Advertisement
  • গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
  • মে ২৯, ২০২২

মুহূর্ত

একদিন খুব বড় লেখক হবি । আমাকে মনে না রাখলেও চলবে । শুধু তোর যখন প্রথম গল্পের বই বেরোবে, আমাকে সেই বইটা সই করে দিবি

অ্যাঞ্জেলিকা ভট্টাচার্য
মুহূর্ত

অলঙ্করণ: দেব সরকার

হিমালয় বসুর কর্মজীবনের আজ বত্রিশ বছর হয়ে গেল । পত্রিকার দপ্তরে সামান্য একজন সাংবাদিক হয়ে ঢুকেছিলেন । জীবনের পাহাড় পর্বত, মাঠ ঘাট ডিঙিয়ে এখন বাংলার নামকরা এক পত্রিকার সম্পাদকে উন্নিত হয়েছেন । এখনও পর্যন্ত বেশ কয়েকটি গল্পের বই, উপন্যাস তার নামের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে ।
নামী সংবাদপত্রের রবিবারের পাতায় একটি ধারাবাহিক উপন্যাসে হাত দিয়েছেন । কয়েক কিস্তি জমা আগেই দেওয়া আছে পত্রিকায় । পাঠক মহলে বেশ সারা ফেলেছে তার লেখা – লোকের মুখে মুখে এখন “অপরিমিতা। বর্ষীয়ান লেখকরাও তাকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন । কিন্তু ধারাবাহিক এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে অনেক দূর ।
হিমালয় প্রাতঃভ্রমন অনেক দিন ছেড়েছেন । লেখার সময়, রাত। তাই সকালে ওঠা যায় না । তবে সকালের বাজারটা কোনকোন দিন নিজেই করেন । পতিদেবের নিদ্রায় ব্যাঘাত যাতে না হয়, তাই সীমা অনেক সময় সেটা সেরে রাখেন । আজ দিনটা একটু অন্যরকম । পিকু বাড়ি ফিরছে অনেকদিন পর । এখানে দুদিন কাটিয়েই দিল্লি চলে যাবে । ইঞ্জিনিয়ারিং এর পাঠ শেষ। মাস পয়লাতেই চাকরিতে জয়েনিং ।
পিকু যখন ব্যাঙ্গালুরুতে গেল, পড়তে । সীমা, সে রাতে সারারাত কেঁদেছিল । হিমালয় লেখার টেবিলে বসেই বেশ কয়েকবার নাক টানার শব্দ পেয়েছিল । তখন ওর আলাদা কোন স্টাডি রুম ছিল না , শোয়ার ঘরের এক কোনায় বসে, টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত লিখত । হিমালয় ছেলেকে হস্টেলে রেখে এসে, নিশ্চিন্তে লেখায় মন দিয়েছিল। সীমা পারেনি । পুত্রের চিন্তায় না খেয়ে লো প্রেসার হয়ে গিয়েছিল। এখন মন আর মাথা দুটোই কাজ করছে না। সকালে বাজার করতে না গেলে কি সব কিছু ঠিক ঠাক চলত ! সাহাবাবুর পেপারে উঁকি না মারলে কি ভাবনা চিন্তা সব কিছু সীমাবদ্ধ থাকত !
সাহাবাবু উত্তেজিত হয়ে খবরের কাগজ ওলটাচ্ছিলেন। হিমালয় উঁকি দিয়ে দেখলেন –খবরের কাগজের কোনার দিকে “সন্ধান চাই” বিজ্ঞাপনের অংশটা বেশ খুঁটিয়ে পড়ছেন । – “হিমালয় তুমি তো সংবাদপত্রে কাজ করো। আচ্ছা এই যে মানুষগুলো হারিয়ে যায়। এদের ছবি দিয়ে যে বিজ্ঞাপন দেয়, এদের কি ফিরে পাওয়া যায়।”
হিমালয় মাথা চুলকে বলল – “সব কি আর হারিয়ে যায় ? কেউ কেউ নিজের ইচ্ছেতে চলে যায় । তাদের কি করে খুঁজে পাবেন ?তারা তো হারানোর জন্যই ঘর ছেড়েছে ।”
– “এই দেখো হিমালয় , এই মহিলার ছবিটা দেখো ।”
একটা রঙিন পাসপোর্ট সাইজ ছবি । মনে হচ্ছে ব্যাংক বা পোস্ট অফিসের পাশবই এর জন্য তোলা । তবে মুখটা বেশ পরিষ্কার । নীচে নাম লেখা অপরিমিতা চৌধুরী । ঠিকানা – ঢাকুরিয়া , শহীদ নগর কলোনি । যোগাযোগের জন্য ফোন নম্বর দেওয়া ।

