Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক
  • ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২২

লঙ্কাগড়ের লঙ্কাকাণ্ড 

পর্ব- ১৮

শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী
লঙ্কাগড়ের লঙ্কাকাণ্ড 

চিত্র: দেব সরকার ।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল বাংলার নাড়াজোল রাজবংশ । সেই রাজবাড়ির পরিখায় তরবারি হাতে পাহাড়া দিতেন স্বয়ং দেবী জয়দুর্গা । জনশ্রুতি তাঁর অসির জ্যোতিতে অত্যাচারি ইংরেজরা চোখ ঢাকত। বর্গীরাও এই জনপদের ধারেকাছে ঘেঁষতে পারতো না। সেই দেবী জয়দুর্গার অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে এই ধারাবাহিক…
বিকেল হব হব সময় সুনন্দাদিদিকে নিয়ে রঙ্গীলরা বেরিয়ে পড়ল।’রঙ্গীলরা’ বলতে সকলেই।চন্দন ছাড়া।চন্দন এলো না।অবশ্য সে তো বলেছে ঠিক চলে আসবে।তবু কোনও অজানা কারণে তার জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছিল রঙ্গীলের। কেন কে জানে?এই কম্পাঙ্ক মিলে যাবার কথাই হয়তো বাপি বলছিল দুপুরে।রঙ্গীল আরেকটু অপেক্ষা করতে চাইছিল।তখন সুনন্দাদিদি তাকে বোঝালো।সীতারাম জিউ মন্দির থেকে ওই আমবাগান বেশ খানিকটা দূরে।একবার অন্ধকার নেমে গেলে জায়গাটা নিরাপদ নয়।তার উপর দাসপূর থানার ওসি বিভীষণ মণ্ডল পইপই করে ওদের সাবধানে থাকতে বলে গেছে সেদিন।
-তাহলে চন্দন এসে যদি আমাদের খুঁজে না পায়?
-চিন্তা করো না রঙ্গীল।মনে রেখো আমরা চন্দনকে খুঁজিনি।চন্দনই আমাদের খুঁজে নিয়েছে।ও ঠিক আমাদের খুঁজে নেবে।
         রাজবাড়ির যেখানে রথ দাঁড়িয়ে ছিল,তার সামনে ঘোড়ামূর্তির পূর্বদিক বরাবর হাঁটতে থাকল ওরা।পথে যেতে যেতে সুনন্দাদিদি তার ছোটবেলাকার গল্প বলল।
-মা বলত ওই আমবনের ভিতরেই নাকি লক্ষ্মীহাতি শিকল দিয়ে বাঁধা থাকত।
একথা শুনতেই রঙ্গীলের আবার মাথার ভিতর বিদ্যুৎ খেলে গেল।দ্বিতীয় ছবিতে হাতির পাশেই তো একটি দুটি জলভর্তি কলসির ছবি ছিল ! তবে কি সেখানেই গুপ্তধন ! সুনন্দাদিদি বলে চলে।
-মা আমাদের পূর্বপুরুষের এক ধর্মনিষ্ঠ অথচ দুঃখি রাজার কথা খুব বলতেন ছোটবেলায়।সে রাজার নাম অযোধ্যারাম খান।রাজা খুব সত্যনিষ্ঠ ও প্রজাবৎসল হলেও তার সমস্ত জীবন কেটে গিয়েছিল শরিকি মামলা মকদ্দমা নিষ্পত্তি করতে করতে।এদিকে নাড়াজোল রাজপরিবার তখন অর্থাভাবে জেরবার।তেমনই একটি মামলায় হাজিরা দিতে ডেকে পাঠাল মেদিনীপুরের আদালত।
-মেদিনীপুর কেন?
-কারণ অযোধ্যারামের অগ্রজ মোহনলাল খান ছিলেন অখণ্ড নাড়াজোল আর মেদিনীপুরের অধীশ্বর।পরবর্তীতে সেই মেদিনীপুরের জমিদারি নিয়েই রাণী শিরোমণির এক দূর সম্পর্কের বংশধর রাজা অযোধ্যারাম খানের বিরুদ্ধে মামলা করে বসলেন।
-তারপর?
-আদালতে সে এক মহাবিপত্তি।রাজার পক্ষে সাক্ষী দেবার কেউ নেই।শেষমেশ রাজা বললেন তাঁর হয়ে সাক্ষী দেবে ওই লক্ষ্মীহাতি।

