Advertisement
  • পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ স্মৃ | তি | প | ট
  • জুন ১৬, ২০২৪

সকল স্বপন তুমি ভরিবে সৌরভে

সত্যম রায়চৌধুরী
সকল স্বপন তুমি ভরিবে সৌরভে

পুকুরে ঢিল ছুড়ে গোল গোল বৃত্ত তৈরির খেলা কে না খেলেছে জীবনে ! আমিও খেলেছি। কিন্তু সে বৃত্ত যে জীবন জুড়ে ছড়িয়ে যাবে, কে ভেবেছিল? তখন আমার একুশ । সেদিন, বড়দির বাড়িতে গৃহপ্রবেশ। বড়দি টিউশন পড়াত, যে কোনো উপলক্ষে কিশোরীদের ভিড় হতো ওর বাড়িতে। সেদিনও তা-ই ছিল। আমরা ক’জন বন্ধু আর কয়েকটি চোদ্দো-পনেরো বছরের উচ্ছল মেয়ে পুকুরধারে দাঁড়িয়ে ঢিল ছুড়ছিলাম জলে। কার ঢিল কত বড়ো গোল তৈরি করতে পারে, সে কম্পিটিশন চলছিল। ওই উত্তেজনার মাঝখানে টের পেলাম, একটু অন্যরকম বুক ঢিপঢিপ, আলাদা শিহরন। ওই যে বড়ো বড়ো চোখের ফর্সা মেয়েটা, ও কি আলাদা চাউনি দিচ্ছে আমার দিকে? ভালো লাগার সে শুরু,আর টের পেলাম যখন রোজ সন্ধেবেলা পা টানত বারান্দার দিকে। তখন আমি আর দাদা হুগলিতে কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার খুলেছি। টেকনো ইন্ডিয়ার আরম্ভ সেখান থেকেই। দু’কামরার সে বাড়ির সামনে দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে টিউশনি থেকে ফিরত মৌ। ওকে একঝলক দেখার ইচ্ছেটা নেশার মতো ঘোরে রাখত সারাদিন। বাপি বলে মৌয়ের এক সম্পর্কিত দাদা ছিল আমার সান্ধ্য বারান্দার বন্ধু। ওই বয়সে একবার প্রেমে পড়া মানেই সারাক্ষণ বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা। আমার অস্থিরতা আঁচ করে একদিন বাপি চ্যালেঞ্জ করল, ‘পারবি না রে, পারবি না। শক্ত জায়গা।’ আমি সঙ্গে সঙ্গে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম। বাজি হলো, যে হারবে সে গোঁফ কেটে ফেলবে। বলা বাহুল্য, বাপিদা হারল। আজ মনে হয়, আমার নিশ্চয় যথেষ্ট কনফিডেন্স ছিল, তা না হলে সাধের গোঁফ বাজি রাখে কেউ!

তারপর তো ভরপুর অনুরাগ পর্ব। সে আটের দশকে আজকের মতো হাইটেক প্রেম ছিল না। কোথায় মোবাইল, কোথায় হোয়াটসঅ্যাপ, কোথায় ভিডিও কল? চিঠিই ছিল ভরসা। কম্পিউটার সেন্টারের ছেলেরা একটা মেসে থাকত, সেখানকার বাবলুর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল। সে বইয়ের ভাঁজে করে চিঠি নিয়ে যেত মৌয়ের কাছে, বাড়িতে ধরা পড়ার ভয়ে মৌ সেসব চিঠি রাখত ওর স্কুলের বন্ধু পাপিয়ার কাছে। পরে এক বিবাহবার্ষিকীতে সাজিয়ে-গুছিয়ে সেসব চিঠি আমাদের উপহার দিয়েছিল বন্ধুরা। সঙ্গে মজার সব ফুটনোট। মৌ চলে যাওয়ার পর বাবলু এল যেদিন, ওই চিঠির ঝাঁপি খুলে বসেছিলাম। পড়ছিলাম আর চোখের সামনে সিনেমার মতো ভেসে আসছিল কত ঘটনা, মান-অভিমান, কান্না-হাসির কত ব্যাকুল প্রকাশ। আহা, এমন ছেলেমানুষির নানা রঙের দিনগুলো কোথায় যে হারিয়ে যায়!

