- ধা | রা | বা | হি | ক
- জানুয়ারি ৩০, ২০২২
আমার ছেলেবেলা
স্মৃতিকথা পর্ব-২১
মীর জুমলার বিবি মরিয়াম
মতির কাছে ঢাকার দর্শনীয় স্থানসমূহের একটা তৈরি তালিকা ছিল। দুপুরের দিক থেকেই সেই তৈরি তালিকার ক্রমিক নম্বরে টিকচিহ্ন পড়তে শুরু করলো। তখন আমাদের মুগ্ধ হওয়ার ক্ষমতা এতই প্রবল ছিল যে, যা দেখছিলাম তাতেই আমরা মুগ্ধ হচ্ছিলাম। গুলিস্তানের সামনেই মীর জুমলার ঐতিহাসিক কামানটি রাখা ছিল– মতি তার প্যান্টের বেল্ট খুলে সেই কামানের দৈর্ঘ্য মেপে নিল। আমার মনে হলো, কালীবাড়িতে দেখা শিবলিঙ্গের সঙ্গে এই কামানটার বেশ মিল আছে। হিন্দুরমণীদের হাতে পড়লে নির্ঘাৎ এর কপালে সিঁদুরের টিপ পড়তো। মীর জুমলার কপাল ভালো, রমনার কালীবাড়ির পরিবর্তে তার স্থান জুটেছে গুলিস্তানের গুলবাগিচায়।
যতদূর মনে পড়ে কামানটা গভর্নর হাউসের দিকে তাক করা ছিল। ঐ গভর্নর হাউসে তখন ময়মনসিংহের মোনায়েম খান সাহেব থাকতেন– আমার জ্যাঠামশাইর বন্ধুস্থানীয় উকিল হিসেবে পূর্ব থেকেই তাকে আমরা জানতাম। ঐ বাড়িটার দিকে তাকিয়ে একটু গর্বিত বোধ করলাম। ছাত্র আন্দোলনের জন্য ঐ বছরটা যে গভর্নর মোনায়েম খানের জন্য খুব সুখের ছিল না– তখন জানতাম না। কাছেই একতলা স্টেডিয়াম, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, এলাকার সবচেয়ে উঁচু হোটেল পূর্বাণী তখন তৈরি হচ্ছে। বায়তুল মোকাররম আজকের বিরাটত্ব পায় নি। ডি.আই.টি ভবনের এর চূড়া এবং চূড়ায় উৎকীর্ণ বিপুলকন্টকবিশিষ্ট ঘড়িটি সর্বাগ্রে চোখে পড়তো। নয়া মিঞা জানালো, এই ডি.আই.টি ভবনটি একসময় ঢাকার নবাবদের কাচারিবাড়ি ছিল। স্থির হলো, বিকেলে স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলা দেখে আমরা নারায়ণগঞ্জে ফিরে যাবো। ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে কোন্ দলের যেন খেলা ছিল। খেলা দেখার আগের সময়টা কাটাবার জন্য আমরা চিড়িয়াখানা এবং হাইকোর্ট দেখতে গেলাম। তোপখানা রোডে পাট রফতানী কর্পোরেশনের বিল্ডিংটিতে ছিল ইউসেস বা মার্কিন তথ্যকেন্দ্র। কাঁচের দেয়ালের ভিতর দিয়ে পাঠাগারে অধ্যায়রনতদের আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম। পুরো ভবনটি ছিল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। মার্কিন বিরোধী ছাত্র-বিক্ষোভের মাত্রা বৃদ্ধির ফলে পরে ঐ ভবন থেকে ইউসিস ধানমন্ডিতে স্থানান্তরিত হয়।
হাইকোর্টের ভিতরে তখন এতো জমজমাট ছিল না। হাইকোর্ট-সংলগ্ন চিড়িয়াখানাটাই ছিল প্রধান আকর্ষণ। চিড়িয়াখানাটা ছিল লেইকের পুব পাড় ঘেঁষে, খুব অল্প জায়গা নিয়ে। হাইকোর্ট, মাজার এবং চিড়িয়াখানার এমন অভূতপূর্ব সহাবস্থান পৃথিবীর অন্য কোথাও কখনো ছিল বলে মনে হয় না।
চিড়িয়াখানায় দুটো রয়েল বেঙ্গল, গোটা দুয়েক ভালুক, একটি সিংহ (ভুলও হতে পারে)– কিছু সংখ্যক বানর এবং চার-পাঁচটা হরিণ ছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না। পরে ঐ চিড়িয়াখানাটিকে মিরপুরে স্থানান্তরিত করা হয় এবং আরও পরে লেইকটিকে ভরাট করে দিয়ে হাইকোর্টের সামনে জাতীয় ঈদগাহ মাঠ তৈরি করা হয়।
