- গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
- ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৫
পিকচার

আজ ৩১ ডিসেম্বর। কত সাল ? জরুরি নয়। আজ বছরের শেষ দিন।
সোফিয়া আজও বাড়ি থেকে বেরতে চাইছে না, তার মন ভার, বিছানায় শুয়ে রয়েছে। গায়ে মায়ের হাতে বোনা লেপ।
শীত তেমন পড়েনি। গরমও নেই। দ্রুত শীত চলে যাচ্ছে।
অর্ক সোফার ঘর থেকে বলল, চা খেয়ে দেখবে ?
সোফিয়া আর অর্ক একসঙ্গে থাকে। তারা দম্পতি। নিজেরাই জানে না, বিবাহ মানে বিয়ে কী। হঠাৎ করে তারা একসঙ্গে থাকতে শুরু করেছিল। ইট ওয়াজ লাইক হ্যাভিং ফান। বয়স কম ছিল।
সোফিয়ার বাবা আইনজীবী—কাদের ইসলাম। ধর্ম নিয়ে ভাবেন না। ঈশ্বর নিয়ে তার চিন্তা নেই। দুঁদে। তার দুই মেয়ে। সোফিয়া আর আয়েশা। সোফিয়া এক্সপ্লোরার। আয়েশা টিপিক্যাল। টিপিক্যাল মানে ঠিক কী তা বলা কঠিন। সোফিয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত চায়, আয়েশা বলিউড। এইভাবে তাদের প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া যেতে পারে ?
অর্ক বসুর পরিবার কমিউনিস্ট। সোফিয়ার সঙ্গে অর্কের সম্পর্ক তারা মেনে নেয়নি। ঘরে তোলেনি। অর্ক আর সোফিয়া বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেছিল। কাদের ইসলাম মেয়ে-জামাইকে দেখতে আসতেন।
সোফিয়া বিছানা থেকেই মুখ ঘুরিয়ে বলল, আমার দেখার কী আছে ?
অর্ক চুপ করে ছাদের দিকে তাকিয়ে রইল। কয়েক মিনিট পরে সে বলল, আমি কী করতে পারি, বলো ?
সোফিয়া জানাল, তার জন্য কিছু করতে হবে না অর্ককে। সে আরও বলল, কেন তাকে কষ্ট দেওয়া হচ্ছে দিনের পর দিন ?
অর্ক খানিক ভাবল, কী রকম কষ্ট সে দিয়ে চলেছে। সে কিছু মনে করতে পারল না। অর্ক জানে, সোফিয়া এখন আর তাকে পছন্দ করে না। ভালবাসার কথা পরে। কেন অপছন্দ ? অর্কের অনেক সমস্যা রয়েছে। সোফিয়ার কি নেই ? অর্ক তো মেনে নিয়েছে, সোফিয়া কেন মেনে নিচ্ছে না ?
শোবার ঘর প্রায় অন্ধকার। এক পাশে খাট। এক কোণে। সেখানে শুয়ে রয়েছে অর্কের স্ত্রী। বউ। তার আজ মন ভাল নেই।
সোফার ঘর থেকে উঠে এসে বিছানার পাশে বসল অর্ক। সোফিয়া তার দিকে তাকাল না। টের পেল অর্ক এসেছে। বালিশে আরও জোরে মুখ ঠেসে ধরল সোফিয়া।
লেপের তলায় সোফিয়ার হাত খুঁজতে লাগল অর্ক। সোফিয়া বুঝতে পারছে, অর্ক তার হাত খুঁজছে। সে হাত সরিয়ে নিল। লুকিয়ে রাখল। অর্ক তার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে বলল, সোফি, সত্যিই আমি বুঝতে পারছি না, কী হয়েছে, আমাকে বলো, না হলে বুঝতে আমার সমস্যা হচ্ছে, তোমাকে এভাবে দেখে আমার সমস্যা হচ্ছে, আমি কাজ করতে পারছি না, আমি মুডকে সুইচ অন, সুইচ অফ করতে পারি না, আমার অসুবিধা হচ্ছে, বলো প্লিজ।
জানালা খোলা। উত্তর দিকের জানালা। তবে, হাওয়া নেই। শুকনো একটা ঝাঁঝ আসছে। কাচটা চিড় খেয়েছে।
সোফিয়া চোয়াল শক্ত করে উঠে বসল। সে কি একটা চূড়ান্ত প্রস্তাব দিতে চায় ? তেমনই লাগছে কেন তাকে ? তার চোখের এক ধারে জল, চুল এলোমেলো। রুগ্ন দেখাচ্ছে।
অর্ক তার দিকে তাকিয়েই রয়েছে।
সোফিয়া বলল, আমার দায়িত্ব শেষ হয়েছে।
অর্ক চিন্তিত মুখে বলল, কোন দায়িত্বের কথা বলছ?