প্রেমের সঙ্গে যে বাইকের কী অসাধারণ সম্পর্ক, সেটা কে না জানে। আমার সেসময় বাইক ছিল। অতএব চান্স পেলেই ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ স্টাইলে দিল্লি রোড ধরে ছোটা, ধাবায় মৌয়ের প্রিয় ডিম ভুজিয়া আর দুধ চা। আমার আবার ক্যামেরাও ছিল। তাই পথের মাঝখানে বাইক দাঁড় করিয়ে যখন তখন ফটো তুলতাম। কখনো আবার লুকিয়ে-চুরিয়ে চন্দননগরের স্টুডিওয় ছবি তুলতে যেতাম। তিন কপি, দু’জনের দুটো আর তৃতীয়টা আমার পার্সে। কারণে-অকারণে পার্স খুলে লোককে দেখানো, আমার আছে এক সুন্দরী প্রেমিকা। এই তো জীবন! আর কী চায় এক মধ্যবিত্ত তরুণ ?

একদিন এক কাণ্ড ঘটল। ডিম ভুজিয়া খেয়ে বাইকে স্টার্ট দিয়েছি, জানি মৌ পিছনে বসে আছে। বাড়ি এসে দেখি নেই। আমার তো দিশেহারা অবস্থা। এই যে এত বকবক করতে করতে এলাম সারাটা রাস্তা, মৌ যে জবাব দিচ্ছে না, খেয়াল করিনি ? নিজের ওপর ভীষণ রাগ হল! তবে কি পড়ে গেল বাইক থেকে? প্রবল দুশ্চিন্তা নিয়ে চললাম উল্টোপথে। গিয়ে দেখি এক কাপ চা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। রেগে কাঁই। ও যে ওঠেইনি বাইকে, সেটা আমি খেয়াল করলাম না কেন? মানভঞ্জন কীভাবে করেছিলাম, সেটা আর বলছি না। আর একপ্লেট ডিম ভুজিয়া খাওয়াতে হয়েছিল।

এক সময় দর্শনের আশায় পথের ধারে বসে থাকার দরকার পড়ত না। আমি টিউশন পড়াতাম বাড়িতে। মৌ আসত পড়তে। মা খুব ভালবাসত ওকে। বাবা হয়তো বাগান করছেন, মৌ ঢুকলেই মাকে বলতেন, ওই এসে গেছে তোমার মৌমাছি। ছাত্রীর পড়ায় যত না মন, তার থেকে বেশি মন মাস্টারে। মাধ্যমিকে মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করল। আমি তো ছুতো খুঁজছিলাম। ভালো ঘড়ি কিনে হাজির ছাত্রীর বাড়িতে। ছাত্রী আহ্লাদে আটখানা, আমাদের এসব দুঃসাহস দেখে মায়ের ভুরু কুঁচকে গেল !

কত কী মনে পড়ছে। আসলে এক জীবনের গল্প বলতে বসলে একটা জীবন সময়ও যেন যথেষ্ট নয়। টুকরো টুকরো স্মৃতির মালা। লিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। তাই কয়েকটি ‘ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী, একা একা করি খেলা।’

 

বটতলা নয়, প্রেমনগর

লোকে ওই নামেই ডাকত চুঁচুড়ার গঙ্গার ঘাটে বটতলাকে। একদিন বসে আছি মৌকে নিয়ে, এক বৃদ্ধ বাদামওয়ালা এসে হাজির। বাদাম তো কিনলাম। কী যে মনে হলো, কিছুটা ব্যঙ্গের সুরে জিজ্ঞেস বললাম, কী করলেন সারা জীবন ? বাদাম বেচেই কাটিয়ে দিলেন? দাদু হতাশ গলায় বলল, কী আর করব বাবা ? এভাবেই চলতে হবে। সে যাওয়ামাত্র মৌ ছুড়ে ফেলে দিল বাদামের ঠোঙা। এত রেগে গেছে, এত কষ্ট পেয়েছে বুঝিনি। জলভরা চোখে আমাকে বলল, ‘এরকমভাবে বললে তুমি? নিজে কী করো?’ সত্যি, তখন আমি টিউশন ছাড়া আর কিছুই করি না। খুব খারাপ লাগল। সঙ্গে ওইটুকু প্রেমিকার কাছ থেকে বড়ো শিক্ষা পেলাম। প্রতিজ্ঞা করলাম, জীবনে জেনেবুঝে কাউকে আঘাত করব না। ওই ছোট্ট ঘটনা থেকে একটা জেদও চাপল আমার, কিছু করে দেখাতে হবে।

 

