Advertisement
  • গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
  • সেপ্টেম্বর ৩, ২০২৩

আমার কোন দেশ নাই

ঋভু চট্টোপাধ্যায়
আমার কোন দেশ নাই

অলঙ্করণ: দেব সরকার

 
বেঞ্চটা হাতে করেই ঘরে ঢুকলেন ভদ্রলোক, মানে এই ঘরটার কেয়ারটেকার। ঘরও দেখেন আবার চা’ও বিক্রি করেন। আমরা অনেকেই ভদ্রলোকটিকে আড়ালে একটু মজা করেই বলি, ‘এই যে আমাদের ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী।’
 
তবে শীতের সন্ধ্যায় গল্প পড়বার ফাঁকে একটু গলা ভেজানো গরম চা এক্কেবারে একটা পেগের মত লাগে। গলা শুকনো থাকলেই সমস্যা, তখন কাশি হয়। অথচ এই শীতে লোকটি কাশেন না। তার মানে তার গলা শুকনো নয়, হবেই বা কিভাবে ? ‘শেষ যে চা পড়ে থাকে উনি গলায় ঢেলে নেন।’
একদিন সুশান্ত ধরে ফেলেছিল। জিজ্ঞেস করতেই হেসে উত্তর দেন,‘ড্রেনে ফেলতাম, তাই পেটে ফেললাম।’
 
তার মানে ড্রেন আর পেট দুটেই সমান। কয়েক বছর আগে এক ধর্মীয় যোগার ক্লাসে ট্রেনার এর উল্টো কথাই বলেছিলেন। হেঁচকির আঘাতে এক্কেবারে বেঁকে গেছিলাম, সেই সঙ্গে ট্রেনারের বকবক শুনছিলাম। অসহ্য লাগছিল, বেশিক্ষণ বসে থাকতে না পেরে বাড়ি যাবার কথা বলতেই ট্রেনার আমার দিকে অবাক ভাবে তাকিয়ে বলেছিলেন,‘ভালো লাগছে না ?’
 
— না, এক্কেবারে বিচ্ছিরি।
 
একটা লম্বা শ্বাস ফেলে ট্রেনার ভদ্রলোক বলে উঠেছিলেন,‘তাহলে যান ।’
 
বাইরে এসে মুক্তির স্বাদ নিয়েছিলাম । আমার মত লোকেদের কি আর এই সব ধর্মের কথা মনে আসে ? জোরে জোরে শ্বাস নিলে বুকের ভিতরের আওয়াজ শোনা যায়, ধুকপুক ।
 
— আমি আর পাই না । কেয়ারটেকার ভদ্রলোকলোক বলেন।
 
— কেন ?
 
— বুকটা ছেড়ে এসেছি।
 
— কোথায় ?
 
— দেশে।
 
‘আমাদের কেন দোষ ছিল না গো মজিবর চাচা / আমরা যে এমনি এমনি ভাগ হয়ে গেলাম।’
 
কোথায় যেন পড়েছিলাম, কবির নাম মনে পড়ে না, শুধু এই শব্দগুলো মনে থাকে । পড়লেই দু’চোখ দিয়ে জল পড়ে, জল গিয়ে মেশে কপোতাক্ষ নদীতে, তীরে বসে নিপাট একটা গান ধরে গফুর চাচা, কাছে যেতেই গফুর চাচার চোখে জল দেখতে পাওয়া যায়, তারপর আচমকা ডুকরে কেঁদে ওঠে, ‘তোমরা এখন আসো না কেন ?’
 
— সত্যিই তো আপনি এখন যান না কেন ?
 