হিমালয় চশমার কাঁচটা মুছে আবার দেখল ছবিটা । আর দাঁড়াতে পারেনি । দই , মিষ্টি না নিয়েই হাঁটা লাগিয়েছিল । সীমা গজগজ করতে করতে পরে গিয়ে নিয়ে এসেছিল ।
রাত দেড়টা , সারা বাড়ি নিস্তব্ধ । সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে । এখন লেখার টেবিলে হিমালয় বসুর যত চিন্তা ভিড় করে এসেছে । ধারাবাহিক উপন্যাসের বেয়াল্লিশ নম্বর কিস্তি চলছে । সামনে গতসপ্তাহের কাটিং পরে রয়েছে । জ্বলজ্বল করছে উপন্যাসের নাম আর ইলাস্ট্রেসন। পিছন দিক ফিরে একটি মেয়ে চলে যাচ্ছে । পিঠ ছাপিয়ে তার এলো চুল । হাওয়ায় তার আঁচল উড়ছে । আর এক পাশে দরজা ধরে একটি কিশোর দাঁড়িয়ে তা দেখছে ।
বাথরুমের লাইট জ্বালিয়ে আয়নার সামনে অনেক্ষন ধরে নিজেকে দেখলেন । চুলের সামনের অংশতে পাক ধরেছে । সীমা অনেকবার চেষ্টা করেছে, নিজের হেয়ার কালার হিমালয়ের মাথায় দিতে, কিন্তু পারেনি । বয়েস হয়েছে, এতে লুকবার কিছু নেই । চশমার পাওয়ার বেড়েছে । এতকাল ধরে চশমা পড়ার ফলে নাকের দুপাশে একটা দাগ হয়ে গেছে । চশমা ছাড়া যেন বেমানান লাগে ।

হিমালয় চোখ বন্ধ করল । – “তোমায় বৌদি বলতে একদম ইচ্ছে করছে না । তুমি আমার বন্ধু হবে ?”
– “এই তুই কোন ক্লাসে পড়িস ?”
– “মাধ্যমিক দিয়েছি । রেসাল্ট বেরয়নি এখনও ।”
– “আমি দুবছর আগে মাধ্যমিক পাশ করেছি । তোর থেকে আমি দুবছরের বড় । অবশ্য আর পড়িনি ।”
– “কেন ?”
– “আমদের গ্রামে তো হাইস্কুল নেই।”
– “তোমার নামটা খুব সুন্দর – হাসি!”
– “কিন্তু তোর নামটা ভালো না । ‘হাবু’ একটা নাম হল ?বলে খিল খিল করে হাসতে লাগল।”
– “আমার একটা ভালো নাম আছে – হিমালয় । হিমালয় বসু । আর তুমি বড্ড বেশি হাসো ওর জন্যই তোমার নাম হাসি।”
হিমালয়ের কানের কাছে হাসি ফিসফিস করে বলল –“আমারও একটা ভালো নাম আছে- ‘অপরিমিতা’ । তবে এই নামটায় কেউ ডাকে না । সবাই হাসি বলেই ডাকে।”
– “অপরিমিতা মানে কী ?”
– “যার কোন কিছুই পরিমিত নয়।”
– “যেমন তোমার হাসির কোন পরিমাপ নেই ।অপরিমিতা নামটাই বেশি ভালো।”
– “আমার মা দিয়েছিল নামটা।”
– “আমি তোমায় অপরিমিতা বলেই ডাকব । অবশ্য বড়রা শুনলে রাগ করবে । সবার সামনে বৌদি বলব ।” অপরিমিতা জোরে হেসে উঠল।
এক বাড়িতে শুধু দুঘর ভাড়াটিয়া । সামনের বারান্দার মধ্যে পার্টিশন করে দুটো বারান্দা করা হয়েছে । সেই পার্টিশন উঠোন বরাবর গিয়ে কুয়োর কাছে শেষ হয়েছে । দুদিকেই দুটো করে ঘর সঙ্গে রান্নাঘর, বাথরুম । কুয়োতে জল তুলতে এলে দুপক্ষেরই দেখা হয় , কথাও হয়। বাড়িওয়ালা ছিলেন এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী , তাকে সারাবছর দেখা যেত না । তিনি মাসের প্রথমে লোক পাঠিয়ে দিতেন । সে এসে ভাড়া নিয়ে যেত ।
একপাশে থাকত হাবু মানে হিমালয়দের পরিবার , আরেকপাশে নিপু মানে নিপেন্দ্র সরকারের পরিবার । তার ছোট ছেলে বিনুর দুমাস হল বিয়ে হয়েছে হাসি নামে একটি মেয়ের সঙ্গে। ঠিক সানাই বাজিয়ে , ঘটা করে বিয়ে নয় । একেবারে সটান বউ নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়েছিলো বিনু । বিনুর মা উমাদেবী খুব সাদাসিধে মানুষ , কি করবে বুঝে উঠতে পারেন নি । কর্তার আসার অপেক্ষা না করেই তাড়াতাড়ি বউমাকে ঘরে তুলেছিলেন ।
নিপেন্দ্র সরকার পরে এসে হম্বি তম্বি করলেও বউমাকে বের করে দেন নি । – “বড় ছেলে ঘরে থাকতে ছোট ছেলে বিয়ে করল ! ইস কি লজ্জার ।” হিমালয় এসব শুনেছিল । কদিন উমা কাকিমা এসে তাদের ঘরে কান্নাকাটি করেছিলেন । হিমালয়ের মা’কে জড়িয়ে ধরে আক্ষেপ করেছিলেন – “সুন্দরবনে শুনেছিলাম বাঘে ধরে, আমার বিনুকে পেত্নিতে ধরেছে।”

