Advertisement
  • গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
  • নভেম্বর ৯, ২০২১

গল্প► ঝাপসা কাঁচ

বিকাশের অ্যারোগেন্ট ও অত্যাধুনিক চিন্তাধারা... সে বরাবর বিবাহ প্রথার বিরোধী ছিল। কিন্তু, বিষয়টি নিয়ে তার সিরিয়াসনেসের মাত্রা আমি বুঝে উঠতে পারিনি।

গল্প► ঝাপসা কাঁচ

অলঙ্করন: দেব সরকার

| নাফিসা খান |

শীতের সকাল। কয়েকদিন ধরেই বসের হুতুম পেঁচার মতো বদনটাকে টলারেট করতে হচ্ছে। গতকাল লাস্ট ওয়ার্নিং দিয়েছেন, বৃন্দা সঠিক সময়ে আসতে পারলে আসুন, নয়তো কয়েকদিনের জন্য লিভ নিতে পারেন !

আটটা নাগাদ তৈরি হয়ে বের হলাম। রাসবিহারীর মোড়ে এসে একটা খালি ট্যাক্সি দেখে হাত নাড়তে নাড়তে চিৎকার শুরু করলাম, ট্যাক্সি… ট্যাক্সি… এই… ট্যাক্সিইইই…

ট্যাক্সিচালক এমন ভান করলেন যেন আমাকে দেখতেই পাননি। অগত্যা বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে চললাম। সঙ্গে সঙ্গে খানিকটা খালি মিনি দেখে উঠে পড়লাম।

কী আশ্চর্য ! প্রতি সিটেই একজন করে বসে আছেন। পছন্দ মত একটা সিটে বসে পড়লাম। পাশে বসা ভদ্রলোকের গা থেকে বহু পরিচিত পারফিউমের গন্ধ ভেসে আসতে কৌতূহল বশত আমি মুখটা দেখার চেষ্টায় বেশ কয়েকবার সেদিকে তাকাতে থাকলে ভদ্রলোক নড়েচড়ে বসলেন।

কথায় আছে মাঘের শীত বাঘের গায়ে। কয়েকদিন ধরে শহরে শীতের যা দাপট, সে কারণে ভদ্রলোক বোধ হয় শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য একটি মাফলার আর তার ওপর টুপি চাপিয়ে পুরো মাথাটা ঢেকে রেখেছেন।

বিকাশও অত্যধিক ঠান্ডায় এমন বুড়োটে সাজগোজ করত, সন্দেহটা সেখানেই। আমি আরও একটু ঝুঁকতেই ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে বললেন, ম্যাডাম আপনার কি বসতে কোন অসুবিধা হচ্ছে?

আমি উত্তরটা দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছি,  এমন সময় কন্ডাক্টর হাজির। ভাড়া মিটিয়ে দেখি মুখটা আবার যথাস্থানে ফিরে গেছে।

দশ বছর অতিবাহিত, অনেক কিছুই বদলে গিয়েছে। তবুও…

বিকাশের অ্যারোগেন্ট ও অত্যাধুনিক চিন্তাধারা… সে বরাবর বিবাহ প্রথার বিরোধী ছিল। কিন্তু, বিষয়টি নিয়ে তার সিরিয়াসনেসের মাত্রা আমি বুঝে উঠতে পারিনি।

আমার বাবা, যিনি কোনদিন মান-সম্মানের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করেননি, মেনে নিতে পারলেন না, আমাদের সমাজে এসবের জায়গা কোথায় ? লিভ ইন ? সোসাইটি কী বলবে… ভুলে যেও না আমরা সমাজবদ্ধ !