— শেষ কবে গেছিলেন ? বেণুদি জিজ্ঞেস করে ।
 
— কলেজে পড়তে, তখন বাবা বেঁচে ছিল । বাড়িঘরের কিছুটা অংশ বিক্রি করে দিয়ে এল ।
 
— কোথায় বাড়ি ছিল আপনাদের ? মিতালি দি জিজ্ঞেস করে ।
 
— মানিকগঞ্জ, তবে আমরা থাকতাম সাবারে, বাবা ওখানকার একটা স্কুলে পড়াতেন । কাকাও থাকত, টিউসন পড়াত ।
 
— তারপর ?
 
— তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস গ্রাস করল সময়টাকে। সবাই আস্তে আস্তে চলে এলাম, প্রথমে দাদা, তারপর বাবা, কাকা আমি, দিদি। এল না কেবল মা আর ঠাকুমা। সবাই এল জায়গা পেল, আমার কোন জায়গা নেই।
 
আমাদের কারোরই তো কোন জায়গা নেই। ক্রাইসিস ফর স্পেস কিন্তু এখন সারা বিশ্বের একটা বিরাট সমস্যা হয়ে উঠছে। কি বলেন বেণুদি।
 
বেণুদি আমাদের গ্রুপের এই মুহূর্তের সব থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ। আমি খুব সতর্ক ভাবেই এই মুহূর্তে কথাটা ব্যবহার করলাম । স্থান, কাল পাত্রের পরিবর্তনে বড়ো ছোট সব পাল্টে যায়। আমার কাকার ছেলে বিমান বড়জ্যাঠাকে দেখে আর বলে, ‘বুঝলি, বড় জ্যাঠা আর গাঁয়ের নামোবাঁধের পশ্চিম কোণের বটগাছটার এক বয়স।’
 
আমি নামোবাঁধে নামতে চিরকাল ভয় পাই। কিন্তু ঘাট কাজ আর মড়া পুড়িয়ে এসে এই পুকুরেই সবাই স্নান করে। আমি তো ডুবে স্নান করতে পারি না। হাঁটু জলে নেমে মগে করে মাথায় জল ঢালি। বিমানের বাবা মানে আমার সেজকাকা মারা যাওয়ার সময় শ্মশান ফেরত নামোবাঁধে স্নান করে আসি। তারপর সবাইকে রাস্তায় একটা কাঁটা ডিঙিয়ে হাঁটতে হয়, আর পিছনে তাকাতে নেই। আমিও তাকাতে পারিনি, কিন্তু খুব ইচ্ছে করছিল একবার পিছনে তাকাই, দেখি সেজোকাকা সত্যি দাঁড়িয়ে আছে কিনা, থাকলে জিজ্ঞেস করি, ‘আচ্ছা তোমার কি জায়গা ছিল না, নাকি বয়স হয়েছিল ?’
‘মরার কোন বয়স নেই রে পাগলা।’
 
‘বাংলা সিনেমার নায়ক মার্কা কথাগুলো শুনে সেদিন আমার ফাটছিল, জ্বলছিলও। কিন্তু কিছু বলতেও পারছিলাম না।
 সেজকাকিমার কি সম্পর্কে মামা হন। সেজকাকা মারা যাওয়ার পরে কাকিমার সাথে দেখা করতে আসেন। সকালেই একপেট মদ গিলে নিয়েছিলেন, মুখ দিয়ে ভ্যাগ ভ্যাগ গন্ধ ছড়াচ্ছিল। চলে যাওয়ার পর কাকিমাকে জিজ্ঞেস করতেই বিমান বলে, ‘এই দাদু একদিনে নিজের বউ, মেয়ে, জামাই আর নাতনিকে হারিয়েছেন, তারপর থেকে সকালে উঠেই এক গলা মদ মেরে ঘুরে বেড়ান। কাঁদেন না, কখনও বউ, মেয়েদের নামে কিছু বলে না। প্রচুর সম্পত্তি, মরে গেলে কোন এক মঠ পাবে। তারপর ওই দাদু মিশে যাবে এই পৃথিবীর একটা জায়গায়।’
 
