- গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
- আগস্ট ২৭, ২০২৩
এটিএমওয়ালা

অলঙ্করণ: দেব সরকার
হাতুড়ি ছাপ দেয়া গোটা প্যাকেটটাই নিজের পকেটস্থ করে চোখ বুজে লম্বা করে টান মারল বিধাতা। তারপর বন্ধু ধোঁয়ার পাশে নিজের ধোঁয়া ছুঁড়ে বলল, “ বড্ড ভালো রো টান দিতেই ভেতরটা এমন ফুরফুর করে উঠল, তোরে কী আর বলি!”
‘ভালো লাগিছে তোমারা যাক, আমার অদ্দুর থে বিড়ি নে আসা সাথক হল গো। ওরা কতিছিল, যাতিছিস যা, খুঁজে পাবিনানে। তা আমি কলাম, ছোট্টব্লোয় কতবার এ গাঁ ও গাঁ তন্নতন্ন করে বাড়ির হারানো গরু খুঁজে বার করিছি। খোঁজা আর খুঁজে পাওয়ায় যে কী সুখ, তা তোরা বুঝবি নে। আমি ঠিক বার করি ফেলব আনে। তোমারে দেহি ওই বিভিন্ন টানের মতো আমারও প্রাণে আরাম হতিছে বিধাতাদা।”
“ তা বলরে ভোলা, গাঁয়ের লোকজন সব কে কেমন আছো খুড়িমা কেমন আছে?
গায়ে আকাশি-নীল সাফারি, আর কালো জুতোয় ঝা চকচকে বিধাতা দাসকে কেমন ফিল্মের নায়কের মতো লাগছিল। সূর্যের তেজ ঝরেছে, বাতাসে মিঠে ভাব আর কাঁধের উপর ওই নায়ক নায়ক বিধাতাদার হাত, ভোলানাথ কর্মকার খানিকটা তো ভেবড়ে যাবেই।
“ হ্যাঁ, কতিছি কতিছি। আমাগে গাই-গরুটারে বেচে দিতি হলো। মা কলো, এহনে দ্যাখপে কে । তোমার বাপ নাই। সারাদিন তো আমার কাটে ধানকলের মাঠে। আর খবর, পলাদের জালায় সাঁতার কাটা বন্ধ। সে জালা জুড়ে মাটি পড়ে এখন ঢাউস বাড়ি উঠতিছে। আর জব্বর খবর হলগে, লাল মোরাম পথের জায়গায় আমাদের হেড়োভাঙা গাঁয়ে সব শান বাঁধানো পথ। সাইকেল চালায়ে মজা।”
“ তা ভোলা এখনও দুপুরে টিফিনের সময় জফলা আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে সাইকেল নিয়ে দাঁড়ায়ে থাকিস?”
ভোলানাথ ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে বলল, কী যে বলো দা, সেসব দিন আর আছে নাকি ! এখন প্রজাপতিকাট চুলের ছেলেরা বাইক নে ছুটির ঘন্টার আগে স্কুলের সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর ছুটি হতেই এক একটা সরস্বতীকে পেছনে বসিয়ে ধী। এখন তুমি যদি দেখতে সে বাইকের কী কসরতা যেন মাদারিপুরের মাঠে সার্কাস পড়িছ । এই ভোঁ দৌড় দেয় তো এট্টুস পরে ব্রেকে চাপ। আমাদের ডাক পিওন মার্কা সাইকেলের দিন আর আছে নাকি !”
বিধাতা বিড়ির টুকড়োয় শেষ টান দিয়ে টুসকিতে সেটি রাস্তার উপর যেতে দিয়ে বলল, “তা তো হবেই, শহর এমন করে পাল্টালে, গাঁয়ের গতরেও তো কিছু তার ছাপ পড়বে। একটু বাদেই সন্ধ্যে নামতে না নামতেই দেখবি কেমন ঝিকিমিকি আলো জ্বলে মায়াবী হয়ে যায় শহর !”