বিকেলে আমাদের প্রিয় দল ভিক্টোরিয়া দুই গোলে জয়লাভ করে, কাদের বিরুদ্ধে তা মনে নেই। গুলিস্তানসহ জিন্নাহ্ এভিনিউর নিয়নবাতিগুলো একে একে জ্বলে উঠতে শুরু করে। গুলিস্তানে ছবি দেখার ইচ্ছে থাকলেও সে-আশা পূরণ হলো না, ওই হলে তখন একটি ইংরেজি ছবি চলছিল। পক্ষান্তরে নারায়ণগঞ্জের আশা সিনেমা হলে অশোককুমার এবং মধুবালা অভিনীত ভারতীয় হিন্দি ছবি ‘মহল’ চলছিল– যেহেতু রাতে নারায়ণগঞ্জেই ফিরে যেতে হবে, সুতরাং গুলিস্তান বাদ। আমরা গুলিস্তানের চারপাশে ঘুর ঘুর করে ফুলবাড়িয়া স্টেশনে গিয়ে নারায়ণগঞ্জের ট্রেনে উঠলাম। আমার সিনেমা দেখা শুরু হল মহল দিয়ে। সিনেমার মতো এমন চমৎকার জিনিস যে আর কিছুই হতে পারে না, অল্পক্ষণের মধ্যেই তা বুঝতে পারলাম। এ-ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার জন্য বাবার প্রতি খুব রাগ হলো। আমাকে চোখের জলে ভিজিয়ে দিয়ে সিনেমাটি শেষ হলো। বাবা কেন যে এতদিন আমাকে সিনেমা দেখতে দেন নি, বুঝলাম রাতে হোটেল কক্ষে ঘুমুতে যাবার পর। গতরাতে ট্যাক্সিতে ঘুমুতে পারি নি– ভেবেছিলাম আজ হোটেলের বিছানায় চমৎকার ঘুম হবে। কিন্তু কোথায় চমৎকার, আর কোথায় ঘুম? চোখ বুঁজতেই চোখের সামনে মধুবালা। চোখ থেকে মধুবালার ছবি কিছুতেই তাড়াতে পারি না। মহল দেখতে গিয়ে কখন যে নিজেই অশোককুমারে পরিণত হয়ে গেছি, বুঝতে পারি নি। স্বপ্নের ঘোরে অশোককুমার যেমন মধুবালার গান শুনতে পান, গান শুনে যেমন তার ঘুম ভেঙে যায়– আমারও ঠিক তেমনি অবস্থা হলো। চোখে ঘুম এলেই মধুবালা আসেন, হোটেলের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে গাইতে শুরু করেন : ‘আয়েগা, আয়েগা…..।’ তখন কী আর জানতাম যে ঐ গানটি মধুবালার নয়, লতার। ভাবতাম মধুবালাই গাইছেন। কী হৃদয় পাগল-করা সেই সুর– কী আশ্চর্য সম্মোহন সেই গানে। কী আশ্চর্য যাদু মধুবালার চোখের তারায়। সারারাত মধুবালা আমাকে ঘুমুতে দিলেন না। যাত্রাদলের রাধিকাও আমাকে এতোটা পাগল করতে পারেন নি।
অন্যরা দিব্যি ঘুমালো। আমি মধুবালার নাম জপতে জপতে, তার গান শুনতে শুনতে রাতটা কাটিয়ে দিলাম। সংগতকারণেই পর দিন আমার পেটের অসুখ দেখা দিল। কী বিপদ। এই দুর্দমনীয় অন্ত্রপীড়া পেটে নিয়েই ঢাকার দর্শনীয় স্থানসমূহ, যেমন : রমনা পার্ক, বলধা গার্ডেন, নওয়াব বাড়ি, লালবাগের কেল্লা, নিউ মার্কেট এবং নিমতলীস্থ ঢাকা যাদুঘর পরিদর্শন করে সবার শেষে এশিয়ার বৃহত্তম পাটকলটির হাল অবস্থা দেখে, নওয়াবপুর থেকে ছন্দু মিঞার জন্য র্যালী সাইকেল কিনে আমরা যখন বারহাট্টায় ফিরে এলাম– মনে হলো আমরা একটা বড় রকমের যুদ্ধ জয় করে ফিরেছি। যেখানেই যাই চারপাশে ভিড় জমে ওঠে। কল্পনার রঙ চড়িয়ে, দেখা-অদেখার পার্থক্য ঘুচিয়ে দিয়ে এমনভাবে ঢাকার গল্প বলি, বন্ধুরা ঈর্ষায় মরে যায়। শ্রোতার মনে ঈর্ষা জাগানোর মধ্যেই তো ভ্রমণ কাহিনীর সাফল্য। আমি নিজেকে ‘ঢাকা ফেরত’ বলে দাবি করতে থাকি।
মধুবালার পাশাপাশি ঢাকার কথাও আমার খুব মনে পড়তে থাকে। বলতে ভুলে গেছি, পেটের পীড়ায় উপকারী হবে, এই বিবেচনায় নিউমার্কেটের একটি দোকানে দাঁড়িয়ে আমরা প্রত্যেকেই একটি করে সেভেন আপ খেয়েছিলাম। তখন প্রতি বোতলের দাম ছিল বাষট্টি পয়সা। মতি আমাকে রঙধনু পত্রিকার অফিসে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, আমি উৎসাহ দেখাই নি। মতি না জানলেও পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন সেদিন কেন আমি উৎসাহ দেখাই নি। আসলে কবি হওয়ার ইচ্ছাটাকে আমি নিজের মধ্যে গুটিয়ে নিয়েছিলাম।
ক্রমশ
❤ Support Us