Advertisement
  • গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
  • মার্চ ১৬, ২০২৫

কুঞ্চি কোরবে

পুলক কুমার বন্দোপাধ্যায়
কুঞ্চি কোরবে

 

মি এথে বসু সকত্‌ কা ?

আমি এখানে বসতে পারি কি ?

 

   দীপা ‘মহেশ লাঞ্চ হোম’-এর উত্তর পশ্চিম কোণের দু-জনের একটা বসার টেবিলে বসে, একমনে মেনু-কার্ডের পাতা ওল্টাচ্ছিল। হঠাৎ করে মারাঠি ভাষায় এক পুরুষ কণ্ঠের আবেদন শুনে, মাথা উঁচিয়ে সামনের দিকে তাকাতেই, দীপা দেখল’ এক বছর তিরিশের যুবক ওর সামনে দাঁড়িয়ে, হাত উঁচিয়ে দীপা যে টেবিলে বসেছে, সেখানকার ফাঁকা আসনের দিকে ইঙ্গিত করে বসার অনুমতি চাইছে।

 

   পুরুষটির ঠোঁটে একটা মিষ্টি হাসি; চোখদুটো ভীষণ রকমের শান্ত। আবার উদ্ধত ধরণেরও বটে। ছফুটের উপরের একটা কাঠামোয় একটা কালো প্যাণ্ট, আর তার উপরে একটা ধবধবে টাইট-ফিটিং সাদা জামা। আবলুশ কাঠের মত রং; অনেকটা যেন ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটারদের মত অবয়ব।

 

   দীপা আবার মেনু-কার্ডের পাতায় চোখ নামিয়ে, মনে-মনে ভাবে আসন যখন ফাঁকা আছে, তখন বসে পড়লেই তো হয়। জোর করে ভদ্রতা প্রদর্শনের কি প্রয়োজন ! দীপা মাথা নামিয়ে নেওয়ায়, পুনরায় পুরুষ কণ্ঠে মারাঠি ভাষায় বসার অনুমতি প্রার্থনা শোনা গেল। দীপা এবার মাথা তুলে পুরুষটির চোখে চোখ রেখে একেবারে ব্রিটিশ উচ্চারণে জানাল, ‘হোয়াই নট্‌ ! নো বডি ইজ হিয়্যার !’

 

   শুধু দীপার কণ্ঠস্বর নয়, তার চোখের ভাষা পড়তে পারলে, কোনও বিদেশি তো দূরের কথা, কোনও দেশি মানুষও ওর সামনে বসতে অস্বস্তি বোধ করবে। কিন্তু সম্মুখস্থ পুরুষটি কোনও রকম দ্বিধা না করে, একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। দীপা ওয়েটারকে ডেকে পমফ্রেটের ঝাল ও ভাতের অর্ডার দেওয়ার পরে, মুহূর্তের মধ্যে ওয়েটার ভদ্রলোক ফিরে এসে, একটা ডিম্বাকৃতি রেকাবের মধ্যে বিভিন্ন মাপের কয়েকটা পমফ্রেট মাছ সামনে মেলে ধরে জানতে চাইল—কোন মাপের মাছটি তার কাছে অগ্রগণ্য; এটাই মহেশ লাঞ্চ হোমের দস্তুর।

 

   ওয়েটার ভদ্রলোক দীপার সাথে কথা শেষ করে, সামনে বসা পুরুষটির কাছ থেকে খাবারের অর্ডার সংগ্রহ করে নিল। পুরুষটির সামনে চুপচাপ বসে থাকতে, ভিতর থেকে সমানে একটা অস্বস্তি হচ্ছিল দীপার। আসন ছেড়ে উঠে, হাত ধুয়ে খাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য, ওয়াশ-বেসিনের দিকে পা বাড়াল সে। ওয়াশ বেসিনে একটু বাড়তি সময় ব্যয় করে, নিজের আসনে ফিরে আসতেই, ওর খাবার এসে গেল।

 

   একমনে খাবার খেতে-খেতে, দীপা বেশ বুঝতে পারছে, সামনের পুরুষটি একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। দ্রুততার সঙ্গে খাওয়া শেষ করে, দীপা আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। পুরুষটি এবার দীপার কাছে মারাঠি ভাষাতেই জানতে চাইল, ‘আপল্যা মূল মহারাষ্ট্রাতীল কা ?’