পরিমলের ভেলপুরি

সে স্কুলে পড়ার সময় থেকে মৌয়ের প্রিয় খাবার ছিল পরিমলের ভেলপুরি। চুঁচুড়ায় গেলেই মাঠে ঘুরতে যাওয়া লেগে থাকত, আর পরিমলের ভেলপুরি খাওয়া চাই। কলকাতাতেও আনাত মাঝে মাঝে। এমন তৃপ্তি তখন তাঁর চোখেমুখে, লেগে থাকত যেন পৃথিবীর সেরা সুখাদ্য পেয়েছে।

 

৫ লক্ষের জীবন

একদিন হাঁটতে হাঁটতে মৌকে বললাম, যে করে হোক, পাঁচ লক্ষ টাকা জমাতে হবে। পাঁচ বছরে ডবল হবে, মানে বছরে ধরো এক লাখ টাকা। এটা হলেই কেল্লা ফতে। আমরা দু’জন শুধু দেশ-বিদেশ ঘুরব। ভাবা যায়, টার্গেট ৫ লক্ষ ! এখন ভাবলে যে কারও হাসি পাবে। কিন্তু সে আটের দশকে, প্রেমে হাবুডুবু দু’জন কত আকাশকুসুম কল্পনা করতাম পাঁচ লক্ষ টাকার কথা ভেবে।

 

রাজধানী মিস

দিল্লি হয়ে যাব শিমলা। রাজধানীর টিকিট কেটেছি। উত্তেজনার বশে হাওড়া, শিয়ালদা ব্যাপারটা খেয়াল করিনি। আমি আর মৌ বিকেল চারটের ট্রেন ধরব বলে হাওড়া পৌঁছে শুনি, আমাদের টিকিট ছিল শিয়ালদার, আর সে ট্রেন ছেড়ে গেছে সকালে। তা বলে কি শিমলা যাব না ? কোনো রকমে ম্যানেজ করে সন্ধের কালকা মেলের টিকিট কাটলাম। এসি টু টিয়ার। উঠে দেখি কী মজা ! আমরা দু’জন ছাড়া কেউ নেই। এক্সট্রা কোচ জুড়েছে কিনা শেষ মুহূর্তে। রাজা-রানির মতো চললাম। সারা কামরা ঘুরে ঘুরে নিজেরাই ঠিক করলাম, বেশ এটাই আমাদের বেডরুম, এটা ড্রইংরুম। সে কী আনন্দ !

 

নেতারহাটে নিশিযাপন

বিয়ের পর বন্ধুদের আর বউদের নিয়ে একটা দারুণ গ্রুপ তৈরি হলো। হইহই করে একসঙ্গে কত বেরিয়েছি । একবার গেছি নেতারহাট। বন্ধু গৌরবের হানিমুন ছিল। হোটেল-ফোটেল আগে থেকে বুক করার ব্যাপারই নেই। সন্ধেবেলা পৌঁছে দেখা গেল, কোনো হোটেলে ঘর নেই। খুঁজে পেতে ডাকবাংলো পাওয়া গেল একটা, টিনের ছাউনি দেওয়া। কুছ পরোয়া নেই। ঢুকে পড়লাম। মেঝেতে শোয়ার ব্যবস্থা। কেয়ারটেকার এবার যে বিছানা বার করল, সেটা তেলচিটে বললে কম বলা হয়। মৌয়ের সেসব দিকে নজরই নেই। ও ততক্ষণে কেয়ারটেকারকে দিয়ে চাল ডাল মুরগি আনিয়ে রান্নার তোড়জোড় করছে। রাতে শুতে গিয়ে মনে হলো, আরে, গৌরব আর তার বউকে তো আলাদা বিছানা দিতে হবে। হানিমুন বলে কথা ! সে না হয় হলো, কিন্তু শুয়েই দেখি, টিনের চালে হাজার ফুটো আর সেখান দিয়ে দিব্যি আকাশ দেখা যাচ্ছে। মৌ অবলীলায় বলল, আকাশই যদি দেখব, চলো সবাই মিলে বাইরে বারান্দায় বসি। তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে মৌ খোলা গলায় গান ধরল, ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে’। এমন কতবার যে মৌয়ের সঙ্গে চাঁদের হাসিতে ভেসে গেছি দেশে-বিদেশে।