— পুরনো কথা বলতে হয়। অনেক পুরনো কথা।
— পুরাতন ধরে থাকতে থাকতে আমাদের দিনগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে। তুমি পুরাতন থেকে বের হয়ে আসতে পারছ না ?
— আমি পারছি না, কারণ আমি পুরাতনেই ভাল ছিলাম। এখন নেই। আমাকে বারবার পুরাতনে ফিরে যেতে হয় যাতে আমি এই সময়টাকে সহ্য করতে পারি।
— সেই পুরনো গল্পে আমি আছি তো ? সেই গল্পগুলো আমি জানি। একই গল্প আমি শুনতে চাই না। তুমি অন্য কথা বলো।
— গল্পগুলো একই আছে, কিন্তু এতদিন পর তাদের ব্যাখ্যা পাল্টে গেছে আমার কাছে। আমি যদি তোমাকে পুরনো গল্প শোনাই তাহলে সেগুলো শুধু গল্প হবে না, সেগুলো আমার ব্যাখ্যা।
বিছানার পাশ থেকে উঠে আসতে আসতে অর্ক বলে, কোনও কিছু অনেক দিন ধরে ফেলে রাখলে পোকা হয়। স্মৃতিতেও। আমিও সব গল্পের আমার মতো ব্যাখ্যা হাজির করতে পারি, সেই ব্যাখ্যায় আমি নায়ক, আমি নিরপরাধ, আমি শিশুর মতো, কিন্তু আমি চাই না যার সঙ্গে এত গল্প আমি ঘটিয়েছি তাকে এক ধাক্কায় সমস্ত অপরাধের মূল মাথা করে দিতে।
পাশের ঘরে তাদের দুই মেয়ে ঘুমোচ্ছে। তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়েছে। তারা কি সব বুঝতে পারে ? তাদের আব্বা-মা ভাল নেই, তা কি তারা টের পায় ? পারবে না কেন ! খুব ছোট তারা আর নেই। ছোটদের আন্ডার-এস্টিমেট করার কোনও মানে হয় না। বৃষ্টি আর বারিধারা— দুই বোন। তাদের কাছে আব্বা আর মা অভিভাবক ছাড়া আর কিছু কি নয় ?
আর কয়েক ঘন্টা পরে পয়লা জানুয়ারি। বারোটা বাজলেই কি আগের সব শেষ ? সকাল সকালই থাকে, নতুন দিনের সকাল আর পাঁচটা সকালের মতো। অর্ক ঘুমিয়ে থাকবে, সোফিয়া ঘুমিয়ে থাকবে, বৃষ্টি ঘুমিয়ে থাকবে, বারিধারা, কাদের ইসলাম, অর্কের বাবা ঘুমিয়ে থাকবে। গল্প বানিয়ে না তুললে একটা মহান ঘটনাও হারিয়ে যেতে পারে।
অর্ক সোফায় ফিরে এসে ভাবে, সে কি অপরূপাকে ফোন করবে ? জানাবে, সে কতটা খারাপ আছে ? তার কতটা সেবা আর স্নেহের দরকার, সে কি বলবে ? তারপর আবার ভাবে, সোফিয়া কী চায় তার কাছে ? সোফিয়ার মনে ঠিক কী ঘটছে, তার নাগাল সে পাচ্ছে না কেন ? আরেকবার ভাবল, সে কেন সোফিয়ার প্রেমে পড়েছিল ? প্রেম, প্রেম, ছিল, আছে, নেই, কতদূর।
হাসি পেল অর্কের, এত বছর পর কেন বউয়ের প্রেমে পড়েছিল তা ভাবা দরকার কি ? তবে, অর্কের বাবা দর্শন শাস্ত্রের শিক্ষক তপন বসু বৌমাকে মেনে নেননি। তিনি পা থেকে মাথা পর্যন্ত বামপন্থী। কাদের ইসলাম তার বন্ধুও। সোফিয়া আর অর্ক যখন এক হল, দুই পরিবার তখন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কাদের ইসলাম খুশি ছিলেন। তার ইনহিবিশন নেই, সেকুলার, প্লুরালিস্ট।
