শিবভোলার দেশ শিবখোলা
শিবখোলা পৌঁছলে শিলিগুড়ির অত কাছের কোন জায়গা বলে মনে হয় না।যেন অন্তবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে একান্ত রেহাই পাবার পরিসর মিলে গেছে।
স্মৃতিকথা পর্ব-২০
চিত্র: সাদেক আহমেদ ।
ভাওয়ালের শাল-গজারির গড়ের ভিতর দিয়ে, চলন্ত ট্রেন থেকে জয়দেব পুরের সেই ঐতিহাসিক রাজবাড়ীটিকে এক ঝলক দেখে, বিশ্ব-বিখ্যাত টঙ্গী-জংশনএবং তেজগাঁ-র শিল্পাঞ্চল পেছনে ফেলে আমরা যখন ঢাকা শহরের ভিতরে প্রবেশ করলাম, তখন নগরীর বিভিন্ন মসজিদ থেকে মাগরিবের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছিল।
কাওরানবাজার, হাতির পুল, বাবুপুরা, নীলক্ষেত, পলাশী এবং বকশীবাজারের ভিতর দিয়ে তখন রেলপথ ছিল। ঢাকার রেলস্টেশনটি ছিল ফুলবাড়ীয়ায়। আমাদের স্বপ্নের নগরীকে দ্বিখন্ডিত করে স্লথগতিতে ছুটে-চলা ট্রেনের কামরা থেকে দু’চোখের সমস্ত সাধ্য দিয়ে পথের দু’পাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে চলেছি। একটু পরপরই লেভেল ক্রসিং পড়ছে—লেভেল ক্রসিংয়ের দু’পাশে লাইন দিয়ে ট্রাক-ট্যাক্সি-রিক্সা দাঁড়িয়ে রয়েছে। লেভেল ক্রসিং-এ আটকা পড়া পথচারীদের চোখে ঐদিনের ঐ বিশেষ ট্রেনযাত্রীদের কেমন লেগেছিল জানি না, কিন্তু চলন্ত ট্রেন থেকে আমি তাদের সবাইকে খুব ভালবেসে ফেলেছিলাম। মনে হচ্ছিল আমাদের নগরে বরণ করে নেয়ার জন্যই নগরবাসীরা যেন লেভেল ক্রসিং গুলোতে অপেক্ষা করছিল। চোখে পড়ার মতো গগনচুম্বী উঁচু ভবন বা অট্টালিকার সারি তখন একেবারেই ছিল না। লেভেল ক্রসিং গুলোতেও মোটরয়ানের চাইতে হতশ্রী রিক্সারই ছিল আধিক্য— পথগুলোও ছিল অপ্রশস্ত। আধুনিক নগরজীবনের প্রাচুর্য এবং স্বচ্ছলতাকে প্রকাশ করে, এমন দৃশ্যই আমি খুজছিলাম— কিন্তু আমার চোখে পড়ছিল শুধুই এই নগরীর দৈন্যদশার ছবি। রেললাইনের দু’পাশের বস্তিগুলোর দিকে তাকিয়ে আমার খুব খারাপ লাগলো। মানুষ এতো কষ্ট করেও থাকতে পারে আমি জানতাম না। আমার ধারণা ছিল রাজধানী ঢাকার মানুষজন সুখী, স্বাস্থ্যবান এবং হাসিখুশি হবে— কিন্তু তেজগাঁও থেকে ফুলবাড়িয়া পর্যন্ত প্রসারিত দীর্ঘ পথের দু’পাশে বসবাসকারী নাগরিকদের অবস্থা দেখে আমার ধারণাটা সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। স্টেশনে কুলির হাঁকাহাঁকি, যাত্রীদের মোট নিয়ে কাড়াকাড়ি, প্লাটফর্মে খোঁড়াখঞ্জ ভিখিরির ভিড়, স্টেশনের বাইরে অপেক্ষমাণ টমটম গাড়ির গাড়োয়ান এবং রিকশাওয়ালাদের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম— ঢাকা মূলত গরিবদের শহর। নীলক্ষেত-নিউমার্কেট লেভেলক্রসিং এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের নির্মাণসম্পন্নপ্রায় আধুনিক