- ন | ন্দ | ন | চ | ত্ব | র
- জুন ১৬, ২০২৫
২২ জুন গিরিশে ফিরছেন বাদল ! ‘বাকি ইতিহাস’-এ কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ‘নোটো’-র ?

১৯৬৫ সাল। কাশ্মীরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে চলছে ভারত-পাকিস্তানের সশস্ত্র সংঘাত। ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির দৃশ্য জানান দিচ্ছে সভ্যতার বর্বর, ক্ষমতালোভী, রক্তপিপাসু আলেখ্য। সে স্রোত গিয়ে মিশল ঝিলমের জলে। ১৯৬২-র ভারত-চিন যুদ্ধ, ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫ সাল ভিয়েতনামে মার্কিন সেনাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রাম যা বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হিসাবে পরিগণিত হয়, সমূলে নাড়িয়ে দিয়েছিল মহানগরকে। ঠিক এমনই সময়ে সুদূর নাইজেরিয়াতে বসে থার্ড থিয়েটারের প্রাণপুরুষ নাট্যকার বাদল সরকার লিখলেন তাঁর তিন অঙ্কের কালজয়ী নাটক ‘বাকি ইতিহাস’ – যেখানে ব্যক্তিসত্ত্বা মিশে গেল বৃহৎ চেতনার নির্যাসে, যুদ্ধের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতি মঞ্চে ঘোষিত হল আরেক দীর্ঘ ‘যুদ্ধ’। সে যেন ক্ষমতার বিরুদ্ধে শোষিত, অত্যাচারিত, লাঞ্ছিত, দমিত মানুষের সম্মিলিত চিৎকার, অদম্য প্রতিবাদ।
আজকের যুদ্ধ বাজারে, ‘যুদ্ধ চাই, শান্তি নয়’-এর বিভৎস চাহিদায়, লাখো লাখো মানুষের অস্তিত্ব অস্বীকার করে, ‘দুর্বল’ এর বিরুদ্ধে হত্যালীলায় মেতেছে ক্ষমতাধরেরা। বোমা আর বুলেটের আঘাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে দেশ, নারী শিশু আর নিরীহ মানুষের আর্তনাদে মহাবিশ্বের বাতাসে কলরব তুলছে অথচ সমাজের বিবেকরা অদ্ভুত নিশ্চুপ ! দরজায় কড়া নাড়ছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালো গহ্বর, নয়া ইতিহাসের এমন যুগসন্ধিক্ষণে, যুদ্ধবিরোধী বাঙালির জাগ্রত বিবেক-কে পুনরায় সচকিত করতে, বাদল সরকারের ‘বাকি ইতিহাস’ আবার মঞ্চে ফিরিয়ে আনছে না-বলা আখ্যান । এই প্রত্যাবর্তনের কারিগর নাট্যব্যক্তিত্ব অমর চট্টোপাধ্যায় এবং ময়ূরী মিত্র এবং নোটো থিয়েটার গ্রুপ।
বাদল সরকারের ‘বাকি ইতিহাস’ মূলত অস্তিত্ববাদ ও মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের উপর ভিত্তি করে রচিত হলেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পাশ্চাত্যের অস্তিত্ববাদী নাট্যকাররা তাঁদের নাটকে যেভাবে ব্যক্তিজীবনের ক্ষোভ, দুর্দশা, গ্লানি, রিক্ততাকে ফুটিয়ে তোলবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, যেখানে নায়ক-নায়িকারা সবসময়ে সমাজের প্রচলিত ধারাকে অস্বীকার করে বাদল সরকারের সমাজ বিচ্ছিন্ন চরিত্রেরা নিজেদেরকেই পরিহাস করে, বিব্রত করে ঝাঁকিয়ে, নাড়িয়ে একাকার করে দেয় গলাপচা সমাজের দ্বিচারীতা আর লালসাকে।