মাধ্যমিকের তিনমাস পর রেজাল্ট বেরল । স্টার মার্কস পেয়ে পাশ করেছে হিমালয় । ওর বাবা মিষ্টি খাইয়েছিল সবাইকে । অপরিমিতা একদিন লুচি পায়েস খাইয়েছিল ।
হিমালয় ক্লাস ইলেভেনে ভর্তি হল । তার মাঝেই সে লুকিয়ে কবিতা লিখতে শুরু করেছে । হিমালয়ের বাবা একটি ওষুধের দোকানে কাজ করতেন । মোটামুটি ভাবে সংসার চলে যেত । সেখানে দাঁড়িয়ে একটা সরকারী চাকরী জুটলেও তা ছিল হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো । কিন্তু হিমালয়ের ইচ্ছে, সে সাংবাদিক হবে । তার জন্য তো কমার্স , সাইন্স, আর্টস লাগে না । চাই বুদ্ধি , সাহসিকতা , ঝরঝরে ভাষার দখল । যা হয়ত ওর ছিল ।
ছোট থেকেই গল্প বইয়ের প্রতি খুব টান, নেশাই বলা ভালো । লাইব্রেরি থেকে বিভিন্ন কবিতা, গল্পের বই নিয়ে আসত । একেকদিন দুপুর বেলায় চিলেকোঠার ঘরে অপরিমিতার সঙ্গে কবিতা, নাটক পাঠ, করত । মাঝে মধ্যে দুএকটা নিজের কবিতাও শোনাত ।
ওদের চিলেকোঠার ঘরটা ছিল পুরনো জিনিস পত্রে ঠাসা । ভাঙা চোরা আসবাবপত্র, অকেজ ঘড়ি , বর্ষার দিনে ঘুঁটে কয়লাও থাকতো এই ঘরে । আর কয়েক মাস পরপর একটা মেনি বিড়াল এসে বাচ্চা দিয়ে যেত । একটা ভাঙা চৌকীর পিছনে তার আস্তানা । বিড়ালের বাচ্চাগুলো মাঝে মাঝে আরশোলাদের সঙ্গে খেলা করত ।


অপরিমিতার ঠাণ্ডা হাত পড়তেই হিমালয়ের বেশ ভালো লাগল।  ঘামের একটা মিষ্টি গন্ধ হিমালয়ের নাকে আসছিল, এই প্রথম হিমালয়ের শরীরে কিছু অনুভুত হল । অপরিমিতার বুকের উপর হাত রাখল । পরম যত্নে সে তার ঠোঁটে ঠোঁট রাখল ।