স্থাপত্যের ছাত্রাবাসগুলোই শুধু আমার ভালো লেগেছিল। নিউমার্কেট তখন ঢাকার একমাত্র আধুনিক সরকারী বিপণীকেন্দ্র— নগরীর বিভিন্ন এলাকার বিত্তশালীরা তাদের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা এবং চিত্তবিনোদনের জন্য তখন ছুটে আসত নিউমার্কেটে; ফলে এই এলাকাটায় একটু স্বচ্ছলতার ছাপ ফুটে উঠেছিল। তাছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন কলেজ, হোম ইকনমিক্স কলেজ এবং আজিমপুর কলোনী এলাকার গুরুত্বটাকে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল।
আধুনিক নগরজীবনের প্রাচুর্য এবং স্বচ্ছলতাকে প্রকাশ করে, এমন দৃশ্যই আমি খুজছিলাম— কিন্তু আমার চোখে পড়ছিল শুধুই এই নগরীর দৈন্যদশার ছবি। রেললাইনের দু’পাশের বস্তিগুলোর দিকে তাকিয়ে আমার খুব খারাপ লাগলো।
আমার চোখ জুড়ালো ফুলবাড়িয়া ছেড়ে ট্রেনটি যখন নবাবপুর-গুলিস্তানের রেলক্রসিংটি অতিক্রম করলো তখন। নয়া মিঞার নির্দেশে আমরা গুলিস্তানের দিকে মুখ করে দরোজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বাঁ দিকে জিন্নাহ এভিনিউ বা গুলিস্তান, ডান দিকে নবাবপুর। জিন্নাহ এভিনিউর প্রশস্ত সড়কে লাইন দিয়ে দাঁড়ানো তকতকে ঝকঝকে অনেকগুলো মটরগাড়ি এবং পথের একপাশে সারিবদ্ধ উঁচু-উঁচু অট্টালিকা। বিভিন্ন অট্টালিকার গায়ে বা ভবনশীর্ষে নানারকমের নিয়নবাতির জ্বলা-নেভা। এতক্ষণে মনে হলো আমরা অবশেষে একটা বড় নগরীতে এসে প্রবেশ করেছি। আমার মনের মধ্যে তখন যে প্রশ্নটা মাথা কুটছিল তা হলো, এতো কারেন্ট আসে কোথা থেকে? ঢাকা তে তখন সাত আট তলার উঁচু কোনো ভবন ছিল না বলেই মনে পড়ে—তবে গ্রামের মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য ঐ উঁচ্চতাই যথেষ্ট। আমাদের গ্রামের হরিকাকা একবার ঢাকায় এসেছিলেন, ফিরে গিয়ে ঢাকা সম্পর্কে গল্প বলতেন—একটা ব্যাপার তার কাছে কিছুতেই বোধগম্য হতো না, বাবাকে প্রায়ই বলতেন: ‘তুমিতো কলিকাতায় থাইক্যা আইছ, আইচ্ছ্যা কওছে দেখি এই যে উঁচা উঁচা বিল্ডিং বানাইছে—অতো লম্বা বাঁশ অরা পাইলো কই?’ বাবা হাসতেন, বাবার সঙ্গে আমরাও হাসতাম; কিন্তু পরে নিজে উঁচু ভবনের তলায় দাঁড়িয়ে বুঝেছি, হরিকাকার প্রশ্নটা একেবারে হাস্যকর ছিল না। বড়কিছুর সামনে দাঁড়ালে বড়মানুষও বোধহয় কান্ডজ্ঞান হারিয়ে মাঝে মাঝে শিশুর মত কৌতুহলী হয়ে ওঠে। জিন্নাহ্ এভিনিউতে বিজলিবাতির খেলা দেখে আমার চোখ ঝলসে গেলো। অনেক ঘরেই যেখানে বাতি জ্বলে না, সেখানে পথে পথে কী চমৎকার বিজলিবাতির ছড়াছড়ি। বুঝতে পারলাম, এই এলাকাটাই হচ্ছে ঢাকার প্রাণকেন্দ্র, সেই জন্যই তো জিন্নাহ এভিনিউ। জিন্নাহ্ সাহেবের নামটা কি আর হাতিরপুলের বস্তি এলাকায় মানাতো?
