Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক
  • মার্চ ১৩, ২০২২

লঙ্কাগড়ের লঙ্কাকাণ্ড

পর্ব ২১

শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী
লঙ্কাগড়ের লঙ্কাকাণ্ড

অলঙ্করণ: দেব সরকার

অনেক রাত অবধি ঘুম এলো না রঙ্গীলের ।সে ভাবছিল ।এই লঙ্কাগড়ের রহস্যভেদ আর কোন কোন ভয়ানক ঘটনা ঘটাবে কে জানে ?এইবার এই অভিযানের ইতি হলেই ভালো ।স্কুল খুলবে কবে কী জানে ।কতোদিন স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়না তার ।চন্দনের জন্যও মন কেমন করতে থাকে তার ।স্কুলে তার বন্ধুরা বলাবলি করত,গ্রামের স্কুলে সব দারুণ দারুণ ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা করে ।বোর্ড পরীক্ষায় তো তারাই প্রথম দিকে রাঙ্ক করে ।এই অতিমারীর পর কী তবে চন্দনের মতো বুদ্ধিমান ভালো ভালো ছেলেমেয়েরা পাকাপাকিভাবে পড়াশোনাই ছেড়ে দেবে ? ভাবতে ভাবতে চোখ লেগে আসে তার ।তারপর রঙ্গীল দেখে সে পৌছে গেছে এক রাজদরবারে । সেখানে সাদা রঙের সিংহাসনের উপর বসে আছেন এক রাজা । এই রাজামশাই অমূল্যনারায়ণই তো বটে । দরবারে বিচার চলছে । যার বিচার চলছে তার ডানহাতে একটা ত্রিশূল আঁকা উল্কি । লোকটার মুখটা হুডওলা জ্যাকেটে ঢাকা । হঠাৎ রঙ্গীল দেখতে পায় রাজসিংহাসনে বসে থাকা রাজামশাই অমূল্যজ্যেঠু নন । তারই মতো দেখতে আরেক রাজা । আরে !একে তো সে আগে দেখেছে ! ইনি রাজা মহেন্দ্রলাল খান ।দরবারে বন্দি ওই লোকটি একবার ঘুরে তাকায় তার দিকে । চোখাচোখি হওয়া মাত্র রঙ্গীল তার মুখ ঢেকে নেয় ভয়ে । লোকটার একটা চোখ সাদা । সে হাসতে থাকে । উপরের পাটির একটি দাঁত চকচক করে ওঠে । শিকলে বাঁধা হাতের আঙুলগুলো রঙ্গীলের দিকে তাকিয়ে লোকটা জাদুভঙ্গিমার মতো নাড়াতে থাকে । তারপর রাজদরবার দুলতে শুরু করে । রঙ্গীল দেখল তার নিচের মার্বেলের স্ল্যাবটা সড়ে যাচ্ছে দ্রুত । ধপ করে রঙ্গীল নীচে পড়ে গেল একটা ঘরে । অন্ধকার সোঁদা গন্ধ মাখা ঘর । এটা কি তবে একটা অন্ধকূপ!এখন সে কী করবে?ভাবতে না ভাবতেই ঘরের আরেকপ্রান্ত থেকে ভেসে আসে চেনা গলার আওয়াজ । ‘রঙ্গীল । তুমি এসেছো ? আমি জানতাম তুমি আসবে ।চলো পালাই।’কুঠুরির ঘুলঘুলির আবছায়া আলোয় রঙ্গীল এইবার দেখতে পায় । ঘরের উল্টোকোণায় চন্দন দাঁড়িয়ে হাসছে ।
