- এই মুহূর্তে দে । শ
- নভেম্বর ৪, ২০২৩
উন্নয়ন বনাম কুৎসা, এই আবহেই ৭ নভেম্বর শুরু ছত্তিশগড় বিধানসভা নির্বাচন। মাও আতঙ্ক এড়িয়ে বস্তারের ১২০ গ্রামের বাসিন্দা ভোট দেবেন প্রথমবার। হাত পা পদ্মে আস্থা, পাল্লা ভারী কোনদিকে ?
উন্নয়ন বনাম কুৎসা! এই পরস্পর বিপরীত ধর্মী স্লোগানকে সামনে রেখেই ছত্তিশগড় বিধানসভা নির্বাচনের প্রচার চালাচ্ছে কংগ্রেস ও বিজেপি। ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনের আগে যে পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন হতে চলেছে এই মাসে তার মধ্যে একটি রাজ্য ছত্তিশগড়। ছত্তিশগড় রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফল কোন দিকে যাবে তা নিয়ে সমীক্ষা ও জল্পনা এখন তুঙ্গে। রাজ্যের শাসক দল তো বটেই, বিরোধী বিজেপিও সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রেখেছে ছত্তিশগড়ে। ছত্তিশগড়ে কংগ্রেস ও বিজেপির মুখোমুখি লড়াই।
এদিকে স্বাধীনতার পর এই প্রথম ছত্তিশগড়ের মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকার মানুষ নিজের ভোটে নিজের এলাকায় দেবেন। এটাও জাতীয় নির্বাচন কমিশন ও ছত্তিশগড়ের ভুপেশ বাঘেলা পরিচালিত কংগ্রেস সরকারের কাছে বড়ো চ্যালেঞ্জ। দক্ষিণ ছত্তিশগড়ের মাওবাদীদের গড় হিসেবে পরিচিত বস্তার-এর সাতটি জেলা নিয়ে গঠিত। মধ্যপ্রদেশ ভেঙে ছত্তিশগড় রাজ্য গঠন হওয়ার পরেও বস্তারে একছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে মাওবাদীরা। তাদের ফতোয়া অমান্য করার সাধ্য ছিলনা মাও অধ্যুষিত ১২০টি গ্রামের কোনও মানুষের। ভোট দেওয়া তো দূরের কথা, যে কোনও অনুষ্ঠান করতেও অজানা আতঙ্ক তাদের তাড়া করত। বাধ্য হয়ে তাই এই মাওবাদী এলাকার মানুষদের গ্রাম থেকে দূরে যেতে হত ভোট দিতে। এবার বিধানসভা নির্বাচনে মাও অধ্যুষিত গ্রামের মানুষজন যাতে নিজেদের এলাকায় ভোট দিতে পারেন, তার জন্য জাতীয় নির্বাচন কমিশনের তরফে নেওয়া হয়েছে ব্যবস্থা। জাতীয় কমিশন সূ্ত্রে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, এবার বস্তারের ১২০টি গ্রামের মানুষের জন্য ১২০টি আলাদা ভোট কেন্দ্র তৈরি করা হবে। এতে প্রায় ৫৪ হাজারের বেশি ভোটার উপকৃত হবেন, নিজেদের এলাকার বুথে ভোট দিতে পারবেন। বিগত বছরগুলির মতো মতো ভোট দেওয়ার জন্য কষ্ট করে ১০ কিলোমিটার পথ হেঁটে যেতে হবে না। ছত্তিশগড় বিধানসভা নির্বাচনের এটা আরও একটা উল্লেখযোগ্য দিক।
ছত্তিশগড়ের নির্বাচনী হাওয়া বলছে, কংগ্রেস দ্বিতীয় মেয়াদে ছত্তিশগড়ে ক্ষমতায় আসতে চলেছে। বিজেপি আর একটি পরাজয়ের সম্মুখীন হতে চলেছে এই রাজ্যে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস এই রাজ্যে পর্যাপ্ত প্রাধান্য নিয়ে জিতেছিল। বিজেপি টানা তৃতীয় মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার পর গতিচ্যুত করেছিল কংগ্রেস।
এবারের ছত্তিশগড় বিধানসভা নির্বাচনের পরিবেশ পরিস্থিতি ও ভোটের হাওয়া আভাস দিচ্ছে, আবারও এই রাজ্যে ক্ষমতায় আসতে চলেছে ভুপেশ বাঘেল পরিচালিত বর্তমান কংগ্রেস সরকার। ২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বেশ ভালো ভাবেই কংগ্রেস ছত্তিশগড়ে জিতেছিল। আবার কংগ্রেস যদি জয়ী হয় তাহলে এটা হবে কংগ্রেসের ছত্তিশগড়ে ২০১৮-র পর ২০২৩-এর বিধানসভা নির্বাচনে জয়। ২০১৮ সালেই পর পর তিন বারের বিজেপি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে কংগ্রেস ছত্তিশগড়ের কুর্সিতে বসেছিল। ৯০টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ২০১৮তে ৬৮টি আসনে জয়লাভ করেছিল কংগ্রেস। রাজনৈতিক সমীক্ষকরা বলছেন ২০২৩ এর বিধানসভা নির্বাচনেও যথেষ্ট শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে কংগ্রেস। বাঘেলের সরকার মানুষের চাহিদা পূরণে গত পাঁচ বছরে যে ভাবে ছত্তিশগড়ে কাজ করেছে তাতে রমন সিং-এর চাইতে লড়াইয়ে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছেন ভুপেশ বাঘেল।