“কিরে হিমালয় আজ স্কুল যাসনি!”
“না , কাল রোদ লেগেছিল খুব। জ্বর এসেছে ।”
“দেখি দেখি ।” অপরিমিতার ঠাণ্ডা হাত কপালে পড়তেই হিমালয়ের বেশ ভালো লাগল ।
“এখন একটু গরম । তেমন নয়, তা এই গরমে এই চিলেকোঠায় বসে আছিস কেন?”
“তোমার জন্য লাইব্রেরি থেকে শরৎচন্দ্রের উপন্যাস নিয়ে এসেছি।”
অপরিমিতা কেমন মন মরা হয়ে গেল । “ফেরত দিয়ে দিস । গল্পের বই পড়লে তোর বিনুদা রাগ করে ।”
“ওমা বিনুদা জানবে কি করে সে তো সারাদিন ঘরেই থাকে না । অফিস যায় তো।”
“শাশুড়ি মা বলে দেন।”
হিমালয়ের রাগ হয় – “বিনুদা আর দিনুদা এক সময় এই চিলেকোঠা ঘরেই লুকিয়ে লুকিয়ে কি সব বই পড়ত। অনেকবার চাইলেও আমাকে সে বইয়ের ভাগ দেয়নি।”
অপরিমিতা হেসে ফেলল –“বুঝেছি। ওই সব বই না পড়াই ভালো । আমাকেও পড়িয়েছিল কদিন । কিন্তু তোকে ওসব বই এখন দেওয়া যাবে না। তোর বিয়ের সময় দেবো ।”
“আমার দরকার নেই।”
“আচ্ছা তোকে কেওড়ার টক খাওয়াব । আমাদের সুন্দরবনে অনেক কেওড়া পাওয়া যায় । একধরণের ফল। কিন্তু আমি নিজেই কি আর সেখানে যাবো?”
“তোমার মা বাবার জন্য মন খারাপ করবে না ?
“মা কে মনে পড়ে না। মা নদীতে মীন ধরতে যেত। মীন মানে জানিস?”
“জানি চিংড়ির বাচ্চা।”
“এই মীন বিক্রি করেই অনেকের সংসার চলে । তবে অনেক বিপদ । সে বছর মাকে কুমীরে নিয়ে গেল । আমি তখন খুব ছোট । পারে বসে নাকি খেলছিলাম । মায়ের মুখ এখন মনে পড়ে না । বাবাও এখন বেঁচে নেই । কাকাদের কাছে থাকতাম । তোর বিনুদা অফিসের কাজে গেছিল আমাদের গ্রামে । কয়েকদিনের আলাপে আমার প্রেমে পড়ল । বাড়িতে জানাজানি হল । কাকারা আমায় এক বুড়োর সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়ে ছিল । অনেক টাকা পেত।”
“বিয়ে দিত , না বিক্রি করে দিত?”
অপরিমিতা হাসল – “এরকম বিয়ের নাম করে সুন্দরবনের কতো মেয়ে রাতারাতি বিক্রি হয়ে যায়। তোর বিনুদা আমায় নিয়ে পালিয়ে এলো। আমরা কালীঘাটে বিয়ে করলাম।”
“তোমাদের গ্রামে নিয়ে যাবে আমায়?”
“আমাদের গ্রামটা তোদের শহরের মতো নয়রে । মাটির রাস্তা , মাটির ঘর । নদীর উঁচু পার ধরে হেঁটে যাওয়া যায় অনেকদূর । জোয়ারে মাতলা নদীর জল একদম নদীর ঘাট পেরিয়ে চলে আসে । ভাঁটাতে নদীর জল নেমে যায় পাঁক জেগে ওঠে। গাছের শ্বাসমূল দেখা যায়।”
“সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট , পড়েছি আমি।” হিমালয় ভীষণ বিজ্ঞের মতো বলল । “তুমি কখনো রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার দেখেছ ?”
“আমাদের গ্রামে বেশিরভাগ মানুষ জঙ্গলে যায় মধুর খোঁজে আর খাঁড়িতে কাঁকড়া শিকারে । বাঘের দেখা পায়নি এমন লোক কম । আমাদের গ্রামেও ভরা বর্ষাতে মাঝে মাঝে বাঘ চলে আসত । গরু বাছুর উঠিয়ে নিয়ে গেছে । সুন্দরবনের বাঘ খুব ভালো সাঁতার জানে । কয়েক মিনিটেই ওপারের জঙ্গল থেকে মাতলা নদী পেড়িয়ে আমাদের মাধবপুরে । সেবার জানলা দিয়ে দেখেছিলাম , বাপরে কি ভয়ানক।”
অপরিমিতা হঠাৎ চুপ করে গিয়ে থম মেরে বসে পড়ল ।
“কি হল তোমার ? গ্রামের কথা মনে পড়ছে?”
“না , বাবা তার পরের বছর কাঁকড়া ধরতে গেছিল নদীতে । জঙ্গলের ভিতরে সরু খাঁড়ি ধরে অনেক ভিতরে চলে গেছিল । আরও দুজন ছিল । বাবা বসে ছিল নৌকোর মধ্যেখানে । বাঘ এসে এমন অতর্কিতে আক্রমন করল । ঘাড় কামড়ে জঙ্গলে হিঁচড়ে নিয়ে গেল । অনেক খোঁজার পর আধ খাওয়া দেহটা পাওয়া গেছিল ।খুব রাগ হয়েছিল বনবিবির উপর । আমরা বনবিবির পুজো করি , তার ভরসায় জঙ্গলে যাই। সে কেন রক্ষা করবে না আমাদের বল তো?”
“বনবিবি কে?”