ব্যাঙাই থেকে ব্যাঙ্কক

মৌয়ের আদি বাড়ি ব্যাঙাই বলে একটা গ্রামে। হুগলি জেলার শেষ গ্রাম। প্রথম আমাদের বিদেশ ভ্রমণ ব্যাঙ্কক। নেমেই মৌকে খেপাতে শুরু করলাম, এই যে ব্যাঙাই থেকে ব্যাঙ্কক এসেছে। পরে বহুবার থাইল্যান্ড গেছি মৌকে নিয়ে। একবার একটা সাঙ্ঘাতিক অভিজ্ঞতা হলো। আমরা যাব ফুকেতে, সঙ্গে আমেরিকা-প্রবাসী দেবাশিসদা আর মুনমুনদি। কলকাতা থেকে ব্যাঙ্কক এয়ারপোর্টে নামলাম, তিন ঘণ্টা পর ফুকেতের ফ্লাইট। মৌ হঠাৎ জেদ ধরল, ফুকেতে যাব না। এখুনি গাড়ি নিয়ে পাটায়া চলো। মৌয়ের খুব প্রিয় জায়গা পাটায়া। তাই বলে এখন ফ্লাইট ! হোটেল সব বুকিং নষ্ট করে এই খামখেয়ালিপনায় বিরক্ত হলাম। দেবাশিসদারাও নিশ্চয় অখুশি হলেন। যা-ই হোক, মৌয়ের জেদই রইল। আমরা গেলাম পাটায়া। প্রথম দিন কাটল ভালোই। দ্বিতীয় দিন ঘুমিয়ে আছি হোটেলের ঘরে। ছুটি কাটাতে গিয়ে বেলা করে উঠব, সেটাই স্বাভাবিক। উঠে দেখি, প্রচুর মিসড কল। তারপর তো ফোনের বন্যা। ট্রাভেল এজেন্ট তো নিশ্চিত, আমরা আর বেঁচে নেই। সুনামি হয়েছে থাইল্যান্ডে। সব ভেসে গেছে। উনি জানেন, আমরা ফুকেত গেছি। সেখানে যে হোটেল বুক করে দিয়েছিলেন, সেটা ঢেউয়ের আঘাতে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে। টিভিতে দেখছে সারা পৃথিবী আর শিউরে উঠছে। রাখে হরি মারে কে! এরকম কতবার যে মৌ বাঁচিয়েছে নিশ্চিত বিপদের মুখ থেকে। কী করে বুঝত, কে জানে, আগে থেকে!

 

মরুভূমিতে বৃষ্টি, ঋষি গেল হারিয়ে ভিয়েতনামের দ্বীপে

অবিশ্বাস্য! দুবাইয়ের মরুভূমিতে ঝমঝমে বৃষ্টি ক’জন দেখেছে ! আমরা দেখেছি ওই বিরল ঘটনা।মৌ কিছুতেই ডেসার্ট সাফারি করতে যাবে না । গরম সহ্য করতে পারত না। আর দুবাইয়ে মরুভূমির গরম কী সাঙ্ঘাতিক। আমি জোরজার করতে লাগলাম। বললাম, তুমি চলো, দেখবে ঠিক বৃষ্টি নামবে। বিশ্বাস কতটা করল কে জানে, তবে রওনা হলো। তারপর ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল তপ্ত বালিতে। ড্রাইভার পর্যন্ত অবাক। বলল, কত বছর বাদে এমনটা দেখলাম।

প্রাণের ঋষিকে খুঁজে না পেয়ে মৌয়ের প্রাণটাই যেন বেরিয়ে যাচ্ছিল সেদিন। বছর তিনেকের ছেলেকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। ক্রুজে করে ভিয়েতনামের একটা দ্বীপে বেড়াতে গিয়ে ওই কাণ্ড। মৌ তো হাউ হাউ করে কাঁদছে। আর আমি পাগলের মতো এধার-ওধার খুঁজছি। ঘণ্টাখানেক কেটে গেছে। ক্রুজ ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। হঠাৎ দেখি, কয়েকটি ভিয়েতনামি মেয়ে হাসতে হাসতে আসছে, সঙ্গে ঋষি। দিব্যি কথা বলছে, হাসছে, চকোলেট খাচ্ছে। ওরা ওকে একা দেখে বাবা-মায়ের সন্ধানে নিয়ে আসছিল ক্রুজের দিকে। মৌয়ের যেন এতক্ষণ নিঃশ্বাস আটকে ছিল, ঋষিকে ফেরত পেয়ে সেদিন কী সজল তাঁর আনন্দ। কখনও চোখের আড়াল করত না ছেলেকে।

 