ধড়মড় করে উঠে রঙ্গীল দেখল সকাল হয়ে গেছে কখন । বাপি মাম বোধহয় ইচ্ছে করেই তাকে ডেকে ঘুম ভাঙায়নি । উঠে মুখ হাত ধুয়ে জলখাবারের ঘরে গিয়ে সে দেখে সেখানে বিভীষণ মণ্ডল বসে । অমূল্যজ্যেঠুর সঙ্গে কোনও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলছিল হয়তো । কিন্তু রঙ্গীল কে আসতে দেখেই বিভীষণের মনোযোগ তার দিকে ঘুরে গেল ।
-কী গোয়েন্দা বাবু ।চেকা মেনা বিনাঃ থুড়ি থুড়ি কেমন আছেন ?
রঙ্গীল চোখ কচলে বলল,”কাকু ।নূরচাচার খুনীকে ধরতে পারলেন ?”
-দু একজন সন্দেহভাজনকে আটক করেছি । চিত্রকর পাড়াতেই থাকে । কিন্তু তোমার জ্যেঠুর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারছি তাদের ছেড়ে দিতে হবে ।
-কেন ?
-তাদের কারো ডানহাতেই ত্রিশূল আঁকা উল্কি নেই ।
-ওওওও
রঙ্গীল গতরাতে দেখা স্বপ্নর কথা কারোকে কিছু বলে না ।তিন্নির পাশে বসে পড়ে ।সুনন্দাদিদি ফুলকো লুচি আর আলুরদম দিয়ে যায় । বিভীষণ মণ্ডল এইবার উঠে পড়ে ।
-অমূল্যবাবু । কোনও কিছু জানতে পারলেই আমাকে জানাবেন । পুলিশ তৈরি আছে । খুনী যদি নাড়াজোল থেকে পালিয়ে গিয়েও থাকে তাকে আমরা ধরবই ।
হঠাৎ রঙ্গীল বলে ওঠে ।
-আমার তা মনে হয় না কাকু । খুনী যেই হোক । সে নাড়াজোলের ভিতরেই আছে ।
-কেন একথা বলছ রঙ্গীলবাবু ?
-কারণ নূরচাচাকে খুন করতে সে এখানে আসেনি । এসেছে গুপ্তধনের সন্ধানে । আর সেই গুপ্তধন এখনও পাওয়া যায়নি ।
-হুম ।বুঝলাম ।
-আর একটা কথা বলি কাকু?
-বলো ।
-রামতনুকাকুকে তোমরা ছেড়ে দাও ।কাকু বোধহয় সত্যিই ওই বিষয়ে কিছু জানত না । চন্দন অনুমান করতে গিয়ে ভুল করে ফেলেছিল ।
-বেশ ।তাই করি তবে । এমনিতেও হানি থুড়ি ওর বিরুদ্ধে আমাদের কোনও এভিডেন্স নেই ।
বিভীষণ জানে দেখতে বা বয়সে ক্ষুদে হলেও রঙ্গীলের মগজের ধার তীক্ষ্ণ । তাই বেশ বড়দের মতোই তার কথা মন দিয়ে শুনে বিভীষণ মণ্ডল দলবলসমেত চলে গেল । সকলেই এইবার রঙ্গীলের দিকে তাকিয়ে রইল । এই অভিযানের অধিনায়ক যেন সেইই ।
-আর একটিবার রাসমঞ্চর দিকে যাব চলো । তারপর বলব ।