ছোটবেলায় একটা সিনেমা দেখে মাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলাম । বন্যার পর একটা দ্বীপের সবকিছু নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর দ্বীপের একজন একা ফিরে আসে, দ্বীপটাও তখন লোক শূন্য, শুধু এসে দেখে তাদের ফেলে আসা ঘর থেকে একটা নেকড়ে বাঘ বের হচ্ছে, মুখে রক্তের দাগ। আমিও কেঁদে উঠি, মনে হয় এই বুঝি আমার মা আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে, অথবা আমি মাকে ছেড়ে যাচ্ছি ।
 
— আমিও খুব কেঁদে ছিলাম জানেন, আমারও তো মা ও’দেশেই রয়ে গেছিল, আসেনি, শেষদিন মোচড় দিয়ে কষ্ট হচ্ছিল ।
 
মাকে বললাম, ‘ইন্ডিয়া যাবা না ?’ মা হেসে দেয়,‘ক্যান, দ্যাশ ছাইড়া যামু ক্যান ? হক্কলরে ফেলাইরা যামু কই ?’
 
জানেন আমাদের উঠোনে আরেকটা পরিবার থাকত, আমি তখন সতোরো আঠারো আর বিনি তোরো, ওরাও হিন্দু ছিল। এখানে আসবার আগের দিন মাঠে ঘোরবার সময় বিনির চোখে জল দেখেছিলাম । আমাকে বলে, ‘তুমার আর ফিরনের মন নাই, ফিরবানা কও ?’
 
— দেহা হইব, আবার দেহা হইব।
 
কিন্তু আর দেখা হয়নি, তবে শেষ দিন ওর বুকে মাথা রেখে অনেকক্ষণ বসেছিলাম, সদ্য কিশোরি, দুপাশে দুটো নরম বালিশ, ঘুম এসে গেছিল। চোখ খুলতেই দেখলাম বিনির ভেজা চোখের নিচে ভেজা চিবুক ।
 
— আর দেখা হয়নি ?
 
— না, শেষবার গিয়ে শুনলাম বিয়ে হয়ে গেছে। ইন্ডিয়াতেই আছে, আসামে বা অন্য কোথাও।
 
— তার মানে বিনির জন্যেই আপনি বিয়ে করেননি।
 
—না না, তা নয়।
 
ভদ্রলোক প্রতিবাদ করে ওঠেন, আমার কোন জায়গা নেই।
 
জায়গা তো আমাদের কারোরই নেই, ভাসছি সবাই ভাসছি, অথবা একটা চেষ্টা,‘যদি অন্য কিছু বিকল্প পাওয়া যায়।’
 

দ্রৌপদির আগের জন্মের নাম ছিল নালায়নী, তার বিয়ে হয় ঋষি মৌদগল্যের সাথে। ঋষি নালায়নীর ভালোবাসা বোঝার জন্য কুষ্ঠ রোগী সেজে থাকতেন । নালয়নীও সব কিছু জেনে বুঝে স্বামীর সেবা করতে থাকে। ঋষি খুশি হয়ে বর দিতে চান, নালায়নী অদ্ভুত এক বর চেয়ে বসেন, আপনি আমাকে পাঁচজন আলাদা পুরুষের মত ভালোবাসবেন

 
— আমাদের শাস্ত্র বলে,‘ভার্যায়াং রক্ষ্যমাণায়াং প্রজা ভবতি রক্ষিতা/প্রজায়াং রক্ষ্যমাণায়ামাত্মা ভবতি রক্ষিত। ধর্ম পত্নীকে রক্ষা করলে প্রজা রক্ষিত হয়, প্রজা রক্ষিত হলে সকলের নিজের আত্মাই রক্ষিত হয়।’
 