সুরের দেশে

গানবাজনা চিরকাল পছন্দ মৌয়ের। মোজার্টের দেশে গিয়ে ওকে আর পায় কে ! সার্সবুর্গে মোজার্টের বাড়ির সামনে গিয়ে খুশিতে আত্মহারা। সমুদ্রের বুকে একটা রেস্তোরাঁয় বসে খাচ্ছি, দেখি পাহাড়ের ওপর ছোট্ট একটা কটেজের দিকে অপলকে তাকিয়ে আছে। একসময় বলল, চলো সব ছেড়েছুড়ে এরকম একটা জায়গায় থাকি। সারাদিন মোজার্ট শুনব আর গান গাইব।

 

রিকশায় ভিয়েনা ভ্রমণ

ভিয়েনা বেড়াতে গিয়ে মৌ খুঁজে পেল এক রিকশাওয়ালাকে। সে এমন ফ্যান হয়ে গেল মৌয়ের যে ওকে নিয়ে ঘুরতে লাগল সব জায়গায়। মৌ ভারতীয় খাবার ছাড়া পছন্দ করে না। রিকশাওয়ালা খুঁজে খুঁজে মৌকে নিয়ে যেত ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁয়। ফিরে আসার পর দেখতাম মৌ ওকে ভোলেনি। মাঝেমধ্যে দু’জনের মেসেজ বিনিময় হতো। আমি ফোনে ওকে দুঃসংবাদ দিলাম। শুনেই কী কান্না তার।

 

পিঠে পড়ল ছত্রি

একটা বিয়েবাড়ি গিয়েছিলাম। ওরা গেস্ট হাউসে থাকতে দিয়েছিল। মনে আছে, পাশেই খাটে শুয়ে খেলা করছিল একটি বাচ্চা। মৌ গিয়ে ওর কপালে হাত বোলাতে লাগল। কী সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড, হঠাৎ খাটের ছত্রি ভেঙে সটান পড়ল মৌয়ের মাথায়। কতটা আঘাত লাগল, সেটা ভুলে আমরা আশ্চর্য হয়ে ভাবলাম, মৌ যদি উঠে ওকে আদর করতে না যেত, ছত্রিটা পড়ত বাচ্চাটার ওপর। তাতে যে কী হত, ভেবে শিউরে উঠলাম দু’জনে। এই যে কারও খারাপ কিছু নিজের ভেতর টেনে নেওয়া, মৌয়ের এ অদ্ভুত ব্যাপারটা আমি বরাবর লক্ষ করেছি। প্রিয়জনের অসুখ হলেই মনখারাপ, চট করে নিজের ভেতর কষ্ট নিয়ে নিত। কী করে পারত জানি না, কিন্তু বহুবার তা দেখেছি। ২০০৩ সালে বঙ্গ সম্মেলনে যাব আমেরিকা, সব ঠিক। আমার ডেঙ্গি হল, হাসপাতালে ভর্তি হলাম। দিন নেই রাত নেই, মৌ আমার সেবা করে যাচ্ছে। বাড়ি ফিরলাম সুস্থ হয়ে।মৌ পড়ল কঠিন অসুখে। ম্যালিগন্যান্সি। আবার লড়াই শুরু ওর। হাসপাতাল থেকে ফেরার পর সারাদিন কাঁদত, আয়নার সামনে দাঁড়াতে চাইত না। ওই যে বলছিলাম, প্রিয় কারও খারাপটা নিজের ভেতর নিয়ে নেওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল মৌয়ের। আজ ভাবি, উল্টোটা হলে ওকে হয়তো যেতে দিতাম না।

 

হেঁশেল রানি

মৌকে মাঝে মাঝে এই নামে ডাকতাম। কী যে ভালোবাসত রান্না করতে। কখনও শুধুই আমার আর ঋষির জন্য, কখনও বাড়িতে বিশেষ অতিথির জন্য, কোমর বেঁধে লেগে গেল চিংড়ির মালাইকারি কিংবা সরষে-ইলিশ রাঁধতে। নিজে মাছ খেত না, কী করে যে এমন অসাধারণ রাঁধত কে জানে! কত লোক যে বলত, তোমার হাতের রান্না খাব। একটুও বিরক্তি নেই, বাজার আনিয়ে রাঁধতে বসে গেল মৌ। মনে আছে, একবার রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি এসেছিলেন আজকাল-এর অনুষ্ঠানে। প্রণববাবু ভাত ডাল আলুপোস্ত ছাড়া কিছু খাবেন না। শুনেই মৌ বলল, আমি ওঁর জন্য নিজে হাতে রাঁধব। রান্না করে টিফিন কৌটো করে নিয়ে গিয়ে খাওয়াল। শুধু কি বাড়িতে? হোটেলে গিয়েও ঠিক ম্যানেজ করে ঢুকে পড়ত তাদের রান্নাঘরে। তারপর কী ম্যাজিক করে কে জানে নিজের পছন্দমতো রেসিপিতে রাঁধাত। জাপানে গিয়ে বলল, এদের এই আধকাঁচা খাবারদাবার মুখে তোলা যায় না। আমি রাঁধব। সুইৎজারল্যান্ডে ঋষির ক্যুলিনারি কলেজে গিয়ে এক্সপার্ট শেফদের মাংস রান্না শেখাল!