কোথায় গেল চন্দন।রঙ্গীল ভাবতে থাকে।বড় অভিমানী ছেলেটা।


রথ চলে যাবার পর জায়গাটায় লোকসমাগম কমে এসেছে অনেক।সুনন্দাদিদির গল্প শুনতে শুনতে রঙ্গীল যেন সেই মামলাকবলিত অসহায় রাজাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল।তিন্নিও খুব মজা পেল হাতির সাক্ষী দেবার গল্প শুনে।
-হাতি সাক্ষী দেবে কীকরে?সে যে কথাই বলতে পারবে না।
-ঠিক বলেছ তিন্নি।সেই কারণেই জজসাহেব নির্দেশ করলেন।একটি বিশেষ উপায়ে লক্ষ্মীহাতির সাক্ষ্য নেওয়া হবে।আসলে লক্ষ্মীহাতি যে সাধারণ হাতি নয়,একথা ততোদিনে সকলেই জেনে গেছে।
-তারপর?
-তারপর লক্ষ্মীকে নাড়াজোল থেকে নিয়ে যাওয়া হলো মেদিনীপুর।সেদিন আদালত বসল সামনের খোলা মাঠে।জজসাহেব দুটি কলসি রাখলেন সেই হাতির সামনে।দুটি কলসিতেই জল ভর্তি।কিন্তু একটিতে গঙ্গাজল।অন্যটিতে সাধারণ নদীর জল।কোন কলসে কোন জল সেকথা জানেন একমাত্র জজসাহেব।
-বাপরে।তারপর?
-ঠিক হলো।লক্ষ্মীহাতি যদি সঠিক কলস চিনতে পারে যেটিতে গঙ্গাজল আছে,তাহলে রাজামশাইয়ের বয়ান সত্য ধরে নেওয়া হবে।অন্যথায় মিথ্যা।
-তারপর কী হলো?
-তারপর আর কি।লক্ষ্মীহাতি সবাইকে চমকে দিয়ে গঙ্গাজল ভর্তি কলসিটি চিনে ফেলল।আর রাজামশাই মামলা থেকে রেহাই পেলেন।
কথা বলতে বলতেই তারা সকলে খান পনেরো ঘন আমগাছের ভিতর দাঁড়ালো।এই তবে একসময়ের সেই বিশাল আমবাগান।এখন তার চারদিক থেকে জনবসতি যেন শ্বাসরোধ করবার মতোই আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে।মাঝের এই কয়েকটি গাছ এলাকার শেষ সবুজসারথির মতো জেগে রয়েছে।রঙ্গীল বলল।
-বুঝলাম।মন্দিরের তথ্য অনুযায়ী আমাদের এই আমবাগানে লক্ষ্মী হাতি ঠিক যেইখানে বাঁধা থাকত সেইখানটি খুঁজে বের করতে হবে।
বাপি বলল,”ঠিক।ছবিতে হাতির পাশে দুটি জলভর্তি কলস তাহলে রাজা অযোধ্যারাম খানের সেই অলৌকিক মামলার ঘটনার কথা বলছিল।কিন্তু এই আমবাগান তো সুবিস্তৃত ছিল একসময়।সেখানে আমরা লক্ষ্মীর হাতির পায়ের নিশান কীভাবে পাব কে জানে!”
সকলেই হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে।হাতিকে ধরে রাখতে শক্ত খিলানের প্রয়োজন।কালের নিয়মে সে খিলান ভেঙে গেলেও তার ভিতস্তম্ভটি অটুট থাকবার সম্ভাবনা কিছু হলেও আছে।খুঁজতে খুঁজতে মাম বলে উঠল হঠাৎ।
-একটা কথা বলো দেখি তোমরা।চারপাশে গাছ কেটে ঘর উঠে গেল।শুধু এখানেই ঘর উঠল না কেন?এর কি কোনও কারণ নেই?নিশ্চয়ই আছে।
সকলেই গাছগুলির ধার বেয়ে খুঁজতে থাকে খিলানের ভগ্নাবশেষ।এমন সময় হঠাৎ তিন্নি বলে ওঠে,”মাসি।দেখ।দুগ্গা।”
সকলে সত্যিই দেখে রাজবাড়িতে খেলে বেড়ানো ছোট্ট মেয়েটিও যেন কোথা থেকে হাজির হয়েছে।সেও দৌড়ে দৌড়ে খেলে বেড়াতে বেড়াতে গাছগুলির মাঝখানে থাকা একটি ভাঙা গাছের গুড়িতে গিয়ে বসল।তিন্নি আবার বলে ওঠে,”এই দাভাই।এদিকে দেখ।সিঁড়ি!”