ভোলানাথ এই পালটানো তো টের পাচ্ছে তার সামনের লোকটার চেহারায়, আদব-কায়দায়, দাঁড়ি-গোঁফহীন মুখের চকচকেপনায়। একদম পালটে গেছে চেহারা। বিধাতাদারাও তো তাদের মতো সবজি বেচত বাজারে।
মনে পড়ছে তার বাপ সকাল বেলায় চেল্লাত, “আরে অবেধাতা, কনে গেলি ! হেদেই, নড়িয়ে আয় বলছি। রোদ্দুরের রং পালটি গেলি আর বাজারে বসতি জায়গা পাব নানে।” তার “বাপের চেল্লানোর পর চোখে পড়ত, একটা স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে হাফপ্যান্ট পরে মাথায় ইয়া বড় ঝাঁকা নিয়ে চলছে বিধাতা দাস। পেছনে পেছনে লুঙ্গি আর ফুল শার্ট পরে তার বাবাও একটা ঝাঁকা মাথায় নিয়ে বের হত।
সেই বিধাতার সাথে এই বিধাতার কত যে ফারাক ! ভোলানাথ কথাটা পাড়তে পারছে না। মানে গাঁয়ে যেমন ঝাপ্ করে যেকোনো কথা বলা যেত, তা কি শহরে বলা যায়। ভাবনাটা মাথার ভেতর কুড়মুড়ি খেলছে। বলবে কি বলবে না ! অনেক কষ্টে যোগাড় করেছে বিধাতাদার ঠিকানা । এক সময় এক সাথে ফুটবল খেলেছে, পুকুরে সাঁতার কেটেছে, রথের মেলা কি গাজনের মেলা— সব একসাথে। বয়সে একটু বড়ো হলই না, প্রায় তো বন্ধুর মতো ছিল। বন্ধুরে এটুকু কি বলা-কওয়া যাবে না ! তাছাড়া কলকাতায় তার আর কে আছে, যাকে ধরাকরা করা যায় !
ভোলানাথ দেখল, বলতে গিয়েও সে কথাটা বলতে পারছে না। মুখ ফাঁক হচ্ছে আবার বুজে আসছে। যেন পুকুর থেকে কাতলা মাছ তোলা হয়েছে, এমন দশা । জলের কথা মনে হতেই খুব তেষ্টা বোধ হলো তার। সে বলল, বিধাতাদা, তোমার কাছে কি টুকুস জল আছে? খুব তেষ্টা পেয়েছে, জানো।!
ভোলানাথকে হাতের ইশারায় শান বাঁধানো গাছতলায় বসতে বলে বিধাতা চলে গেল রাস্তার অন্যপারে ঝকঝকে কাচের ঘরটিতে। তারপর দু’লিটারের সবুজ জলের বোতলটি এনে তুলে দেয় ভোলানাথের হাতে। ভোলানাথ উঁচু করে গলায় খানিক ঢালার পর শব্দ করে বলল, “আহ ! কী যে আরাম হল বিধাতাদা, তা তোমারে কী করা জলের যে এমন সোন্দর স্বাদ হয় আগে জানিনি। আট্টুস খাব ?”
— হ্যাঁ, খা না। খেয়ে শেষ করলেও কোনো ক্ষতি নেই। আবার জল ভরে একে ঠিক এমন স্বাদের বানিয়ে ফেলব ওই ঘরে রেখে।
ভোলানাথ দেখল এটাই ঠিক সময়। সে বলল, তুমি দেকতিছি কল্পতরু।
এটুকু বলেই সে আরো খানিক জল ঢক ঢক করে গলায় ঢেলে দিল। তারপর বোতলের ছিপি এঁটে তা ফিরিয়ে দিয়ে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখ মুছে বলল, বিধাতাদা, তোমার নাম একেবারে সাত্থক। বিধাতার মতো খোলামেলা তোমার পরাণড়া। তোমার কাছে কিছু চাইতে গেলে লজ্জা লাগে না।
বিধাতা একটু যে ভড়কে যায়নি তা নয়। একটা বিড়ি খেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু বান্ডিলটা বের করলেই তো একটা ভোলানাথকেও দিতে হয়। ওরই দেয়া। সাত-পাঁচ ভেবে ইচ্ছে সংবরণ করে সে। বদলে ভোলানাথের দিকে একটা ফ্যাকাশে চোখ নিয়ে তাকায়।
মা আমারে ঠেলেঠুলে পাঠালো গো। কলো, যা ভোলা যা, বিধেতার কাছে যা, সে তোর একটা হিল্লে করে দেবেনে।
বিধাতা কথা বলে না। সে অজানা আশঙ্কায় কাঁপে। অনেকক্ষণ এসেছে ভোলা। এখনো যাচ্ছে না তো ! আজ কি এখানে থেকে যাবে নাকি !