 

শত ভাইয়ের বোন

ভাইফোঁটা ছিল মৌয়ের খুব প্রিয় উৎসব। ভাইয়ের লিস্ট এত লম্বা, বছর বছর যে হারে তা বাড়ে, আমি ঠাট্টা করে বলতাম, সেঞ্চুরি হয়ে গেছে? ভিআইপি থেকে ছোটবেলার বন্ধু, কে নেই ! নিজের হাতে সব আয়োজন না করলে শান্তি নেই। কী খাওয়াবে, কী উপহার দেবে, বহুদিন আগে থেকেই প্ল্যান করত। ভাইফোঁটার দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নানা বয়সের ভাইদের ভিড়। আজ তাঁর ভাইদের চোখে জল, আর জল।

 

এ তো রাগ নয়, এ যে অভিমান

বড় অভিমানী ছিল মৌ। কথায় কথায় ফর্সা মুখটা, নাকের ডগাটা লালচে হয়ে উঠত। গভীর চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠত। ছুটন্ত পৃথিবী, দুরন্ত জীবনে সেদিকে তাকানোর সময় কই ? মৌয়ের কবিতা পড়লেই মনে হয়, কত অস্ফুট বেদনা বুকে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে? এত কষ্ট? এত অভিমান? কার ওপর? আমার? জিজ্ঞেস করা হয়নি কোনোদিন।

 

কিশোরীর সারল্য

মাঝে মাঝে মনে হতো, আজকের দিনে সত্যিই কি এমন সরল হতে পারে কোনো মানুষ? লোককে বিশ্বাস করে ঠকা ছিল মৌয়ের অভ্যেস। তারপর এমন রেগে যেত, আর তার মুখদর্শন করবে না। আবার হয়তো একদিন সব ভুলে তাকে বুকে টেনে নেবে। মিথ্যে একদম সহ্য করতে পারত না। রাগ, দুঃখের প্রকাশ ছিল ঠিক বাচ্চাদের মতো। আমিও মৌকে ছোটো মেয়ের মতো সবসময় ভেবেছি। আসলে সে যে ১৪ বছরের মৌকে দেখেছিলাম, সেটাই রয়ে গেল মনে । আর কোনোদিন ভাবতেই পারলাম না, মৌ বড়ো হয়ে গেছে। এখন ভাবি, কত সহজ ছিল মৌয়ের কাছ থেকে কিছু লুকিয়ে রাখা। গত বছর কোয়েম্বাটোরে একটা কনফারেন্সে গিয়েছি। বন্ধু ভাস্করদা ছিল সঙ্গে। সেদিন ছিল শিবরাত্রি। কাজকর্ম সেরে গেলাম সদগুরুর আশ্রমের আদিযোগী অর্থাৎ বিশাল শিবমূর্তির নীচে যেখানে হাজার হাজার ভক্ত উদ্বাহু হয়ে নাচছে। আমারও যে কী হলো, আমিও যেন একটা ঘোরের মধ্যে নাচতে লাগলাম। রাতে হোটেলে ফেরার পর ফোন এল ঋষির, মাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছি। আইসিইউ-তে। পরদিনই ফিরে সোজা হাসপাতাল। মৌকে আশ্রমের কথা আর বললাম না । কিছুদিন আগে ইচ্ছে হলো ফেসবুকে পোস্ট করি নাচের ছবিটা। মৌ একটুও রাগ করল না। উল্টে বলল, তুমি সেদিন শিববন্দনা করেছিলে বলেই আমি সেযাত্রা বেঁচে গেলাম।

 

