- এই মুহূর্তে দে । শ
- ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২৫
মেলাজুড়ে হাঁটছেন দিনপঞ্জির সালভাদর দালি, কাল থেকে ছুটবেন ‘পায়ে পায়ে পাঁচালি’-র বীরেন্দ্র

বইমেলার কত শেডস, কত আকাশ, কত নদী, কত পাহাড় আর অরণ্য, বলা কঠিন। প্রতিদিন মুর্হুমুহু রং বদলায় তার ধরা চত্বর। অসংখ্য বই আসে, অন্য হাতে চলে যায়, যেতে যেতে গান শোনে, আওয়াজ শোন, কলধ্বনি তুলে ছড়িয়ে দেয় রুদ্ধ হৃদয়, আর সব রুদ্ধতাকে তছনছ করে প্রতিদিনই বইয়ের মোড়ক উন্মোচনকে ঘিরে শুরু হয় নিজেদের অতীতকে, বর্তমানকে ভবিস্যতের মুখ আর অভিমুখকে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা। কত বই বিক্রি হল, তার হিসেব আনুষ্ঠানিকতা ছুঁয়ে শেষ দিন জানিয়ে দেবেন মেলা কর্তৃপক্ষ। শুভ উদ্যোগ। কিন্তু কোন্ কোন্ প্রকাশক কী কী নতুন বই বের করলেন, বইয়ের বিষয় কী, তা কি বলা হয়? হলে ভালো, না হলে ভবিষ্যতে বলতে হবে। পাঠকদের, না-পাঠকদেরও জানাতে হবে এসব তথ্য।
এই যে অধ্যাপক মুস্তাক আহমেদ বের করেছেন নিপুণ সম্পাদনায় গহন-কমল, যা লেখক-চর্চা আর একজন ভবঘুরের ঐক্যচর্যার ইতিহাস হয়ে থাকবে। এই যে সিগনেট থেকে বের হয়েছে বরাক সন্তান মনোতোষ চক্রবর্তীর ‘মাঠ প্রান্তরের কবিতা’, এই যে বাংলা ভাষার অন্যতম ঋদ্ধ কবি কওসর জামালের অনুবাদে মহান চিত্রকর সালভাদর দালির ‘প্রতিভাবানের ডায়েরি’, সুরিয়ালিজমের শতবর্ষ পূর্তিতে, ‘সুরিয়ালিজম ও ফরাসি কবিতা’ — শীর্ষক দুটি পুস্তক; এই যে আরম্ভ-র উদ্যোগে আড়াল থেকে বেরিয়ে এল দেবাশিষ ভট্টাচার্যের ‘ক্রুশবিদ্ধ চরিত্ররা’, এই যে বসন্তের আমেজ ছড়িয়ে দিচ্ছে হেদায়েতুল্লার — নির্বাক অথবা হলুদ নগরী [গল্প সংকলন], এই যে টগবগে রসিক, রম্য রসিক সোমা দত্ত-র প্রথম, দ্বিতীয় আর তৃতীয় চোখে দেখার তীর্যক বয়ান ঢেউ তুলছে, ছোট বই, বড় বই, গম্ভীর বই – এসবের খবর কে বলবে? বলা দরকার। কেবল চেনা মুখে রং লাগালেই দায়িত্ব শেষ ! অভিযোগ নয়, দুষ্টু মন্তব্য নয়, এটা একটি প্রস্তাব, নতুন লেখক, নতুন বই-প্রকাশের সংবাদও জানাতে হবে। পরের বইমেলায়, আশা করব, মেলা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে ভাববেন, কাঙ্খিত দায়িত্বের দরজা খুলে দেবেন।
জানি তাঁদের কাজ অনেক। অনেকানেক দংশন সহ্য করতে হয়, নবীন-প্রবীণ মননের সাধনাকে না হয় একটু গুরুত্ব দিলেন, এতে যদি ভার বাড়ে, বাড়ুক, আমরা অবশ্যই পাশে থাকব। এই যে, মৃত্যু অতিক্রম করে, আগামীকাল, ৭ ফেব্রুয়ারি রাঢ় বাংলার একটি গ্রামের আত্মকথা, পায়ে পায়ে পাঁচালি- র গল্প শোনাবেন সুলেখক বীরেন্দ্রকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, এও একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ। এ খবর বইমেলায় আগাম কেন বলা হবে না ? প্রশ্ন তুলছি কারণ, সাব-অল্টার্ন ইতিহাসের চর্চায়, পায়ে পায়ে পাঁচালি-র বৃত্তান্ত অবজ্ঞার বিষয় হতে পারে না, হওয়া উচিত নয়। নিজের নয়, জন্ম-গ্রাম আর রাঢ় বাংলার মিলিত ঐক্য, মিলিত ঐতিহ্যের কাহিনী শুনিয়েছেন বীরেন্দ্রকুমার। বঙ্গীয় সমতটের সমগোত্রীয় মানুষের, একটি বিশেষ অঞ্চলের, আত্মবৃত্তান্ত আলোর মুখ দেখবে, এ টা কি অনালোচিত থাকার মতো বিষয়?
