- গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
- জুলাই ২৭, ২০১৯
সংশোধনাগার

রেখাচিত্র: রবীন মণ্ডল
যুবকটিকে পাহারাদার গুহার সামনে নিয়ে এলেন। তারপর দরজায় কলিংবেল টিপলেন। দরজার ওপর দিকে একটি খড়খড়ি লাগানো জানলার মতো। জানলা দিয়ে উঁকি মারল একটি ঘেয়ো কুকুরী। যুবকটি অবাক হয়ে কুকুরীর দিকে তাকিয়ে রইল। কুকুরী পাহারাদারকে দেখে নিমেষের মধ্যে দরজাটা খুলে দিল। এবার মাথা নিচু করে পাহারাদারের কাদা মাখা নোংরা জুতো চাটতে শুরু করল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই জুতোর কাদা পুরো সাফ হয়ে গেল।
পাহারাদার বিরক্ত হচ্ছিলেন। কুকুরীটির বয়স হয়েছে। এইসব বয়স্ক মেয়ের হ্যাংলামো তিনি একদম সহ্য করতে পারেন না। আবার আরামও পাচ্ছিলেন। মেয়েরা লেহন করলে তা সবসময়ই আরামের হয়। তাছাড়া, কুকুরীটি পাহারাদারের খুব কাজে লাগে। দিনরাত খাঁটে পাহারাদারের স্বার্থে।তার কিসে একটু সুবিধা হবে, সবসময় ভাবে।
এরকম প্রভুভক্ত, বাধ্য কুকুরী সচরাচর মেলে না। কুকুরীটিকে তিনি ‘ফুল বস’ বলে ডাকেন।
পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল আরেকটি ঘেয়ো কুকুরী। এ হল ফুল বসের অ্যাসিস্টেন্ট। পাহারাদার একে ‘হাফ বস’ বলে ডাকেন। সে ফুল বসকে নানারকম বুদ্ধি যোগায়। গুহার মধ্যে কে কী করছে, সে ব্যাপারে কড়া নজরদারি চালায় দুই বস। এই গুহায় তাদের অনেক গুপ্তচর আছে। তারা সব খবরাখবর এনে দেয়। দুই বস সেসব খবর সোজা পাহারাদারের কানে গিয়ে পাচার করে দেয়। খবরের ভিত্তিতেই পাহারাদার কুকুরীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন। তাদের মর্যাদা দেন অমর্যাদা দেখান। গুহার কুকরীরা তাই দুই বসকে রীতিমতো সমীহ করে চলেন।
ফুল বস এবার কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল, কী ব্যাপার, স্যার?
আর কী! পাহারাদার করুণার হাসি হাসলেন। এই যুবক এবার থেকে তোমাদের সঙ্গেই থাকবে। একে একটু দেখেশুনে রেখো।
‘দেখেশুনে’ শব্দটার ওপর তিনি জোর দিলেন। দুই বস একে অপরের দিকে অর্থময় দৃষ্টিতে তাকাল।
এবার হাফ-বস জানতে চাইল, এ তো একজন মানুষ, স্যার। এখানে তো…
ঠিক আছে। ওকেও তোমাদের মতো ঘেয়ো কুকুর বানিয়ে নিও।
আবার দুই বস একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসল। ফুল বস জানতে চাইল, স্যার এর অপরাধ কী?
অপরাধ? পাহারাদার তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন। এর অপরাধ তিনটি। এক, ঘড়ি দেখলেই ভেঙে ফেলে। দুই, টাকা দেখলে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে বাতাসে উড়িয়ে দেয় আর পয়সা দেখলে কাছেপিঠে যেখানে খুশি জলে ভাসিয়ে দেয়। তিন, বনে-জঙ্গলে শুধু প্রজাপতি ধরে বেরায়। এর বাবা খুব প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। সিনেমার সফল নায়ক। মা বিরাট ব্যবসায়ী পরিারের মেয়ে ফ্যাশন ডিজাইনিং আর কসমেটিকসের রমরমা ব্যবসা। পাশাপাশি একটি ধর্মীয় আশ্রম চালান। ধর্মের দিকে, দান-ধ্যানে, মানুষের সেবায় খুব মন। প্রচুর অনাথ শিশুকে নিজের আশ্রমে এনে রেখেছেন। দু’জনেই বেশিরভাগ সময় বিদেশে থাকেন। আর ছেলেটি একদম অপদার্থ আর অকেজো। ওকে পথে আনার অনেক চেষ্টা করেছেন বাবা-মা। কোনও ফল হয়নি। ছেলেকে মানুষ করার জন্য ওরা একটা উপযুক্ত সংশোধনাগার খুঁজছিলেন। অনেক জায়গায় চিঠিও লিখেছিলেন। শেষপর্যন্ত আমাকেই ওরা উপযুক্ত ভেবেছেন। আর এই প্যারাসাইটটাকে…
পাহারাদার জ্বলন্ত চোখে যুবকের দিকে তাকালেন। দৃষ্টিতে ঘৃণা আর বিদ্বেষ, করুণা আর তাচিছল্য মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। বললেন, এর বাবা মা একটা মোবাইল দিয়ে গেছেন। শুধু ওরা ফোন করলে তবেই এটি ওর হাতে দেবে। অবশ্য অন্য কেউ এর নম্বরও জানে না! তবু সাবধানের মার নেই…
গুহার ভেতরে ঢোকার আগে পাহারাদার যুবককে আলাদা করে ডেকে নিলেন। তাকে সতর্ক করে কানের কাছে মুখ রেখে ফিসফিস করে বলে দিলেন, এই গুহা ঘেয়ো কুকুর আর কুকুরীদের আস্তানা। কয়েকটা ঘেয়ো কুকুরের মধ্যে থাকতে গেলে তোমাকেও কামড়া-কামড়ি করে থাকতে হবে। তুমি না চাইলেও ওরা তোমাকে কামড়াতে থাকবে, আঁচড়াতে থাকবে, তোমার দিকে নোংরা ছুড়তে থাকবে। তোমাকে সব সহ্য করতে হবে, নইলে এখানে টিকতে পারবে না।
আমাকে এখানে টিকতে হবে কেন? যুবকটি অবসন্ন গলায় জানতে চাইল।
কারণ এটাই তোমার শাস্তি। তোমাকে এ শাস্তি পেতেই হবে। শাস্তি? আমি কী দোষ করেছি? কে আমাকে শাস্তির নির্দেশ দিয়েছে? যুবকটি অসহায় হয়ে জানতে চাইল।
তোমার বাবা-মা। তুমি দুনিয়ার উপযুক্ত নও। তাই তোমাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তুমি নিজেকে শুধরে নিলেই…
আর যদি না শুধরোতে পারি?
