- বি। দে । শ
- এপ্রিল ২৭, ২০২৪
পশ্চিম এশিয়ায় ঘনায়মান যুদ্ধের সঙ্কেত। উড়ছে ইরান ইসরাইলের বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র

১৩এপ্রিল, ২০২৪ । ইসরায়েলের আকাশ আচমকা আলোময় হয়ে উঠল। প্রাথমিকভাবে অবাক হলেও পরে ইরানীয় গণমাধ্যমের সৌজন্যে ইসরায়েলের মানুষজনের আর জানতে বাকি রইল না যে, গত বছরের “হামাস আতঙ্ক” আবার ফিরে এসেছে। এবার আর পিছন থেকে নয়, কোন ছায়া যুদ্ধের মাধ্যমেও নয়, এবার তা এসেছে সরাসরি। “ইরানিয়ান রেভলুশনারি গার্ড” ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান জানিয়ে এক অর্থে যুদ্ধের আহ্বান জানিয়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু তার যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক ডেকে ইরানের হামলার জবাব দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তা গণমাধ্যমে জানান।
এক হাতে তালি বাজেনা। ইরান কেন উপযাচক হয়ে আক্রমন করতে গেল ইসরায়েলকে? যেখানে তাদের তৈরি যুদ্ধাস্ত্রের বিশ্বজুড়ে বিপুল চাহিদা ?
ঘটনাটির শুরু হয় ১ এপ্রিল, ২০২৪। সেদিন দামাস্কাসে ইরানের কনস্যুলেটে হামলা করে ইসরায়েল, এজন্য ইরানের দুই বরিষ্ঠ সামরিক কমান্ডার মহঃ রেজা জায়েদি ও সেকেন্ড কমান্ডার হাজি রাহিমি নিহত হন। আক্রমণের জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে প্রতিশোধ নেওয়ার শপথ নেয় ইরান।
মূলত পশ্চিম এশিয়া বা আরো বিশদে বললে ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে একসময়ের “পরম বন্ধু” আজ দুই “পরম শত্রু” তে পরিনত হয়েছে। ইসরায়েল ইহুদিদের প্রাণকেন্দ্র। ধর্মীয়ভাবে তো বটে, পাশাপাশি “সন্ত্রাসী গোষ্ঠী”কে কাজে লাগানোর অভিযোগ এনেও ইসরায়েল তাদের ওপর হামলা চালানর জন্য ইরানকে দায়ি করছে।
অবাক করার মতো বিষয়, ১৯৭৯ সালের আগে পর্যন্ত এই দুই দেশের সম্পর্ক এতটাই মধুর ছিল যে, তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান চলত।এমনকি প্যালেস্টাইনকে বিভক্ত করে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র তৈরির বিরোধিতা বিশ্ব জুড়ে হলেও, নতুন দেশকে স্বীকৃতি দিয়ে ছিল ইরান। ইসরাইল তখন ছিল ইহুদি সম্প্রদায়ের অন্যতম বৃহত্তম আবাসস্থল।ইরান শাসন করতেন পাহলভি রাজবংশের মহঃ রেজা পাহলভি ।পশ্চিম এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান মিত্রও ছিল ইরান। কিন্তু ১৯৭৯ সালে পরিস্থিতি পুরোপুরি পাল্টে যেতে শুরু করে।
রুহুল্লাহ খোমেনির “ইসলামি বিপ্লব” পাহলভিকে ক্ষমতাচ্যুত করে ধর্মীয় প্রজাতন্ত্রের জন্ম দেয়। নতুন সরকার ছিল মার্কিন বন্ধুত্ব বিরোধী ও ইসরায়েলের আগ্রাসন বিরোধী। আয়াতুল্লাহ সরকার ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, তেহরানে ইসরায়েলি দূতাবাস দখল করে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) হাতে তুলে দেয়। পিএলও ইসরায়েলি সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই ও প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব দিচ্ছিল।আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের ইরান প্রোগ্রামের পরিচালক আলি ভায়েজের মতে,নতুন ইরান নিজেকে প্যান-ইসলামিক শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়। যেহেতু আগে থেকে আরব দেশগুলি ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিল সেহেতু প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সমর্থন পেয়ে যায় নতুন ইরান । তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে “বৃহৎ শয়তান” আর ইসরায়েলকে “ছোট শয়তান” বলে অভিহিত করে। ইসরায়েলের জন্য ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ব্যর্থ করা সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যাতে ইরান কোনোভাবেই পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী না হয়।