আগামী ৭ ও ১৭ নভেম্বর দুই দফায় বিধানসভা নির্বাচন। এদিকে শনিবার ছত্তিশগড়ে নির্বাচনী প্রচারে এসে বিজেপি শীর্ষ নেতা তথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে বলেছেন, “বেআইনি বেটিং অ্যাপ থেকে হাওয়ালার মাধ্যমে ছত্তীসগঢ়ের নির্বাচনে টাকা ঢালছে কংগ্রেস।” প্রসঙ্গত নরেন্দ্র মোদি মহাদেব বেটিং অ্যাপ-এর কথা যে বলেছেন তাতে কোনও সংশয় নেই।
সম্প্রতি এই মহাদেব বেটিং অ্যাপের সঙ্গে ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রী ভুপেশ বাঘেলের যোগের বিষয়টি ইডি প্রকাশ্যে এনেছে। তার পরই শনিবার দুর্গ -এ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কংগ্রেস সরকারকে আক্রমণ করে বলেন, “ভারতীয় জনতা পার্টির এটা ট্রাক রেকর্ড যে আমরা যা বলি, তাই করি। ছত্তিশগড় বিজেপির শাসনকালেই তৈরি হয়েছিল। আমি আপনাদের গ্যারান্টি দিচ্ছি যে বিজেপি-ই ছত্তিশগড়কে সঠিক অবস্থায় আনবে। কিন্তু কংগ্রেস পার্টির মিথ্যাচার বিজেপির সংকল্প পত্রের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কংগ্রেসের এখন প্রধান কাজই হল দুর্নীতি দিয়ে খানাখন্দ পূরণ করা।”
নরেন্দ্র মোদি আরও বলেন, “কংগ্রেস পার্টির ছত্তিশগড় সরকার আপনাদের লুট করার কোনও সুযোগই ছাড়ছে না। ওরা মহাদেবের নামটাকেও ছাড়ল না। দুইদিন আগে রায়পুরে বিরাট অভিযান চলে। বিশাল পরিমাণ নগদ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। এই টাকা সাধারণ মানুষের, যা তারা বেটিং করে ব্যয় করেছিলেন।”
নরেন্দ্র মোদির কথায় প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে যে কংগ্রেসের প্রচারের কাছে ধোপে টিকছে না বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদির প্রচার ও সংকল্প পত্র। তাই নরেন্দ্র মোদির ভাষণে শনিবার উঠে এসেছে, “কংগ্রেস পার্টির মিথ্যাচার বিজেপির সংকল্প পত্রের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কংগ্রেসের এখন প্রধান কাজই হল দুর্নীতি দিয়ে খানাখন্দ পূরণ করা।” পরাজয়ের সময় এই ভীতি নরেন্দ্র মোদিকে চেপে ধরেছে বলে মন্তব্য করেছেন ভুপেশ বাঘেল।
কংগ্রেসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে নরেন্দ্র মোদি বলেন, “যারা ছত্তিশগড়ের মানুষদের লুঠ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করা হবে। প্রত্যেকটা পয়সার হিসাব নেওয়া হবে। ছত্তিশগড়ের দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার একের পর এক দুর্নীতি করে আপনাদের বিশ্বাস ভেঙেছে। আমি আপনাদের আশ্বাস দিয়ে বলছি, রাজ্যে বিজেপি সরকার গঠন হলে, এই সমস্ত দুর্নীতির কড়াভাবে তদন্ত করা হবে। যারা লুঠ করেছে, তাদের জেলে পাঠানো হবে।”
নরেন্দ্র মোদির এই বক্তব্যে কোথায় যেন একটা হতাশার সুর ধরা পড়ছে। আসলে ২০১৮-র বিধানসভা নির্বাচনে ১০ শতাংশ ভোট কম পেয়েছিল বিজেপি। কংগ্রেস ২০১৮-র নির্বাচনে ৪৩ শতাংশর বেশি ভোট পেয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। বিজেপি ২০১৮তে পেয়েছিল ৩৩ শতাংশ ভোট।