কথাগুলো মিতালিদি ভদ্রলোককে বলে সেইমাত্র চপে দাঁত ছোঁয়ালেন। ভদ্রলোক তখন চা তৈরিতে মগ্ন। দিদির কথাগুলো শুনলেন কিনা জানিনা, আপন মনে গানও গাইছেন, গান মানেও কৃষ্ণ নাম। ভারতবর্ষের মাটিতে ধর্মকে বাদ দিয়ে কোন কিছুই সম্ভব নয়। যে খেতে পাচ্ছে না, যে খাচ্ছে, সেই সঙ্গে চোর ডাকাত সবার মুখেই এক কথা,‘অধনং মধুরং বদনং মধুরং।’
 
মিতালিদি ভদ্রলোককে ডেকে সেই শাস্ত্রের কথাগুলো বাংলা করে আবার বলতেই ভদ্রলোক বলে উঠলেন,“যদি মেয়ে হতাম কি বলতাম জানেন, ‘নৈব মে পতয়ঃসন্তি ন পুত্রা না চ বান্ধবাঃ । না ভ্রাতরো ন চ পিতা নৈব ত্বং মধুসূদন ।’ জানেন মহাভারতের কখন কে এই কথাগুলো বলেছিল ?”
আমরা তখন চুপ । এর ওর মুখের মানচিত্র খুঁজছি ।
 
— কিছু বদলায়নি, আজও আমি রজঃস্বলা হই, আর আমাকে টানতে টনতে রাজসভায় নিয়ে যায় । আমি দাঁড়াই, কাঁদি, কিন্তু তারপর…?
 
ভদ্রলোক একটা লম্বা শ্বাস নেন, ‘আমার তো আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই।’
 
গ্রামের বাড়িতে আমাদের অনেক জায়গা ছিল। দেখতাম গরুর গাড়ি করে আসছে চাল, আখের গুড়, মুড়ি বিভিন্ন রকেমর ডাল। সেই সবের ভাগ হত। শহরে আসবার পরেও বাবা মাঝে মাঝে গ্রামে গিয়ে সেই সব বিক্রি করে আসত। পরে আস্তে আস্তে সেই সব জমি বিক্রি হল। আমি তখন ছোট তাও বাবার সাথে রেজিস্ট্রি অফিস যেতাম । বহুবার রেজিস্ট্রি অফিসে জমি বিক্রি করতে আসা কতজনকে হাউহাউ করে কাঁদতে দেখেছি। বাবাকে জিজ্ঞেস করেছি, ‘এরা কাঁদছে কেন, আমরাও তো জমি বিক্রি করছি।’
 
—আমরা করছি শখে, এরা করছে দায়ে । এদের কাছে জমি হল মা, আমাদের কাছে টাকা রোজগারের উপায় ।
‘এখানে আমার দেশ ছিল, আজ নেই ।’
 
শহরে আসার পরে বাবাও মনে হয় বলত, ‘ওইখানে আমার গ্রাম ছিল, আজও আছে, শুধু আমি নেই ।’
 
গ্রাম আর দেশ কি এক ?
 
— ওসব বাজে কথা, যখন যেখানে থাকা হয় সেটাই দেশ হয়ে ওঠে, থাকার জায়গায় কোন সমার্থক শব্দ হয় না ।
 
কথাগুলো সুশান্ত বলেই একটা গল্প পড়বার প্রস্তুতি নেয়, ল্যাপটপ বের করে। তারমানে সব লেখাই ভার্চুয়াল। ভার্চুয়াল লেখা কি জায়গা নেয় ? প্রথম প্রথম ফিজিক্স পড়বার সময় মাথায় একটা প্রশ্ন হামলা করে, ‘লেখার ছায়া হয় ?’ স্যারদের জিজ্ঞেস করি, উত্তরও পাই, ‘হয়, কিন্তু আমরা ধরতে পারি না ।’
 
