- খাস-কলম
- এপ্রিল ১৭, ২০২৫
“কেন এ হিংসাদ্বেষ, কেন এ ছদ্মবেশ…”

সংকটকালে বারবার দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথ বাঙালির কাছে ঠিক কতটা অপরিহার্য। অগত্যা তাঁর সৃষ্টি থেকেই ধার করে উদ্ধৃত এই শিরোনাম, আজকের এই সন্ধিক্ষণে যার প্রাসঙ্গিকতা প্রশ্নাতীত।
গত কয়েকদিন ধরে এই বাংলার প্রতিটা মহলে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে – সারা দেশে মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন থাকলেও ওয়াকফ বিল নিয়ে শুধু বাংলায় কেন এত উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে ? প্রশ্নটা অর্ধসত্য, সঠিক তথ্য-নির্ভর তো নয়ই। অন্য রাজ্যেও পরিস্থিতি কমবেশি উত্তপ্ত। উত্তরপূর্বের রাজ্য ত্রিপুরা, যেখানে মসনদে বিজেপির সরকার, ওয়াকফ বিরোধিতার পরিস্থিতি সামাল দিতে সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী।
একটা কথা এখানে মনে রাখা দরকার। দেশজুড়ে বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসের মানুষ থাকলেও সারা দেশে কেন্দ্রের-বিরোধী শক্তির সরকার কম, তাই সামাজিক বিভাজন বাড়িয়ে অশান্ত পরিস্থিতি সৃষ্টির প্রয়োজন সারাদেশে নেই। পূর্বোত্তরের ত্রিপুরা ও অসমের কথা ধরা যাক। কিছু কিছু জায়গায় অশান্তি হলেও, এই দুটো রাজ্যে পরিস্থিতি প্রত্যাশিত ভাবেই নিয়ন্ত্রণে, কারণ সেখানে পশ্চিমবঙ্গের মতো কেন্দ্র বিরোধী সরকার নেই। বলাই বাহুল্য, যাঁরা কেন্দ্রের মসনদে আসীন, সাম্প্রদায়িক হিংসা, বিদ্বেষ এবং দাঙ্গা তাঁদের অন্যতম রাজনৈতিক পুঁজি। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর প্রাথমিক প্রয়োজন অসমে বা ত্রিপুরায় এই মুহূর্তে নেই, যা পশ্চিমবঙ্গে আছে।
দক্ষিণ ভারতে বিরোধী সরকার থাকা সত্বেও সেখানে পদ্ম শিবিরের ডিজিটাল দাঙ্গাবাজরা এ মুহূর্তে তেমন সক্রিয় নন। অবধারিত কারণে এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গই সাম্প্রদায়িক হিংসার ল্যাবরেটরি। আগামী বছর রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। যথারীতি প্রস্তুতি এখন তুঙ্গে। আরেকটা কথা, দক্ষিণ ভারতীয়রা বাঙালির মতো আত্মঘাতী নন, তাই সেখানে এরকম কুমতলব তেমনভাবে চরিতার্থ করা কঠিন। সেখানকার মানুষ সে এলাকার সঙ্গে জড়িয়েই নিজেদের পরিচিতি গঠনকে বেশি গুরুত্ব দেন। তার একটি জীবন্ত উদাহরণ, হিন্দি আধিপত্যবাদের হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও সেখানে কল্কে পাওয়া যায়নি।
আগামী বছর রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন, তার আগে পশ্চিমবঙ্গকে সাম্প্রদায়িক হিংসার গবেষণাগারে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর বিভাজনকামীরা । দক্ষিণ ভারতে সেই কুমতলব চরিতার্থ করতে পারেনি তারা, কারণ সেখানকার মানুষ, সে এলাকার সঙ্গে জড়িয়ে নিজেদের পরিচিতি গঠনকে বেশি গুরুত্ব দেন। আত্মঘাতী বাঙালি কী পারবে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিরুদ্ধে সঙ্গবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ?