অমূল্যজ্যেঠু ছাড়া সকলেই কথামতো তৈয়ার হয়ে খাওয়াদাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়ল রাসমঞ্চর দিকে । জ্যেঠু রাজবাড়ি রয়ে গেল । বলল তার শরীরে ক্লান্তি আছে খুব ।তাই সকলে তাকে জোর করল না আর ।
রাসমঞ্চর তৃতীয় দরজার উপরের সেই ‘শ্যাল্যুম্যু’ নামক যন্ত্রটি মন দিয়ে দেখছিল রঙ্গীল ।গতরাতে শিবমন্দিরের চাতালে খোদাই করা ছবিটি আর এই ছবিটি হুবহু এক । সাতটি ত্রিশূল একইরকম ।আর তফাতে থাকা ত্রিশূলটি সামান্য অন্যরকম ।মাম জিজ্ঞেস করল ।
-কিছু বুঝলি রঙ্গীল ?
-মনে হচ্ছে একটা ক্লু পেয়েছি ।চলো এইবার পরের সূত্র সমাধানে যাই আমরা ।
আবার সকলে মৃত্যুঞ্জয় শিবমন্দিরের দিকে হেঁটে চলল । পরের সূত্রের প্রথম ধাপে রয়েছে পঞ্চমূখী গণেশ ও হনুমান । যেতে যেতে রঙ্গীলের হঠাৎ অনেক পুরনো একটা পৌরাণিক গল্প মনে পড়ে গেল ।
-আচ্ছা বাপি । গণেশের হাতির মাথা খুঁজতে শিবঠাকুর নন্দীভৃঙ্গীকে কোনদিকে পাঠিয়েছিল ?
-যতোদূর মনে পড়ছে উত্তর পশ্চিম কোণে । কেন রে ?
-বাপি । আমার মন বলছে আমাদের শিবমন্দির থেকে ওই কোণা বরাবর হাঁটতে হবে । আচ্ছা সুনন্দাদিদি,ওই দিকে কোনও জলাশয় আছে বলে মনে করতে পারো ?
-আছে তো।রাজবাড়ির দ তো ওইদিকেই।
-রাজবাড়ির দ?
-হ্যাঁ।সে এক গল্প।একবার রথযাত্রার সময় রাজা অযোধ্যারাম খান নগর পরিক্রমায় বের হলেন।ভাগ্যদেবতা বোধহয় এই ধর্মনিষ্ঠ রাজাটির উপর চিররুষ্ট ছিলেন।রথ পথ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ বিগ্রহ সমেত ওই জলাশয়তে পড়ে গেল।অতো বড় আর ভারি রথ।রথ আর উদ্ধার করাই গেল না।তখন রাজা ঘোষণা করলেন,ওই জলাশয়ে আর কেউ স্নান করতে পারবে না।
-তাহলে চলো আমাদের সেই রাজবাড়ির দ’এর কাছে নিয়ে।
-কিন্তু সে বেশ খানিকটা পথ।হাঁটতে হবে কিন্তু।