আমরা ফুলবাড়িয়া-গেন্ডারিয়া-ফতুল্
লা-চাষাড়া হয়ে এগিয়ে চললাম এশিয়ার বৃহত্তম পাটকলসমৃদ্ধ, মতির ভাষায় প্রাচ্যের ডান্ডি, শীতলক্ষ্যা তীরবর্তী প্রাচীন বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জের দিকে। স্টেশন থেকে পায়ে হেঁটে নয়া মিঞার মামার দোকানে যাবার পথে একটি বিরাট আয়ুর্বেদীয় ফার্মেসি দেখেই আমার মনে হলো, বারহাট্টার নারায়ণ চক্রবর্তীর সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের কোথাও একটা মিল আছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আমরা ভিক্টোরিয়া রোডের সেই বিখ্যাত দোকানটিতে পৌঁছে গেলাম, নয়া মিঞার মামা যে দোকানের মালিক, মসলিন হোসিয়ারি যার নাম। দোকানের নাম থেকেই বুঝা যায়, দোকানের মালিক দুর্লভ ধনে ধনী। জগদ্বিখ্যাত মসলিনের কথা বইয়ে পড়েছি, কে জানে নয়া মিঞার মামার দোকানে আজও সেই মসলিনের কিছু অবশিষ্ট আছে কিনা। এতো বড় একজন ধনী মানুষের সঙ্গে কীভাবে কথা বলবো, কেমন আচরণ করবো এসব ভেবে আমি ভিতরে ভিতরে খুবই বিব্রত বোধ করছিলাম। তার করুণা এবং স্নেহ আকর্ষণে সফল হলে আমাদের ঢাকা ভ্রমণ অনেক সুখের হবে, অন্যথায় বিপদ। পাছে আমাদের পকেটের দৈন্যদশা এবং অপরিমার্জিত গ্রাম্যতার ত্রুটি প্রকাশ পেয়ে যায়, সে-জন্য আমরা খুবই সতর্ক ছিলাম। আমরা মানে আমি, মতি এবং ছন্দু মিঞা। আমাদের ঢাকা অভিযানের প্রস্তুতিপর্বের প্রথম দিকে ছন্দু মিঞার নাম ছিল না, শেষ মুহূর্তে ছন্দু এসে আমাদের দলে ভেড়ে। তার প্রধান উদ্দেশ্য ঢাকা ভ্রমণ নয়, ঢাকা থেকে একটি ভালো সাইকেল কেনা। ছন্দু আমাদের এক দুই ক্লাস নিচে পড়তো— গৌরিপুর বাজারে ওদের একটি মনোহারী দোকান ছিল। পড়াশোনায় সে ছিল প্রায় রফিজের মতোই, পার্থক্য ছিল স্বাস্থ্য এবং প্রাচুর্যে। দোকানে পাইকারি খন্দেরদের ভিড় ছিল না। রাত দশটার মতো বাজে। দোকানের কর্মচারীরা দিনের বিক্রির হিসাব নিয়ে ব্যস্ত। ক্যাশ বাক্সের সামনে বসে থাকা সুদর্শন ভদ্রলোকই যে দোকানের মালিক, নয়া মিঞার বহুকথিত সেই মামা, তা দেখেই বুঝতে পারলাম। আমাদের দোকানের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে নয়া মিঞা দোকানের ভিতরে ঢুকলো। তাকে দেখে তার মামার মধ্যে তেমন একটা ভাবান্তর ঘটলো বলে মনে হলো না। প্রথমে দোকানের কর্মচারীদের সঙ্গে কিছু কথা বিনিময় হলো, নয়া মিঞা তার বিখ্যাত হাসিখানি দিয়েও পরিস্থিতিটাকে আয়ত্তে আনতে পারল বলে মনে হলো না। লক্ষ্য করলাম মামা থেকে নিরাপদ দূরত্বে তক্তপোশের এক কোনায় নয়া মিঞা বসে আছে। সে চার সদস্যবিশিষ্ট ঢাকা-ভ্রমণকারী একটি দলের নেতার মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়ে অনেকদিন পর ঢাকায় ফিরেছে, অন্য যে কেউ হলে ভাগ্নের এই কৃতিত্বে গর্বিত হতো, কিন্তু তিনি নিশ্চিত বিরক্ত হলেন। দিনের বিক্রির টাকাটা পকেটে নিয়ে বাইরে অপেক্ষমান একটি ট্যাক্সিতে এসে চড়লেন। চলে যাবার আগে কর্মচারীদের দু’একটা প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন, কিন্তু নয়া মিঞাকে কিছুই বললেন না। শুধু গাড়িতে ওঠার সময় আমাদের দিকে একটি বক্র দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে গেলেন।