জীবনপুরের পথিক

কম বয়সে আমল দিইনি, প্রায়ই শুনতাম, মৌয়ের শরীর খারাপ। চিঠিতে লিখত আজ জ্বর, কোনোদিন লিখত, চারদিন স্কুল যাইনি। ওইটুকু মেয়ে কেন এরকম অসুস্থ থাকবে, সেটা চিন্তা করার মতো ম্যাচ্যুরিটি ছিল না। চিন্তাটা কিন্তু শেষমেশ সাকার হলো, যখন মৌয়ের বাড়ি থেকে খবর এল, ওর বাড়াবাড়ি রকম শরীর খারাপ। সারা গায়ে রেড স্পট বেরিয়েছে। আমার মেজদা ডাক্তার, তাঁর দুই ইন্টার্ন বন্ধুর ভরসায় মৌকে নিয়ে ট্রেনে করে কলকাতায় নিয়ে এসে সি এম আর আই হাসপাতালে ভর্তি করলাম। তখনই ডাঃ বি ডি মুখার্জির সঙ্গে পরিচয়। পরীক্ষা করে দেখা গেল, লিউকোমিয়া। প্লেটলেট নেমে গেল ১০ হাজারে। ডাক্তারদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল, আশা বুঝি নেই আর। ও নেগেটিভ রক্ত দরকার। সারা রাত ছোটাছুটি শহরের নানা প্রান্তে। শেষমেশ মিলল শ্যামবাজারে। রক্ত তো জোগাড় হল, কিন্তু পকেটে অত পয়সা নেই। কী করব? হাতঘড়িটা খুলে বললাম, দাদা, এটা রাখুন, পরে বাকি টাকা দিয়ে নিয়ে যাব। রোজ আসতাম হাসপাতালে। বসে থাকতাম বাইরে। ভেতরে মৌ লড়াই করছে।

আজ মনে পড়ছে অত বছর আগে, একবার সিএমআরআইতে দাঁড়িয়ে বন্ধু সৌম্যকে বলেছিলাম, ‘বিয়ে করলে বোধহয় এত কষ্ট হতো না। প্রেমিকা মারা গেলে বেশি কষ্ট, না রে?’

 

ঠাকুর দেখা

তখন মৌয়ের বেঁচে থাকাটা এতই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল যে, পুজোর সময় ডাক্তার পারমিশন দিয়েছিলেন, কয়েক ঘণ্টা ঠাকুর দেখিয়ে আনার। ১৭ বছরের ফুটফুটে এক কিশোরীর এটাই হয়তো শেষ পুজো, ভেবেছিল সবাই। সেবার, দু-চারটে ঠাকুর দেখে সোজা লিন্ডসে স্ট্রিট। বাদশা রেস্টুরেন্টে বসে চাউমিন, চিলি চিকেন খেয়ে আবার হাসপাতাল ফেরত। এটুকুতেই কী খুশি মৌ! ওই বয়সের একটা ছেলে যে কীভাবে বুকের কাছে দলাপাকানো কান্না চেপে মেয়েটার হাত ধরে সেদিন ঘুরেছিল, সে-ই জানে।

 

মিরাকেলের আশায়

মিরাকল যে ঘটে, বিশ্বাসটা আমার হল মাস দুয়েক বাদে যেদিন মৌকে ছেড়ে দিল। পুরোপুরি খুশি অবশ্য হতে পারলাম না। শেক্সপিয়ারের ট্র্যাজেডির নিয়তির মতো ডাক্তার বললেন, ‘আয়ুর মেয়াদ ২৮-৩০ বছরের বেশি নয়।’ যা-ই হোক, মিরাকেল যখন ঘটেছে, আবারও ঘটবে, এই আশা নিয়ে মৌকে বাড়ি ফেরালাম।
কিন্তু মৌ একটা কাণ্ড করল। হঠাৎ নিজেকে সরিয়ে নিল আমার থেকে। ১৮ বছরের একটা মেয়ে জেদ ধরল, এত অসুস্থ যখন, সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নেই। আমার তো পাগলের মতো অবস্থা। বিবাগী হয়ে খানিকটা বোহেমিয়ান হয়ে গেলাম। ‘৮৯ সাল। সেদিন ভারত বন্ধ। জনা দশেক বন্ধু মিলে ঠিক করলাম, বাইকে করে কাছেই মন্দিরে যাব রাধাগোবিন্দ দর্শনে। ফুল স্পিডে বাইক ছুটল। আমার বাইক চালাচ্ছিল বাপি, আমি পিছনে বসেছিলাম। জি টি রোড দিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ কী হল, উড়ে গেলাম। জ্ঞান ফিরল নার্সিং হোমে, পাশে বসে মৌ। অত বড়ো দুর্ঘটনা, অত বিপদ, অত যন্ত্রণার মাঝে শান্তির প্রলেপ, মৌ হাত বোলাচ্ছে আমার কপালে। সে যে আমার ভাল-মন্দের দায়িত্ব তুলে নিল হাতে, পঁচিশ বছরেরও বেশি কোথাও এতটুকু ফাঁক রাখেনি।