তিন্নিসহ সকলেই এই প্রস্তাবে রাজি।হাঁটতে কারোই আপত্তি নেই।মেঠোপথ পেরিয়ে জঙ্গলাকীর্ণ একটি জলাশয়ের সামনে পৌছোল ওরা।রঙ্গীল সুনন্দাদিদিকে জিজ্ঞেস করল,”দিদি।শিবমন্দির থেকে এই জলাশয়ের দূরত্ব কতো?”
-দুশো তিনশো হাত তো হবেই।
-তাহলে পঞ্চমুখী বানর বা গণেশ কেন ?
বাপি বলে,”মিলে যাচ্ছে।পাঁচ আর পাঁচের যোগফল দশ।তিনশো হাত আনুমানিক দশ ছটাকের সমান।সেই সময় স্বল্প দূরত্ব মাপতে ‘ছটাক’ ব্যবহার করতেন গণিতজ্ঞরা।
রঙ্গীলের মনে হল ঠিক যেন অঙ্কবইয়ে জটিল একটা অঙ্ক সমাধান করে ফেলল সে।হঠাৎ জলাশয়ের দিকে তাকিয়ে তিন্নি বলল,”দা ভাই দেখ।উইকেট!”
সত্যিই সকলে অবাক হয়ে দেখল রাজবাড়ির দ তে লঙ্কাগড়ের জলহরির প্রতিফলন ঠিক ছবিতে দেখা ওই ক্রিকেটের উইকেটগুলোর মতোই লাগছে।সুনন্দাদিদি বলল।
-গ্রিসের অ্যাপোলো দেবের মন্দিরের ধাঁচে আমার পূর্বপুরুষরা এই জলহরি বানায়।এই স্থাপত্য তারই উদাহরণ।
-এর অর্থ এটাই দাঁড়াচ্ছে যে নাড়াজোলের গুপ্তধন লোকানো আছে লঙ্কাগড়ের জলহরিতে।
কথোপকথনের ভিতরেই হঠাৎ সকলে লক্ষ করে তাদের চারপাশের ঝোপগুলো কেমন নড়ে উঠছে।কোনও সাপখোপ নয়তো ! ভাবতে না ভাবতেই জনা দশেক ষণ্ডামার্কা লোক ঘিরে ধরল তাদের।তাদের প্রত্যেকের হাতে বন্দুক।মধ্যিখানের নেতা গোছের লোকটি হাতজোড় করে বলে উঠল,”নমস্তে নমস্তে রঙ্গীলবাবু।এইবার সকলকে বলুন চুপচাপ ওই ঝোলার ভিতর সকলের মোবাইল রেখে দিতে।”
ওই ভীড়ের ভিতরেই একটি লোক ঝোলা নিয়ে এগিয়ে আসে।সুনন্দাদিদি হঠাৎ বলে ওঠে।
-আরে ! আপনি প্রিয়তোষবাবু না।দেড় বছর আগে আমাদের বাড়ি এসেছিলেন গবেষণার নাম করে ! এইসব কী হচ্ছে?
উত্তরে লোকটি হেসে উঠল।রঙ্গীল দেখল তার স্বপ্নে দেখা লোকটির মতোই এই লোকটির উপরের পাটির দাঁত সোনালী।
-কী করব ম্যাডাম।কিষণ ভগবানের মতোই নানান নাম লিতে হয় হামাকে।কখনো প্রিয়তোষ।কখনও জয়রাম।