এবার পাহারাদারের গলা কঠোর হয়ে উঠল। বললেন, তাহলে এখানেই তোমাকে সারাজীবন থেকে যেতে হবে। এই বন্ধ গুহায়। কোনওদিন তুমি তোমার প্রিয় প্রজাপতিদের দেখতে পাবে না…
ও, তাহলে আমার বাবা-মাই এই ব্যবস্থা করেছেন! সংশোধনাগারে আমাকে পাঠিয়েছেন! যুবকটির চোখ জলে ভরে গেল। সে ফুঁপিয়ে উঠে বলল, সমুদ্র দেখাতে নিয়ে যাচেছ। সমুদ্রের জলে ভেসে থাকা বরফ দেখাতে নিয়ে যাচেছ। এইভাবে ওরা আমাকে ঠকালো! ওদের বিশ্বাস করে কাল রাতে ঘুমোতে গেছিলাম। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি, একটা লঝ্ঝরে গাড়ির পিছনের সিটে শুয়ে আছি। নুড়ি-পাথর বিছানো এবড়ো-খেবড়ো পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে গাড়িটা চলছে। চারপাশে শুধু কাঁটাঝোঁপ আর কাঁটাঝোঁপ। তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল। তুমি আমাকে একটা ললিপপ দিয়েছিলে। ললিপপ খেতে খেতে কাঁটাঝোপের ফাঁকফোঁকরে শুধু প্রজাপতি খুঁজছিলাম। আমার চোখ ঘুমে জড়িয়ে গিয়েছিল…
যুবককে নিয়ে দুই বস গুহার ভিতরে ঢুকে গেল। সেদিন থেকে শুরু হল তার নতুন জীবন। গুহার ভেতরে ঢুকে যুবক গুহাটাকে আঁতিপাতি করে দেখল। গুহাটাকে সে ভালোবাসতে চেষ্টা করল। কিছুদিনের মধ্যেই গুহাটাকে সে ভালোবেসে ফেলল। নতুন জায়াগাটাকে আপন করে নিতে চাইল। আর ভুলেই গেলে, আসলে এখানে সে শাস্তি পেয়ে এসেছে। একজন মানুষকে পেয়ে কুকুর-কুকুরীদের মধ্যেও বেশ সাড়া পড়ে গেল।
গুহার গায়ে একটা গর্ত ছিল। একদিন রাতে সে গর্ত দিয়ে যুবক পূর্ণিমার চাঁদকে দেখতে পেল। তখনই সে গলা ছেড়ে গান গেয়ে উঠল। অনেকক্ষণ ধরে সে গান গেয়ে চলল। কেউ তার গান শুনছিল না। কুকুর-কুকুরীগুলো ভয়ানক আওয়াজ করে ডাকছিল। এক সময় যুবক গান থামিয়ে দিতে বাধ্য হল। হঠাৎ তার মন খারাপ হয়ে গেল। ভেতরে কেমন যেন কষ্ট হচিছল। হঠাৎ তার মনে পড়ল, এখানে এই গুহায়, সে স্বেচছায় আসেনি। শাস্তি পেয়ে এসেছে !
যুবক চাঁদটাকে কিছুতেই ভুলতে পারছিল না। একদিন ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ তার খুব ছবি আঁকতে ইচছা করল। সে একটি পাথরের ওপর পূর্ণিমার গোল চাঁদটাকে আঁকতে শুরু করল। গোল চাঁদটা ক্রমশ হয়ে উঠল এক অপরূপ সুন্দরী মুখ। যুবক দেখল, কেউ তার ছবির দিকে ফিরেও তাকাচেছ না। সে সামনে যাদের পেল, যেমন দু-তিনজন কুকুর-কুকুরীকে ডাকল। কেউ তাকে গ্রাহ্য করল না। ভয়ানক আওয়াজ করতে করতে তারা সেখান দিয়ে ছুটে চলে গেল। যাওয়ার সময় নিজেদের মধ্যে কামড়া-কামড়ি করতে লাগল। পরদিন সকালে উঠে যুবক দেখল, কারা যেন তার ছবির উপর হাগু করে রেখে গেছে। নিজের আঁকাবাঁকা ছবির উপর তাকাতেও যুকটির খুব ঘেন্না হল। হঠাৎ তার ভেতরের কষ্টটা আবার ফিরে এল। যুবকের মনে পড়ে গেল, সে এখানে স্বেচছায় আসেনি।
একদিন যুবকটি গুহার দেওয়ালে কয়েকটা লাইন লিখে ফেলল। একটি সুন্দরী কুকুরী ফ্লার্ট করার ভঙ্গিতে চোখ ঘুরিয়ে মেদুর গলায় তাকে জিজ্ঞেস করল, কী লিখেছ?
যুবকটি উত্সাহ নিয়ে বলল কবিতা।
সুন্দরী কুকুরীটি জিজ্ঞেস করল, কাকে বলে কবিতা?
যুবক হাসল, বলল জানি না।
সুন্দরী কুকুরীটী ঝাঁঝিয়ে উঠল, যা জানো না, তা লেখো কেন? সে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল। একবার ফিরেও দেখল না। আর কেউ তার কবিতার দিকে ফিরেও তাকাল না। সবাই এমন ভাব করল, যেন দেওয়ালের গায়ে সেফ্র ময়লা পড়েছে!
একদিন যুবক দেখল, শ্যাওলায় তার কবিতাটা ঢেকে গেছে। কতিার লাইনগুলোও তার মনে পড়ল না। তার খুব কষ্ট হল। আবার তার মনে হল, এখানে সে শাস্তি পেয়ে এসেছে!
একদিন যুবকটি একটি ভাঙা আয়নার টুকরো খুঁজে পেল। টুকরোটা সে নিজের মুখের সামনে ধরল। আর তখনই চমকে উঠল। এমন একজনকে সে দেখতে পেল, যাকে আদৌ চেনে না। তবু তাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?
অচেনা যুবক বলে উঠল, তোমার বন্ধু।
ক্রমে দুই যুবকের মধ্যে বন্ধুত্ব জমে উঠল, তুমি জানো, আমি ওদের ভালোবাসতে চেয়েছিলাম?
তারপর? অচেনা যুবকটি বলে উঠল।
আমি ভুলে যেতে চেয়েছিলাম, এখানে আমি স্বেচছায় আসিনি।
তারপর?
আমি যত ভুলতে চাই, ওরা যেন তত আরও বেশি করে মনে করিয়ে দেয়, এখানে আমি দণ্ড ভোগ করতেই এসেছি! না, ওরা কিছুতেই শাস্তির ব্যাপারটা আমাকে ভুলতে দেয় না…
তাই কী তুমি আগের মতো কথা বলো না?
আমি আর কথাই বলি না। শব্দের দুনিয়া থেকে সরে যেতে চাই। ডুবে যেতে চাই নিজের গভীরে। চুপ করে থাকতেই আমার ভালো লাগে।
তাই কী তুমি আগের মত আর হাস না?
হাসব কী? এখন সব সময় আমার কান্না পায়।
ওদের জীবনে তুমি তাহলে একজন আইটসাইডার?
হুম। আর আমার জীবনে ওরা …
তোমরা কেউ কারও জীবনে ভেতরের লোক হতে পারলে না…
যুবক আয়নার দিকে তীক্ষ্ন চোখে তাকায়। অচেনা যুবকের মুখে সহনাভূতি খোঁজে। তার মনে হয়, অচেনা যুকটি মুচকি হাসছে। সে আয়নাটাকে একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে রেখে দেয়।
একদিন যুকটির একটা ফোন আসে। ফুলবস তার হাতে মোবাইলা দিয়ে বললে, তোমার বাবা…ফোনটা হাতে নিয়ে যুবক ফুঁপিয়ে ওঠে। তারপর বলে, এ তোমরা আমার কী করলে?
বাবা বলে, কেন, কী হয়েছে?
এখানে আমার কোনও বন্ধু নেই…
তাই নাকি?
এখানে কেউ আমাকে উত্সাহ দেয় না…
ও, আচছা…
এখানে কেউ আমাকে সম্মান দেয় না।
কী করে ওরা?
আমাকে উপেক্ষা করে, অগাহ্য করে, তাচিছল্য করে। সামনে আমাকে দেখে কখনও হয়তো হাসে। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে। পেছনে আমার নিন্দা করে। আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করে। বেশিরভাগই আমাকে এড়িয়ে যায়। আমাকে দেখলে ওদের মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে।
ওরা তোমাকে ঈর্ষা করে।
কেন? যুবকটি সরলভাবে জানতে চায়।
কারণ, তুমি একজন মানুষ। যদিও অপদার্থ…
ভেতরে সবসময় আমার একটা চাপা কষ্ট হয় বাবা..
