Advertisement
  • খাস-কলম
  • মে ২৯, ২০২০

তবুও তাঁদের ফিরতে হবে

তবুও তাঁদের ফিরতে হবে

একতলার উপরে পাঁচ ইঞ্চি ইটের গাঁথুনি। নিলটন পর্যন্ত হয়ে আকাশের দিকে হাঁ করে আছে। বাপ ঠাকুরদার সময়ে কী আর ছিল? এই আড়াই কাঠা ভিটের ওপর খড়ের বাড়ি আর তার গা-গতরের হাড় মাংসটুকু ছাড়া? ভিনরাজ্যে খেটে সেই কাঁচা বাড়ির জায়গায় এখন পাকা বাড়ি। মোজাইক করা বাথরুম পায়খানা। এবার কেরল থেকে ফিরলেই দোতলার ছাদটা ঢালাই করত আবেদ সেখ। মুর্শিদাবাদের বেলডাঙ্গার বাসিন্দা রাজমিস্ত্রি আবেদ এখন তিরুবন্তপুরমে আটকে। অনেক চেষ্টা করেও ফেরার টিকিট জোগাড় করতে পারেনি। বাড়িতে সমত্ত বোন। বিয়ের জন্যে দোপ হয়ে উঠেছে। কন্যাশ্রীর টাকাটা পেলেই পাত্রস্থ করবে। একটা মেয়ের বিয়েতে কম খরচ! ঘর মাঠান ফতুর হয়ে যায়। মাথা থেকে বোনের বোঝাটা নেমে গেলেই নিজের বিয়ের কথা ভাববে। আর সে মহৎ উদ্দেশ সাধন করার জন্যেই সুরাট খাটতে গিয়েছিল ডোমকলের সামসুল আলি। কাপড়ের ফ্যাক্টরিতে কাজ করা সামসুল তখন সরকারের বিশেষ ‘শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন’এ। হাত প্রায় নিঃস্ব। যা টাকাকড়ি ছিল লকডাউনের এই উনপঞ্চাশ দিনে খেতেই ফুরিয়ে গেছে। বাড়ি ফেরার ট্রেন পাওয়ার ব্যাপারে সামসুল ছলছল চোখে বলছিল, যখন ট্রেনটা চোখের সামনে দেখলাম তখন মনে হচ্ছিল আমার সামনে জান্নাত দাঁড়িয়ে আছে। হরিহরপাড়ার আব্দুলপুর গ্রামের রাজমিস্ত্রির জোগাল আনারুল সেখ আবার অন্য পাঁচজনের সঙ্গে লক্ষাধিক টাকা ব্যায়ে ব্যক্তিগত গাড়ি ভাড়া করে সড়ক পথে বাড়ি ফিরে এখন সরকারের কিষাণমাণ্ডিতে চোদ্দ দিনের কোরায়েন্টাইনে। আবেদ আনারুলরা না হয় থড় বড় খাড়া করে বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু কত হাজার হাজার আবেদ আনারুল এখনও রাজপথে হাঁটছেন তার ইয়াত্তা নেই! কেউ রেলপথ ধরে কেউবা জাতীয় সড়ক ধরে। বাড়ি ফিরবে কি না তার নিশ্চয়তা নেই। গ্রামের বাড়িতে গভীর উৎকণ্ঠায় রয়েছেন নিকটজন। ছেলে বউ বাচ্চা। মায়ের কোল হা হা করছে।

কত হাঁটার ছবিই দেখছি আমরা। গর্ভে সাত মাসের বাচ্চা নিয়ে হাঁটছেন মা। কেউ কেউ আবার এই রাজপথেই সন্তান প্রসব করছেন। বাবার কাঁধে ছেলে। কাঁধে পিঠে করেই দিয়েছেন লম্বা হাঁটন। আবার উত্তরপ্রদেশে শ্রমিকদের ওপর কীটনাশক স্প্রে করার ঘটনা বা মহারাষ্ট্রের ওরাঙ্গাবাদের রেললাইনে ঘুমিয়ে পড়া ক্লান্ত শ্রমিকদের মালগাড়ির চাকায় নির্মম মৃত্যু আমাদের ব্যাথাতুর করে তুলেছে।

এভাবেই রক্ত পানি করে শহর নগর গড়া মানুষগুলো কেউ বাড়ি ফিরেছেন কেউ বাড়ি ফিরছেন আর কেউ এখনও ভিনরাজ্যে আটকা পড়ে আছেন আবার কেউ চিরতরে এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। আর কিছুদিন গেলে ভারতের মেট্রপলিটন মহানগরগুলো শ্রমিকহীন হয়ে যাবে। এখন দুনিয়াজুড়ে মহামারি চলছে। মানুষ চাইবেন তার নিকটজনের কাছে ফিরতে। এটাই স্বাভাবিক।


আসল ব্যাপার হল জানের থেকেও এখানে পেট বড় কথা। রুটি রুজি না হলে যে এমনিতেই না খেয়ে মরতে হবে। শ্রমিকরা বলছেন, রোগ ব্যাধি বালা মুসিবত সমাজে থাকবে তাই বলে হাত গুটিয়ে তো আর বাড়িতে বসে থাকা যায় না?