ভোলানাথ খানিক দম নিয়েছিল। ছোটবেলা থেকেই কাজের কথা বলার সময় সব গুলিয়ে যেত। প্রাইমারি স্কুলে ঢুকেছিল, কিন্তু দিদিমণিরা কিছু জিজ্ঞেস করলেই এমন আকাশ ভেঙে পড়ত মাথায় যে মনে হত সব গ্রহ-নক্ষত্র বুঝি মাথার ভেতর ছুটোছুটি করতে লেগেছে। এখন বিধাতাদাকে কিছু বলতে হবে ভেবে সেই দশা।
তবুও দান ছাড়তে তো সে রাজি নয়। আজ না বললে আর হবে না। কিছু না বলে ঘরে ফিরলে মা চ্যালা কাঠ নিয়ে তাড়া করবে। সে বলল, তুমি জানো তো বিধাতাদা, বাবা বুকের অসুখে মরে যাবার পর বাজারে কাঁচাসবজির ব্যবসা আমাদের উঠে গেলা বাবার জমানো টাকা দিয়ে ভ্যান-রিক্সা কিনলাম। তা বেশ পক্ষীরাজ নিয়ে ক্যানিং টেশন আর আমাদের গাঁয়ের ভেতর দিব্য উড়ছিলাম। কিন্তু ঝেই টোটো মহারাজরা এসে গেল অমনি আর কেউ ভ্যান-রিক্সায় চাপতি চায় না। কী করি তখন ! পেট চালাতে মালপত্র, সিমেন্ট, ইট টানা শুরু করি। কিন্তু তাও তো আমার কপালে সইল না। এখন সেসব দোকানের গাড়িই পৌঁছে দেয়। আর আমার গাড়ি গাছতলায় বসে থাকে।
—তুই ইট-বালির দোকানদার কে ধর। তোকেও কাজ দেবো ।
—তা হলি তো হয়েই ঝ্যাত। তেনারা কন, তোকে দিয়ে মাল টানার ক্যানা আমাগে ছ্যামড়ারা দিনির বেলায় মাল বয়, রাতের বেলায় ঝান্ডা। তো আমার তো হোঁকানো ভাব৷ সে কাজ তো আমি করতি পারব না। আর তা মুখের পরে বলি দিলে আমার মতো ঢ্যামনারে কাজ দেবেনে কোন শুয়োরের পো !
ভোলানাথ নিজের মুখেই হাত চাপা দিয়ে নিজেকে থামায়। তারপর খানিক গুছিয়ে নিয়ে বলে, বিধাতাদা, শীতে এবার তুমি দ্যাশে গেছিলে না ?”