সোফিয়া শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে এক কাপ চা বসিয়ে বোনকে ফোন করল। আয়েশা। আয়েশা এখন মা হওয়ার দিন গুনছে। জানুয়ারিতেই ডেট দিয়েছে ডাক্তার। সে আর অপেক্ষা করতে পারছে না। ডিসেম্বর শেষ হয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে তার কোনুও আগ্রহ নেই। তার বয়স আরও এক বছর বেড়ে যেতে চলেছে তা নিয়ে তার চিন্তা নেই।
রান্নাঘর থেকে অর্ককে দেখা যাচ্ছে। সে মুখ নিচু করে বসে আছে। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না, কিন্তু এই আবহাওয়া তার ভাল লাগছে না, মাথা ধরে যাচ্ছে, এইভাবে বছরের শেষ দিনটা কাটবে ! অর্ক মাথা নামিয়ে বসে আছে।
অর্ক সোফা ছেড়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখল সোফিয়া হাসতে হাসতে ফোনে কথা বলছে। অর্ককে দেখতে পেয়ে সে মুখ গম্ভীর করে নিল। চায়ের জল ফুটছে। ছোট পাত্র। প্রচুর বুদবুদ।
অর্ক চিৎকার করে জানতে চাইল, সোফিয়া তুমি কী চাও ? কী চাও বলো।
কানে ফোন ধরে রেখে শূন্য চোখে অর্কের দিকে তাকিয়ে রইল সোফিয়া । তার কোনও তাড়াহুড়ো নেই, ব্যস্ততা নেই, সময় বয়ে যাচ্ছে না তার কাছে।
বকখালি গিয়েছিল তারা দুজনে। অনেক বছর হয়ে গেল। সমুদ্রের ধারে দুজনে বসেছিল। ঢেউ নেই, বালি আছে। বালির উপরে তারা শুয়ে পড়বে কিনা ভাবছিল। তারপর সোফিয়াকে অর্ক জিজ্ঞেস করেছিল, ধর্ম নিয়ে সমস্যা হবে না তো?
সোফিয়া বলেছিল, এই প্রশ্ন তো আমার।
অর্ক সংখ্যালঘু, তার পরিবারে সে-ই একমাত্র কবিতা লেখে। অর্কের মা সংখ্যালঘু কারণ সংসারে তিনিই একমাত্র কাঁথা সেলাই করেন। অর্কের বাবা সংখ্যালঘু কেননা তিনিই শুধু মার্ক্স পড়েন। সোফিয়া সংখ্যালঘু কারণ সে ভারতের মুসলমান।
অর্ক আকাশের দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে চেয়ে বলেছিল, দেখা যাবে। আমরা তো আর আকাশ থেকে পড়িনি।
সোফিয়া এই কথার মানে না বুঝেই রিপিট করেছিল, আমরা তো আর আকাশ থেকে পড়িনি।
তারপর সোফিয়া বলেছিল, তোমাকে পেয়ে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আমি লটারি পেয়েছি। তোমার কি এরকম কিছু মনে হচ্ছে?
অর্ক এভাবে বিষয়টাকে ভাবেনি। প্রথমে কী বলবে বুঝে পেল না। তারপর, সোফিয়ার হাতে চুমু খেয়েছিল।
এই চুমুর মানে কী ? এই চুমুর মানে—হ্যাঁ, আবার না। আসলে এই চুমুর কোনও ব্যাখ্যা নেই। এটা একটা প্রতিক্রিয়া, তাৎক্ষণিক জবাব, শরীরি বিবৃতি। মানুষ তখনই শরীরে আশ্রয় নেয় যখন ডায়লগ ফুরিয়ে যায়। কেউ আঘাত করে কেন ? কথা দিয়ে সমস্যার আর নিষ্পত্তি হচ্ছে না । চুমু। আরেকবার চুমু খেয়েছিল অর্ক, সোফিয়ার অন্য হাতে।
সময়ে বাঁধ নেই, সে বইছে । রাত-দিন, সকাল-বিকাল, মার্চ-এপ্রিল, পৌষ-মাঘ সে বয়ে যাচ্ছে। অর্ক আর সোফিয়ার মতো মানুষরা ক্যালেন্ডারে বাঁধ দিয়েছে। তারা পস্তাচ্ছে। নতুন দিনে নতুন কিছু দেখার ইচ্ছা নিয়ে তারা জেগে থাকে আর ব্যর্থ হয়। তারপরেও জেগে থাকে
সোফিয়া বলেছিল, আমাদের কি বিয়ে করতেই হবে ? আমরা একসঙ্গে থাকতে পারি না ?
