্ত্র ব্যবসা রুখতে আগ্রহী নয় । বাইরে যতই শান্তির কথা বলুক না কেন, আড়ালে অস্ত্র তৈরির বিকট ফন্দি তাদের উদ্দেশ্যকে ভরাট করছে । রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ দুষ্টশক্তিকে অস্ত্র উৎপাদন ও অস্ত্র ব্যবসার প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সুযোগের খোঁজ দিয়েছে । এই অশুভ ব্যবসার অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী  যখন যুদ্ধরত, তখন  নেটো দেশগুলি কি চুপ করে বসে থাকবে ? না, অস্ত্র উৎপাদন ও রপ্তানি বাড়িয়ে তুলবে ? নিউইয়র্ক পত্রিকায় বাইডেনের সাম্প্রতিক লেখায় বেমালুম ফাঁস হয়ে গেল তাঁর স্পষ্ট মনোভাব —- ‘আমরা ইউক্রেনকে বলছি না তারা তাদের সীমান্তের বাইরে গিয়ে আমাদের কাছ থেকে পাওয়া অস্ত্রগুলি ব্যবহার করুক। আমরা পুতিনকে ক্ষমতাচ্যুতও করতে চাই না । তাঁকে টিকিয়ে রাখা না রাখা রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ অভিপ্রায়। তাঁর সঙ্গে যতই মতবিরোধ থাকুক, যতই তাঁর আচরণকে অপছন্দ করি না কেন, আমরা নেটো এবং রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ চাই না। তার মানে বাইডেন চাইছেন, পুতিন ক্ষমতায় থাকুন । ইউক্রেন সহ পূর্ব ইউরোপে নেটোকে অস্ত্র সরবরাহও অব্যাহত থাক। অর্থাৎ অস্ত্রের বাড়তি উৎপাদন বন্ধ হবে না। বাজার বেড়েছে, আরও বাড়ুক।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিও বাইডেনের এই অনুভূতিই ব্যক্ত করেছেন। দেশের নিউজ চ্যানেলে বলেছেন, রাশিয়ার ভেতর হামলার চালানোর ইচ্ছা নেই আমাদের । তাদের অভ্যন্তরে কী ঘটছে, এ ব্যাপারে উৎসাহী নই।  আমরা শুধু ইউক্রেনের ঘরোয়া সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত। চিন্তিত। জেলেনেস্কির এরকম মন্তব্যের কারণ কী? বাড়তি অস্ত্র সংগ্রহ এবং স্থায়ী যুদ্ধপরিস্থিতি তৈরির আবহ গড়ে তোলা? অর্থাৎ অস্ত্র আসছে আসুক । যুদ্ধ চলছে, চলতে থাক। আমরা এখন মরছি, পরে মারব । অস্ত্র আমদানি বাড়াব । প্রয়োজনে বেআইনি অস্ত্রের গোপন সংগ্রাহালয় করে তুলব ইউক্রেনকে । এতে বিদেশি আয় বাড়বে । অস্ত্রধর দেশ হিসেবে পতিপত্তি প্রশস্ত হতে থাকবে ।

জেলেনস্কি ওস্তাদ খেলোয়াড় । সুবিধাবাদী মানুষ। স্বৈরাচার চাপিয়ে দিতে অভ্যস্ত। মুখে গণতান্ত্রিক। আচরণে স্বৈরতান্ত্রিক। রুশ পুতুলকে সরিয়ে ক্ষমতায় বসেই মার্কিন পুতুল সাজতে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন। পরে নেটোর দিকে বাধ্যবাধকতার শর্তে হাত বাড়ালেন। এখন নেটোর ভাষায় কথা বলছেন। ওদের হয়েই স্বপ্ন দেখছেন। নেপথ্যে ইসরাইলি মস্তিষ্ক, ইসরাইলি পুঁজি। সামনে জেলেনস্কির মুখাভিনয়। অদ্ভুত অভিনেতা। কখনও হাসছেন। কখনও কাঁদছেন। তাঁর হাসিকান্নার আড়ালে, সম্মুখেও ইউক্রেন ধুঁকছে। উদ্বাস্তু জনস্রোত, পূর্ব ইউরোপের দিকে প্রতিদিন পা বাড়াচ্ছে। ইরাক থেকে সিরিয়া, ইয়েমেন থেকে প্যালেস্টাইন, লেবানন থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত এতদিন যে রক্তশূন্য স্রোত দেখেছি আমরা, তারই বর্ধিত চেহারা আজ ইউক্রেন থেকে ক্রমশ পূর্বদিকে ধাইছে। এর শেষ কোথায়? কোথায় তার অন্তহীন সূচনা?

ইউরোপের বক্ষমূলে আঘাত পড়েনি। পড়লে সে সমস্বরে জিগির তুলত, সমবেদনায় আর্তনাদ করে উঠত। সে এখন লাভ লোকসানের হিসেব নিকেশে মগ্ন। অস্ত্র গড়ছে। পাচার করছে। প্রকাশ্যে। গোপনে। গোপনের সঙ্কেত আর লেনদেন বড়ো বেশি ভয়ঙ্কর। মনে পড়ে? পড়ে নাকি তালিবান ও উসামা বিন লাদেনের স্বশিক্ষিত , প্রত্যাশিত যোদ্ধারা বিদেশি অর্থ ও অস্ত্র পেয়েই পরিকল্পিত কায়দায় গুড়িয়ে দেয় মার্কিন টাওয়ার? সদর দপ্তরেও আঘাত হানল। ওই রকম পুনরাঘাতের জঙ্গিরা ফিরে আসবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? নির্বোধ হাতে গোলাভর্তি বন্দুকের দূষ্টি সবসময় একপেশে। ক্রোধ তার বোধকে ভোঁতা বানিয়ে দুই হাতে অসংখ্য হিংস্রকে মিলিয়ে দেয়। লেলিয়ে দেয় ধ্বংসকাণ্ডে। ইউক্রেনকে ঘিরে এরকম ঘটবে না, তা, নিশ্চিত ভাবে বলা কি সম্ভব? বুকের ওপর ছোরা, মুখ খুলবে কে?

 

 

 

 

 


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!