তুমি তোমার শ্রেষ্ট পুরস্কারটাই পেয়োছো, সোনা। এটাই তোমার পাপ্য।
যুবকটি আবার ফুঁপিয়ে ওঠে। তারপর বলে, মাকে দাও…
যুবকটির মা বলেন, কী হয়েছে বাবা কাঁদছ কেন?
তোমরা এখন কোথায় মা?
সমুদ্রের ধারে। একটা পাঁচতারা হোটেলের বারান্দায়…
ওখানে তোমরা কী করতে গেছো?
ঘুরতে এসেছি। তুমি তো জানোই, আমরা কেমন ব্যস্ত থাকি। তাই কয়েকটা দিনের ছুটি পেয়ে..
আমি আর পারছি না মা…
পারতেই হবে, বাবা। তুমি যতটা ভালো আছ, এর চেয়ে ভালো থাকা তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমরাও এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা করতে পারতাম না। তোমাকে মানুষ হতে হবে। সমাজে মিশতে গেলে, সমাজের যোগ্য হয়ে উঠতে গেলে…
তোমরা আমাকে মানুষ করতে চাও, মা? তাই কি আমাকে কয়েকটা নোংরা ঘেয়ো কুকুরের মাঝে বাস করতে পাঠালে?
আর কোনও উপায় ছিল না, বাবা! দেশের শ্রেষ্ঠ সংশোধনাগারেই তোমাকে পাঠিয়েছি।
ঠিক তখনই পাশ থেকে তাড়া দিয়ে বাবা বলে উঠলেন, এবার চলো, আর সময় নেই…
এখন ফোনটা রাখছি। মা বললেন, এক্ষুণি আমাদের একটা পার্টিতে যেতে হবে…
সেখানে খুব ফূর্তি হবে, তাই না মা? আর খুব মজা?
হ্যাঁ, খুব। আসি বাবা…
মা ফোনটা কেটে দেন। ফুল বস যুবকের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নেয়। তার দিকে একবার কঠোর দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর গটমট করে সেখান থেকে চলে যায়।
একদিন গুহায় ডাকপিওন আসে। গুহার দরজার খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে একটা খাম গলিয়ে দিয়ে যায়। খামের ওপর যুবকের নাম লেখা। হাফ বস লাফ দিয়ে খামটা মুখে তুলে নেয়। তারপর দাঁত দিয়ে খামটা ছিড়ে ফেলে। হাফ বসের কৌতূহল ফুল বসের চেয়ে অনেক বেশি। দু’জনেরই সব ব্যাপারে নাক গলানোর স্বভাব।
খামের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা চিঠি আর পদক।
ফুল বস যুবকের কাছে এসে দাপুটে গলায় বলে, কী আছে এই চিঠিতে? আমাদের পড়ে শোনাও…
যুবক চিঠিটি পড়ে। তারপর বলে, আমি একটি প্রবন্ধ লিখে পাঠিয়েছিলাম। সেটা ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছে।
সে জন্যই ওরা পদক পাঠিয়েছে? হাফ বস জানতে চাইল।
হুম।
শুনেছি, প্রবন্ধ লিখতে গেলে অনেক চিন্তা করতে হয়! তুমি চিন্তা করো নাকি? ফুল বস জানতে চাইল। করি তো! আমি সবসময় চিন্তা করি!
আর কী করো তুমি? হাফ বস জানতে চায়।
আমি স্বপ্ন দেখি!
বলো কী! দুই বস একে অপরের দিকে অর্থপূর্ণভাবে তাকায়। তাদের চোখের দৃষ্টি হিংস্র হয়ে ওঠে।
তাই বলে ওরা তোমাকে প্রাইজ দেবে? ফুল বস বলে ওঠে।
তাই বলে ওরা তোমাকে পদক পাঠাবে? হাফ বস বলল।
কই, আমাকে তো ওরা কখনও প্রাইজ দেয়নি?
কই, আমাকে তো ওরা কখনও পদক পাঠায়নি?
এর মধ্যে নিশ্চয় কোনও ষড়যন্ত্র আছে!
হ্যাঁ, ষড়যন্ত্র। তোমার কী এমন যোগ্যতা আছে যে…
তুমি ওদের বশ করেছ। তোমার সাহস তো কম নয়…
আর কী স্পর্ধা!
হঠাৎ হাফ-বস যুবকের হাতে আঁচড়ে দেয়। আর ফুল বস অন্য হাতে কামড়ে দেয়। যুবক যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে।
তারপর বলে, আমি নির্দোষ। তোমরা এভাবে আমাকে…
ফুল বস আগুনের মতো জ্বলতে থাকে। আর হাফ বস মিষ্টি হেসে বলে, আজ আমরা তোমাকে আদর করে গেলাম। এবার তোমার মনে থাকবে।
আর কখনও তোমার নামে চিঠি বা পদক যেন না আসে…
যুবকটি দেওয়ালে ঠেস দিযে দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ে। ফুঁপিয়ে ওঠে সে। দুই বসকে ঘিরে থাকা কুকুর আর কুকুরীরা সশব্দে হাসতে থাকে। তাদের হাসি যেন আর থামতেই চায় না।
এরপর থেকেই যুবকের মধ্যে একটা পরির্তন আসে। অচেনা যুবকের সেটা নজর এড়ায় না। একদিন সে জানতে চায়, কী হয়েছে তোমার?
আমার সবসময় ভয় হয়।
কীসের ভয় ?
ভয় হয়, কেউ যেন আমাকে আঘাত দেবে।
ইনসিকিওর বোধ করছ?
খুব। মনে হয়, যে কোনও সময় যে কোনও সুযোগে ওরা আমার গায় নোংরা ছেটাতে পারে…
ঈর্ষা থেকে এসব করছে। ওরা যে কুকুর। আর তুমি…
এখানে কেউ আমাকে পছন্দ করে না। আমি মনের জোর হারিয়ে ফেলছি।
হুম।
খুব লো স্পিরিটেড হয়ে যাচিছ।
আর কী হচেছ?
আমার আত্মবিশ্বাস ক্ষয়ে যাচেছ…
কী করে বুঝলে?
ওসব বোঝা যায়। নানারকম ছোটোখাটো ভুল করে ফেলছি। একই কথা বারবার বলছি। ওরা এটাই চায়। এটা ওদের ট্র্যাপ…
তাহলে আমার কী হবে? আমি সত্যিই একটা অপদার্থ হয়ে উঠছি। আমি এখন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলতে পারি না। আমার হাবভাবে অসহায় মানুষের ছবি ফুটে ওঠে। কী করব আমি? আরও আছে…
হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলে যাও…
তুচছ তুচছ ব্যাপারে আমি জড়িয়ে যাই। অতি সামান্য অধিকারের জন্য আমাকে লড়াই করতে হয়। ছোটাছুটি করতে হয়। আমার কথা কেউ শোনে না। আমি কিছু বললে গ্রাহ্য করে না। গুরুত্ব দেয় না। আমার যে কোনও প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়। সবসময় আমাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, আমি কেউ নই। নেহাত্ একটা পোকামাকড়। আমার সঙ্গে এখানে কেউ কিছু শেয়ার করে না। আমাকে বোবা, বধির, অন্ধ হয়ে থাকতে হয়। যেন দয়া করে, করুণা করে ওরা আমাকে ওদের সঙ্গে থাকতে দিয়েছে। ওদের কথা না শুনে চললে ওরা আমাকে আঁচড়ে, কামড়ে শেষ করে দেবে। আমি ওদের সঙ্গে পেরে উঠছি না। পেরে উঠব না। ওরা কী চায় জানো?