— লেখার কিন্তু একটা লম্বা ভার্চুয়াল ছায়া আছে। এক্কেবারে সেই কাকদ্বীপ থেকে কুচবিহার, অথবা কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারি ।
এটা রঞ্জনদার কথা । আমাদের গ্রুপের সম্পাদক, এতক্ষণ চুপ ছিলেন, মানে জরিপ করছিলেন । আমরা, মানে যারা এই সপ্তাহের শুরুর সন্ধেটা একটা টেবিলের চারদিকে কয়েকটা চেয়ার পেতে কাফকা, কামু থেকে এখানে হাংরী নিম আর সমস্ত চৌধুরিদের কাটা ছেঁড়া করি সেই জায়গার সম্পাদক । দাদাও কিন্তু কেলেঙ্কারিতে আহত । দিনের পর দিন বদলে গিয়েছে ঠিকানাও । এখানে পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণের ব্যাপার ।
— রঞ্জন, তুমি সেই মাইক্রো থেকে ম্যাক্রো কসমিক জগতে উঠলে ।
 
বলে উঠলেন অলোকদা। আমাদের গ্রুপের এই মুহূর্তে যার একটা আলাদা জায়গা আছে। শব্দ অক্ষরের জায়গা খোঁজার মাঝেই নতুন উপন্যাসের ভরকেন্দ্র খুঁজছেন।
 
রঞ্জনদা জবাব দিত এমন সময় ঘরে ঢুকল করবী। ‘কে বলবে শীতকাল ঘেমে গেলাম। তোমাদের অনেকক্ষণ আগেই আরম্ভ হয়ে গেছে ?’ তারপরেই সেই ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কিছু হবে হাতটা টোটোতে কেটে গেল।’
 
— চুষে নাও। রঞ্জনদা বলল।
 
— এই চোষা শব্দটাই খুব বিতর্কিত। কত মানুষ কত কিছু যে চুষে নিচ্ছে তার আর হদিশ পাওয়া যায় না।
 
আমার কথার উত্তরে কেউ কোন উত্তর দেবে না, এটাই স্বাভাবিক, সবাই তো আর শেলী নয়। আমার সঙ্গে কলেজে পড়ত। এক গ্রীষ্মের দুপুরে কলেজের ব্যালকোনীতে একটা মেয়ের কাঠি আইশক্রিম চোষা দেখে একরকম হেসে লুটিয়ে আমাকে দেখিয়ে বলে,‘দেখছিস ?’
 
—কি দেখব ?
 
পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সোমা, শেলিকে বলে,‘তুই ভালো করে দ্যাখ পরে কাজে লাগবে ।’ তারপরেই দুজন ওই জায়গা থেকে সরে গেছিল। এখানেও সেই জায়গা।
 
— আপনারা মহাভারত পড়েছেন ? দ্রৌপদির পূর্ব জন্মের কথা জানেন ?
 
কিন্তু ভদ্রলোকের প্রশ্ন শুনেই আমাদের সবার মুখে আবার মরূভূমির ছাপ। চা তৈরি হয়ে গেছে। ছোট ছোট কাপে চা দিতে দিতে বললেন, ‘দ্রৌপদির আগের জন্মের নাম ছিল নালায়নী, তার বিয়ে হয় ঋষি মৌদগল্যের সাথে। ঋষি নালায়নীর ভালোবাসা বোঝার জন্য কুষ্ঠ রোগী সেজে থাকতেন । নালয়নীও সব কিছু জেনে বুঝে স্বামীর সেবা করতে থাকে। ঋষি খুশি হয়ে বর দিতে চান, নালায়নী অদ্ভুত এক বর চেয়ে বসেন।’
 
— কি বর ? রঞ্জনদা জিজ্ঞেস করে ।
 
— আপনি আমাকে পাঁচজন আলাদা পুরুষের মত ভালোবাসবেন, দেখুন সব স্ত্রী তার স্বামীর মধ্যেই ওই পাঁচটি গুণ খোঁজে ।
 
— তার মানে এখানেও কি সেই একটা ছোট জায়গার জন্য পাঁচজনের লড়াই ।
 
— বাবা ! আপনি তো বেশ পড়াশোনা করেছেন, চাকরি করেননি কেন ? সেই সময় তো চাকরির এতটা খারাপ বাজার ছিল না ।
 
— আমার সব কিছু পোকাতে নষ্ট করে দিয়েছে, একটা জায়গায় রাখা ছিল ।
 
এতক্ষণ আমাদের অলোকদা চুপ ছিল । এবার কথা আরম্ভ করতেই সুশান্ত চিৎকার করে ওঠে, ‘গল্পটা পড়ব নাকি এরকম এই ভাটের আলোচনা হবে ?’
 
