Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক
  • জানুয়ারি ২৩, ২০২২

অন্য ভাষা ভিন্ন স্বর

অংশুমান কর
অন্য ভাষা ভিন্ন স্বর

কে সচ্চিদানন্দ, আলোকচিত্র: শিখা খান

annya-bhasa-bhinnya-swr


ইউরোপ , লাতিন আমেরিকা, চিন ও জাপানি কবিতার অনুবাদ বিরল নয় বাংলায় । গত শতাব্দীর ত্রিশের দশক থেকে, বিদেশি ভাষার বহু স্বর, বহু সুর, নানা রকম ভাষাভঙ্গি আর বহুমাত্রিক বিষয়ের সংযোজনে ঋদ্ধ হয়েছে আমাদের মনন, আমাদের কবিতা পাঠের মগ্ন চেতনা । কিন্তু এই উপমহাদেশের উত্তর আর দক্ষিণ, পূর্ব আর পশ্চিমের কবিতা, কবিতা ভাবনা দূরে পড়ে রইল এখনও । কেন ? ভারতীয় ভাষাচর্চায় বাঙালির অনীহা, না এক প্রতিবেশীর সঙ্গে আরেক প্রতিবেশীর, আরোপিত প্রকান্তরে অনুশাসিত দূরত্বই তৈরি করেছে অপরিচিতির চৌহদ্দি ? এসব প্রশ্নের জবাব খোঁজা জরুরি । সম্ভবত, যুক্তিপ্রসূত জিজ্ঞাসা নিয়ে উপমহাদেশের বিভিন্ন ভাষার কবিতার ধারাবাহিক তরজমায় প্রতিস্পর্ধী, সমান্তরাল চিন্তার বিশিষ্ট সহযোগী অংশুমান কর


কে সচিদ্দানন্দন

বাড়ি, একটা পশু

বাড়ি হল একটা পশু
যার ফুসফুস রয়েছে শরীরের বাইরে।
সেজন্যই সূর্য বা বরফের
সামান্য ছোঁয়াতেই
বাড়ির জ্বর চলে আসে।

বাতাস আর বৃষ্টি যদি
এভাবে চলতেই থাকে
তাহলে বাড়ি মারা যেতেও পারে।

 

একজন নারীকে ভালোবাসা

একজন নারীকে ভালোবাসা মানে
তাকে পাথরের জীবন থেকে পুনর্জীবন দেওয়া,
তাকে আশিরনখ এমনভাবে আদর করা
যাতে অভিশাপে জমে বরফ হয়ে যাওয়া তার রক্ত
এক স্বপ্নের ছোঁয়ায় গরম হয়ে গলে যায়।

একজন নারীকে ভালোবাসা মানে
তার ঝুলকালিতে ভরা দিনগুলোকে
এমন একটা ভরত পক্ষী বানিয়ে দেওয়া
যে স্বর্গের ফুলের পরাগের মধ্যে শ্বাস নেয়।
একজন নারীকে ভালোবাসা মানে
নিজেকে ফুল-ফলে ভরা একটা গাছে রূপান্তরিত করা
যেখানে রাত্রিবেলা তার ক্লান্ত ডানা নিয়ে নারীটি বিশ্রাম নিতে পারে।

একজন নারীকে ভালোবাসা মানে
এক নতুন মহাদেশের খোঁজে
মেঘাচ্ছন্ন আকাশের নীচে
ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সমুদ্রে পাল তুলে দেওয়া;
তোমার উঠোন থেকে
একটি লাল দোপাটি তুলে নিয়ে
তাকে এক অজানা উপকূলে পুঁতে দেওয়া।

একজন নারীকে ভালোবাসা মানে
তোমার পেশির রুক্ষতা
একটি পুষ্পের কোমলতার সঙ্গে বদলে নেওয়া,
নিজেকে অস্ত্র এবং মুকুট থেকে মুক্ত করা,
নগ্ন হয়ে, আর এক আকাশকে অতিক্রম করে
তোমার শরীরের মাংস অন্য এক গ্রহের বাতাস আর
অন্য এক জলকে সমর্পণ করা।