বাঙালি জাতিকে কেন আত্মঘাতী বলা হয় ? পূর্বোত্তরের যে দুটো রাজ্যের কথা বললাম, তার মধ্যে ঘটনাচক্রে ত্রিপুরাও বাঙালি অধ্যুষিত রাজ্য। এমনকি অসমেও বাঙালি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অন্যতম নির্ণায়ক শক্তি। দুটো রাজ্যেই বাঙালিকে সহজে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত করা গেছে, তাই আজ সেখানে সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্ষমতার শীর্ষে ।
বাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে রাজনৈতিক খুঁটি মজবুত করার সম্ভাবনা মূলত জিইয়ে রাখতে সাহায্য করছেন আরও অনেকের সঙ্গে তথাকথিত সুশীল সমাজের একাংশ। এতে প্রধান দুই সম্প্রদায়ের লোকই আছেন। এঁরা আপাতদৃষ্টিতে সংস্কৃতিমনা প্রগতিশীল বলেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। এঁদের অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় নিয়মিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ আলোকিত করেন, কিন্তু নিজের ভাবনা-চিন্তার অন্ধকার দূর করার প্রয়োজন মনে করেন না
নৃতত্ত্বের ছাত্র হিসেবে, গত ৩৫ বছর ধরে মানুষ আর সমাজকে নিয়ে আমার অধ্যয়ন ও জীবন-জীবিকা। দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণ বলছে জাতি বিদ্বেষ কিংবা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ পশ্চিমবঙ্গের গড়পড়তা বাঙালির চরিত্র নয়। এরাজ্যের মানুষ এখনও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী। এখনো বাংলায় দাঙ্গা লাগানোর জন্য হিন্দি বলয় থেকে দাঙ্গাবাজ আমদানি করতে হয়। বিদ্বেষী মনোভাবটা মূলত উচ্চবিত্ত, পরশ্রমজীবি, তথাকথিত সুশীল সমাজের একাংশের মধ্যেই রয়েছে, এঁদের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এঁদের কাছে সময় অফুরন্ত, সামাজিক মাধ্যমে বিদ্বেষ চাষ করাই তাদের প্রিয় কাজ।
বাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে রাজনৈতিক খুঁটি মজবুত করার সম্ভাবনা মূলত জিইয়ে রাখতে সাহায্য করছেন আরও অনেকের সঙ্গে তথাকথিত সুশীল সমাজের একাংশ। এতে প্রধান দুই সম্প্রদায়ের লোকই আছেন। এঁরা আপাতদৃষ্টিতে সংস্কৃতিমনা প্রগতিশীল বলেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। এঁদের অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় নিয়মিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ আলোকিত করেন, কিন্তু নিজের ভাবনা-চিন্তার অন্ধকার দূর করার প্রয়োজন মনে করেন না। প্রগতিশীল মুখের আড়ালে একাংশের সাম্প্রদায়িক মন আছে আর বাকিদের আছে চাটুকারি মনোভাব। এঁরা প্রত্যেকেই উচ্চশিক্ষিত। মনের খাদ্যে ভেজাল মিশে থাকলে প্রথাগত শিক্ষা মূল্যহীন। সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলেও একজন চরম নির্বোধ হতে পারে। এই বোধহীনতাই ভিন্নধর্মী কিংবা ভিন্নমত পোষণকারী মানুষের প্রতি বিদ্বেষের জন্ম দেয়।