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক অব্যাহত থাকলেও তাদের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটে। শেষ পর্যন্ত, ইরান, সিরিয়া, ইরাক, লেবানন এবং ইয়েমেনের মতো দেশে ‘প্রক্সি মিলিশিয়া গোষ্ঠী’ গঠন এবং বিপুল অর্থের যোগানে দুই দেশের মধ্যে ছায়া যুদ্ধ শুরু হয়। ২০২৪ এর এপ্রিলে তেহরানের ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের পর পরিস্থিতি বদলে যায়। বহু আন্তর্জাতিক-সম্পর্ক বিশেষজ্ঞের মতে, পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, দুই পরমাণু শক্তিধর দেশ যদি তাদের নিজস্ব ক্ষমতার বিধ্বংসী প্রয়োগ শুরু করে দেয়, তাহলে অচিরেই আরও এক বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে । অনেকের মতে, আমেরিকা ও ইসরায়েল বন্ধুরাষ্ট্র। ইতিহাস সাক্ষী আমেরিকার অংশগ্রহণ এবং খনিজ তেলের বিপুল সম্পদের অধিকারী আরবদুনিয়া যেখানে তাদের মাথা গলিয়েছে সেখানেই যুদ্ধ হয়েছে।অতএব প্রকারন্তরে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েই গেছে হয়ত। এখন শুধু ঘোষিত বিস্ফোরণের অপেক্ষা।
সরাসরি যুদ্ধ শুরু হলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে।ইউক্রেনের মতো রক্তক্ষয় চলতে থাকবে। প্রতিবেশি আরব দেশগুলি চুপ করে বসে থাকবে না। যুদ্ধে যোগ দেবে। বিনাশ চাইবে ইসরাইলি আগ্রাসনবাদের। তাদের পাশে থাকবে রাশিয়া এবং চিন। চিন ধীরে ধীরে পশ্চিম এশিয়া ও মধ্য এশিয়ায় তার পণ্য আর অস্ত্রবাজারে প্রবেশ করছে। উপসাগরীয় অঞ্চলে যুদ্ধ শুরু হলে ফায়দা তুলবে বেইজিং। নিজের কূটনীতির আওতায় নিয়ে আসবে সৌদি আরব, সংযুক্ত আমিরশাহী, জর্ডন, ইয়েমেন সব বহু দেশকে। অন্যদিকে তাদের প্রতিরোধ করতে চাইবে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। আমেরিকা ও তাদের মিত্রশক্তি এখনো যুদ্ধ চায় না। সামনে আমেরিকার ভোট। সেখানে নির্বাচনের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে ইহুদি ধনকুবেররা। ভোটের মুহূর্তে, তার আগেও যুদ্ধ চাইবে না ওয়াশিংটন। কিন্তু ইসরাইলের আগ্রাসন নীতিকে সমর্থন জুগিয়ে যাবে বাইডেন প্রশাসন। বাইডেনের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরাইল পন্থী। তিনিও সুযোগ ছাড়বেন না। মার্কিন সমর্থন ছাড়া ইসরাইলের একা টিঁকে থাকা সম্ভব নয় । কঠোর বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতে পরমাণু অস্ত্রই তার ভরসা।ইরানেরও তাই। শিয়া বিপ্লবের সাফল্য, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিরোধিতা ইরানকে যথাসম্ভব সাবলম্বী করে তুলছে। প্রতিরোধের নামে তেহরান গুঁড়িয়ে দিতে চাইবে ইসরাইলের আর্থিক ও সামরিক মেরুদন্ডকে। অতএব সমানে সমান যুদ্ধ আসন্ন, ঘোষিত পরমাণু শক্তিধরের সঙ্গে অঘোষিত কিংবা নির্মীয়মান পরমাণু অস্ত্রে সমৃদ্ধ ইরানের মধ্যে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে পশ্চিম এশিয়া কৌশলিক আর কূটনৈতিক যুদ্ধের রক্তাক্ত, নীরক্ত ময়দান হয়ে আছে। পূঁজিবাদ আর গণতন্ত্রহীনতা গণশক্তিকে বিভ্রান্ত করছে। ইসলামি বিপ্লব হলে খুমেইনির ও বিপ্লবী গার্ডের উত্থানের পর চেহরা বদলাতে থাকে। ঝড়ো হওয়া, ইরান ইরাক যুদ্ধ এবং পশ্চিমি মিত্র জোটের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও ইরান হয়ে উঠেছে উপসাগরীয় অঞ্চলের সবচেয়ে বড়ো শক্তি। সিরিয়া-ইরাকের বাথপার্টির বিভাজন আর বিচ্ছেদের পরেও ইরানই এখন হামাস, হিজবুল্লাহর মতো ক্ষমতালোভীদের প্রধান ভরসা। ইরানের উপলক্ষ্য ইসরাইল, লক্ষ্য একমাত্র আঞ্চলিক শক্তি হয়ে ওঠা। ইরানকে ঘিরে মহাযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে না, কিন্তু পশ্চিম এশীয় মানবজমিনের, শান্তি আর আর্থিক বৃদ্ধির সমূহ প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে পারে ইসরাইল আর ইরানের মধ্যে ঘনায়মান যুদ্ধের সঙ্কেত।
❤ Support Us