একজন নারীকে ভালোবাসা মানে
তাকে সাহায্য করা
তার প্রাচীন ক্ষত থেকে এক ঝকঝকে তরবারিকে টেনে বের করতে
আর তারপর সেই তরবারির ফলায় নিজের হৃদয়কে চেপে ধরে শুয়ে থাকা
যতক্ষণ না দেহের শেষ রক্তবিন্দুও ঝরে নিঃশেষিত হয়।

আমি কখনওই একজন নারীকে ভালোবাসতে পারিনি।

চিত্র: দেব সরকার

 

নেকড়ে

আমি সেই বিখ্যাত নেকড়ে:
তিনটে পৃথিবীর প্রভু।
আমার যুক্তিই জঙ্গলের যুক্তি,
আমার ভাষা, মৃত্যু।
পৃথিবী আমার কাছে আমার শিকারে পরিপূর্ণ
বড় একটা থালা।
আমার চোখের গ্রীষ্ম থেকে কোনও ভেড়ার রেহাই নেই।
মৃত জীবজন্তুর নাড়িভুড়ি আমাকে দিও না, আমি কোনও কুকুর নই
মধুও দিও না, আমি কোনও ভাল্লুকও নই।
মৃতদেহ আমি শেয়াল আর শকুনের জন্য ফেলে রাখি।
কেবল জীবিতের গরম রক্তই
আমার জিহ্বায় নেশা জাগায়।
আমি শান্তি ভালবাসি, যুদ্ধও।
জঙ্গলের স্বাভাবিক শব্দের ভেতরে
আমার শিকারদের আর্তনাদ ডুবে যায়।

আমি স্বর্গের নেকড়ে,
তিনটে যুগের প্রভু।
আমার হুঙ্কার পর্বতকে দুটুকরো করে দেয়।
আমার পদচারণা ভূমিকম্পকে ডেকে আনে।
আমার দৃষ্টি বসন্তে আগুন লাগায়।
যারা প্রবহমান, আমি তাদের বেঁধে রাখি,
যারা উড়তে পারে, আমি তাদের নীরব করে দিই।
আমার নখ ঋতুগুলিকে দুফালা করে দেয়।
আমার লেজের ঝাপটে মহাদেশগুলো দুলতে থাকে।
আমার শিকারের সঙ্গে আমি কোনও আলোচনায় যাই না;
চুক্তিতে আমার বিশ্বাস নেই।
আমাকে যে প্রশ্ন করে
সে ভঙ্গ করে প্রকৃতির নিয়ম।

আমার খাদ্য হওয়া এক পরম সৌভাগ্য
আমার শিকারেরা কেবল সেই স্বপ্নই দেখতে পারে।
এটাই মুক্তি।
বোধিসত্ত্বের আরেকবার জন্মানোর প্রয়োজন নেই।

 

ঘর আর জেলখানা

তুমি এনেছিলে একটা সূর্যমুখীর বীজ
আর আমি, দিনের আলোর একটা পাতা।
তুমি এনেছিলে একমুঠো চাঁদের আলো
আর আমি, নাচের এক রাত্রি।
তুমি এনেছিলে এক হরিণীর চোখের জল
আর আমি, এক বুনো বোলতার মধু।
তুমি এনেছিলে স্বর্গের একটি পালক
আর আমি ঈশ্বরের একটি শব্দ।
আমাদের বাড়িটা ছিল সাদা
আর আমাদের শিশুগুলি কালো।
ওরা কাঁদছিল; আমি সহ্য করতে পারিনি,
একদানা শস্যের জন্য আমি উড়ে গিয়েছিলাম সূর্যের কাছে।

এখন আমার ডানা আর আমার গান
এই মেঘের ভেতরে বন্দি।
আমার একাকীত্ব কথা বলে ওঠে বজ্রের ভাষায়
আর বিদ্যুতচমকের সঙ্গে
আমি হাতড়ে হাতড়ে আমাদের ঘরে ফিরতে চাই।

যখন খুব শীত করে, আমার গানগুলো
গলে হয়ে যায় বৃষ্টি আর ঝরে পড়ে
আমাদের সাদা বাড়িটার ওপর,
আমাদের মধ্যের অন্ধকার শূন্যতার ওপর।

 

♦♦−♦♦♦♦−♦♦

 

 

 

 


❤ Support Us
error: Content is protected !!