অলঙ্করণ: দেব সরকার

“ওমা তুই বনবিবিকে জানিস না ? বনবিবিকে সুন্দরবনের সবাই খুব মানে । যারা কাঁকড়া ধরতে যায় , বনে মধু সংগ্রহে যায় , তারা সবাই আগে বনবিবির পুজো করে তারপর বনে যায় । দক্ষিন রায়ের হাত থেকে তো বনবিবি রক্ষা করবে । আচ্ছা তোকে একদিন বনবিবির গল্পটা বলব।”
“দক্ষিন রায় কে?”
অপরিমিতা হেসেই অস্থির “হালুম,বাঘ মশাই।”
গল্পে গল্পে খেয়াল ছিল না কখন চারিপাশটা অন্ধকার নেমেছে । গরমের মধ্যে দুজনেই ঘেমে ভুত । অপরিমিতার ঘামের একটা মিষ্টি গন্ধ হিমালয়ের নাকে আসছিল – কি মেখেছ গো এতো সুন্দর গন্ধ ?
“তোর বিনুদা নিয়ে এসেছে , আতর । কানের পাশেও মেখেছি । তুই এতক্ষনে গন্ধ পেলি ?
খুব কাছে সরে এলো অপরিমিতা । হিমালয়ের নাকের কাছে নিজের কানের পিছনের অংশটা এগিয়ে দিল।”
এই প্রথম হিমালয়ের শরীরে কিছু অনুভুত হল । রোমকূপ খাড়া হয়ে গেছে , অপরিমিতাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হল । এবং সে ইচ্ছেকে কিছুতেই অবদমিত করতে পারল না । অপরিমিতার বুকের উপর হাত রাখল । কিন্তু কি আশ্চর্য অপরিমিতা রাগ করল না । পরম যত্নে সে তার ঠোঁটে ঠোঁট রাখল । অনেক্ষন পর্যন্ত হুশ ছিল না হিমালয়ের । এতো অস্থির আগে হয়নি কখনও । তবে নিজেকে সেদিন অপরাধি মনে হয়েছিল ।