 

   দীপা বুঝতে পারল, সামনের পুরুষটি তার কাছে জানতে চাইছে, ‘আপনি কি মারাঠি ?’ দীপা অপাঙ্গে পুরুষটির দিকে তাকিয়ে জবাব দিল, না ! আমি মারাঠি নই; বাঙালি। কিন্তু অভারতীয়। জবাব শুনে, পুরুষটি দু-হাতের চেটো বুকের দু-পাশে চেপে ধরে, সামনের দিকে সামান্য মাথা ঝোঁকাল।

 

শান্ত আরব সাগরের নরম ঢেউ জুহু বীচের উপরে আছড়ে পড়ছে। দু-চারজন শিশু-কিশোর-কিশোরী ঢেউয়ের হাত থেকে বাঁচতে ছুটে পালানোর প্রচেষ্টা করছে একবার; পরক্ষণেই আবার ফিরে যাওয়া ঢেউয়ের পিছন-পিছন ছুটে যাচ্ছে তারা

   দীপা পুরুষটিকে আর কোনো বাক্য বিনিময়ের সুযোগ না দিয়ে, মহেশ লাঞ্চ হোমের দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এল দ্রুত পায়ে। আজ রবিবার; মহেশ লাঞ্চ হোমের সামনে ভোজন রসিক খদ্দেরের ভিড় উপচে পড়ছে। ছুটির দিনগুলোতে দুপুরের এই সময়টায় খুব ভিড় হয় এই রেস্তোরাঁয়। দীপা ভিড় ডিঙিয়ে জুহু তারা রোডের উপরে দাঁড় করানো ওর গাড়িতে এসে উঠে বসল।

 

   কালো কাচে ঢাকা গাড়ির ভিতরে বসে, ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলল, একটু দাঁড়িয়ে যাও ! তারপরে মহেশ লাঞ্চ হোমের গা-ঘেঁষা সরু এক-প্রস্ত বালিয়াড়ির উপর দিয়ে উত্তর-পশ্চিম দিকে তাকালো দীপা। শান্ত আরব সাগরের নরম ঢেউ জুহু বীচের উপরে আছড়ে পড়ছে। দু-চারজন শিশু-কিশোর-কিশোরী ঢেউয়ের হাত থেকে বাঁচতে ছুটে পালানোর প্রচেষ্টা করছে একবার; পরক্ষণেই আবার ফিরে যাওয়া ঢেউয়ের পিছন-পিছন ছুটে যাচ্ছে তারা।

 

   কালো কাচে ঘেরা গাড়ির ভিতরে বসা দীপার হৃদয়-তটেও একটা অচেনা ঢেউ একই রকম ভাবে যেন ওঠানামা করছে। দীপা বুঝতে পারে, কেন, কি-কারণে, এইভাবে উথালি-পাথালি চলছে তার বুকের ভিতরে।

 

   দীপা ইউকে থেকে মুম্বাই এসেছে সবে মাত্র দিন দশেক হয়েছে। আজ থেকে বছর বারো আগে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইকনমিক্সে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার পরে, একটা ভারতীয় বহুজাতিক সংস্থায় চাকরি পেয়েছিল। তারাই ওকে লন নে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে বছর-তিনেক ওই কোম্পানির বেশ কয়েকটা বিদেশী ব্যাঙ্কিং ক্লায়েন্ট সংস্থাকে পরিষেবা দেওয়ার কাজ করেছিল ও।

 

   সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শরীরপাত করে, সেই পরিষেবা দেওয়ার পরে, মাসের শেষে যে-কটা পাউন্ড দীপার পার্সে ঢুকত, তার থেকে লন্ডন শহরের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে হাউন্সলো অঞ্চলে নেওয়া একটা এক-কামরার ঘর ভাড়া দেওয়ার পাশাপাশি, কাউন্সিল ট্যাক্স, বিদ্যুতের খরচ, মেডিক্যাল ইনশিওরেন্সের পাওনা মিটিয়ে, গোটা মাসের নিজের খাওয়া-খরচ চালিয়ে, অফিস আসা-যাওয়ার পথ খরচ সামলিয়ে, শেষ অবধি হাতে যে-কটা পাউন্ড পড়ে থাকত, তা কলকাতায় মায়ের এ্যাকাউণ্টে পাঠিয়ে দিত।

 