অনেক রাত অবধি ঘুম এলো না রঙ্গীলের ।সে ভাবছিল ।এই লঙ্কাগড়ের রহস্যভেদ আর কোন কোন ভয়ানক ঘটনা ঘটাবে কে জানে?এইবার এই অভিযানের ইতি হলেই ভালো ।স্কুল খুলবে কবে কী জানে ।কতোদিন স্কুলে ভন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়না তার ।চন্দনের জন্যও মন কেমন করতে থাকে তার ।স্কুলে তার বন্ধুরা বলাবলি করত,গ্রামের স্কুলে সব দারুণ দারুণ ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা করে ।বোর্ড পরীক্ষায় তো তারাই প্রথম দিকে রাঙ্ক করে ।এই অতিমারীর পর কী তবে চন্দনের মতো বুদ্ধিমান ভালো ভালো ছেলেমেয়েরা পাকাপাকিভাবে পড়াশোনাই ছেড়ে দেবে?ভাবতে ভাবতে চোখ লেগে আসে তার ।তারপর রঙ্গীল দেখে সে পৌছে গেছে এক রাজদরবারে । সেখানে সাদা রঙের সিংহাসনের উপর বসে আছেন এক রাজা । এই রাজামশাই অমূল্যনারায়ণই তো বটে । দরবারে বিচার চলছে । যার বিচার চলছে তার ডানহাতে একটা ত্রিশূল আঁকা উল্কি । লোকটার মুখটা হুডওলা জ্যাকেটে ঢাকা । হঠাৎ রঙ্গীল দেখতে পায় রাজসিংহাসনে বসে থাকা রাজামশাই অমূল্যজ্যেঠু নন । তারই মতো দেখতে আরেক রাজা । আরে !একে তো সে আগে দেখেছে ! ইনি রাজা মহেন্দ্রলাল খান । দরবারে বন্দি ওই লোকটি একবার ঘুরে তাকায় তার দিকে । চোখাচোখি হওয়া মাত্র রঙ্গীল তার মুখ ঢেকে নেয় ভয়ে । লোকটার একটা চোখ সাদা । সে হাসতে থাকে । উপরের পাটির একটি দাঁত চকচক করে ওঠে । শিকলে বাঁধা হাতের আঙুলগুলো রঙ্গীলের দিকে তাকিয়ে লোকটা জাদুভঙ্গিমার মতো নাড়াতে থাকে । তারপর রাজদরবার দুলতে শুরু করে । রঙ্গীল দেখল তার নিচের মার্বেলের স্ল্যাবটা সড়ে যাচ্ছে দ্রুত । ধপ করে রঙ্গীল নীচে পড়ে গেল একটা ঘরে । অন্ধকার সোঁদা গন্ধ মাখা ঘর । এটা কি তবে একটা অন্ধকূপ!এখন সে কী করবে?ভাবতে না ভাবতেই ঘরের আরেকপ্রান্ত থেকে ভেসে আসে চেনা গলার আওয়াজ । ‘রঙ্গীল । তুমি এসেছো ? আমি জানতাম তুমি আসবে ।চলো পালাই ।’কুঠুরির ঘুলঘুলির আবছায়া আলোয় রঙ্গীল এইবার দেখতে পায় । ঘরের উল্টোকোণায় চন্দন দাঁড়িয়ে হাসছে ।
ধড়মড় করে উঠে রঙ্গীল দেখল সকাল হয়ে গেছে কখন । বাপি মাম বোধহয় ইচ্ছে করেই তাকে ডেকে ঘুম ভাঙায়নি । উঠে মুখ হাত ধুয়ে জলখাবারের ঘরে গিয়ে সে দেখে সেখানে বিভীষণ মণ্ডল বসে । অমূল্যজ্যেঠুর সঙ্গে কোনও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলছিল হয়তো । কিন্তু রঙ্গীল কে আসতে দেখেই বিভীষণের মনোযোগ তার দিকে ঘুরে গেল ।
-কী গোয়েন্দা বাবু ।চেকা মেনা বিনাঃ থুড়ি থুড়ি কেমন আছেন ?
রঙ্গীল চোখ কচলে বলল,”কাকু ।নূরচাচার খুনীকে ধরতে পারলেন ?”
-দু একজন সন্দেহভাজনকে আটক করেছি । চিত্রকর পাড়াতেই থাকে । কিন্তু তোমার জ্যেঠুর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারছি তাদের ছেড়ে দিতে হবে ।
-কেন ?
-তাদের কারো ডানহাতেই ত্রিশূল আঁকা উল্কি নেই ।
-ওওওও
রঙ্গীল গতরাতে দেখা স্বপ্নর কথা কারোকে কিছু বলে না ।তিন্নির পাশে বসে পড়ে ।সুনন্দাদিদি ফুলকো লুচি আর আলুরদম দিয়ে যায় । বিভীষণ মণ্ডল এইবার উঠে পড়ে ।
-অমূল্যবাবু । কোনও কিছু জানতে পারলেই আমাকে জানাবেন । পুলিশ তৈরি আছে । খুনী যদি নাড়াজোল থেকে পালিয়ে গিয়েও থাকে তাকে আমরা ধরবই ।
হঠাৎ রঙ্গীল বলে ওঠে ।
-আমার তা মনে হয় না কাকু । খুনী যেই হোক । সে নাড়াজোলের ভিতরেই আছে ।
-কেন একথা বলছ রঙ্গীলবাবু ?
-কারণ নূরচাচাকে খুন করতে সে এখানে আসেনি । এসেছে গুপ্তধনের সন্ধানে । আর সেই গুপ্তধন এখনও পাওয়া যায়নি ।
-হুম ।বুঝলাম ।
-আর একটা কথা বলি কাকু?
-বলো ।
-রামতনুকাকুকে তোমরা ছেড়ে দাও ।কাকু বোধহয় সত্যিই ওই বিষয়ে কিছু জানত না । চন্দন অনুমান করতে গিয়ে ভুল করে ফেলেছিল ।
-বেশ ।তাই করি তবে । এমনিতেও হানি থুড়ি ওর বিরুদ্ধে আমাদের কোনও এভিডেন্স নেই ।
বিভীষণ জানে দেখতে বা বয়সে ক্ষুদে হলেও রঙ্গীলের মগজের ধার তীক্ষ্ণ । তাই বেশ বড়দের মতোই তার কথা মন দিয়ে শুনে বিভীষণ মণ্ডল দলবলসমেত চলে গেল । সকলেই এইবার রঙ্গীলের দিকে তাকিয়ে রইল । এই অভিযানের অধিনায়ক যেন সেইই ।
-আর একটিবার রাসমঞ্চর দিকে যাব চলো । তারপর বলব ।