হ্যাঁ, বলো না…
ওরা চায়, তুমি ওদেরই মতো ঘেয়ো কুকুর হয়ে ওঠো। এই যে তুমি প্রতি মুহূর্তে প্রমাণ করে দিচেছা, তুমি ওদের মতো নও, তুমি আলাদা, তুমি ঘেয়ো কুকুর হতে চাও না, এটাই ওদের সমস্ত জ্বালা যন্ত্রণার কারণ। তুমি পদক পাও, তুমি চিন্তা করো, তুমি ঘড়ি সহ্য করতে পারো না, অর্থের জোর নেই তোমার, টাকাপয়সা দেখলে ছিড়ে ফেলো বা জলে ভাসিয়ে দাও, তোমাকে ওরা সহ্য করে কী করে? তোমাকে ওরা ঠিক স্বাভাবিক মনে করে না। ওদের কাছে, তুমি এক ফ্যান্টাসির দুনিয়ার বাসিন্দা। ওরা সবাই মিলে তাই এভাবে আরও বেশি করে তোমাকে একা করে দিচ্ছে…
আমি এখন কী করব?
আমিও তো তাই ভাবছি। তুমি সোজা গিয়ে পাহারাদারকে সব কথা জানাতে পারো না? ওটাই শেষ ভরসা…
যুবকটি ঠিক করে, সে তাই করবে। সে পাহারাদারের অপেক্ষায় থাকে। একদিন সত্যিই পাহারাদার আসেন। সেটা ছিল ঝড়বৃষ্টির রাত। পাহারাদার এসে ওদের গুহাতেই আশ্রয় নেন। তাঁকে দেখেই ফুল বস আর হাফ বস ছুটে যায়। গদগদ হয়ে তার পায়ে নাক ঘষে, মাথা ঘষে, বুক ঘসে, আদর চায়। পাহারাদার একটু বিরক্ত হন। তিনি তাকিয়ে থাকেন সেই সুন্দরী, যুবতী কুকুরীটার দিকে। আর কুকুরীটাও জানে, কীভাবে একটা বুড়ো লোকের সঙ্গে ফ্লার্ট করতে হয়। সে একদম সামনের সারিতে এগিয়ে আসে। বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়। তার চোখের তাকানোর, দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে পাহারাদার একদম বশ হয়ে যান। তিনি জুলজুল করে কুকুরাটীর দিকে তাকিয়ে থাকেন। এতে কুকুরীটীও বেশ মজা পায়।
সেদিকে তাকিয়ে পাহারাদার বলে ওঠেন, ওর হাবভাব দেখে মনে হয়, ঠিক যেন একটা বেড়াল। কুকুরী না বলে ওকে বেড়ালী বললেই ভালো হয়! যেমন ধূর্ত, তেমনই আদুরে।
পাহারাদারের দুই বউ। তিনি অলটারনেটিভ রাতে তাদের বিছানায় ডেকে নেন। তাদের সঙ্গে সঙ্গম করেন। এতে দুই বউ-ই তৃপ্ত থাকে। কিন্তু মনে মনে তিনি ভাবেন, সুন্দরী কুকুরীটার কথা। তার যৌনাঙ্গের কথা। কুকুরীটাকে নিজের কাছে ডেকে নেন। তখন অন্য কুকুরীগুলোও পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে। তিনি তাদের কারো বুক টিপে দেন, কারো যোনিতে হাত ঘষে দেন, আর তারপর হঠাৎ সুন্দরী কুকুরীটাকে নিজের বুকে চেপে ধরেন। এসব দেখে বাকি কুকুরীগুলো খিলখিল করে হেসে ওঠে। সবচেযে বেশিক্ষণ ধরে হাসতে থাকে ফুল বস আর হাফ বস।
যুবকটি ভিড় ঠেলে পাহারাদারের দিকে এগোতে চায়। পাহারাদার এমন ভান করেন, যেন তিনি তাকে দেখতে পাননি। তিনি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে থাকেন তাকে। তার চোখে ফুটে ওঠে তুচছ-তাচিছল্যের ভাব। যেন কোনও মানুষ নয়, একটি পোকার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। যুবকটি ভিড় থেকে সরে আসে।
আয়নার সামনে দাঁড়িযে সে প্রশ্ন করে, আমি এখন কী করব?
অচেনা যুবকটি বলে ওঠে, তুমি ওঁকে কিছুই জানাওনি?
কী করে জানাব? যুবকটি বলে। উনি তো কুকুরীগুলোকে নিয়ে ব্যস্ত…
তবু তোমার উচিত ছিল…
উনি কি আমার কথা শুনতে চান? কোনও আগহ আছে ওর? সুযোগ পেলে, উনি আরও বেশি করে ওই কুকুর আর কুকুরীগুলোকে আমার দিকে লেলিয়ে দেবেন। যাতে আমি ভয়ে ভয়ে থাকি। ওদের বশে থাকি। যাতে আমি ওদের ছাপিয়ে যেতে না পারি। কেউ মাথায় বড়ো হতে চাইলে উনি সহ্য করতে পারেন না। তাই মানুষ হয়ে জন্মালেও এখানে আমাকে একটা ঘোয়ো কুকুর হয়ে থাকতে হবে।
তবু, তোমার একবার চেষ্টা করে দেখা উচিত…
পাহারাদার এখন একাই একটা চেয়ারে বসে আছেন। তাঁর দু’দিকে গুহার পাথুরে মেঝেতে বসে আছে দুই বস।
যুবকটি তবু সাহস করে পাহারাদারের দিকে এগিয়ে যায়। দুই বস জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়।
যুবকটি বলে, স্যার, একটা কথা ছিল…
পাহারাদার ঢুলু ঢুলু চোখে তাকান। তারপর জড়ানো গলায় বলেন, কী ব্যাপার? তাঁর গাল দু’টো লাল হযে উঠেছে।
স্যার, আমি একজন মানুষ।
তাই নাকি? পাহারাদার বিদ্রুপের স্বরে বলে ওঠেন।
হ্যাঁ, স্যার। কিন্তু নিজের ডিগনিটি বজায় রেখে…
মানুষের ডিগনিটি? পাহারাদার সোজা হয়ে বসেন। তারপর তীব্র তাচিছল্য নিয়ে বলে ওঠেন, তোমাকে আগেই বলছি, এখানে থাকতে হলে, কামড়া-কামড়ি করেই থাকতে হবে। এটা তো ঘেয়ো কুকুরদের আস্তানা…
ঠিক তাই, স্যার। কিন্তু আমি তো আর ঘেয়ো কুকুর নই। কুকুরদের মধ্যে থাকতে হলে তোমাকেও ঘেয়ো কুকুর হয়েই থাকতে হবে। তোমার ওসব দাবি-দাওয়া এখানে চলবে না। আর মনে রেখো…
হ্যাঁ, স্যার…
তোমার বাবা-মা আমাকে প্রতি মাসে টাকা পাঠান। অনেক টাকা। তাঁরা তো জানেন, তুমি কাদের মধ্যে আছো। তবু কেন এই টাকা পাঠান, জানো?
কেন স্যার?
যাতে ঘেয়ো কুকুরদের সঙ্গে থেকে তুমি দুনিয়ার হালচাল শিখতে পারো। মানুষের মধ্যে থেকেও তুমি মানুষ হতে পারোনি। এখন কুকুরদের মধ্যে থেকে দ্যাখো যদি মানুষ হতে পারো…
যুবকটি আর কথা বাড়ায় না। দুই বস উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। ফুল বস বলে ওঠে, কাল সকালটা অন্তত আমাদের এখানেই থেকে যান, স্যার।
কেন? পাহারাদার জানতে চান। কিছু আছে নাকি?