মা বললেন, ও যদি সত্যিই তোকে ভালবাসে তাহলে বিয়েতে আপত্তি কিসের ?
দুই পৃথক মতাদর্শের মাঝখানে পৃষ্ঠ আমি, নিজে কী চাই সেটা বুঝে উঠতে পারলাম না !
দায়িত্ব ও ভালোবাসার মাঝখানে এসে হাজির হল বিকাশের ইগো। প্রাচীর ভেদ করা আমার আয়ত্তের বাইরে ছিল।

তারপর, বাবা আমার বিয়ে অন্যত্র ঠিক করলেন।

নির্ঘাত বিকাশ ! আমি আরেকটু ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করতেই ভদ্রলোক সরাসরি আমার চোখে চোখ রেখে বললেন, ব্যাপারটা কী বলুন তো ? আপনি তখন থেকে উঁকি মেরে কী দেখার চেষ্টা করছেন ?

আমি থতমত খেয়ে হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম, তারপর বললাম, না… মানে… কুয়াশায় ঠিক বুঝতে পারছি না কোথায় এলাম।
কোথায় নামবেন আপনি ?
বেলতলা বাগান!
পরের স্টপ।
ধন্য… বাদ, অসংখ্য ধন্যবাদ !

বিকাশ ! ও আমাকে চিনতে পারল না ! হতবাক হয়ে  সিট ছেড়ে উঠে এলাম । বাস স্টপেজ থেকে পায়ে হেঁটে পাঁচমিনিট গেলেই অফিস।
ইগনোর করলো ! একটা সীমা আছে ! এতদিন বাদে দেখা… সামান্য সৌজন্যও আশা করাটা কি ভুল ?

দরজার মুখে এসে দাঁড়ালাম। মাথার উপরের আয়নায় চোখ পড়তেই মনে পড়ে গেল গাড়ি দুর্ঘটনার কথা।

প্লাস্টিক সার্জারির পর আমি এখন অন্য বৃন্দা, অপরিচিতা অনেকের কাছে। অফিসে পৌঁছে ব্যাগ থেকে পকেট আয়না বার করে অনেক চেষ্টা করলাম পুরোনো বৃন্দাকে খোঁজার। স্মৃতিগুলো বড্ড আবছা ও এলোমেলো। হাতড়েও অবশিষ্টাংশে অপ্রাপ্তি !

এমন সময় দারোয়ান এসে বলল, ম্যাডাম এক ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন ।
পাঠিয়ে দাও।

দারোয়ান যাওয়ার পথে দরজা যৎসামান্য খোলা ছিল। সেখান থেকেই দেখলাম, বাসের ভদ্রলোক দারোয়ানের সাথে এদিকেই আসছে ।

দারোয়ান ডোর নক করে বলল, ম্যাডাম,ভদ্রলোক এসেছেন।

আমি আবেগ আপ্লুত হয়ে ভাবলাম, হয়তো আমাকে চিনতে পেরে পুরোনো অনুভূতি বিকাশকে তাড়া করছে। কিন্তু, ভদ্রলোক ভিতরে প্রবেশ করার পর জানতে পারলাম, তিনি কোম্পানির নতুন প্রোজেক্ট নিয়ে আলোচনা করতে এসেছেন।

গতকাল রাতের ফ্লাইটে বস অফিসের কাজে সিঙ্গাপুরে রওনা দিয়েছেন। এখন সব  দায়িত্ব  আমার উপর।

অফিসিয়াল পরিচয় পর্ব সমাপ্তির পর বিকাশ কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিল,  আমি অফিসিয়াল আলোচনা ছাড়া অন্য বিষয়ে আমার অনাগ্রহ দেখে ও থেমে যায়। কথার ফাঁকে ফাঁকে ওর চোখ দুটিকে বেশ কয়েকবার আমার নেমপ্লেটের  উপর বোলাতে  দেখে একটু আশার উদ্রেক হল। হয়তো আগের মতোই অনুধাবন ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে আমাকে চিনে নেবে।  সময়ই শুধু গড়িয়ে গেল। আলোচনা শেষে আমি জিজ্ঞাসা  করলাম, চা না কফি ?
কফি।
পছন্দ বদলাইনি !
কিছু বললেন?
না… ও কিছু নয় ।