ভিনরাজ্য থেকে ফিরে আসা শ্রমিকরা এখন দোলাচলে। বাড়ি তো ফেরা গেল। কিন্তু আগামী দিনে রুজির কী হবে? আবার কি পুরোনো কাজে ফেরা যাবে? সেসব কাজ কি আর হবে? এই অসম্পূর্ণ বাড়িঘর কি আর সম্পূর্ণ হবে? মোদ্দা কথা করোনা থেকে জানে বাঁচলেও পেটের খিদে থেকে কী করে বাঁচব? নিজ রাজ্যে সেরকম কাজ কোথায়? বাপঠাকুরদার জমিজমা ভাগ ভাগ হতে হতে পাঁচ কাঠা দশ কাঠায় পরিণত হয়েছে। তাতে আর কতটুকু আবাদ হবে? মা বাপ বউ বাচ্চা এতগুলো পেটের খাবারের সংস্থান কি ওই মাঠান জমি থেকে হবে? হবে না। ব্যবসাপাতি করবে তার জন্যেও তো মূলধন প্রয়োজন। তাছাড়া শহরের বড়বড় বাতানোকুল শপিংমলের চাপে গ্রামগঞ্জের ছোটখাট দোকানগুলোরই তো হাঁসফাঁস অবস্থা। ধুকধুক করে ধুঁকছে। সেখানে আরও গুচ্ছের ছোট দোকান! এসবে এত লক্ষ শ্রমিকের রুজির সংস্থান হবে না। তার জন্যে দরকার বড় বড় শিল্প। নতুন নতুন কাজের সুযোগ। সেসব তো এখন দূর অস্ত। অনেকেই বলছেন, সরকারের বিনি পয়সায় দেওয়া রেশন বন্ধ হয়ে গেলে সামজে অপরাধ বাড়বে। চুরি ডাকাতি খুন ছিনতাই বাড়বে। কিন্তু ভিনরাজ্য ফেরত শ্রমিকরা অন্য কথা বলছেন।

রেজিনগরের বাসিন্দা পেশায় রাজমিস্ত্রি হালিম বিশ্বাস বললেন, আমরা বাইরে যাবার জন্যে মুখিয়ে আছি। ভিনরাজ্যে খেটেই তো সংসারে কিছুটা সুখ এসেছে। দস্তুরপাড়ার বাসিন্দা নাসিরুল যেমন পাঞ্জাব থেকে বাড়ি ফেরেনি। একটা কারখানায় কাজ করে। তার এখনও কাজ চলছে। সে জানিয়েছে, বাড়ি ফিরে তো সেই বেকার হয়েই বসে থাকতে হবে। তার চেয়ে যেহেতু এখানে কাজ হচ্ছে তাই থেকেই গেলাম। অনেকেরই মন পড়ে আছে কাজের জায়গায়। অধীর অপেক্ষায় এই দুঃসঙ্কট কাটলেই আবারও কাজের জায়গায় ফিরে যাবে। আসল ব্যাপার হল জানের থেকেও এখানে পেট বড় কথা। রুটি রুজি না হলে যে এমনিতেই না খেয়ে মরতে হবে? তারা বলছেন, রোগ ব্যাধি বালা মুসিবত সমাজে থাকবে তাই বলে হাত গুটিয়ে তো আর বাড়িতে বসে থাকা যায় না? তাদের হক কথা, কাজ পেলেই তারা আবারও ভিনরাজ্যে পাড়ি দেবেন। আবারও কেরালা মুম্বাই ব্যাঙ্গালোরের ট্রেন ধরবেন। তা না হলে দেশ গড়বে কারা? এই শ্রমিকরাই যে আসল দেশ গড়ার কারিগর। ওই তো ডাকছে কোভালম সমুদ্র সৈকত, আরবসাগর, আগ্রা চণ্ডীগড়। হাতে গড়া মহানগরের অসম্পূর্ণ আবাসন। ফ্লাইওভার। ফ্লাটবাড়ি। দেশের সোনালি চতুর্ভুজ।


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!