অর্ক বলে, বিয়ে না করে আমরা একসঙ্গে থাকতে পারি, আবার পারি না। তুমি আমার, আবার তুমি আমার নও। আমি তোমার, আবার আমি তোমার নই।
পাঠক দেখুন, দুই তরুণ-তরুণী বিয়ের কথা ভাবছে। দুজনেই আর্থিকভাবে জিরো। তারা ধরেই নিচ্ছে, তাদের ভার বয়ে দেবে অন্য অনেকে। তারা ভাতকাপড় নিয়ে ভাবছে না। মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে মেয়েরা এই ভুল করে। তারা ধনী নয়, দরিদ্রও নয়। তাদের পোশাক খুব দামি নয়, একেবারে মলিন নয়। তারা খুব ভাল স্কুলে পড়েনি, আবার যে স্কুলে পড়ে সেটা খুব খারাপও নয়। তাদের মনে জগতের যে ধারণা তৈরি হয়, সেখানে সমস্যা রয়েছে। তারা বুঝতে পারে না। তারা কী চায়, কেনই বা চায়, ঠাওর করে ওঠার আগেই শরীর তেতে ওঠে। তাদের দুর্ভিক্ষের ভয় নেই। বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে। তাদের প্রেমালাপগুলো সব প্রায় একই ধরনের। এরাই বেশি কবি হয়। এই যেমন অর্ক আর সোফিয়া এখন যে জগতে বাস করছে সেটা গীতিকবিতার জগত। পয়সাকড়ি নিয়ে ভাবে না চট করে, তবে গরিবি থেকে তারা কয়েক কদম দূরে বাস করছে। এটা বোঝে হয়ত, অ্যাডমিট করে না।
বকখালির হোটেলে দুজন যুবক-যুবতী সঙ্গম করবে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে ! কে কোথায় কাকে নগ্ন করল, কোন আসন ট্রাই করল, তখন কেমন মনে হচ্ছিল, কে কার কতটা গভীরে—এসবের বিবরণ দেওয়ার দরকার আছে কি? পাঠক, আপনি সিদ্ধান্ত নিন। গল্পটি আপনি শুধু পড়ে স্নান করতে যাবেন, নাকি এর কিছুটা আপনিও তৈরি করে নেবেন, সিদ্ধান্ত নিন।
ইতোমধ্যে ১২টা বেজে গেছে। বারোটা বাজতেই চারদিক থেকে বাজি ফাটার শব্দ আসতে লাগল রান্নাঘরে। অবশেষে নতুন বছর।
সোফিয়া কান থেকে ফোন নামিয়ে বলল, চিৎকার করো না। মেয়েরা ঘুমোচ্ছে।
অর্ক বলল, আমার কষ্ট হচ্ছে। আমি এরকমভাবে থাকতে পারি না। আমার সব কাজ গুলিয়ে যায়। প্লিজ, তুমি বলো। কেন তুমি এমন করে রয়েছ ? ফোনে সবার সঙ্গে হাসছ আর আমার সামনে এলেই গম্ভীর ? কেন কেন কেন ? তুমি ঠিক কী চাও ?
সোফিয়া ঠান্ডা গলায় বলে, তুমি কী চাও ?
— এটা তো আমার প্রশ্নের উত্তর নয়। উত্তর দাও।
— আমার আর উত্তর দিতে ভাল লাগে না।
নতুন বছর এলেও রাত শেষ হয়নি। এখনও যেন ৩১ ডিসেম্বর। সকাল না হওয়া পর্যন্ত পয়লা জানুয়ারি নয়। সময়ে বাঁধ নেই, সে বইছে । রাত-দিন, সকাল-বিকাল, মার্চ-এপ্রিল, পৌষ-মাঘ সে বয়ে যাচ্ছে। অর্ক আর সোফিয়ার মতো মানুষরা ক্যালেন্ডারে বাঁধ দিয়েছে। তারা পস্তাচ্ছে। নতুন দিনে নতুন কিছু দেখার ইচ্ছা নিয়ে তারা জেগে থাকে আর ব্যর্থ হয়। তারপরেও জেগে থাকে।
অর্ক চিৎকার করে বলল, আমি কালই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি ।
· খ ·
রাত দেড়টায় আয়েশার বর নাসিরের ফোন।‘ অর্কদা, আয়েশাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। তুমি হয়ত আজই খালু আব্বা হবে।’
অর্ক বলল, কোন হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছ ?