হ্যাঁ, স্যার। এবার হাফ বস বলে। কাল আমাদের ফসিলের পুজো আছে।
যুবকটি কৌতূহল বোধ করে। পরদিন সকালে ফসিলটিকে সে দেখে। বহু পুরনো একটি পাথর। হয়ত প্রাগৈতিহাসিক যুগের। তার গায়ে কুকুরের লেজের মতো ছাপ।
ভোরবেলা গুহার দরজা খুলে দেওয়া হয়। যুবকটি দেখে, গুহার বাইরে লম্বা লাইন। কেউ কাঁদছে। কেউ হাসছে। কেউ বা হৃদয়ে উচছ্বাস উগরে দিচেছ। কেউ হাতে ধরে আছে টাটকা, রঙিন, সুগন্ধী ফুলের মালা। একজন একজন করে গুহার ভিতরে ঢুকছে। প্রণামীর বাক্সে যে যা পারছে উজার করে দিচেছ। ফসিলের গায়ে মালা পরাতে গিয়ে কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ছে। কেউ বা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে শ্যাওলা ধরা পাথরটির দিকে। কেউ বা ক্যামেরা দিয়ে পটাপট ছবি তুলছে।
একজন বিদেশি সাংবাদিক ফুল বসের সামনে মাইক ধরেন। তারপর জানতে চান, এখন এই ফসিলের আর কী দেওয়ার আছে? এ তো বহু যুগ আগে শেষ হয়ে যাওয়া একটা ব্যাপার। আমাদের সংস্কৃতি প্রতিনিধি ও অভিভাবক হিসাবে ভাবছি? কেন তাকে এইভাবে আমরা এক্সিবিট করছি?
ফুল বস চোখ পাকিয়ে প্রভুত্বের গলায় বলে ওঠে, কী বলছেন আপনি? এই ফসিলের মধ্যে ম্যাজিক আছে। লোক কি এমনি এর কাছে ছুটে আসছে তারা ধন্য হয়ে যাচেছ! ফসিলের সঙ্গে তারা ছবি তুলছে। সেসব ছবি সোস্যাল মিডিয়ায় দিচেছ। আর লোকে যেমন তাদের বাহবা দিচেছ, তেমনই তারা নিজেরাও ধন্য হয়ে যাচেছ। ম্যাজিক ছাড়া একে আপনি কী বলেন?
বিদেশি সাংবাদিক মৃদু হেসে বলেন, এই জন্যই আপনাদের দেশের কিস্যু হয় না, জানেন! আপনাদের দেশে কী প্রতিভার অভাব আছে? আপনারা তাদের আবিস্কার করুন। আপনারা কী করছেন? ফসিলের মধ্যে ম্যাজিক খুঁজে বেড়াচেছন। তাঁকে প্রমোট করার জন্য অঢেল অর্থ আর শব্দ ছড়াচেছন। এই অর্থ আর শব্দ সঠিক জাযগায় কাজে লাগালে আপনাদের দেশটা বর্তে যেত…
ফুল বস এবার ধমক দিতে গিয়ে চুপ করে গেলেন। যতোই হোক, সাংবাদিকটি একজন শ্বেতাঙ্গ। খুই শক্তিশালী একটি দেশের মানুষ। তাঁকে বেশি চমকাতে গেলে শেষে না নিজেকেই বিপদে পড়তে হয়!
সাংবাদিকটি গুহার ভেতরটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। পাহারাদারের নির্দেশে তাঁর সঙ্গে একটু সমঝেই কথা বলছিলেন হাফ বস। হঠাৎ সামবাদিকটি থমকে দাঁড়লেন। গুহার দেওয়ালের ছবির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন,এটা কার আঁকা?
এবার যুবকটি এগিয়ে এল। বলল, আমার। সুপুরুষ যুবকটিকে দেখে সাংবাদিকটি চমকে গেলেনে। তারপর বললেন, এটা আপনার আঁকা? কী প্রতিভা! আপনি তো সাধারণ কেউ নন। আপনি তো…
হঠাৎ সাংবাদিকটি লক্ষ্য করল, তাঁর মুলাটো বান্ধবী একদৃষ্টিতে যুবকটির দিকে তাকিয়ে আছে। তার দু’চোখে কামনা। যুবকটিও মেয়েটির দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। তার যৌন আবেদনে সে একবারে আবিষ্ট হয়ে গেছে।
সাংবাদিকটি আর কথা বাড়ালেন না। বান্ধবীকে নিয়ে তাড়াতাড়ি সরে গেলেন। হাফ বস মনে মনে হাসল।
একদিন যুকটির খুব মন খারাপ ছিল। ঠিক তখনই তার সামনে দিয়ে সেই সুন্দরী কুকুরীটি হেঁটে যাচিছল।
যুবকটির আবারও মনে হল, কুকুরী না হয়ে এই প্রাণীটি বিড়াল হলেই বেশি ভালো ছিল। সে কুকুরীটির কাছে গিয়ে তার কানে কানে বলল, তুমি খুব সুন্দর!
কুকুরীটি মিষ্টি হেসে বলল আমি জানি।
যুবকটি বুঝতে পারল, যদিও সে জানে সে সুন্দর, তবু এই কথাটা তার বারবার শুনতে ভালোই লাগে। যুবকের মুখে নিজের রূপের প্রশংসা শুনে সে আপ্লুত।
কিছুদিনের মধ্যেই সুন্দরী কুকুরীটির সঙ্গে যুকটির ঘনিষ্ঠতা সবার চোখে পড়ল। সুন্দরী কুকুরীটি এখন সুযোগ পেলেই যুবকটির সঙ্গে ফ্লার্ট করে। আর আগুনের ছোঁয়া পেয়ে মোম যেভাবে গলে যায়, যুবকটিও সেভাবে গলে যেতে থাকে।
কিন্তু এর ফল ভালো হল না। পুরুষ কুকুরেরা যুবকটির প্রতি তীব্র ঈর্ষা বোধ করতে শুরু করল। সুন্দরী কুকুরীটি তাদের কাউকে পাত্তা দেয় না। যুবকটিকে সে পছন্দ করে । এটা তারা মেনে নিতে পারল না। তারা যুবকটির পিছনে তাকে নিয়ে হাসাহাসি শুরু করে দিল। তার নামে যা তা বলতে লাগল। এতদিন যারা একে অপরের মুখ দেখত না, তারাও নিজেদের মধ্যে ভাব করে নিল। সবাই মিলে যুবকটিকে একঘরে করে দেওযার চেষ্টা করল।
একজন তো বলেই বসল, এই লাটসাহেবকে এবার উচিত শিক্ষা দেওয়া দরকার।
অন্য একজন বলল, আরে, ও হলো ছুপা রুস্তম। বাইরে থেকে দেখে কিছুই বুঝতে পারি না। অথচ মেয়েদের নিয়ে ভালোই ফস্টিনস্টি চালিয়ে যাচেছ…
সবচেয়ে রেগে গেল একটা লম্বা কুকুর। তার ঈর্ষা সবাইকে ছাপিয়ে গেল যুবকটিকে দেখলেই সে শ্লেষের হাসি হাসত। যুবকটিকে সবার সামনে হাসির খোরাক করে তুলে আনন্দ পেত। যুবকটি সামনে এলে এমন ভাব দেখাত যেন তার সামনে নেহাত্ একটা পোকামাকড় রয়েছে। যুবকটিকে এইভাবে নস্যাত্ করে, তাকে সবার চোখে ছোটো করে, তাকে খোঁচা দিয়ে দিয়ে কথা বলে সে খুব আনন্দ পেত।
ফুল বস আর হাফ বসেরও মনে হল, যুবকটিকে এবার শিক্ষা দেওয়া দরকার। যুবকটির প্রতিভা আছে, একথা সাংবাদিকটির মুখে শোনার পর থেকেই তারা ঈর্ষা করতে শুরু করেছিল। এবার তারা নিজেদের প্রভুত্ব খাটিয়ে যুবকটিকে একা করে দিতে চাইল। সমস্ত কুকুর আর কুকুরীকে ডেকে বলে দিল, তারা কেউ যেন ওর সঙ্গে প্রয়োজন ছাড়া না মেশে। যুবকটি শুধু মানুষ নয়,প্রতিভাবানও বটে। অর্থাৎ সে খুই বিপদজ্জনক।
পাহারাদার বলে গেছিলেন, যুবকটির বাবা-মা মোটা টাকা পাঠান। অতএব যুবকটিকে যেভাবে হোক টিকিয়ে রাখতে হবে। তাকে কামড়ে, আঁচড়ে বেশি আঘাত দেওয়া যাবে না। যেভাবে হোক তার শরীরটাকে বাঁচাতে হবে। যুবকটির মনের কী হবে, সে ব্যাপারে তিনি কিছুই বলে যাননি। আর এই সুযোগটাই নিল ফুল বস আর হাফ বস।