অমূল্যজ্যেঠু ছাড়া সকলেই কথামতো তৈয়ার হয়ে খাওয়াদাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়ল রাসমঞ্চর দিকে । জ্যেঠু রাজবাড়ি রয়ে গেল । বলল তার শরীরে ক্লান্তি আছে খুব ।তাই সকলে তাকে জোর করল না আর ।
রাসমঞ্চর তৃতীয় দরজার উপরের সেই ‘শ্যাল্যুম্যু’ নামক যন্ত্রটি মন দিয়ে দেখছিল রঙ্গীল ।গতরাতে শিবমন্দিরের চাতালে খোদাই করা ছবিটি আর এই ছবিটি হুবহু এক । সাতটি ত্রিশূল একইরকম ।আর তফাতে থাকা ত্রিশূলটি সামান্য অন্যরকম ।মাম জিজ্ঞেস করল ।
-কিছু বুঝলি রঙ্গীল ?
-মনে হচ্ছে একটা ক্লু পেয়েছি ।চলো এইবার পরের সূত্র সমাধানে যাই আমরা ।
আবার সকলে মৃত্যুঞ্জয় শিবমন্দিরের দিকে হেঁটে চলল । পরের সূত্রের প্রথম ধাপে রয়েছে পঞ্চমূখী গণেশ ও হনুমান । যেতে যেতে রঙ্গীলের হঠাৎ অনেক পুরনো একটা পৌরাণিক গল্প মনে পড়ে গেল ।
-আচ্ছা বাপি । গণেশের হাতির মাথা খুঁজতে শিবঠাকুর নন্দীভৃঙ্গীকে কোনদিকে পাঠিয়েছিল ?
-যতোদূর মনে পড়ছে উত্তর পশ্চিম কোণে । কেন রে ?
-বাপি । আমার মন বলছে আমাদের শিবমন্দির থেকে ওই কোণা বরাবর হাঁটতে হবে । আচ্ছা সুনন্দাদিদি,ওই দিকে কোনও জলাশয় আছে বলে মনে করতে পারো ?
-আছে তো।রাজবাড়ির দ তো ওইদিকেই।
-রাজবাড়ির দ?
-হ্যাঁ।সে এক গল্প।একবার রথযাত্রার সময় রাজা অযোধ্যারাম খান নগর পরিক্রমায় বের হলেন।ভাগ্যদেবতা বোধহয় এই ধর্মনিষ্ঠ রাজাটির উপর চিররুষ্ট ছিলেন।রথ পথ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ বিগ্রহ সমেত ওই জলাশয়তে পড়ে গেল।অতো বড় আর ভারি রথ।রথ আর উদ্ধার করাই গেল না।তখন রাজা ঘোষণা করলেন,ওই জলাশয়ে আর কেউ স্নান করতে পারবে না।
-তাহলে চলো আমাদের সেই রাজবাড়ির দ’এর কাছে নিয়ে।
-কিন্তু সে বেশ খানিকটা পথ।হাঁটতে হবে কিন্তু।