— না না, তুমি পড়, আমাদের তো এই গল্প পাঠটাই আসল, এর জন্যেই তো এক একটা জায়গা ছাড়তে ছাড়তে এখানে এসেছি, না পড়লে সব তো জলে চলে যাবে।
 
রঞ্জনদার কথার লেজেই সুশান্তের গল্পের দুটো নদী এসে মিশল। দেখলাম দুটো নদীর একটার লিঙ্গ আছে, আরেকটার যোনি, মাঝরাস্তায় দাপাদাপি, আরেকটা নদী জন্মের অক্ষর প্রাপ্তি ।
 
— তোমার গল্পে বড়ো বেশি শরীরের গন্ধ, একটুও মন নাই ।
 
সুশান্ত গল্প পড়বার মাঝে থেমে বেণুদির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,‘শরীর ছাড়া প্রেম হয় ?’
 
— নিশ্চয় হয়, প্লেটোনিক লাভ আছে না ।
 
— ওটা তো ফোকলা দাঁতে মাংস খাওয়া । একটু আগে ওই ভদ্রলোক যে দ্রৌপদির মহাভারত বললেন না, ওখানেও শরীর আসে। তিন ইঞ্চি পুরো পৃথিবীকে ঘুরিয়ে দিতে পারে।
 
আমার সেই ছোট্ট চুটকিটা মনে পড়ে গেল। সেই অঙুল ভরা, আঙটি হারিয়ে যাওয়া, কয়েকজনকে ভিতরে পাওয়া, ট্রাক হারিয়ে যাওয়া ইত্যাদি, সত্যিই তিন ইঞ্চিই জায়গা লাগে।
 
— আজকের আলোচনা অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে, আঁশটে গন্ধ উঠছে । সেই বেণুদি ।
 
কথাগুলোর উত্তর দিতে পারিনি। সার্থকদার ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দূরের নিজের বাড়িতে চলে যাওয়ার পরে এ’ডাল ও’ডাল থেকে কিভাবে যে আস্তানা জোগাড় হল সে বিষয়ে আমাদের ধারণা অল্পই। একটা জায়গায় কয়েকজন গুটি মেরে বসে থাকবার পর একদিন আকাশ থেকে একটা চায়ের টেবিল আর কয়েকটা চেয়ার এল, চেয়ার থেকে কয়েকটা হাত পা । জায়গা দখলের জন্য ছোটাছুটির মাঝপথে মাথা এল । আমি এড়িয়ে যাবার জন্যে একটু বাঁ’পাশে গেলাম ফিরে একটু ডানপাশে। এরমাঝে একটা অনুষ্ঠানের জন্য কয়েকদিন রিহার্শাল করতে হবে। একদিন একটা গানের মাঝেই এই ঘরটার মালিকপক্ষ হাজির । না, কটু কথা নয়, খুব আস্তে আস্তেই বললেন, ‘আমাদের একটা মেলা আছে তো, জিনিসপত্র এই ঘরটাতে কয়েকদিনের থাকবে, আপনারা সামনের সপ্তাহে যদি অন্য কোথাও বসেন তবে খুব ভালো হয় ।’
 
আমরা সবাই সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি,  দেখছি সেই রিক্সাওয়ালার মত, যে বলে, ‘আমার কোনো স্ট্যান্ড নাই ।’
 

♦♦♦♦♦—♦♦♦♦♦

 


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!