   দীপা যখন স্কুলের গণ্ডী পেরোনোর ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছে, তখন ওর বাবা মারা যান। ওর বাবা ছিলেন দক্ষিণ কলকাতার একটা নামী কলেজের অধ্যাপক। দীপার যেদিন স্কুলের সেই ফাইনাল পরীক্ষার প্রথম দিন, ক্লাস নিতে-নিতে সেদিনই বুকে ব্যথা অনুভব করেন ওর বাবা। সহকর্মীরা কলেজের কাছেই একটা হসপিটালে তৎক্ষনাৎ নিয়ে গেলে, ডাক্তাররা ওনাকে মৃত বলে ঘোষণা করেছিল। দীপা সেদিন পরীক্ষা দিয়ে ফিরে এসে, বাবার মুখাগ্নি করেছিল। বাড়ি-সুদ্ধ সবাই কেঁদে আকুল হলেও, ওর চোখ থেকে সেদিন এক-ফোঁটা জল গড়াতে দেখেনি কেউ। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে, আবার পরীক্ষা দিতে চলে গিয়েছিল দীপা।

 

   মাধ্যমিক পরীক্ষায় খুব ভালো ফল করেছিল দীপা। হায়ার-সেকেণ্ডারিতেও প্রথম দশজনের মধ্যে ছিল সে। তারপরে প্রেসিডেন্সি থেকে ইকনমিক্সে অনার্স নিয়ে গ্রাজুয়েশন করা পর্যন্ত জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে, ওর বাবার অভাব কোনোদিন ওকে বুঝতে দেয়নি ওর মা। চাকরি নিয়ে লন্ডনে চলে আসার পরে, দীপার ইচ্ছে ছিল নিজের পায়ের তলার মাটিটা একটু শক্ত করতে পারলেই, মাকে ও নিজের কাছে নিয়ে আসবে।

 

    সেই কারনেই দিনের বেলায় অফিসের দায়িত্ব সামলে, দীপা সন্ধ্যার সময় একটা পার্ট-টাইম কোর্সে ভর্তি হয়েছিল নর্থ-আমব্রিয়া ইউনিভার্সিটিতে; ফিনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্টে দুই-বছরের এমএসসি কোর্সে। কিন্তু মেয়ের সেই সাফল্য দীপার মা দেখে যেতে পারেনি। মাত্র সাত দিনের জ্বরে ভুগে চলে গিয়েছিলেন তিনি। দীপা নর্থ-আমব্রিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করে, একটা আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা ব্যাঙ্কিং-সংস্থায় এ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টরের পদে যোগ দিয়েছিল।

 

   সেদেশে পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হলেই, ইউকে সরকারের তরফ থেকে পিএলআর বা চিরস্থায়ীভাবে সেখানে থাকার অনুমতিপত্র পাওয়া যায়। সেই অনুমতি পাওয়ার পরে, হাউন্সলোতেই ম্যাজেস্টিক টাওয়ারে সাত-তলার উপরে দু-লক্ষ পাউন্ড খরচ করে একটা স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট কিনে ফেলল দীপা। তার আগে অবশ্য শেষবারে মত কলকাতায় এসে ওদের যোধপুর পার্কের ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়ে, শহরের সঙ্গে সব সম্পর্ক চিরতরে চুকিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।

 

   বর্তমানে কোম্পানীর সিনিয়র এ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর দীপাকে, তার অফিস থেকে এদেশে পাঠিয়েছে, মুম্বাই শহরের আন্ধেরি ওয়েস্টের জুহু তারা রোডে তাদের আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্কের নতুন শাখা চালু করার উদ্দেশ্যে। ছয় মাসের প্রজেক্ট। একটা কর্পোরেট বিল্ডিং-এর নির্ধারিত দুটো তলা জুড়ে ব্যাঙ্কের নতুন শাখা চালু করার জন্য অফিস ডিজাইন, লে-আউট, কর্মী নির্বাচন- নিয়োগ, তাদের ট্রেনিং-পর্ব সামলানো, সব কিছুই এই প্রজেক্ট পিরিয়ডের মধ্যে কমপ্লিট করার দায়িত্ব তার।

 

   জুহু তারা রোডে একটা বহুতল আবাসনের এগারো তলায় ফ্ল্যাট। দীপার জন্য অফিস থেকে বরাদ্দ হয়েছে চব্বিশ ঘণ্টা ব্যবহারের জন্য একটা গাড়িও। রান্নাবান্না এবং সারাদিনের দেখাশোনার জন্য এক মহিলা রয়েছেন। নাম কমলা দাভালকার।

 