এদিকে ছত্তিশগড় বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে এসে বড় প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাহুল গান্ধির ঘোষণা, আমরা ছত্তিশগড়ে ভোটে জিতে গরিব মানুষের জন্য ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনা পয়সায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করব। দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এলে ছত্তিশগড়়ের বাসিন্দাদের জন্য় এই বিরাট স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। ভূমিহীন কৃষকদের জন্য গ্রামীণ এলাকায় প্রতিবছর ১০,০০০ টাকা করে প্রতি বছর দেওয়া হবে। বর্তমানে তাদের ৭,০০০ টাকা করে দেওয়া হয়।
রাহুল গান্ধি জানিয়েছেন, কংগ্রেস গরিব, কৃষক, কৃষি মজদুর, শ্রমিক, পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য কাজ ছত্তিশগড়ে কাজ করেছে আবারও তাদের জন্যই কাজ করবে। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে রাহুল গান্ধি জানিয়েছেন, আমি বাঘেলজীকে বলেছি বড় করে ভাবুন। এখানে ধান, সবজির ভালো চাষ হতে পারে। এলাকায় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল তৈরি করা, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট তৈরি নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, ক্ষমতায় ফেরার পরেই আমরা দুতিনটি বিমানবন্দর খুলব। ইংরেজি শেখার জন্যও বলছি। কারণ আমেরিকা, দুবাই, ইংল্যান্ডে সবজি রফতানি করতে গেলে, সেখানে যেতে গেলে আপনাকে ইংরেজি জানতে হবে।
রাহুল গান্ধির ঘোষণা, কৃষক ও দিনমজুরদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। তারা আমাকে জানিয়েছেন, ৭০০০ টাকাটা তাঁদের কম হয়ে যাচ্ছে। এরপর মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এটা বাড়িয়ে ১০,০০০ টাকা করে দেওয়া হবে। ছত্তিশগড় ক্ষমতায় আসার পরের দিন থেকেই কংগ্রেস জাতিগত জনগণনা শুরু করে দেবে বলেও রাহুল গান্ধি প্রতিশ্রুতি দেন।
এই প্রতিশ্রুতি ও দুর্নীতির অভিযোগের মধ্যে কংগ্রেসের দিকেই পাল্লা ভারী লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে। ছত্তিশগড়ের কংগ্রেস সরকার গত পাঁচ বছরে ছত্তিশগড়ের মানুষের জন্য বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষের জন্য কাজ করেছে, সেই কাজ স্থায়ী উন্নয়নের পক্ষে যেমন সহায়ক হয়েছে তেমন আবার কিছুটা চমকের রাজনীতিও হয়েছে। তবে সার্বিকভাবে বিচার করলে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যে ভাবে দেশের মানুষের জীবনযাপনের উপরে আর্থিক বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে তাতে কোনও ভাবেই বিজেপির কোনও প্রতিশ্রুতি ছত্তিশগড়ের মানুষ বিশ্বাস করছে না, সেই হাওয়া ছত্তিশগড়ের নির্বাচনের পালে লেগেছে। কাজেই বলা যায় দ্বিতীয়বারের জন্য কংগ্রেস ছত্তিশগড়ে ক্ষমতায় আস্তে যে চলেছে সেটা সময়ের অপেক্ষা। কেন না মানুষ ভালো কথা ভালো কাজ চায়। বিজেপি ভালো কথা বলেছে কিন্তু ভালো কাজ সেই অর্থে করেনি। অথচ সীমিত ক্ষমতার মধ্যে কাজ করতে গিয়ে ভুপেশ বাঘ্যের কংগ্রেস সরকার বিজেপির বঞ্চনার মুখে পড়েছে। পাশাপাশি দুদিন আগে ইডি বেআইনি বেটিং অ্যাপ থেকে কংগ্রেস নির্বাচনী খরচ তুলছে, রাজ্যে ক্ষমতায় এলে কংগ্রেসকে উচিত শিক্ষা দেওয়া হবে বলে নরেন্দ্র মোদি ভাষণে বললেও সেই কথা মানুষ বিশেষ পাত্তা দিচ্ছে না। এই আবহেই ৭ ও ১৭ নভেম্বর দুই দফায় ভোট হতে চলেছে ছত্তিশগড়ে।
❤ Support Us