মামা চলে যাবার পর দোকানের মধ্যে একটা স্বতস্ফূর্তভাবে ফিরে এলো। এতক্ষণ যে পাথরচাপা গুমোট ভাবটা ছিল, মামার অন্তর্ধানে তা দূর হলো। নয়া মিঞা আমাদের দোকানের ভিতরে নিয়ে গিয়ে দোকানের কর্মচারীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর আমরা বসতে পারলাম। স্থির হলো আমাদের দু’জন দোকানের ভিতরে থাকতে পারবে, দু’জন থাকবে দোকানের সামনে যে ট্যাক্সিটি রাত্রিবাস করে তার মধ্যে। মামাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে একটু পরেই সেই টাক্সিটি ফিরে এলো। ড্রাইভার ভদ্রলোক বেশ চমৎকার দিলখোলা মানুষ। নয়া মিঞার তথাকথিত মামার মতো নয় সে। নয়া মিঞার সঙ্গে তার পূর্ব-পরিচয় ছিল। এই দোকানেরই সে কর্মচারী ছিল একসময়। তাদের আলাপ থেকে বুঝতে পারলাম নয়া মিঞাও একসময় এই দোকানের কর্মচারীই ছিল, এর বেশি কিছু নয়। মালিককে মামা ডাকার ব্যাপারটা ছিল একতরফা প্রেমের মতো। তাতে মালিকের কোনো সম্মতি ছিল না। আসল মামারাই ভাগ্নেদের খবর রাখে না, নকল মামাদের আর দোষ দিয়ে লাভ কী? ক্ষিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছিল। আমরা আমাদের পোটলাপুটলিগুলি দোকানে রেখে একটা হোটেলে খেতে গেলাম। ক্ষিদের মধ্যে খাওয়াটা ভালোই লাগলো যদিও ভাত-তরকারি সবই প্রায় ঠান্ডাই ছিল। ট্যাক্সির ড্রাইভার রমজান আলীও আমাদের সঙ্গে খেলো। দোকানে এসে আমরা দু’দলে ভাগ হয়ে গেলাম। ঠিক হলো মতি আর আমি ট্যাক্সিতে থাকবো দোকানের ভিতরে থাকবে নয়া মিঞা আর ছন্দু মিঞা।
পরিস্থিতিটা নয়া মিঞার বর্ণনার অনুকূলে ছিল না। এই নিয়ে সে খুবই লজ্জিত ছিল। ভেবেছিলাম, হোটেলে উঠব কিন্তু নয় মিঞা বললো এতো রাতে হোটেলে জায়গা পাওয়া যাবে না— সুতরাং আজকের রাতটা কোনোমতে কাটিয়ে দিতে পারলে হয়। কাল থেকে হোটেলে। তখন ছিল গরমের দিন, ট্যাক্সির পেছনের নরম ফোমের সীটে আমরা বসলাম মাথাটা পেছনের দিকে এলিয়ে দিয়ে। ইতিপূর্বে ট্যাক্সিতে চড়ি নি।বেশ মজাই লাগলো। শুধু একটাই ভয় হলো, ঘুমের মধ্যে ড্রাইভার যদি ট্যাক্সি চালিয়ে আমাদের দূরে কোথাও নিয়ে যায়? আমাদের ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে কীভাবে গাড়ির দরজা খুলতে এবং বন্ধ করতে হয় বুঝিয়ে দিয়ে রমজান কোথায় যেন চলে যায়। আমরা শুনতাম ড্রাইভাররা মদ খায়। কে জানে সে-ও মদ খেতে গেলো কিনা? সারাদিনের ভ্রমণের ক্লান্তিতে গভীর নিদ্রায় আমাদের আচ্ছন্ন হওয়ার কথা, কিন্তু ঘুম এলো না। যতবার ঘুমের ভাব আসে, মনে হয়, ট্যাক্সিটি চলতে শুরু করেছে।
অনেক রাত করে ড্রাইভার ফিরল। তার মুখে হিন্দী গান : আয়েগা, আয়ে গা…। তার এলোমেলো পা ফেলা দেখেই আমরা বুঝে ফেলি ব্যাপারটা। ভয়ে বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। ঘুমের ভান করে চোখ বন্ধ করে রাখলাম। ট্যাক্সির কাছে এসেই সে আমাদের ভাগ্নে বলে সম্বোধন করলো। ‘কী ভাইগ্নারা, ঘুমাইয়া পড়ছ নাকি?’