আর কখনও বনবিবির গল্প শোনানোর সময় হয়নি অপরিমিতার । কারন সেদিনের দৃশ্যটা মা দেখে নিয়েছিল । হিমালয় মায়ের নজর এড়িয়ে আর কখনই অপরিমিতার সঙ্গে দেখা করতে পারেনি । মাঝে মধ্যে ভদ্রতার খাতিরে দু চারটে কথা হয়েছে । হিমালয়ও যেন পালিয়ে বেড়াচ্ছিল অপরিমিতার থেকে, নিজের থেকে । ক্রমশ পড়ার চাপ বেড়েছে । অপরিমিতাকেও মেয়ের মা হতে দেখেছে । একটা সুন্দর বন্ধুর সম্পর্ক থেকে দুজনেই কেমন ছিটকে গেছিল । বলা চলে স্রোতের টানে দুজনেই গা ভাসিয়েছিল । অপরিমিতা সংসারের টানে ভেসে গিয়েছিল । হিমালয় নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিল । ততদিনে বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিনে কবিতা, গল্প লিখতে শুরু করেছে ।
হিমালয় কলেজ থেকে বেরোতেই দেখল অপরিমিতা রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে । হিমালয় কাছে আসতেই একটা পত্রিকা এগিয়ে দিয়ে বলল – বাংলার সব থেকে নাম করা পত্রিকাতে তোর গল্প বেড়িয়েছে । আমাকে একবার বললি না ? হিমালয় চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল, কি বলবে ভেবে পেল না । অপরিমিতা যাওয়ার সময় শুধু বলে গেল – একদিন খুব বড় লেখক হবি । আমাকে মনে না রাখলেও চলবে । শুধু তোর যখন প্রথম গল্পের বই বেরোবে, আমাকে সেই বইটা সই করে দিবি । কিছুটা এগিয়ে আবার ফিরে এসেছিল, চোখে চোখ রেখে বলেছিল –কখনও কোন পরিস্থিতিতে পালিয়ে যাবি না । যে পালিয়ে যায় তাকে কাপুরুষ বলে। অপরিমিতা কি হিমালয়কে কাপুরুষ বলেছিল !
কলেজ পাশ করে খুব তাড়াতাড়ি সংবাদপত্রের দফতরে চাকরিটা পেয়ে গিয়েছিল হিমালয় । অপরিমিতা তখন দুই বাচ্চার মা , গর্ভে আরেকটা বেড়ে উঠছে । হিমালয়রা তার পরে পরেই সেই বাড়ি ছেড়ে ছিল । অফিসের কাছেই একটা ফ্ল্যাট কিনে চলে এসেছিল ।
ততদিনে দিনুদাও বিয়ে করেছে । পরিবার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুই ভাইয়ের মতানৈক্য বেড়েছে । হিমালয়দের সঙ্গেও ওদের যোগাযোগ ক্রমশ আলগা হতে হতে, একসময় ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল । মধ্যে একবার শুনেছিল ওরা বাড়ি, জায়গা প্রমোটারকে বিক্রি করে দিয়েছে । “ওখানে একটা মস্ত কমপ্লেক্স গড়ে উঠেছে ।” বাবার মুখে কথাগুলো শুনেছিল হিমালয় । তাও প্রায় পঁচিশ বছর হয়ে গেল । হিমালয়ের বাবা, মা দুজনেই ইতিমধ্যে মারা গিয়েছেন । ফলে কেউ আর বিনুদের বাড়ির কথা বলে না । অপরিমিতা এখন একটা হারিয়ে যাওয়া নাম । এত বছর পর শুধু একটা বিজ্ঞাপন সব মনে করিয়ে দিল ।
“কি হল বাবা , এতক্ষণ বাথরুমে কি করছ ? শরীর খারাপ লাগছে ?” অনেক্ষন ধরে বাথরুমের দরজা ধাক্কাচ্ছে পিকু ।
হিমালয় চোখে মুখে জল দিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো – “না রে, তুই শুয়ে পর ।”

বিছানায় শুয়েও ঘুম এলো না হিমালয়ের । নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলছিল – অপরিমিতা নামটা , চেহারাটা অবচেতনে তার মনেই কোথাও লুকিয়ে ছিল । তাই কি উপন্যাস লিখতে গিয়ে ছোট ছোট ঘটনা উঠে আসছে !
এখনও শহীদ নগর কলোনির সেই ভাড়াবাড়ির অপরিমিতা তাকে টানছে! সেই বাড়ি আর নেই , অপরিমিতা নিরুদ্দেশ । তবু এতো বছর পর যদি তার অস্তিত্বের ঘ্রান পাওয়া যায়…

আজ ট্যাক্সি করে ফ্লাইওভার দিয়ে উড়ে , বাইপাশ ধরে পৌঁছে গেলেন ঢাকুরিয়ার সেই কমপ্লেক্সের সামনে । আগে সে এখানে আসে নি কখনও । পেপারে বিজ্ঞাপন থেকে ফোন নম্বর কালেক্ট করে নিয়েছিলেন । ফোনে হিমালয় একটু ইতস্তত করে বলল – “অপরিমিতা চৌধুরী।“
কথাটা পুরো শেষ করার আগেই ছেলেটি ফোনের অপর প্রান্ত থেকে চিৎকার করল –“মা’কে কী পেয়েছেন ?”
হিমালয় বুঝল , অপরিমিতার ছেলে ফোন ধরেছে । একটু থেমে বলল – “না , আমি কি বিনুদার সঙ্গে কথা বলতে পারি?”
কিছুক্ষন কোন আওয়াজ এলো না । তারপর , একজন বয়স্ক গলার আওয়াজ পাওয়া গেল – “কে বলছেন ?”
হিমালয়ের মনে হল বিনুদাই ফোনটা ধরেছে “বিনুদা আমি হাবু । চিনতে পারছ?”
“হ্যাঁ ,হাবু। তোকে চিন্তে পারব না?”
“বিনুদা আমি তোমাদের কমপ্লেক্সের সামনে দাঁড়িয়ে । কোন ব্লকটা তোমাদের জানিনা । আমাকে ফ্ল্যাট নাম্বার বল ,আমি আসছি।”
“ও তাই ? আমি ছেলেকে পাঠাচ্ছি।”