 

পথ বেঁধে দিল

‘৯৪ সালে বিয়ে করলাম। অনেকেই বারণ করেছিল, এমনকি দুই বাড়ির লোকেদেরও সংশয় ছিল। অসুস্থ মেয়েকে কেউ জেনেশুনে বিয়ে করে? আমার একটাই কথা, ভালবেসেছি যাকে, বিয়ে তো তাকেই করব। বিয়েতে খুব জাঁকজমক হল, মফস্সলের লোকজন অবাক হয়ে দেখলেন। মৌয়ের শখ ছিল, হানিমুনে জাহাজে করে আন্দামান যাবে। সে-ও গেলাম। শরীর ভাল-মন্দের টানাপোড়েনে মৌয়ের মন খারাপ থাকত, ওকে খুশি রাখতে অনেক জায়গায় ঘুরতাম। কয়েক বছর পর ডাঃ আর এন দত্ত বললেন, মা হলে মৌয়ের শরীর, মন দুই-ই ভালো হবে। হরমোনের পরিবর্তনে মৌ ভালো হয়ে যাবে। এতখানি ঝুঁকি নেওয়া কি ঠিক হবে? অনেক ভাবনাচিন্তার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম। ঋষি এল আমাদের জীবনে একরাশ আনন্দ নিয়ে। তারপর এতগুলো বছরে একের পর এক কত যে বিপদ এসেছে, মৌয়ের শরীরে বোমার মতো আঘাত হেনেছে অসুখ। সহ্যশক্তি অসামান্য। ৫৩ বছরের জীবনে বারবার হাসপাতালে গেছে, প্রতিবারই যুদ্ধ জয় করে ফিরেছে। এর মধ্যেই সংসার, ছেলেকে মানুষ করা, আমার আর পরিবারের দেখভাল, অফিসের কাজ- কোনটা না করেছে ! মুখ থেকে কথা সরতে না সরতে হাজির সবকিছু। যেন এক অসাধারণ জাদুকর। সামান্য চেনা কেউ সাহায্য চেয়েছে, সারাদিন ধরে ফোন করছে কোথায় ডাক্তার, কোথায় হাসপাতাল। একদিকে নিজের ডাক্তার, হাসপাতাল, ওষুধ, অপারেশন আর অন্যদিকে আত্মীয়-বন্ধুদের জড়িয়ে বাঁচা, কাজের জগতের অনেক দায়িত্ব, দেশ-বিদেশ বেড়ানো—সব মিলিয়ে মৌয়ের জীবনের নকশিকাঁথা বোনা হতে লাগল নিজস্ব রঙে।

 

না বলা বাণীর ঘনযামিনী

শূন্য ঘরে বসে ভাবি, কত কথা বলার ছিল মৌয়ের। কত ইচ্ছে অপূর্ণ রয়ে গেল। আমারও। মৌ কাশ্মীর যেতে চেয়েছিল টিউলিপ দেখবে বলে। হল না। তখন বললাম, ৫ মে আমি লন্ডন যাচ্ছি কাজে। ১০ তারিখ কাজ শেষ হয়ে যাবে । ১১ তারিখ চলে এসো আমস্টারডাম। তোমাকে নিয়ে টিউলিপ গার্ডেন দেখব। সে আর হল কই? এখন মৌ ওর প্রিয় টিউলিপের মাঝখানে। জেনে, না-জেনে কত মানুষ যে টিউলিপ পাঠিয়েছেন মৌকে !

এই তো সেদিন বেনারস যেতে চাইল। টিকিট কাটা হল। কিন্তু হোটেল নিয়ে সমস্যা। ক্যানসেল করে পুরী গেলাম। এবার অবশ্য মৌকে নিয়ে বেনারস যাব । ওর চিতাভস্ম রেখে দিয়েছি। গঙ্গায় ভেসে চলে যাবে কত দূরে কে জানে! আর আমি? মৌয়ের হাত ধরে সারাজীবন ডুবতে রাজি আছি। যে হাত ছেড়ে দিয়েছিল ৭ মে, হাসপাতালে, ও জানে না, সে হাত আসলে ধরে রেখেছি শক্ত করে। যাওয়া তো নয় যাওয়া।বারবার ফিরে আসা। কাছে আসা।

♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦

আরো পড়ুন…

 


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!