আমরা তার ডাকে সাড়া দিলাম না।
অগত্যা একা একাই সে কিছুক্ষণ গুন গুন করে গান গাইলো। তারপর এক সময় রূপকথার সেই দৈত্যের মতো ঘুমিয়ে পড়লো। জন মানবের চলাচলশূন্যে এভিন্যুর পথপার্শ্বে সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা একটি প্রাইভেট টাক্সির মধ্যে বসে আকাশের তারা গুনতে গুনতে, শীতলক্ষ্যর হাওয়ায় খেতে খেতে, কখন এই টাক্সিটি আমাদের নিয়ে অজানার পথে চলতে শুরু করবে—সেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য বুদ্ধি আঁটতে আঁটতে এবং ফেলে আসা গ্রামের কথা ভাবতে ভাবতেই আমাদের রাত্রি ভোর হলো।
আমাদের ঢাকা-অভিযানের শুরুটাই এমন তালকাটা হয়ে যাবে তা নয়া মিঞা ভাবতেও পারে নি, পুরো-ব্যাপারটার জন্যই সে কিছুটা বিব্রত বোধ করছিল। আমি তখন আমার সঙ্গে আমার মামাদের সম্পর্কের প্রসঙ্গ তুলে তাকে কিছুটা সান্ত্বনা দিলাম। বললাম : ‘আমাদের জন্য কিছু ভাববেন না, আজকালকার মামারা এরকমি হয়।’ নয়া মিঞা যেন এরকম একটি সংলাপের জন্যই অপেক্ষা করছিল। মামা সম্পর্কে সকল নিরবতার অবসান ঘটিয়ে নয়া মিঞা ঢাকাইয়া ভাষায় বললো : ‘হালায় আমগো পাত্তাই দিলো না।’ দোকানের একজন কর্মচারীও মালিকের প্রতি তার গায়ের ঝাল ঝাড়ার এই সুযোগটা ছাড়লো না, নয়া মিঞার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বললো: ‘হালায় চামার, কিরপিনের বাচ্চা।’ মামার অবর্তমানে মামা-ধোলাই পর্বটি নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করে সকাল সকাল স্নানটা সেরে নেয়ার জন্য নয়া মিঞার নেতৃত্বে আমরা শীতলক্ষ্যায় গেলাম। ভোরবেলার স্ফটিকস্বচ্ছ জলে প্রাতঃস্নান করার পর দেহমনের সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো।
নাস্তা করার জন্য নয়া মিঞা আমাদের নারায়ণগঞ্জের একটি বিখ্যাত রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলো। খদ্দেরের ভিড়ে রেস্টুরেন্টে ছিল জমজমাট, অনেক কষ্টে জায়গা পাওয়া গেল। ঐ রেস্টুরেন্টের বেয়ারাদের সঙ্গে নয়া মিঞার পূর্ব-পরিচয় ছিল, অনেকদিন পর নয়া মিঞাকে দেখে তারা বেশ খুশি হয়েছে বলেই মনে হলো। রেস্টুরেন্টের নাম বোস কেবিন। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে হিন্দুর এমন জমজমাট দোকান আছে, আমার জানা ছিল না। নয়া মিঞা আমার ধারণা পাল্টে দিলো। বললো, নারায়ণগঞ্জে প্রচুর হিন্দু আছে। এখানকার হিন্দুদের মধ্যে বড়-ব্যবসায়ীও রয়েছে। এদের মধ্যে গরিব খুব কম। এখানে কয়েকটি হিন্দু-প্রধান এলাকাও নাকি আছে। শুনে বেশ ভালো লাগলো। হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কটা পান-চুনের মতো, একটু কমবেশি হলেই বিপদ। লুচি-মোহনভোগ সহযোগে পুরোপুরি হিন্দুস্টাইলে পেট পুরে টিফিন করে বোস-কেবিন থেকে বেরিয়ে আসার পথে ধুতিপরা কিছু হিন্দুপুরুষ এবং সিঁদুর পরিহিতা হিন্দুরমণীদেরও দেখা পেলাম। মনে হলো, তারা বেশ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই চলাফেরা করছে। বুঝলাম, পাকিস্তানে হিন্দুরা থাকতে পারবে না, এই ধারণাটার পেছনে কোনো যুক্তি নেই। দাঙ্গা যা হবার তা হয়ে গেছে, আর হবে না। গ্রামে ফিরে গিয়ে বাবাকে এসব কথা জানাতে পারবো ভেবে আমার খুবই আনন্দ হলো।
শিবখোলা পৌঁছলে শিলিগুড়ির অত কাছের কোন জায়গা বলে মনে হয় না।যেন অন্তবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে একান্ত রেহাই পাবার পরিসর মিলে গেছে।
সৌরেনির উঁচু শিখর থেকে এক দিকে কার্শিয়াং আর উত্তরবঙ্গের সমতল দেখা যায়। অন্য প্রান্তে মাথা তুলে থাকে নেপালের শৈলমালা, বিশেষ করে অন্তুদারার পরিচিত চূড়া দেখা যায়।
মিরিক নামটি এসেছে লেপচা ভাষার “মির-ইওক” শব্দ থেকে, যার অর্থ আগুনে পুড়ে যাওয়া জায়গা।
15:34