   আজ মহেশ লাঞ্চ-হোমে তার এই প্রথম অভিজ্ঞতা কি জানি কোন এক অমোঘ আকর্ষনে দীপাকে আবিষ্ট করে রাখে। গাড়ি নিয়ে খানিকক্ষণ এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করার পরে, সন্ধ্যা নামার আগেই নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে আসে। এগারো তলার ফ্ল্যাটের বারান্দায় এসে বসে সে। এগারো তলার ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে দৃশ্যমান একফালি জুহু বিচ-সহ, গোটা জুহু তারা রোড। সেদিকে তাকিয়ে দীপা বসে-বসে ভাবে, তার এই ঘরে ফিরে আসা কি তার জীবনে পিছনে ফিরে আসা, না-কি তার মনের সুপ্ত কোনও বাসনাকে আঁকড়ে ধরে জীবনের সন্ধানে এক ধাপ সামনে এগিয়ে যাওয়া !

 

   সারা সপ্তাহ জুড়ে তার প্রজেক্টের নির্ধারিত সূচী সম্পাদনের ফাঁকে-ফাঁকে, দীপার মাথার ভিতরে পাক খায়, কবে আসবে সপ্তাহান্তের সেই ক্ষণ, যখন মহেশ লাঞ্চ হোমের টেবিলে বসে পুনরায় সে দর্শন করতে সক্ষম হবে, তার সেই ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটার-সুলভ পুরুষটিকে।

 

   প্রতি রবিবার দুপুরে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে দীপা মধ্যাহ্ণভোজ সারতে মহেশ লাঞ্চ হোমে এসে ঢোকে। মহেশ লাঞ্চ হোমের টেবিলে দীপার মুখোমুখি হয়ে, মুখে মিষ্টি হাসি বিছিয়ে সেই পুরুষটি নানান কথা জানতে চায় দীপার কাছে।

 

   এথে আপল্যা রহিলা কুঠে ?—মারাঠি ভাষায় সে দীপার কাছে জানতে চায়, আপনি এখানে কোথায় থাকেন।

 

   দীপা সেই প্রশ্নে নিরুত্তর থেকে, পুরুষটির পিছনের দিকের স্বচ্ছ কাচের দেওয়ালের ভিতর দিয়ে জুহু বিচের উপরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের ওঠা-নামার দিকে দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের হৃদয়ের উথালি-পাথালি অবস্থা অনুভব করতে-করতে, ইংরাজিতে পুরুষটির কাছে তার নাম জানতে চায় একদিন।

 

আরব সাগরের তীরে সন্ধের ঝাপ খুলতেই, গোধুলি মিশে যায় আঁধারে। অন্ধকারের হাত ধরে হু-হু করে রাত নামতে থাকে

 

   রোহিত,দু-হাত বুকের কাছে জোড় করে জবাব দেয় পুরুষটি। আকর্ণ হাসি ছড়িয়ে, দীপার কাছে মারাঠি ভাষায় সে ফিরে প্রশ্ন করে, আপল্যা নাও কায় ? অর্থাৎ আপনার নাম কি।

 

   দীপা ! দীপান্বিতা বোস ! — চোখ নীচে নামিয়ে সলজ্জ বাঙালি কন্যাসুলভ ভঙ্গিতে জবাব দেয় দীপা।

 

   দীপার সেই জবাব শোনার পরে, কলকল ধ্বনিতে রোহিতের হৃদয়ের উচ্ছ্বাস আছড়ে পড়ে। ‘বোস’ ! আমরা সবাই এই ‘বোস’ শব্দটাকে সম্মান করি। আমরা সবাই নেতাজি সুভাস চন্দ্র বোস’কে চিনি। নেতাজির অন্তর্ধানের সময়, তার দেশ ছাড়ার সময়, আমাদেরই একজন পূর্ব-পুরুষ তাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। এখানে আমাদের গোষ্ঠীর প্রতিটি পরিবারের দুটো জিনিসের ক্ষেত্রে আপনাদের বাঙালি পরিবারের সাথে একটা মিল পাবেন। এক, কালী মায়ের ছবি; আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসের ছবি। আমাদের সব ঘরে-ঘরে এই দুটো জিনিস আপনি অবশ্যই দেখতে পাবেন। আর আমি শুনেছি, এটা আপনাদের ঘরে-ঘরেও…!