আমি বেল বাজিয়ে দারোয়ানকে ডেকে দুটো কফির অর্ডার দিলাম। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম, এনিথিং এলস ?
নো, থ্যাংকস। সরি, অ্যাকচুয়ালি কোম্পানির সাথে আমার যোগাযোগ থাকলেও ইতিপূর্বে আপনার সাথে পরিচয়ের সুযোগ হয়ে উঠেনি। সেই কারণেই বাসে বোধহয়…


ব্যাগ থেকে পকেট আয়না বার করে অনেক চেষ্টা করলাম পুরোনো বৃন্দাকে খোঁজার। স্মৃতিগুলো বড্ড আবছা ও এলোমেলো।


বাস শব্দটা শোনামাত্রই বললাম, ও আচ্ছা ! সেজন্য বোধহয় সরি বললেন। আমি ভেবেছিলাম…
আসলে আমি এতোটা  রুড নই। যদি আপনার খারাপ লেগে থাকে, আই অ্যাম সরি !
ইট’স ওকে, ফরগেট ইট।

এক ঘন্টা ধরে নেমপ্লেট পর্যবেক্ষণের পর প্রতিক্রিয়া শূন্য! সত্যি গুরুদেব, তোমার কাছে ট্রেনিং নিতে হবে। একটু পায়ের ধুলো দিয়ে যাবেন !
কিছু বললেন ম্যাডাম?
গুরুদেব শব্দটি মুখ থেকে স্লিপ হওয়ার পর বললাম, না… না… কিছু না।

ততক্ষণে, গরম গরম কফি হাজির। কফি টেবিলের উপর রেখে দারোয়ান বলল, “ম্যাডাম আপনার অর্ডার। আমি বললাম, স্যারকে দাও।
আপনি ?
রেখে যাও !

কাপটা হাতে তুলে আরও কয়েকবার চলল নেমপ্লেটের উপর নিখুঁত পর্যবেক্ষণ। আমি নিশ্চিত ওর মাথায় কিছু চক্কর দিচ্ছে। কিন্তু এত হিচকিচানোর কী আছে? সরাসরি আই মিন খুল্লাম খুল্লা বলতেই পারে, বৃন্দা কেমন আছো?
ম্যাডাম ?
ইয়েস,বলুন।
কাজটা কনফার্ম ?
অ্যাজিউম করতে পারেন, বাকিটা বসের হাতে ! আমার দিক থেকে পজেটিভ। আবারও হতাশ,  কাজের প্রসঙ্গ ছাড়া বাবুর মাথায় আপতত আর কিছু নেই নাকি ! ভালো… ভালোই… ভুল আমারই। এখনও বৈঠা ধরে বসে আছি।

আমাকে অন্যমনস্ক দেখে বিকাশ বলল, আপনার কফিটা আর কিছুক্ষণ হলে সুমেরুর তাপমাত্রা অ্যাবজর্ভ করে ফেলবে।
হেসে উঠলাম।
পরবর্তী প্রসেস সম্পর্কে জানার জন্য আপনার নম্বরটা পেলে উপকৃত হব।
স্যারের সঙ্গে কথা বললেই হবে।
মাইন্ড করলেন ?
না… না…।

সামান্য কয়েক বছরের ব্যবধানে মানুষটার অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। আগের মতো হ্যান্ডু চেহারা থাকলেও কোথায় একটা খামতি সমগ্র পার্সোনালিটিকে গ্রাস করেছে। যে কারণে ধরা যেতে পারে, ট্র্যাকটা মাইনাসের দিকে। গভীর চিন্তার সাগরে ঝুপ করে ঢিল পড়ার মতোই প্রবেশ করল, ম্যাডাম আসছি, সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ।
ওয়েলকাম !

আমি তাকিয়ে ছিলাম, শেষ ঝলকটাও কপি করে রাখার ইচ্ছায়। হঠাৎ পিছন ফিরে ও বলল, আর একটা বিষয়। অবশ্যই আপনার অনুমতি নিয়ে বলতে চাই !

