- এই মুহূর্তে বি। দে । শ
- ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৫
জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং কমিটির তথ্য : বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট ‘গণঅভ্যুত্থান’-এ সংগঠিত হত্যার বলি ১৪০০

বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট মাসে ‘গণঅভ্যুত্থান’ চলাকালে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নিপীড়নের ঘটনায় ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। রিপোর্টে উল্লেখ, অভ্যুত্থানের সময়ে প্রায় ১৪০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। যার মধ্যে প্রায় ১২-১৩ শতাংশ ছিল শিশু ও কিশোর। প্রায় ১১ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি মানুষকে গ্রেফতার হয়েছিলেন সে সময়। এই পরিস্থিতি সুপরিকল্পিত ও এর পিছনে শেখ হাসিনার বিশেষ ভূমিকা আছে বলে চাঞ্চল্যকর দাবি জাতিসংঘের রিপোর্টে।
বাংলাদেশে গত বছরের জুলাই-আগাস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ‘সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের’ দাবিতে চলা আন্দোলন পরবর্তীকালে সরকারবিরোধী আন্দোলনের চেহারা নেয়। ভয়াবহ চেহারা নেয় ঢাকার রাজপথ। পুলিশ ও নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে মুহুর্মুহু সংঘাত বাঁধে আমজনতার। পুলিশের গুলিতে মারা যান আবু সাঈদ, হৃদয় চন্দ্র তরুয়া, মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের মতো যুবকেরা। সহ্যের বাঁধ ভাঙে, উত্তাল নাগরিক বিক্ষোভে পতন হয় শেখ হাসিনার আওয়ামী সরকারের, দেশ ছেড়ে বাংলাদেশের ‘প্রাক্তন’ প্রধানমন্ত্রী আশ্রয় নেন ভারতে। তারপর ৮ আগস্ট ড.ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। জুলাই-আগস্টের উত্তপ্ত সময়ে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্খিত হয়েছে বলে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টুর্কের দ্বারস্থ হয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। বুধবার সেই তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি। বাংলাদেশের জন্য বিশেষ গঠিত ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনকে সে সময়ের ঘটনা প্রবাহ, সহিংসতার পিছনে থাকা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা, কেন এরকম ঘটনা ঘটল তার কারণ বিশ্লেষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। আগামী দিনে যাতে বাংলাদেশ এসবের পুনরাবৃত্তি না হয়, সে জন্য সুনির্দিষ্ট পরামর্শও চাওয়া হয়েছিল।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর তদন্ত শুরু হয়। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে জাতিসংঘ তাঁদের খসড়া প্রতিবেদন বাংলাদেশকে দেয় মতামতের গ্রহণের জন্য। বুধবার জেনেভায় এ বিষয়ে পুর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পেশ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে ছাত্র-জনতা আন্দোলনে প্রায় এক হাজার ১৪০০ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। যাঁদের বেশিরভাগ মিলিটারি রাইফেল ও মেটাল প্যালেটস লোড করা শটগানে নিহত হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশের গণ অভ্যুত্থান সংক্রান্ত বিশেষ সেল শহীদ তালিকা প্রকাশ করেছিল, তাতে মোট ৮৫৮ জন শহীদদের নাম ছিল। বর্তমান তদন্ত প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার তাঁদের সময়কালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, নির্যাতন এবং অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের মতো নানা মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা উঠে এসেছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “তৎকালীন সরকারের ক্যাডার, গোয়েন্দা সংস্থা, আরো কিছু সহিংস গোষ্ঠী ও সংগঠনের সঙ্গে মিলে পরিকল্পিতভাবে একেরপর এক মানবতা বিরোধী কার্যকলাপ করেছে। গণ অভ্যুত্থানে হত্যা ছাড়াও সেসময় প্রায় ১১ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি মানুষকে গ্রেফতার এবং আটক করা হয়েছিল বলে উল্লেখ। আন্দোলনে নিহতদের মধ্যে প্রায় ১২-১৩ শতাংশ ছিল শিশু ও কিশোর। সরকারি বিরোধী বিক্ষোভ রুখতে ব্যাপকভাবে বেআইনি সহিংসতা ঘটানো হয়েছিল। পুলিশের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সমর্থকরাও লোকজনকে রাস্তায় থামিয়ে তল্লাশি চালিয়েছিল, বিক্ষোভকারীদের আটক করেছিল, পূর্বপরিকল্পিতভাবে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছিল। ছাত্র লীগ ও যুবলীগের কর্মীদের অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশে। গোটা ঘটনার পিছনে শেখ হাসিনার হাত রয়েছে বলে চাঞ্চল্যকর দাবি রিপোর্টের। আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা নারীদের উপর যৌন ও লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা ঘটিয়েছেন বলেও দাবি রিপোর্টে।
ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ে, এই প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়েছেন ড.মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, ‘আমি অন্তর্বর্তী সরকারে কর্মরত সব ব্যক্তি এবং দেশের আপামর নাগরিককে সঙ্গে নিয়ে এমন একটি বাংলাদেশ গড়তে চাই যেখানে সব মানুষ নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে পারবে।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘জাতি সংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার শাসনকালে বাংলাদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিচার ব্যবস্থায় নানান খামতি তৈরি হয়েছে। আমরা তো এমন সমাজ গড়তে চাই, যেখানে সব মানুষ নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে পারে, সবার সমান অধিকার থাকবে। সে জন্য এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপুল সংস্কার করা অত্যন্ত জরুরি। আমি এই প্রতিষ্ঠানগুলোয় কর্মরত সবাইকে আহ্বান জানাই, আপনারা ন্যায়বিচার, আইন ও বাংলাদেশের জনগণের অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখুন। যাঁরা আইন ভঙ্গ করেছেন এবং মানবিক ও নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন করেছেন, তাঁদের জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসা হবে।’
উল্লেখ্য, এর আগে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের জন্য জাতি সংঘের বিশেষ তদন্ত দল গঠন করা হলেও বাংলাদেশের জন্য এই প্রথম ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশের অর্ন্তবর্তী সরকার সর্বতভাবে তদন্ত কমিটিকে সাহায্য করেছে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই-কমিশনার ভলকার তুর্ক। তাঁর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন এশিয়া-প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান মুঙ্গোভেন, মানবাধিকার কর্মকর্তা জ্যোৎস্না পৌড়িয়াল এবং জাতিসংঘের মুখপাত্র রাভিনা শামসাদানি।
❤ Support Us