নাসির বলল, আর জি কর। টেনশন হচ্ছে, তুমি আসতে পারবে ?
— সোফিয়াকে জানিয়েছ ?
— না, জানানো হয়নি।
– আমি আসছি। তুমি একবার সোফিয়াকে জানিয়ে রাখো।
নানা রাসায়নিকের গন্ধ আসছে। চারদিকে রোগের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। প্রসূতি বিভাগের বাইরে অনেকেই অপেক্ষারত, কেউ দাদু হবে, কেউ নানা হবে, কেউ মামা, কেউ বাবা।
আরজিকরের বেহাল বন্দোবস্তের মধ্যে রাত তিনটে সতেরোতে আয়েশার ছেলে হল। তার কানে আজান দিল নাসির। অর্ক পাশে দাঁড়িয়েছে। বাচ্চার দিকে তাকিয়ে তার হঠাৎ মনে হল, এর তো কোনও অপরাধ নেই, অথচ খামোখা শাস্তি ভোগ করতে এল ।
নাসির বলল, অর্কদা, বাচ্চার একটা নাম দাও।
অর্ক বলল, আমি তো আরবি জানি না।
— তাতে কী ?
— তবে, একটা নাম মাথায় আসছে। আমার প্রিয় কবির নাম। বলব ?
— নিশ্চয়ই, তুমি যা বলবে সেটাই ওর নাম হবে।
— রুমি।
— তাহলে, রুমি রাহমান।
অর্ক নাসিরের একটা হাত নিজের দুই হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, নতুন বছরের শুভেচ্ছা।
দুজনের চোখে জল। দুজনেই চোখ লুকোনোর চেষ্টা করছে।
অর্ক বলল, আচ্ছা নাসির, আমরা যদি ভায়রাভাই না থাকি, তারপরও আমাদের বন্ধুত্ব থাকবে ?
নাসির উদ্বিগ্ন। বলল, কেন, কী হয়েছে ?
–আয়েশা কিছু বলেনি আগে ?
নাসির চুপ করে থাকে। কয়েক মিনিট পর সে বলে, বৃষ্টি আর বারিধারার তোমাকে দরকার, অর্কদা।
অর্ক বলে, সোফিয়ার আর দরকার নেই আমাকে ?
নাসির কিছু বলে না।
নানা রাসায়নিকের গন্ধ আসছে। চারদিকে রোগের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। প্রসূতি বিভাগের বাইরে অনেকেই অপেক্ষারত, কেউ দাদু হবে, কেউ নানা হবে, কেউ মামা, কেউ বাবা।
নাসির চাপা গলায় বলল, অপরূপা কে, অর্কদা ?