এবারও নিশ্চয় প্রোজেক্টের কথাই বলবে, হ্যাঁ, বলুন !
আপনার নামটা!
যাক কিছু তো বের হল, এনি প্রবলেম?
বৃন্দা রায়, অ্যাকচুয়ালি এই নামের একজন আমাদের কলেজে পড়ত, নামটা দেখে তার কথা মনে পড়ে গেল।
বান্ধবী নিশ্চয় ?
না… না… পরিচিত !

পরিচিতদেরও বেশ যত্নসহকারে মনে রাখেন দেখছি ! তারপর মনে মনে বললাম, পরিচিত ? গোবর গণেশ, ভোদলা, হোদোলকুৎ ! দশ বছর চুটিয়ে প্রেম করার পর এখন পরিচিত। কষিয়ে দিতে পারলে বেশ আনন্দ পেতাম।
কিছু বললেন ম্যাডাম ?
ইচ্ছা ছিল, আপাতত বল থাকলেও ব্যাটটা নেই।
ব্যাটিং করবেন ?
না, কফি দিয়ে ভিজিয়ে খাব।
সে কি ! ব্যাট আর কফি ? বেশ ইন্টারেস্টিং কম্বিনেশন !

আমি খটমট করে তাকিয়ে বললাম, আপনি আসতে পারেন, অযথা সময় নষ্ট আমি পছন্দ করিনা।

বিকাশ চলে যাওয়ার পর মাথাটা রিভিক কিউবের মতো এলোমেলো হয়ে গেল, কম্পিউটারে এম.এস ওয়ার্ডগুলো মাথার দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে যাচ্ছে। ব্যবধান দীর্ঘ হলেও বাবা মারা যাওয়ার পর আর অন্য কাউকে নিয়ে ভাবার সুযোগ আসেনি। আমি অমিতকে ডেকে বললাম, বিকেলে যে মিটিংটা আছে ওটা আগামীকাল সকালে ফিক্স করো, আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। আমি বেরিয়ে  যাচ্ছি।
কোনও হেল্প লাগবে ম্যাডাম ?
অমিত, আমি চলে যেতে পারবো। বাই দ্য ওয়ে থ্যাঙ্কস।
ওয়েলকাম।

অফিস থেকে বার হওয়ার সাথে সাথে হুতুম প্যাঁচার কল, ম্যাডাম শুনলাম আপনার হেল্থ ভালো নেই। ওয়েট করুন, অফিসের গাড়ি আসছে। আপনাকে ড্রপ করে দেবে।
নো, থ্যাঙ্কস। আমি চলে যাব স্যার!
তুমি জানো আমি আর্গুমেন্ট পছন্দ করিনা !
ওকে স্যার।

আসলে শরীর নয়, মন খারাপ। বসকে সেটা বলা যাবে না। বললে আবার শুরু করবেন,  চিন্তা করবেন না।  চেহারা খারাপ হয়ে যাবে। কেউ না থাকলেও আমি তো সঙ্গে আছি।
বাড়ি ফিরেও অস্থিরতা হ্রাস পেল না। অন্যমনস্ক দেখে মা জিজ্ঞাসা করলেন, অফিসে বসের সঙ্গে আবার কী হল ?
না, মা। বস সিঙ্গাপুর !
অফিস থেকে ফেরার পর থেকেই চুপচাপ !
আজ বিকাশের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

মা কিছুক্ষণ থেমে বলল, বিকাশ ? সে আপদ কোথা থেকে এলো ?
অফিসে এসেছিল।
মা আমার কথা শেষ করার আগেই শুরু করলেন, কী কারণে ?

অফিসিয়াল কাজে।
এতে তোর মন খারাপের কী আছে ? অতীতকে আকড়ে ধরে বসে থেকে ফায়দা নেই।  আগামীর কথা ভেবে এগিয়ে যাওয়া উচিত।
সুযোগ পেলাম কই !
তার মানে।
ও কিছু না। আপাতত একটু চুপ করো !