সকলে তিন্নির কাছে দৌড়ে গিয়ে সত্যিই দেখে ঠিক যেখানে গাছগুলি শেষ হয়েছে,তার চারপাশ দিয়ে বাউণ্ডারির মতো ঘিরে আছে দুই ধাপ সিঁড়ি।সুনন্দাদিদি বলে।
-এবার বুঝেছি।এটা একটা অক্টাগন।আটটি কোণ বিশিষ্ট বহুভূজের একটি চিতাল।তার ভিতরে এই গাছগুলি।
-তবে কি এখানে আগে কোনও মহল ছিল?মাম জিজ্ঞেস করে।সুনন্দাদিদি ঘাড় নাড়ে।
-আমার তা মনে হয় না।কারণ এতো বড় দেউল এখানে থাকলে মা আমাকে সেকথা বলত।এটাই হয়তো সেই চাতাল যেখানে লক্ষ্মীহাতিকে বেঁধে রাখা হতো।
কিন্তু তারপর?দিনের আলো নিভে আসছে।এখনও চন্দনের কোনও আসবার চিহ্ন নেই।আর ওই ছোট্ট দুগ্গা মেয়েটাই বা গেল কোথায়?ভাবতে ভাবতেই রঙ্গীলের হাতে লাগল সেই ভাঙা গুড়িটি যার ওপর দুগ্গা বসেছিল।যাকে এতক্ষণ তারা গাছের গুড়ি ভাবছিল,সেটি কোনও গুড়ি নয়।শ্বেত পাথরের একটি ভেঙে যাওয়া স্তম্ভ।তার ওপর গুল্মলতা উঠে  যেন একটা গাছের কাণ্ড তৈরি হয়েছে।সকলেই সেখানে এসে ভিড় করতে সুনন্দাদিদি বলল,”এই তবে লক্ষ্মী হাতিকে ধরে রাখার সেই খিলান।”বাপি এর মধ্যে সেই ভগ্নখিলানের পাশে মাটি সরিয়ে একটা প্রাচীন শ্বেত ফলক আবিষ্কার করল।সকলেই সেই ফলকে খোদাই করা লিপি পড়বার চেষ্টা করল।আশ্চর্যের।এতো বছর পরেও ধুলো সরিয়ে দিতে লেখাগুলি আশ্চর্য স্পষ্টতায় ধরা দিল তাদের সামনে।ফলকটিতে লেখা আছে,”প্রত্যয়ঃ ক্ষুদি অংশে শকাব্দের লক্ষ্মী লগ্নে/মৃত্যুঞ্জয় শিবং নিস্তারিনী ভূপ নরেন্দ্রমঃ।।”ফলকটি দেখেই সুনন্দাদিদি চমকে উঠল।
-আরে।এই ফলক তো আমাদের ঠাকুরবাড়ির মৃত্যুঞ্জয় শিবমন্দিরের দেয়ালে লেখা আছে!”
রঙ্গীল বলল।”বুঝেছি।লক্ষ্মীহাতির ছবির পর ছিল একটি ত্রিশূল আর আটটি ফুলের ছবি।অর্থাৎ ত্রিশূল হলেন মৃত্যুঞ্জয় শিব।আর আটটা ফুলের অর্থ আটচালা মন্দির।মৃত্যুঞ্জয় শিবমন্দির যে আটচালারীতির,একথা বাপি আমাকে আগেই বলেছে।”
-সাবাশ রঙ্গীল।আমাদের পরবর্তী গন্তব্য তবে ঠাকুরবাড়ির আটচালা মন্দির।কিন্তু আজ কি আর হবে?অন্ধকার হয়ে আসছে।
ঝোপের ভিতর একটা সড়সড় আওয়াজ শুনতে পেল সকলেই।তবে কি চন্দন? কিন্তু তার তো লুকিয়ে থাকবার কারণ নেই আর! কোথায় গেল চন্দন।রঙ্গীল ভাবতে থাকে।বড় অভিমানী ছেলেটা।ইবার কি রাগ করল তাদের ওপর? কে জানে?বাপি বলল।
-সাপখোপও হতে পারে।চল।আজকের মতো আমরা ফিরে যাই।
সকলেই লক্ষ্মীদালানের সেই আমবন ছেড়ে রাজবাড়ির দিকে ফিরে আসছিল।হঠাৎ সুনন্দাদিদির মোবাইলটা বেজে উঠল।অমূল্যজ্যেঠুর ফোন।ফোনের ভিতরেও রঙ্গীলরা বুঝতে পারছিল জ্যেঠুর গলায় সাঙ্ঘাতিক উৎকন্ঠা।থমথমে মুখ করে সুনন্দাদিদি ফোনটা কেটে দিয়েই বলল,”সকলে দ্রুত চলো।আমাদের এখনই রাজবাড়ি ফিরতে হবে।”রঙ্গীল  কোনও কিছু আশঙ্কা করেই যেন বলল,”কী হয়েছে দিদি?আবার কোনও বিপদ?”
উত্তরে সকলের হাড় হিম করে সুনন্দাদিদি বলল।
-হ্যাঁ।নাড়াজোলের আজ খুব বিপদ।এক্ষুণি খবর মিলেছে।নূরচাচা খুন হয়ে গেছেন।চলো সবাই।

  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!