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস– এ বঙ্গের গড়পড়তা মানুষ এখনও অপরাধীকে অপরাধী হিসেবে অপেক্ষাকৃত বেশি চেনেন। তাঁরা তথাকথিত প্রগতিশীলদের মতো অপরাধীর শাস্তি দাবি করার আগে তাকে ধর্মের ভিত্তিতে চিহ্নিত করে, বিদ্বেষের আগুনে ঘি ঢালেন বলে মনে হয় না। তেমনটা হলে হয়তো এতদিনে এই রাজ্যও দাঙ্গা ব্যবসায়ীরা কব্জা করে নিত। চেষ্টা চলছে, ২০১৪ থেকে। কিন্তু তা হতে দেননি রাজ্যের সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষ শান্তিপ্রিয়। তাঁরা সহাবস্থানের পক্ষে এবং থাকবার গুরুত্বটা বোঝেন। কেননা দাঙ্গা হলে তাঁরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন।
দাঙ্গাবাজদের জাতি কিংবা ধর্মীয় পরিচয় হয় না। দাঙ্গাবাজ আলাদা একটা সম্প্রদায়। ওঁদের সাম্প্রদায়িক পরিচিতি তৈরি হয় রাজনৈতিক কারণে, রাজনীতির স্বার্থে। এটা কেউই যে বোঝেন না, তা নয়। যাঁরা জেনেশুনে মানুষকে উস্কানি দেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বয়ে বেড়ানো বিদ্বেষ। এই বিদ্বেষের ভিত্তি কর্তৃত্ব হারানোর পর প্রজন্মের পর প্রজন্ম বয়ে বেড়ানো হতাশা। তাঁদের পূর্বপুরুষরা যাদের যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পায়ের তলায় পিষে ফেলতেন, হঠাৎ তারা ধর্মান্তরিত হয়ে নাগালের বাইরে চলে যায়। ইতিহাস সাক্ষী– বাঙালির সিংহ-ভাগই তথাকথিত উচ্চবর্ণের এবং উচ্চবর্গের দ্বারা নিপীড়িত হয়ে ভিন্ন ধর্মে সহায় খুঁজেছিলেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর প্রাথমিকভাবে বলতে গেলে অনেক ক্ষেত্রে শোষিত ও নিপীড়িতদের শোষক ও নিপীড়কদের সমকক্ষ করে দেয়। শোষক শ্রেণির এই আক্রোশ, এই গাত্রদাহ বংশানুক্রমে সময়ের স্রোত বেয়ে ছুটছে। এক জীবনে বা এক প্রজন্মে এটা নির্মূল হওয়া সম্ভব ছিল না, যথারীতি এই গাত্রদাহ আজও আছে। একদিন এটা অবশ্যই নির্মূল হবে। ততদিনে অনেক কিছু ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। পুরোপুরি ধ্বংসের পর হিটলারের শাসনকালে যেমন জার্মানরা বুঝতে পেরেছিলেন, আমরাও হয়তো বুঝতে পারব ব্যাপক ধ্বংসের পর। অনেক বিশিষ্ট লেখক, মানবাধিকার কর্মী এবং জনপ্রতিনিধি আশঙ্কা করছেন আজ আমরা সেই ধ্বংসেরই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। তাঁদের লেখনী বারবার আমাদের সতর্ক করে যাচ্ছে। আমরা কি আদৌ তা বুঝতে প্রস্তুত ?
ইতিমধ্যে বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও নির্মম হত্যায় জড়িত কয়েকজন অভিযুক্তকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। প্রশাসনের কাছে সমাজের সমবেত দাবি হোক, এরা অপরাধী প্রমাণিত হলে সময় নষ্ট না করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
বেশ কিছু গুজবও ছড়ানো হয়েছে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে, সেটা প্রমাণিত। বিভিন্ন রাজ্যের সাম্প্রদায়িক হিংসার ছবি ভাইরাল করার অপচেষ্টা করেছেন রাজ্যের বিরোধী দলের ধ্বজাধারীরা। নাগরিক সমাজের তরফ থেকে প্রশাসনের কাছে এঁদের বিরুদ্ধেও অনতিবিলম্বে উপযুক্ত আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি উঠুক। এটা সময়ের অভিপ্রায় এবং নির্বিশেষের সমূহ ইচ্ছা।
♦•♦–♦•♦♦•♦–♦•♦
লেখক পরিচিতি : নৃ-বিজ্ঞানী আজমল হুসেন, কলকাতায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ।
❤ Support Us