যুবকটিকে তারা মানসিকভাবে পঙ্গু করে দিতে চাইল। গুহায় যা কিছু হতো, সবকিছু থেকেই যুবকটিকে তারা বাদ দিতে শুরু করল। যে কোনও উৎসবে, পালাপার্বণে, ফাংশনে সবাই অংশগ্রহণ করত। যুবকটিকে কেউ ডাকত না। তাকে সবাই আলাদা করে দিয়েছিল। এইভাবে তারা মজা পেত। এই নিয়ে কারো মনে কোনও প্রশ্ন জাগত না। কারো সাহসও ছিল না এর বিরুদ্ধে কিছু বলার। বরং সবাই যুবকটির এই অসহায়তাকে বেশ উপভোগ করত। তাকে একটু একটু করে ভেঙে পড়তে দেখে, শুকিয়ে যেতে দেখে উল্লাসিত হয়ে উঠত।
গুহায় নতুন কেউ এলে যুবকটিকে যথাসম্ভ এড়িয়ে যেত। তাকে আগেই সতর্ক করে দেওয়া হত যুবকটির ব্যাপারে। বলা হত, ও খুবই বিপদজ্জনক। কেউ ওকে পছন্দ করে না। ওর সঙ্গে বেশি মেলামেশা করতে গেলে তার আর রক্ষে নেই। গুহায় তার টেকাই মুশকিল হবে।
এইভাবে যুবকটির ব্যাপারে সবার মনে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। বেশ হিসেব কষে। ধীরে ধীরে বিষ ছড়ানো হচিছল যুবকটির নামে। সবাই তার ব্যাপারে সাবধানী হয়ে গেছিল। কুকুরীদের মধ্যেও তীব্র পতিক্রিয়া। একটি কুকুরী বলেছিল, ও সবাইকে ছেড়ে ওই কুকুরীটার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে গেল কেন? সুন্দরী বলে?
হ্যাঁ, তাই তো। আরেকটা কুকুরী বলেছিল, আমরা তো আর সুন্দরী নই!
আমরা সুন্দরী নই, তাই ভালোবাসারও যোগ্য নই। তাই না? ও এইভাবে একজন বেছে নিয়ে আমাদের সবাইকে ছোটো করে দিয়েছে, আমাদের সবাইকে অপমান করেছে।
আরে না, আর একটা কুকুরী বলল, নিজেকেই ও এভাবে চিনিয়ে দিয়ছে। আসলে সেক্সুয়ালি স্টার্ভড। সুন্দরী মেয়ে দেখলে যার লোভ হয়, কামনা-বাসনা উথলে ওঠে, তার আবার চরিত্র কী?
অন্য একটা কুকুরী জ্বলে উঠল, ও আমাদের তাচিছল্য করেছে। আমরাও ওকে তাচিছল্য করব। এড়িযে চলব। উপেক্ষা করব। অবজ্ঞা করব। ওর সঙ্গে কথা বলব না। গ্রাহ্য করব না। পাত্তা দেব না।
একটা কুকুরী বলল, ওকে এত গুরুত্ব দেওয়ার কী আছে? ওর মতো একটা পোকাকে নিয়ে শুধু ঠাট্টা করা যায়। ওকে আমরা হাসির খোরাক বানিয়ে ছাড়ব।
হাওয়া ঘুরে গেছে দেখে সুন্দরী কুকুরীটিও নিজেকে পাল্টে ফেলল। অসম্ভব ধূর্ত সে। তাকে বোঝানোর লোকেরও অভাব ছিল না।
একজন তাকে বলল, ওর সঙ্গে তুই মিশিস কেন? কেন ওকে পাত্তা দিস? এতে অন্যের চোখে তুই ছোট হয়ে যাবি। ওরা তোকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতে শুরু করবে।
অন্য একজন তাকে বলল, ও একটা ইতরের মতো লোভ দেখাচেছ, আর তুই ওর ফাঁদে ধরা দিচিছস। ওকে তুই বুঝিয়ে দে, ওর আসল উদ্দেশ্য তুই বুঝে গেছিস।
এইসব কথা শুনে সুন্দরী কুকুরী বদলে ফেলল নিজেকে। বিড়ালী হয়ে উঠল বাঘিনী। সে যুকটির সঙ্গে জঘন্য ব্যবহার শুরু করল। তাকে দেখলেই এড়িয়ে যেত। তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিল। আর যখন কথা বলত, রীতিমতো তুচছতাচিছল্য করত। ইচেছ করেই সবার সামনে তাকে অপমান করত। যুবকটিকে লোকের কাছে ছোটো করে, হেয় করে সে মজা পেতে শুরু করল। যুবকটি অপমানে যত কুঁকড়ে যেত, ততো সে হো হো করে হেসে উঠত, বেশি বেশি করে নিজের উচছ্বাস দেখাত। সাইকে সে বুঝিয়ে দিত, যুবকটিকে সে কত নিচু চোখে দেখে…
এতে তার বন্ধুরা খুব খুশি হল। একজন বলল, লোকে তোকে ভুল বুঝতে শুরু করেছিল। তুই ঠিক সময়ে নিজেকে সামলে নিয়েছিস। নিজের সম্মান ও জনপ্রিয়তাকে রক্ষা করেছিস। ওকে বুঝিয়ে দিতে পেরেছিস, বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়াতে নেই…;
আর একজন বলল, তুই দেখিয়ে দিয়েছিস একটি ইতর ও লোভীর সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করতে হয়। যে মেয়েদের সম্মান দিতে জানে না, কীভাবে তাকে হেনস্থা করতে হয়, চুপ করিয়ে দিতে হয়, সে এগোতে চাইলে তাকে থামিয়ে দিতে হয়…
অন্য একজন বলল, সত্যিই তো, কী আছে ওর? এখানে এসেছে শাস্তি পেয়ে, সবাই ওকে করুণা করে। নিতান্ত নোংরা, মামুলি, নিলর্জ্জ পোকা একটা! এমন লোকের স্পর্ধা দেখলে অবাক হতে হয়। ওকে তুই উচিত শিক্ষা দিয়েছিস। চাবুক মেরেছিস ওকে। উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছে। নিজের ওজন বুঝে যে চলতে জানে না…
এসব কথা শুনে কুকুরীটির বুক গর্বে ফুলে যেত। কিন্তু একটা কথা ভেবে সে একটু অবাকই হত। এত আঘাত পেয়ে যুবকটি কখনও তাকে পাল্টা আঘাত দেয় না। কখনও তাকে কোনও কটুবাক্য বলে না। ঝাঁঝিয়ে কথা বলে না। পাল্টা তুচছতাচিছল্য করে না। অন্য কুকুরদের মতো তার কাছে আসার জন্য হ্যাংলামো করে না। সবসময় সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রাখে। বরং তাকে রীতিমতো সম্মান করে কথা বলে। এমনকি নিজের সাধ্যমতো উপকার ও সাহায্য করার চেষ্টা করে।
এসব কথা শুনে তার এক বন্ধু অবশ্য উড়িয়ে দিল। বলল, বুঝলি না, এইসব হল ওর ইনভেস্টমেন্ট। খুব চতুর। এসব করে ও তোর মন জয় করতে চায়। তোকে কৃতজ্ঞ করে রাখতে চায়। যাতে বিনিময়ে ও যা চায়, তা পেতে পারে। এসব ফাঁদে পা না দিয়ে তুই ভালোই করেছিস। তুই কখনও ওর ভালো ব্যবহারে ভুলিস না। সবসময় মনে রাখিস, এসব ওর ফাঁদ। আসলে তোকে ভুলিয়েভুলিয়ে এভাবে ও তোকে দখল করতে চায়…
কুকুরীটি বুঝতে পারে। যুবকটিকে বুঝিয়ে দেয়, সেও কিছু কম চতুর নয়। যুবকটি যতই ফাঁদ পাতুক, সে কিছুতেই তাতে ধরা দেবে না। বরং গোটা দুনিয়াকে বুঝিয়ে ছাড়ে, একটা শাস্তি পাওয়া, করুণার যোগ্য কেউ বেশি স্পর্ধা ও লোভ দেখাতে এলে, কতভাবে তাকে হেনস্থা করা যায়!