 

   মহেশ লাঞ্চ হোম থেকে বেরিয়ে, পায়ে-পায়ে জুহু বিচ ধরে এগিয়ে চলে দীপা রোহিতের পাশে-পাশে ; আরব সাগরের জলে পা ভিজিয়ে। বিকেলের পড়ন্ত সূর্যের আলো গায়ে মেখে, ঘরে ফেরার পথে নিজের মোটর-বাইকে চড়ে বসার আগে, দীপাকে তার গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে, মাথা ঝুঁকিয়ে মারাঠি ভাষায় রোহিত জানায়, ‘ পুনহ  মিলু  য়া !’ —অর্থাৎ ‘আবার দেখা হবে’।

 

   এইভাবে দেখতে-দেখতে দীপার ছয়’মাসের প্রজেক্ট-কালের, তিন মাস প্রায় অতিক্রান্ত। দীপা তার অফিস প্রজেক্টের দৈনন্দিন কাজ সামলে, তার জুহু তারা রোডের আবাসনে ফিরে আসে রোজ। আরব সাগরের তীরে সন্ধের ঝাপ খুলতেই, গোধুলি মিশে যায় আঁধারে। অন্ধকারের হাত ধরে হু-হু করে রাত নামতে থাকে। দীপা তার এগারো তলার আবাসনের পশ্চিম দিকের ব্যালকনিতে বসে, মনের আঁধার দূর করার জন্য মহেশ লাঞ্চ হোমের ছুটির দিনের দুপুরের স্মৃতির বাতি জ্বালায়। কমলা কফির কাপ এনে রাখে দীপার সামনে। কফির কাপ ঠোঁটে লাগাতে না লাগাতেই সেদিন দীপার চোখ চলে গেল, জুহু তারা রোডের রাস্তার অপর প্রান্তে।

 

   একটা মোটর বাইক থেকে নেমে দাঁড়াচ্ছে কালো-প্যাণ্ট, সাদা জামা পরা একজন পুরুষ। বাইকের পিছনে রাখা একটা ব্যাগ থেকে সে টেনে বার করছে একটা লোহার বালতি আর একগাছা মোটা দড়ি। তারপরে ধীরে-ধীরে জামা-প্যাণ্ট খুলে, সে এগিয়ে যায় দড়ি-বালতি হাতে নিয়ে ফুটপাথের উপরে ম্যান-হোল কাভারের দিকে। দীপাকে একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে, কমলা দীপার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ও হচ্ছে মুম্বাই পৌর নিগমের সাফাইওয়ালা।

 

   সাফাইওয়ালা ! তুমি চেনো লোকটাকে ? দীপা ঔৎসুক্য ভরা কণ্ঠে জানতে চায় কমলার কাছে।

 

   কেন চিনব না ! ওর নাম রোহিত; রোহিত মাঁকড়ওয়ালা। অমন ধোপ-দুরস্ত পোশাক পরে থাকলে কি হবে; দেখতে পাবে, ও এখন ওই জামাকাপড় ছেড়ে কেমন ওই ম্যানহোল কভার সরিয়ে বালতি-দড়ি নিয়ে হাইড্রেনের ভিতরে নেমে পড়বে, কাছড়া সাফাই করতে।

 

   কি নাম বললে ! রোহিত মাঁকড়ওয়ালা ? মাঁকড়ওয়ালা মানে কি ?—দীপা ফিরে প্রশ্ন করল।

 

   মাঁকড়ওয়ালা মানে, বাঁদরওয়ালা। ওরা তো ‘কুঞ্চি কোরবে’ সম্প্রদায়ের লোক। বাঁদর নাচানো, আর ঝাড়ু বানিয়ে দরজায়-দরজায় ফিরি করে বেড়ানোই তো ওদের কাজ। তবে ওরা খুব সাহসী হয়। ওদের ঘরে-ঘরে সকলের কাছে তরোয়াল আছে। ভীষণ মারকূটে হয় ওরা। আন্ধেরির ‘কুঞ্চি কোরবে’ বস্তির মাথা ওই রোহিত ! আন্ধেরি, বান্দ্রা, সান্তাক্রুজ, ধারাবি সব বস্তিতেই ওদের রমরমা। ‘কুঞ্চি কোরবে’ মাঁকড়ওয়ালাদের ভয়ে ওইসব বস্তিতে পুলিশ পর্যন্ত ঢুকতে ভয় পায়। কোনো অপরাধীকে ধরার প্রয়োজন হলে, কুঞ্চি কোরবে সম্প্রদায়ের মাতব্বরের সম্মতি না-মিললে, কোনো বস্তিতে পুলিশ ঢুকতে যায়না কখনও। উপরে অত’ ধবধবে পোশাক-আশাক পরে ঘুরে বেড়ালে কি হবে, ওদের খাওয়া-দাওয়ার কথা ভাবলে, আমাদের ত’ রীতিমত গা  ঘিনঘিন ক’রে ওঠে !”