হিমালয় ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখল , বেশ সাজানো গোছানো ফ্ল্যাট । চারিদিকের কারুকাজ দেখে বোঝা যায় দক্ষ ইন্টেরিওর ডিজাইনার দিয়ে ডেকরেট করানো। বসবার ঘরে কাঠের কারুকাজ করা সোফা । নিপেন্দ্র সরকারের সেই ভাড়াবাড়ির কোনো ছাপ বিনুদার সংসারে পড়েনি ।
বিনুদা হিমালয়কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল – “তোর বৌদি যে কোথায় চলে গেল?”
“খবরটা পড়লাম পেপারে । বিজ্ঞাপন দিয়েছ তো ‘সন্ধান চাই’ বলে ।”
টিভিতে কোন এক খবরের চ্যানেল ধরা । বিনুদা টিভির সাউন্ড কমিয়ে , মাথায় হাত দিয়ে বসে পরল ।
“বিশ্বাস কর , কোনো জায়গায় খুঁজতে বাকি নেই । কথাগুলো বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল বিনুদা আর অপরিমিতার বড় ছেলে ‘পিন্টু’।” হিমালয় সেদিকে তাকিয়ে কি বলবে ভেবে পেল না । পিন্টুকে দেখেছে সেই পাঁচ বছর বয়েসে । এখন চেনা যায়না । বেশ ভারিক্কি এসেছে চেহারায় । কিন্তু পিন্টু মনে হয় ঠিক চিনতে পারেনি হিমালয়কে । – “বিনুদা ঘরে কি কিছু হয়েছিল ?”
– “ তেমন কিছু নয় । দেখ মেয়েদের বিয়ে দিয়েদিয়েছি । ছেলেটা কন্টাক্টারি ব্যবসায় ভালোই দাঁড়িয়েছে । দুবছর হল বিয়ে করেছে । বৌমা সরকারি ব্যাঙ্কে চাকরি করে । পিন্টু চেয়েছিল বাইপাশের ধারে একটা ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট নেবে । বুক করে এসেছে । তা বৌমা তার মন মতো তৈরি করাচ্ছে । হাসির মর্জি না থাকলেও যেতে রাজি হয়েছিল । ওর ঘরে একটা বড় ট্রাঙ্ক আছে । তার মধ্যে রাজ্যের ছেঁড়া বই , কাগজগুলো হলুদ হয়ে গেছে । পুরনো বাড়িতে থাকতে কিছু কাগজে উই লেগে গেছিল । ওগুলোও ফেলেনি । বৌমা বলেছিল ওগুলো নিয়ে যেতে হবে না । বরং ওকে একটা লাইব্রেরী করে দেবে । বই পড়তে খুব ভালোবাসে তো ।আমি অবশ্য বিয়ের পর এসব নিয়ে মাঝে মধ্যে রাগারাগি করেছি ।কিন্তু এখন কিছু বলতাম না । নতুন ফ্ল্যাটে ওই উইয়ে ধরা , ছেঁড়া খোঁড়া বই নিয়ে যাবে কেন ? তা এই নিয়ে কিছুদিন আগে একটু কথা কাটাকাটি হয় । কিন্তু তার জন্য কি ওভাবে কেউ বাড়ি ছেড়ে চলে যায় ?”
হিমালয়ের মনে হল সত্যি এরকম ভাবে তো কেউ যায় না ।-“সুন্দরবনে একবার খোঁজ নিয়েছিলে?”
বিনুদা ধরা গলায় বললেন – “আর কোথায় খোঁজ নেবো হাবু ? বিয়ের পর সেই যে এসেছিল আর তো কোনোদিন যায়নি । কোন আত্মীয়র সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল না । আর শুনেছি সে গ্রামও আর নেই । মাতলায় তলিয়ে গিয়েছে । সেখানের মানুষ কোথায় তাও জানিনা ।হাবু , কোথায় যেতে পারে বলে মনে হয় তোর ?থানা পুলিশ সব করেছি । কেউ কিছু বলতে পারছে না । প্রায় ছমাস হল । হাবু তুই তো কাগজে কাজ করিস । তোদের ওখানে বিজ্ঞাপন দিলে খুঁজে পাবো ?”
হিমালয় কি জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারল না ।
– “বৌমা অফিস থেকে ফেরেনি এখনও।সারাদিনের জন্য একটা মেয়ে থাকে ।দাঁড়া চা করতে বলি।”