আর খুব সফলভাবে সেটা করতে পেরে মনে মনে সে খুব গর্ব অনুভব করে। প্রচুর কুকুর আর কুকুরী এসে তাকে বাহবা দিয়ে যায়। সে সবার নয়নের মণি আর মাথার মুকুট হয়ে ওঠে। তার চলাফেরা হয়ে ওঠে রানির মতো, গোটা দুনিয়া যার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়েছে। তার কাছে আসার জন্য, তার সঙ্গে একটু কথা বলার জন্য, তার একটু সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। নিজেকে সবাই এভাবে দুর্লভ করে তুলতে পারে না। এটা করতে পেরে তার আর আহ্লাদের সীমা-পরিসীমা থাকে না।
যুবকটির পরাভবে সে নিজের বিপুল জয় দেখতে পায়। যুবকটির করুণ মুখ দেখলে নিজের ক্ষমতায় সে বিস্মিত হয়ে যায়। তখন সে দাম্ভিকের মতো আচরণ করতে থাকে। কাউকে আর পরোয়া করে না। আর সবাই তাকে সমীহের চোখে দেখে।
যুবকটি শুধু আয়নাকে নিজের মুখের সামনে ধরে বলে, আমি তো শুধু একজন শিল্পীর চোখ দিয়ে ওকে দেখতে চেয়েছিলাম…
অচেনা যুবকটি হো হো করে হেসে ওঠে। তারপর বলে, তুমি সত্যিই একটা অবাস্তব জগতে বাস করো। একটা কুকুরী কী শিল্প বুঝবে? একদল কুকুর-কুকুরী শিল্প বুঝবে?এটা তুমি আশা করলে কী করে?
তাহলে তারা কী বুঝবে? যুবকটি সরলভাবে জানতে চায়।
তারা বুঝবে নিজেদের হিসেব, নিজেদের স্বার্থ, আর নিজেদের ফায়দা। তুমি শিল্পীর চোখের কথা বলছ? ওদের জগতে ওরকম কোনও চোখের অস্তিত্ব নেই…
কিন্তু আমি তো কুকুরীটির কোনও ক্ষতি করিনি। বরং …
আরে, তোমার জন্য ওর ইমেজের ক্ষতি হচিছল। সেটা ক্ষতি নয়? নিজের পরিচছন্ন ভাবমূর্তি বজায় রাখতে ও তোমাকে বলি দিয়েছে। ওদের চোখে তুমি হয়ে গেছো বলির পাঁঠা, আর ও হয়ে গেছে হিরোইন…
আবার প্রচণ্ড শব্দে হেসে ওঠে অচেনা যুবকটি। যুবকটি অসহায়ভাবে আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার হাসির শব্দে তার বুকের ভিতরে ধস নামে। সে বলে ওঠে, তাহলে আমার জন্য ওর মনে কোনও জায়গায় নেই?
নিজের স্বার্থ ছাড়া ওর মনে আর কোনও কিছুরই জায়গা নেই। তুমি ওকে শিল্প হিসাবে দেখতে চেয়েছিলে। আর ও তোমার মধ্যে লোভ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায়নি। শিল্প সব জায়গায় চলে না। একটা ইতর মন কখনও শিল্পের যোগ্য হতে পারে না। তোমার ব্যবহারেও শুধু বিপদকেই দেখতে পেয়েছে। আর আত্মরক্ষা করতেই তোমাকে পাল্টা আক্রমণ করেছে। তোমার ইমেজ নিয়ে ভাবেনি। তোমার ডিগনিটির এতে কতটা ক্ষতি হচেছ, তা নিয়ে ভাবেনি। ও শুধু নিজেকে, নিজের জায়গাটাকে বাঁচাতে চেয়েছে। নিজেকে উজ্জ্বল করে তুলতে চেয়েছে। তুমি যে তলিয়ে যাচেছা, সেটা শুধু ওর অহংকারকেই পরিতৃপ্ত করেছে। তুমি যত বিপন্ন হয়েছ, ও তত অহংকারী হয়ে উঠেছে। নিজের ক্ষতি করে তুমি ওর দম্ভে ইন্ধন যুগিয়ে গেছো। তোমার যদি ক্ষমতা, প্রভাব,অর্থ, প্রতিপত্তি থাকত, ওর হিসেবটা অন্যরকম হত, ওর জন্য যে ছোটো ছোটো ত্যাগগুলো তুমি করে গেছো, তার প্রতিটার দাম দিতে ও বাধ্য হত…
এখন বুঝতে পারছি। যুবকটি বলল। বিড়ালী কখন বাঘিনী হয়ে ওঠে…
আর বাঘিনী কী করে জানো? সে তার শিকারকে নিয়ে খেলে। বাঘিনীকে কখনও দুর্বলতা দেখাতে নেই।
কখনও তার কাছে নিজের সারল্যকে প্রকাশ করতে নেই। নিজের ভেতরটা মেলে ধরতে নেই। সেখানে যদি ফুল থাকে, বাঘিনী তার সুযোগ নিতে ছাড়ে না। সেখানে আঁচড়াতে থাকে আর একটা একটা করে ফুলের পাপড়ি ছিড়ে নেবে। বাঘিনী তার শিকার নিয়ে খেলতে মজা পায়। সেই মজা আরও বেড়ে যায়, যখন শিকারই তাকে বেশি করে খেলার সুযোগ করে দেয়।। বাঘিনী যত খেলে, তত সে আরও বেশি করে বাঘিনী হয়ে ওঠে। আর মনে রেখো, বাঘিনী সবসময ঈর্ষার বিষয়, পুরুষের চোখে কাম্য। একটা বিড়ালীকে দেখে লোকে কৌতুক ও আহ্লাদ বোধ করে। আর বাঘিনীকে লোকে সমীহ করে, তাকে মাথায় করে রাখে। তুমিই ওকে বাঘিনী করে তুলেছ। বাঘিনী এখনও একটা পোকাকে মর্যাদা দেয়?