 

   কেন, কি খায় ওরা ?

 

   ওরা বিড়াল মেরে, ছাল ছাড়িয়ে, পুড়িয়ে, সেই মাংস খায়। সারাদিন হৈ-হট্টগোল, চিৎকার-চেঁচামেচি ওদের মহল্লায় লেগেই থাকে। ওরা ওদের সারা মাসের আয় সুদে খাটায়। বাপ ছেলেকে, ছেলে মাকে-বৌকে, এমনকি বৌও তার স্বামীর কাছে সুদে টাকা খাটায়। সময় মত কেউ টাকা না-পেলে, হল্লা মাচাতে শুরু করে। হালে এরা সাফ-সুতরো জামা-কাপড় পরে জাতে ওঠার চেষ্টা করছে। এরা সাহসী হওয়ার দরুণ, বড়-বড় নেতারা এদেরকে দেহরক্ষীর চাকরি দিচ্ছে ইদানিং। শুধু বড়-বড় নেতাদের সাথে ঘোরাঘুরি করে বলেই তো রোহিতের এত গুমোর।

 

   দীপার ছয়মাসের প্রজেক্ট শেষ হতে চলেছে। বেশ কিছুদিন যাবৎ ‘মহেশ লাঞ্চ হোম’ মুখো হতে পারেনি সে। আজই শেষ রবিবার। কাল বাদে পরশু তার লন্ডন ফিরে যাওয়ার কথা। দুপুর হতেই দীপা গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গিয়েছে জুহু বিচের ধারে ‘মহেশ লাঞ্চ হোমের’ দোতলায়। ওর ভালো লাগার টেবিলটা ফাঁকাই রয়েছে। দীপা সেখানে বসেই, মধ্যাহ্ণ ভোজের অর্ডার দিয়ে দিল। রেস্তোরাঁর কাচের ভিতর দিয়ে জুহু বিচ সংলগ্ন পিচ রাস্তার দিকে চোখ গেল দীপার। রোহিত মোটর বাইক থেকে নেমে দাঁড়াতেই, এক মহিলা সরাসরি ওর জামার কলার ধরে, হাত ধরে উত্তেজিত ভাবে টানাটানি করতে লেগেছে। রোহিত ঘাড় উঁচিয়ে মহেশ লাঞ্চ হোমের দোতলার দিকে তাকায়। তারপরে সেই মহিলাকে কিছু একটা বুঝিয়ে, এক দৌড়ে উপরে উঠে এল সে। ঠোঁটে আজ সেই আকর্ণ মিষ্টি হাসিটা আর নেই। দীপার সামনে উপস্থিত হয়ে, চোয়াল দুটো শক্ত করে, সে জানতে চাইল, হোয়াই লং এ্যাবসেণ্ট ম্যাডাম ?

 

   দীপা মাথা নীচু করে জবাব দেয়, কিছুদিন যাবৎ খুব ব্যস্ত ছিলাম। আমি পরশু লন্ডনে চলে যাচ্ছি। তাই দেখা করতে এলাম একবার !

 

   না-কি আমার পদবী জানতে পেরেই…! তারপরে একটু থেমে, সে আবার বলতে শুরু করল, ‘ মি. রোহিত মাঁকড়ওয়ালা ! আম্‌হি কুঞ্চি কোরবে ! আমহলা দেখিল মোঠা হবায়চে ! মলা আঠোওন করনার না ম্যাডাম ! মলা বিসরু নকা প্লিজ !’ যার অর্থ, আমি রোহিত মাঁকড়ওয়ালা, আমরা কুঞ্চি কোরবে , আমরাও বড় হতে চাই, আমাকে মনে রাখবেন তো ম্যাডাম ; আমাকে ভুলবেন না প্লিজ !

 

♦–•–♦♦–•–♦♦–•–♦


  • Tags:
❤ Support Us
গুম গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
ধারাবাহিক: একদিন প্রতিদিন । পর্ব ৫ পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
পথ ভুবনের দিনলিপি । পর্ব এক ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
error: Content is protected !!