– “না বিনুদা , অন্যকোনো দিন । দরজার কাছে এসে কি মনে হতে বলল – বিনুদা , আমি কি ওই ট্রাঙ্কটা একবার দেখতে পারি ?”
– “হ্যাঁ , নিশ্চই । পিন্টু যা একবার তোর মায়ের ঘরে নিয়ে যা ।”
ঘরটা খুব পরিপাটি করে সাজানো । খাটের উপরেও কিছু বই , কাগজ ।খাটের পাশেই একটা বড় ট্রাঙ্ক । তার ঢাকনাটা খুলতেই তার মধ্যে সারি সারি বই আর পত্রিকা । হিমালয় কিছুক্ষন নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল । বইগুলো সব হিমালয়ের লেখা । গল্প , উপন্যাস , কবিতা , প্রবন্ধের বই । আরও ঘাঁটতেই কতো পুরনো পত্রিকা । সেই কলেজ জীবনে এসব পত্রিকায় কবিতা লিখেছে ।এখন তো আর কবিতা লেখা হয় না ।কিন্তু যেখানে যা বেড়িয়েছে, বইয়ের সমালোচনা , সাক্ষাৎকার , ভ্রমন , বলা চলে হিমালয় এখনও পর্যন্ত যে টুকু লিখেছে , সব টুকু লেখক জীবন অপরিমিতা তার ট্রাঙ্কে বন্দী করেছে। খুব গরম লাগছে , অস্থির লাগছে – “পিন্টু একটু জল খাওয়াবে ?”
“আনছি।”
হিমালয় অবাক হয়ে যায় , তার বাড়িতেও মনে হয় সব লেখা নেই । এতো যত্ন করে তার লেখা কেউ কখনও রেখে দেয়নি । যত্ন করে কোন জিনিস আগলে রাখতে পারে না হিমালয় ।
মনে পড়ল প্রথম বইটা সই করে পাঠাতে বলেছিল অপরিমিতা । কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি । তবে বই প্রকাশ হওয়ার পরে পরেই প্রকাশকের দপ্তর থেকে ফোন এসেছিল , কয়েক কপি সই করে যাওয়ার জন্য । নিয়মিত লেখালেখির জন্য তখন কিছু পাঠক হয়েছে ।অপরিমিতা কি সেই সই করা বই পেয়েছিল ?
তন্ন তন্ন করে খুঁজেও হিমালয় তার প্রথম গল্পের বই পেল না । সব কিনেছে অপরিমিতা কিন্তু হিমালয়ের প্রথম বই কেনে নি ?হয়ত হিমালয়ের উপর অভিমান করে ওই বইটা পড়েনি কোনোদিন ! প্রতিটা উপন্যাস রয়েছে । প্রতিটা শারদ সংখ্যা রয়েছে । সেখানে প্রকাশিত উপন্যাস , বই আকারে বেড়িয়েছে সেই সব বই অপরিমিতা যত্ন করে রেখে দিয়েছে ।কিন্তু কেন প্রথম বই পড়েনি অপরিমিতা ? এতো অভিমান ?
পিন্টু জল নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে – “আপনার জল ।মা আপনার গল্প পড়তে খুব ভালবাসত।”
হিমালয় মাথা তুলে তাকাল , মনে মনে ভাবল – “আমি শুধু জানলাম না সেই ভালবাসার কথা।”

এক নিশ্বাসে গ্লাসের জল শেষ করে বেরিয়ে এলো রাস্তায় । এখন দিন ছোট , রাত বড় হয়ে গেছে ।তাই তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নেমে এসেছে ।রাস্তায় একটা খালি ট্যাক্সি পেয়ে উঠে পড়ল ।আজ নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে । সেদিন চিলেকোঠার ঘরে যেটা হয়েছিল , বয়েস বাড়লে মনে হয়েছিল সেটা পাপ ছিল না । দুজনের আবেগের থমকে যাওয়া মুহূর্ত ছিল । মুহূর্তরা তো এভাবেই আসে আর যায় ।

♦•♦♦•♦♦•♦


চরিত্র এবং ঘটনা কাল্পনিক । বাস্তবের সাথে এর কোন মিল নেই, কেউ যদি মিল খুঁজে পান তাহলে তা অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয় ।



❤ Support Us
error: Content is protected !!