যুবকটি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে কী ভাবে। তারপর বলে, সত্যি, কে আমাকে মর্যাদা দেবে? আমি যে করুণার পাত্র! আমি যে এখানে শাস্তি পেতে এসেছি!
সেই গুহার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে একটি ছোট্ট শিশু উঁকি মারত। যুবকটি তাকে গান শোনাতো। আর জানতে চাইত, তুমি কী আমাকে চিনতে পারছ?
শিশুটি খিলখিল করে হাসত। তারপর বলত, কী সুন্দর গানের গলা তোমার!
কিন্তু, তুমি কী আমাকে চিনতে পারছ?
খুব পারছি। শিশুটি আবার খিলখিল করে হেসে উঠত।
যুবকটি মাঝে মাঝে শিশুটির সঙ্গে দাবা খেলত। ছোট্ট মেয়েটি একটি দাবার ছক নিয়ে আসত। তারপর গুটি সাজিয়ে বসত। যুবকটি মুখে মুখে নিজের চালগুলি বলে যেত। আর বাচ্চা মেয়েটি দু’জনের হয়ে চাল দিত।
একদিন মেয়েটি এসে খুব অদ্ভুতভাবে যুবকটির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, তুমি যেন কেমন হয়ে গেছ! আর ঠিক আগের মতো নেই।
হ্যাঁ, আমি আর আগের মতো নেই। যুবকটি দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে দিয়ে বলল।
কেন? শিশুটি জানতে চাইল। কী হয়েছে তোমার?
আমি একজন মানুষ। তাই না?
হ্যাঁ, তাই তো। শিশুটি বলল।
কিন্তু এখানে সবাই আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করে, যেন আমি একটা কুকুর…
শিশুটি খিলখিল করে হেসে উঠল।
তুমি হাসছ? যুবকটি খুব দুঃখ পেল। তারপর বিষন্ন গলায় বলে উঠল, এখানে কেউ আমাকে মর্যাদা দেয় না। মানুষ ভাবে না।
মর্যাদা কী? শিশুটি জানতে চাইল। সেটা না থাকলে বুঝি খুব দুঃখ হয়?
যুবকটি আর কিছু বলল না।
কয়েকদিন পর শিশুটি আবার এল। তারপর যুবকটির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। আর খুব আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?
যুবকটি ম্লান হেসে বলল, আমাকে চিনতে পারছ না?
যুবকটি গলার স্বর শুনে শিশুটি তাকে চিনতে পারল। সেদিন যুবকটি তাকে নিজের আঁকা একটা ছবি দেখাল। শিশুটি অনেকক্ষণ ধরে ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলে উঠল, এটা তো একটা মানুষের ছবি!
ঠিক বলেছো। যুবকটি বলে উঠল।
তুমি কী সুন্দর মানুষের ছবি আঁকো।
এটা আমার ছবি। যুবকটি আবার বলে উঠল। একসময় আমি এরকম দেখতে ছিলাম।
আবার এখন তোমাকে দেখতে ঠিক একটা কুকুরের মতো লাগে। কথাটা বলেই শিশুটি আবার খিলখিল করে হেসে উঠল। যুবকটি যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখানে অন্ধকার ঘন হয়ে নামছে। সন্ধে হো হো করছে। শিশুটি যুবকটির মুখ দেখতে পেল না। শুধু একটা ফোঁপানির আওয়াজ শুনল।
একদিন শিশুটি এসে যুবকটিকে বলে, আমি একটা নতুন নাচ শিখে এসছি। তোমাকে আজ নেচে দেখাব…
যুবকটি গর্তের মুখে এসে দাঁড়ায়।
শিশুটি চমকে ওঠে। তারপর বলে, তুমি কে?
যুবকটির গলা ভেঙে গেছে। সে বলে, তুমি আমাকে চিনতে পারছ না?
শিশুটি কোনও উত্তর দেয় না। নাচের কথাও ভুলে যায়। ছুটে পালিয়ে যায় সেখান থেকে।
যুবকটি গুটিসুটি মেরে রাতের অন্ধকারে শুয়ে ছিল। রাতে এখন আর তার ঘুম হয় না। সে আয়নাটা নিজের সামনে ধরে। তারপর অচেনা যুবকটিকে জিজ্ঞেস করে কী হয়েছে আমার?
কী হয়েছে? অচেনা যুবকটি জানতে চায়।
জানি না। সবসময় ভয় করে। কেমন একটা আতঙ্ক, উদ্বেগ, অনিশ্চয়তাবোধ, নিরাপত্তার অভাব…
ওঃ! তুমি খুব সংবেদনশীল।
হ্যাঁ, ঠিক তাই। আমার সবসময় মনে হয়, কেউ আমাকে আঘাত দেবে, কামড়ে দেবে, আঁচড়ে দেবে, আমাকে ফলস পজিসনে ফেলে দেবে, আমাকে হাসির খোরাক করে তুলবে, আমার নিন্দা করবে, সমালোচনা করবে, আমাকে উপেক্ষা করবে, অবজ্ঞা করবে, অসম্মান করবে…
তুমি জানতে না, এভাবেই মানুষকে শাস্তি দেওয়া হয়…
আমি তো আমার রুচি আর পরিচছন্নতা বজায় রাখতে চেয়েছিলাম…
এখানে ওসব বজায় রাখা অসম্ভব, তুমি জানতে না?
আমি ওদের সঙ্গে প্রথম থেকেই দূরত্ব বজায় রেখে গেছি।
তা কী করে সম্ভব? তোমারা সবাই একই গুহায় রয়েছো। আর গুহার দরজাটা বন্ধ…
আমি যতো মার্জিত আচরণ করে গেছি…
ওরা তত বেশি হিংস্র হয়ে উঠেছে, তাই না?
এখানে ডিগনিটি বজায় রাখা অসম্ভব…
এটাই তোমার শাস্তি…
নিজেকে এতো লো-স্পিরিটেড মনে হয় আমার…
ওরা তোমাকে ভুলতে দেবে না, তুমি দণ্ডিত, শাস্তি পেয়ে এখানে এসেছ…
যুবকটির হঠাৎ প্রচণ্ড রাগ হয়। সে গুহার পাথরের গায়ে আঁচড়ে ভেঙে ফেলে আয়নাটাকে। তারপর আয়নার টুকরোগুলোকে মাংসের টুকরোর মতো গপাগপ গিলতে থাকে…
হঠাৎ চারপাশে প্রচণ্ড হাসির হুল্লোড় ওঠে। যুবকটি দেখে, তাকে দেখতে কুকুর-কুকুরীদের রীতিমত ভিড় জমে গেছে। হইচই বাধিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ সাইকে ছাপিয়ে ফুল বস বলে ওঠে, ওই দ্যাখ, মানুষটা এবার কুকুর হয়ে গেছে…
হাফ বস আরও জোরে গলা তুলে বলে ওঠে, পাহারাদারকে খবর দাও। আজ রাতেই একটা পার্টি হয়ে যাক…
সবাইকে ছাপিয়ে খিলখিল করে হেসে ওঠে সুন্দরী কুকুরীটি।
যুবকটির চোখ দিয়ে জল গড়াতে থাকে। সে ওদের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চায়। কিন্তু চেনা কোনও শব্দ বেরোয় না ওর গলা দিয়ে
সে শুধু শুনতে থাকে, ঘেউ ঘেউ, ঘেউ ঘেউ…
নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারে না সে।
♦–♦
❤ Support Us