সকাল হয়ে আসছে। কুকুরগুলো জেগে উঠেছে। পয়লা জানুয়ারি, বছরের প্রথম সকাল।
অর্ক প্রায় ফিসফিস করে বলল, নাসির আমি এবার যাই। ভূমিকা আর বারিধারার কথা মনে পড়ছে। একটু পরে তারা জেগে উঠবে।
· গ ·
সকাল সাড়ে নটা নাগাদ বাড়িতে ফিরে অর্ক দেখল, বোগেনভিলিয়া গাছে ফুল ধরেছে, বৃষ্টি আর বারিধারা উঠোনে নেমে নুড়ি কুড়োচ্ছে, সোফিয়া বারান্দায় বসে তাকিয়ে আছে। আকাশ অত্যন্ত নীল।
সোফিয়ার মুখ শান্ত, চোখ নরম, একটা সম্বোধন আছে, গ্রহণের জন্য তৈরি তার আঙুলগুলো ঠোঁটের কাছে নাড়াচাড়া করছে।
সোফিয়ার সব কিছু নিয়ে অভিমান, গান শুনলে কান্না পেত, বই পড়তে ভাল লাগত না । অর্ক তার হাত ধরেছিল । অপরূপা অর্কের হাত ধরেছিল । টাকা পাঠাত, সমস্ত খরচ সে দিত । এইভাবে অপরূপা একদিন হারিয়ে যেতে যেতে এমন দুনিয়ার বাসিন্দা হয়ে যাবে যেখানে ভুলচুক, বৈধ-অবৈধ, পাপ-পুণ্য বলে কিছু নেই ।
কোনও এক বছরের এমনই এক জানুয়ারির দিনে সোফিয়ার বাইপোলার ডিজঅর্ডার ধরা পড়েছিল আর অর্ক একটা প্রাচীন ভবনের গোল স্তম্ভের আড়ালে দাঁড়িয়ে কেঁদে যাচ্ছিল, সে অত বুঝত না। ডাক্তার বলেছিলেন, ওষুধ খেয়ে যেতে হবে, আরও কিছু ট্রিক। কতদিন খেয়ে যেতে হবে, কতটা কিওর হওয়ার সম্ভাবনা, কী করণীয়, কিছু জানা ছিল না।
দিনের পর দিন সোফিয়া ঘুমিয়ে থাকত ওষুধ খেয়ে, কেউ তাকে ডাকত না, সকাল দুপুর রাত—সব গুলিয়ে গেছে তার। অর্ক পাশে বসে গল্প করার চেষ্টা করত। ম্যাসিভ মুড ডিজঅর্ডার চেপে বসল ধীরে ধীরে। সোফিয়ার সব কিছু নিয়ে অভিমান হত, গান শুনলে কান্না পেত, বই পড়তে ভাল লাগত না। অর্ক তার হাত ধরেছিল। অপরূপা অর্কের হাত ধরেছিল। টাকা পাঠাত, সমস্ত খরচ সে দিত। এইভাবে অপরূপা একদিন হারিয়ে যেতে যেতে এমন দুনিয়ার বাসিন্দা হয়ে যাবে যেখানে ভুলচুক, বৈধ-অবৈধ, পাপ-পুণ্য বলে কিছু নেই।
অর্ককে দেখতে পেয়ে দুই মেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, কোথায় গিয়েছিলে আব্বা ?
সোফিয়া হেসে বলল, রুমি কেমন আছে ?
নাসির নিশ্চয়ই ফোন করে জানিয়েছে ওকে। অনেকেই জানে না, তবে অর্ক জানে কীভাবে নাসির আর আয়েশার সম্পর্ককে আপাতত বাঁচিয়ে দিল রুমি। অন্তত কয়েক বছর। কিন্তু এইভাবে জুড়ে রাখা যায় কি ?
বারিধারাকে কোলে তুলে নিল অর্ক, বৃষ্টি তার জামা ধরে আছে। বোগেনভিলিয়ায় ফুলটা তুলে নিয়ে অর্ক বারান্দার দিকে এগিয়ে চলল। সোফিয়ার চুলে ফুলটি সাজিয়ে দিলে যেন উদযাপন শুরু হবে।
সোফিয়া বৃষ্টিকে কোলে তুলে নিল। তার চোখের কোণে জল। অর্কের দিকে তাকিয়ে বলল, সত্যিই চলে যাবে ?
— কোথায় যাব ?
— কেউ নেই তোমার ?
— সবাই আছে।
— তাদের কাছে যাবে ?
— তাদের কাছেই তো এসেছি।
— আজ তোমার জন্মদিন, মনে আছে ?
— আজ, না ?
— তুমি কি এতই ভুলো মনের ?
— ডোন্ট টেক ইট আদারওয়াইজ, কিছু জিনিস আমি ভুলে যেতে চাই বলে মনে পড়ে না।
— আমাকেও ভুলে যাবে একদিন ?
অর্ক সোফিয়ার চুলে ফুল সাজাতে সাজাতে বলল, যদি ভুলে যাই কষ্ট পাবে ?
— খুব কষ্ট, মরে যেতেও পারি।
আজ সম্ভবত সোফিয়ার মন খুব ভাল আছে। হয়ত আজ তার মন ভীষণ খারাপ। সে হয়ত নিজের মধ্যে নেই, হয়ত ভীষণভাবে আছে। তবে, সোফিয়ার কথাগুলো সঙ্গীতের মতো বাজছে। বাজুক, বাজুক। সবই সাময়িক, স্নায়ুবিকলন।
অর্ক শুধু বলল, ওষুধ খেয়েছ ?
♦–♦♦–♦♦–♦
❤ Support Us