সমাজ, ইতিহাস আর স্মৃতিধৃত অঞ্চলের ঐতিহ্যবোধ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে হাঁটতে শুরু করেছিলেন বীরেন্দ্রকুমার (১৯৩৩-২০১৯), বড়ো হয়েছিলেন ঔপনিবেশিকতার অপরাহ্নে, বর্ধমানে। দেখেছেন পরিবারের ভিতরে ও বাইরে দারিদ্র আর অপুষ্টির ভ্রূকুটি। এসব প্রতিকূল আবহেও কী ভাবে গ্রামের পূজা-পার্বন, যাত্রাপালা, নাট্যাভিনয় প্রেমমগ্ন করে রাখত এলাকার গণমুখকে, তার নিখুঁত, অকৃত্রিম সত্যরূপ যা কৌমজীবনের অংশ হয়ে আছে আজও — এরকম চালচিত্রের নির্মাণ আর বিনির্মাণের গল্প লিখেছেন তারাশঙ্কর আর শৈলজানন্দের ভাবশিষ্য। এক সময়, গ্রামাঞ্চলের বাইরে কাজ করেছেন, যখন সম্প্রসারণবাদী খনি অর্থনীতিতে বস্তুতন্ত্রের ছায়া পড়ছে, বাড়ছে শোষন, দরিদ্রতা আর ঔপনিবেশিক অনাচার। স্থির চোখে সামাজিক বিবর্তন দেখেছেন পায়ে পায়ে পাঁচালি-র লেখক এবং বুকের ভেতর আমৃত্যু লালন করেছেন অন্য এক অপুকে, যে দেখে, যে শোনে, যে সহ্য করে নীরবে, যার কান্না থেকে যায় অশ্রুত, অলিখিত। তারই কান্নার আওয়াজ এবার শুনতে পাবে বইমেলা, মেলার বাইরেও অবাক হয়ে আমরা দেখার সুযোগ পাব – কী দুঃসহ যন্ত্রণা বুকে নিয়ে বীরেন্দ্রকুমার জেগে রইলেন আমৃত্যু, মৃত্যুর পরেও তাঁর অঞ্চলের হয়ে- ওঠার গল্প শোনাচ্ছেন।
সমসাময়িক কিংবা পরের নষ্ট-প্রতিভা অথবা প্রতিভা ভ্রষ্ট লেখকদের দুষ্টু চিহ্নকে আমল দেন নি বীরেন্দ্র, ঠিক বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে প্রান্তজনের গল্পকথা বলে গেছেন। এই ন্যারেটিভ পুরোপুরি অন্য ভাষায়, অন্য স্বরে, এবার কথা বলবে। মেলা কর্তৃপক্ষ কেন এরকম একটি খবরকে এড়িয়ে যাবেন? তাড়িয়ে যাচ্ছেন কি না জানি না, শুনেছি ‘পায়ে পায়ে পাঁচালি’-র মোড়ক উন্মোচনে হাজির থাকবেন গিল্ডের সুধাংশু শেখর দে এবং ত্রিদিব চট্টোপাধায়। বলবেন অমর মিত্র, ভগীরথ মিশ্র, প্রচেত গুপ্ত আর বিনতা রায়চৌধুরী। বীরেন্দ্রকুমারের যোগ্য উত্তরসূরী পুত্র আলাপন বন্দ্যোপাধায়ের বয়ানে সম্ভবত ফুটে উঠবে পিতৃস্মৃতি আর রাঢ়বাংলার স্মৃতি। সূর্যাস্তের পরেও কীভাবে অস্তমিত সূর্য নতুন করে আলো ছড়ায়, তা প্রত্যক্ষ করবার অপেক্ষায় রইলাম। আমীন।
❤ Support Us