আমি রান্না ঘরের দিকে তাকিয়ে হাঁক দিলাম, মাসি আর  কতক্ষণ !
আসছি, বাবা আসছি ! মোচার চপ বানাতে সময় তো লাগবে।
আচ্ছা নিয়ে এসো ।

বাবা চলে যাওয়ার পর মা একা হয়ে পড়েছিল। মাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য বীণা মাসিকে গ্রামের বাড়ি থেকে এনে রাখা হয়েছে। মাসি মায়ের ছোটবেলার খেলার সঙ্গী, অল্প বয়সে স্বামীহারা। দাদা-বৌদির সংসারে কষ্টে ছিল। তাই এক কথায় রাজি হয়ে যায়। এখন সে বাড়ির রান্নাবান্না থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজকর্ম দেখাশোনার দায়ভার একাই সামলায়। মায়ের কোমরে ব্যাথা, বসে বসে ছড়ি ঘোরানো ছাড়া নড়াচড়া বিশেষ করতে পারেন না। আমি দুই বৃদ্ধার ভরসা।

জলখাবার খেয়ে মন খারাপের ওষুধ তল্লাশির জন্য বেরিয়ে পড়লাম। মা ডাইনিংয়ে ছিলেন। দেখেই বললেন, কোথায় চললি ?
বাজার কলকাতা !
আজ ব্যাপক ঠান্ডা। অন্য কোনোদিন গেলে পারতিস।  একান্ত দরকার থাকলে যা।
দরকার ছাড়া যাবো কেন?

আমি বেশ এঁটেসঁটে বার হলাম, অন্যদিনের তুলনায় জ্যাম কম থাকায় আধ ঘন্টার মধ্যে বাজার কলকাতায় পৌছে গেলাম। এন্ট্রান্স লাইনে দাঁড়াতেই অনুভব করলাম আমার নাম ধরে কেউ একজন ডাকছে। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি বিকাশ। একজন মহিলার সঙ্গে দাঁড়িয়ে গল্প গিলছে। ভদ্রমহিলা আমাদের বয়সি। পরণে সবুজ-সাদার মিশ্রণে তাঁতের শাড়ি, শাখা-সিঁদুরযুক্ত, মনে হয়, বিকাশের স্ত্রী। বিকাশ আমাকে হাত উঁচু করে ডাকল। আমি কাছাকাছি যাওয়ার পর বিকাশ ভদ্রমহিলাকে উদ্দেশ্য করে বললেন ইনি হচ্ছেন, বৃন্দা ম্যাডাম।
মানে ? সেই বৃন্দা ?
আরে না না ! আজ ওনাদের অফিসেই গিয়েছিলাম।
আর কে প্রাইভেট লিমিটেড !
আমি বললাম, একদম ঠিক ।

কাবাব মে হাড্ডির মতো দুজনের মধ্যে নিজেকে ভীষণ অপ্রস্তুত লাগছিল। চাপ না নিয়ে বললাম, আমি ব্যস্ত আছি। চলি।
বিকাশ বলল, আমি ঋণ রাখিনা বৃন্দা, বকেয়াটা নিয়ে যাবেন।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে নিজের ন্যাঁড়া নামটা শুনে বেশ ভালোই লাগলো। দাঁড়িয়ে গেলাম। বিকাশ দুটো ভাঁড় আমাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজেরটা নিয়ে ভিড় ছেড়ে বেরিয়ে এল। ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করল, দাদা তোমার চা ?
ও ভাড় দেখিয়ে বলল, এই যে।

মনে মনে বেশ আনন্দ পেলাম। মেয়েটি আর যাই হোক বিকাশের স্ত্রী বা প্রেমিকা নয়। যাক বাঁচা গেল। রাস্তা পরিস্কারই আছে।
কিছু বললেন বৃন্দা?
কই, না তো !