তিন্নিসহ সকলেই এই প্রস্তাবে রাজি।হাঁটতে কারোই আপত্তি নেই।মেঠোপথ পেরিয়ে জঙ্গলাকীর্ণ একটি জলাশয়ের সামনে পৌছোল ওরা।রঙ্গীল সুনন্দাদিদিকে জিজ্ঞেস করল,”দিদি।শিবমন্দির থেকে এই জলাশয়ের দূরত্ব কতো?”
-দুশো তিনশো হাত তো হবেই।
-তাহলে পঞ্চমুখী বানর বা গণেশ কেন?
বাপি বলে,”মিলে যাচ্ছে।পাঁচ আর পাঁচের যোগফল দশ।তিনশো হাত আনুমানিক দশ ছটাকের সমান।সেই সময় স্বল্প দূরত্ব মাপতে ‘ছটাক’ ব্যবহার করতেন গণিতজ্ঞরা।
রঙ্গীলের মনে হল ঠিক যেন অঙ্কবইয়ে জটিল একটা অঙ্ক সমাধান করে ফেলল সে।হঠাৎ জলাশয়ের দিকে তাকিয়ে তিন্নি বলল,”দা ভাই দেখ।উইকেট!”
সত্যিই সকলে অবাক হয়ে দেখল রাজবাড়ির দ তে লঙ্কাগড়ের জলহরির প্রতিফলন ঠিক ছবিতে দেখা ওই ক্রিকেটের উইকেটগুলোর মতোই লাগছে।সুনন্দাদিদি বলল।
-গ্রিসের অ্যাপোলো দেবের মন্দিরের ধাঁচে আমার পূর্বপুরুষরা এই জলহরি বানায়।এই স্থাপত্য তারই উদাহরণ।
-এর অর্থ এটাই দাঁড়াচ্ছে যে নাড়াজোলের গুপ্তধন লোকানো আছে লঙ্কাগড়ের জলহরিতে।
কথোপকথনের ভিতরেই হঠাৎ সকলে লক্ষ করে তাদের চারপাশের ঝোপগুলো কেমন নড়ে উঠছে।কোনও সাপখোপ নয়তো ! ভাবতে না ভাবতেই জনা দশেক ষণ্ডামার্কা লোক ঘিরে ধরল তাদের।তাদের প্রত্যেকের হাতে বন্দুক।মধ্যিখানের নেতা গোছের লোকটি হাতজোড় করে বলে উঠল,”নমস্তে নমস্তে রঙ্গীলবাবু।এইবার সকলকে বলুন চুপচাপ ওই ঝোলার ভিতর সকলের মোবাইল রেখে দিতে।”
ওই ভীড়ের ভিতরেই একটি লোক ঝোলা নিয়ে এগিয়ে আসে।সুনন্দাদিদি হঠাৎ বলে ওঠে।
– আরে ! আপনি প্রিয়তোষবাবু না।দেড় বছর আগে আমাদের বাড়ি এসেছিলেন গবেষণার নাম করে ! এইসব কী হচ্ছে?
উত্তরে লোকটি হেসে উঠল।রঙ্গীল দেখল তার স্বপ্নে দেখা লোকটির মতোই এই লোকটির উপরের পাটির দাঁত সোনালী।
-কী করব ম্যাডাম।কিষণ ভগবানের মতোই নানান নাম লিতে হয় হামাকে।কখনো প্রিয়তোষ।কখনও জয়রাম।
-আপনারা কী আমাদের বন্দি করে নিয়ে যাচ্ছেন?
-আরে।বন্দি কেন বলছেন?আপনি প্রিন্সেস।আপনারা আমার মেহমান।আর এই ছোট্ট জাসুস বাবুটি আমার স্পেশাল গেস্ট।কী রঙ্গীলবাবু?
রঙ্গীল দেখল লোকটার ডানহাতে হাতকাটা চামড়ার জ্যাকেটের আড়ালে একটা উল্কি দেখা যাচ্ছে।একটা লাল আর কালো রঙ দিয়ে নকশা করা ত্রিশূল!

আপনারা কী আমাদের বন্দি করে নিয়ে যাচ্ছেন?
– আরে।বন্দি কেন বলছেন ?আপনি প্রিন্সেস।আপনারা আমার মেহমান।আর এই ছোট্ট জাসুস বাবুটি আমার স্পেশাল গেস্ট।কী রঙ্গীলবাবু?
রঙ্গীল দেখল লোকটার ডানহাতে হাতকাটা চামড়ার জ্যাকেটের আড়ালে একটা উল্কি দেখা যাচ্ছে।একটা লাল আর কালো রঙ দিয়ে নকশা করা ত্রিশূল!

ক্রমশ…


❤ Support Us
error: Content is protected !!