এই নাটকে, বাদল সরকার সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি ও মানুষের মনস্তত্ত্বের জটিলতা তুলে ধরেছেন। নাটকের প্রধান চরিত্র, যারা একটি বদ্ধ পরিবেশে আটকা পড়েছে, তারা জীবনের অর্থ এবং নিজেদের অস্তিত্বের সংকট নিয়ে প্রশ্ন তোলে। মানুষের পাশবিক প্রবৃত্তির অবদমন আর ফুটে ফুটে বের হবার অসহনীয় ছবি শব্দ ছাপিয়ে উঠে আসে। নাটকের প্রধান চরিত্র শরদিন্দু বাসন্তী – সুখী দম্পতি। খবরের কাগজের একটা আত্মহত্যার কাহিনিকে কেন্দ্র করে স্বামী স্ত্রী সেই আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে নিজস্ব ভাবনায় দুটি গল্প লেখেন সীতানাথ ও কণা একটি কল্পিত দম্পতিকে কেন্দ্র করে। সীতানাথের আত্মহত্যার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে শরদিন্দুকে শূন্যতাবোধ গ্রাস করলেও শরদিন্দু আত্মহত্যা করে না, শূন্যতা অবসাদের মধ্যেও আশার আলো খুঁজে পায়। নাটকের ঘটনা প্রবাহ এবং চরিত্রগুলির সংলাপের মাধ্যমে জীবনের অর্থহীনতা এবং সমাজের চাপিয়ে দেওয়া বাঁধনগুলির বিরুদ্ধে ঘোষণা করে ক্লান্তিহীন বিদ্রোহ। যে বিদ্রোহ আর একার থাকে না হয়ে ওঠে সর্বকালের, সর্বজনের।
আরম্ভ-এর সাথে কথাবার্তায় অমর চট্টোপাধ্যায় এবং ময়ূরী মিত্রের কণ্ঠে উঠে এলো বর্তমান সময়কালের যুদ্ধের বীভৎসতার কথা, বিশ্বব্যপি চলা অর্থনৈতিক, সামাজিক, মানবিক সংকটের কথা। মহামারী আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গেছে আমরা কতখানি অসহায়, নিত্যদিনের যুদ্ধের খবর, নির্যাতন নিপীড়নের খবর, মানুষের পাশবিক প্রবৃত্তির বর্বর হাসি, ভেঙে পড়া করুণ সমাজব্যবস্থার দিকে চেয়ে থেকে দুই বিশিষ্ট নাট্যকারের অন্তর কেঁপে ওঠে মুহূর্মূহ, তাঁরা আশ্রয় নেন ‘বাকি ইতিহাস’-এ। শুনতে পান আশার বাণী, একক থেকে দুই, দুই থেকে তিন, মানুষ যদি নিজ অন্তরের অশুভ, প্রবৃত্তি দমন করতে পারে, তাহলে পৃথিবীতে আর হিংসা হানাহানি, যুদ্ধ, শোষণ-নির্যাতন থাকবে না, আবার শ্যামল সুন্দর বাতাসে, স্নিগ্ধ আকাশের নীচে খেলা করবে মানুষের সন্তানরা। দু-দশক আগে লেখা, মঞ্চায়িত হওয়া নাটক আজকের দিনে নতুন করে, নতুন দর্শকদের জন্য গ্রহণযোগ্য করতে হয়তো বা কাহিনী, গল্পভাষ কিংবা চরিত্রায়ণে কিছু বদল হতে পারে, যদিও সেবিষয়ে নাট্যকাররা শেষমুহূর্তের সাসপেন্স বজায় রেখেছেন। তাঁদের আহ্বান, বাংলা নাটকের প্রেমিক-প্রেমিকাদের সবান্ধবে আগামী ২২ জুন, রবিবার, সন্ধে সাড়ে ৬টায়, ‘বালি নোটো’র প্রযোজনায় বাগবাজার গিরিশ মঞ্চে উপস্থিত থাকার জন্য। নাট্যমোদিদের যেতেই হবে, যান্ত্রিক শহরের ধুলোবালি ঠেলে, আর্তচিৎকার কিংবা গম্ভীর সুরের মূর্ছনা, অনুভূতির স্পন্দনে অনুররণ কতখানি ঢেউ তোলে তার সাক্ষী থাকতে। ফায়দা লোভী ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে চরিত্র লালিত সীতানাথের অস্তিত্বে, বাসন্তী, শরদিন্দুর ভিন্নস্রোতের কথনে, গল্প আর তাঁর ফুসফুসের ধ্বনিতে বাদল সরকারের ‘অ্যাবসার্ড’ আর ‘রিয়্যেলিজম’ – ময়ূরী মিত্র, অমর চট্টোপাধ্যায়-দের হাত ধরে ইতিহাসের কোন ভূমে হতবাক, নিশ্চুপ করে রাখবে আমাদের, কখনই বা হয়ে ওঠে প্রতিবাদের বজ্রকুঠার, পথসেনার কোন মিছিল-এ সামিল করেন ক্ষয়িষ্ণু চেতনা আর মননকে; জানতে সঙ্গে থাকাটা জরুরী, অনিবার্য।
নির্দেশনার পাশাপাশি নাটকে অভিনয় করবেন অমর চট্টোপাধ্যায়, ময়ূরী মিত্র। অন্যান্য চরিত্রে আছেন অতসী ভট্টাচার্য ,পল্লব চক্রবর্তী, স্বপ্না সোম, দীপান্বিতা ঘোষ, শুভজিত সোম, মানস সাহা ও বিশ্বজিৎ মাইতি ৷ মঞ্চ, আলো এবং আবহ নির্মাণ সহ বিভিন্ন দায়িত্বে সুপর্ণা সোম, দিগ্বিজয় বিশ্বাস, তাপস ভট্টাচার্য।
❤ Support Us