চা শেষ না হতেই মেয়েটি চলে যাওয়ার জন্য উৎসুক পড়ে। আমার ইচ্ছা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুতে। বিকাশ সেটা বুঝেই বলল, জয়ী কোনও হেল্প লাগবে?
দাদা, তার দরকার হবে না। আমি চলে যাবো। যাওয়ার আগে সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার সাথে পরিচয় হয়ে ভালো লাগলো। সময়ের অভাবে আলাপচারিতা বেশিদূর গড়াল না।
আমি বললাম, নেক্সট টাইম অবশ্যই !
অপেক্ষায় থাকবো, চললাম।
এসো।

আমারা দুজন কথায় কথায় অনেকখানি রাস্তা এগিয়ে এলাম। বিকাশ বলল, একটা কথা বলব, আপনি যদি কিছু মাইন্ড না করেন ?

বলুন ?
আপনাকে দেখার পর থেকে কেন জানিনা মনে হচ্ছে, বহুদিনের হারানো সম্পদ ফিরে পেলাম।

এখনও বুঝতে পারছো না ? চেহারার না হয় পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু বৃন্দা ? অতি ধীরে বললাম,
মে বি !
ও শুনতে না পেয়ে জিজ্ঞাসা করল, কিছু বললেন ?
না, কিছু না ?
বৃন্দা রায় ! একই নাম, কিন্তু চেহারাটা আলাদা ! কী হয়েছিল তোমার ?
মানে ?
কিছু না ! রাত অনেক হল। আপনার বাড়িতে চিন্তা করবে !
না, অফিস থেকে অধিকাংশ দিন ফিরতে লেট হয়। বাই দ্যা ওয়ে আপনার বাড়িতে কে কে আছে ?

আমি একাই ।

অল্পদিনের মধ্যে আবার আমার সাথে বিকাশের আলাপচারিতা বাড়তে লাগল। আজকাল অফিস শেষ মাঝে মাঝেই দেখা সাক্ষাৎ হয়। ওকে সবকিছু খুলে বলার কথা মাথায় থাকলেও সাহস হয় না।

মাসী বিষয়টি জানার পর অতিষ্ঠ করে তুলেছে, তুই ওকে সব কথা খুলে বল। তারপর কপালে যা আছে হবে। আমি বোঝানোর চেষ্টা করলাম, আরও কিছুদিন পরে। না জানালে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে কি ? মাসি নাছোড়বান্দা। বাধ্য হয়েই ওকে বিশেষভাবে সাক্ষাতের কথা বলি। আমার প্রপোজাল এক কথায় একসেপ্ট করে ও বলল, আমিও ভাবছিলাম একান্ত কিছুসময় কাটানোর কথা। ঠিক আছে, তুমি রেডি থেকো। আমি তোমাকে পিক করে নেব।
এখন রাখি, পরে কথা হবে।
ওকে।

দুশ্চিন্তায় পুরো সপ্তাহ কেটে গেল। সবকিছু জানার পর বিকাশের রিঅ্যাকশন কী হবে ? সে চিন্তা আমাকে প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খাচ্ছে। মাসিকে বললাম, মাসী ওকে পরে জানালে কি হয় না ?
তুই কি মিথ্যা দিয়ে সম্পর্ক জোড়া লাগাবি !
না, এক্সাক্টলি তা নয়। তবে…
আজ না হয় কাল সবকিছু প্রকাশ হতে বাধ্য। সেদিন সম্পর্কটা কোন জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে ভেবেছিস ?
তোমার কথা ভুল নয়, তবে টেনশন হচ্ছে ।
ইশ্বরের উপর ভরসা রাখ”।

অবশেষে আমি বিকাশকে সবকথা খুলে বললাম। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর নীরবতা ভেঙে ও বলল, আমারও কিছু বলার আছে!

বুঝে উঠতে পারলাম না, ও ঠিক কি বলতে চাইছে। বললাম, কী?
বৃন্দা, সেদিন যে গাড়িটার সঙ্গে তোমার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল তার ড্রাইভার ছিলাম আমিই।

আমি কয়েক সেকেন্ডের জন্য হতবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর, ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে এলাম।
মনে হচ্ছিল, সবটাই ধোঁয়াটে। ঝাপসা কাঁচের গুড়ো।


❤ Support Us
error: Content is protected !!