এটিএম-এর কাচের দেয়ালে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল বিধাতা দাস। তার বুকের ভেতর থেকে তখন উথাল-পাথাল গোঙানি বেরিয়ে এসে নিজেকে খালি করে দিতে চাইছে। ওই গোঙানিতে কান পাতলে হয়ত শোনা যেত বিধাতা বলছে, আমি বিধাতা নই রে ভোলা। তুইই আমার ভগবান
— হ্যাঁ, খুব দরকার ছিল। একদিন যেতে হয়েছিল।
— তো সেইদিনই মা তোমারে দেকিছিল। সে কলো, আমাগে বিধেতা এমন সাহেব হয়েছে কলকেতা গিয়ে, কী কব! ঝ্যামন দেখতি লাগতিছিল, মনে হয় রাজার ব্যাটা এয়েছে।
বিধাতা শুকনো হেসে বলে, না না, খুড়িমা অনেকদিন পরে দেখেছে তাই অমন মনে হয়েছে।
বিধাতাদা, সেদিন মা কলো, তুই একবার কলকেতায় যেতি পারিস না ! তো আমি বললাম, আমার তো কিছুই চেনা-জানা নাই। কার দোরে যাই, কোথায় দাঁড়াই! মা আবার কলো, কেনে বিষেতার সাথে তোর কি ভাব- ভালোবাসা ছেল না ! আমি আলো দেখতি পালাম বিধাতাদা।
— তা, তোর তো বাড়ি ফিরতে হবে না নাকি ! মেলা দেরি করলে তো বিপদ। শেষে না রাত কাটাতে হয় স্টেশনে ।
বিধাতার মনে হচ্ছে সমস্যা কিছু একটা আসতে যাচ্ছে। আর তা আসার আগেই যদি রুখে দেয়া যায় তো ভাল। রাতে যদি কোনভাবে থেকে যেতে চায় ভোলানাথ, তবে বেশ মুশকিল। কী খাওয়াবে, কোথায় থাকতে দেবে ? কিছুটি ভেবে উঠতে পারে না। সে তাড়া লাগায়, ফিরতে যখন হবেই ভোলা, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়া ভাল। আমি তো জানি স্টেশন থেকে বেশি রাতে আমাদের হেড়োভাঙা গাঁয়ের রাস্তা মোটেও সুবিধার না। চুরি-চামারি, খুন-খারাবি, ছিনতাই-টিনতাই লেগেই থাকে।
ভোলানাথ যখন মুখের আগল ভেঙে ফেলেছে তখন আসল কথাটা না বলে আর ফিরবে না সে। নাচতে নেমে ঘোমটা টেনে আর লাভ নেই। মা-র রাগী মুখটা মনে এল। ধানকলের মাঠে খাঁ খাঁ সুর্যি মাথায় তার ধান শুকোতে। দেবার কাজের ছবি চোখের উপর ভাসতে লাগল। ভোলানাথ বলে উঠল, তা বিধাতাদা, ক’লে নাতো তোমারে হেথায় কী কাজ করতি হয় !
বিধাতা দাস বুঝতে পেরে গেছে। সে কথা ঘুরিয়ে ভয় দিতে চায়— বলিস না, সে অনেক কাজ। জবর কাজ।হাজার হাজার, লাখো লাখো টাকা আমি পাহারা দিই। গুন্ডা, বদমাশ, চোর— সব চোখ পাকাতে পাকাতে যায়। চোখ বড়ো বড়ো করে ভোলানাথ বলে, তোমার ভয় লাগে না ?
— লাগেই তো। ঘুম রাতে কোনো গাড়ি এসে দাঁড়ালে মনে হয়, এই বুঝি তারা এসেছে। আমি ছোটো ফল- কাটা ছুরিটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াই। ফুটবল খেলার কথা ভেবে পা টানটান করি। যেন লাথায়ে ফুটবল ওড়ানোর মতো উড়োয় দিতে পারি।
— উড়িব্বাস ! তোমার তো দেখতিছি খুব সাহস। আমার ও খুব সাহস। বাড়ির পাশের বাঁশের ঝোঁপের মদ্যি সারারাত ধরে মরা কান্না চলে। সেথায় ঢুকতি কেউ সাহস পায় না। আমি একখান হেঁসো হাতে সকাল হলেই চলি যাই। ওইসব ভূত-প্রেত, দত্যি-দানো আমি মোটে ভয় করি না।
বিধাতা কথা চালায়, তবে দুপুরবেলায় কালো গাড়ি আর বন্দুক নিয়ে এসে যখন থরে থরে টাকা রাখে বাবুরা তখন খুব মজা লাগে৷ এই গোলাপি গোলাপি দু’হাজার টাকার নোট এলো এক ব্যাগ তো আর এক ব্যাগ সবজে সবজে কড়কড়ে পাঁচশ টাকা এসে ঢুকে পড়ল। নতুন টাকার ঘ্রাণে একদম চনমন করে শরীর। তাছাড়া দিনভর তো সুন্দরীদের সেন্টের গন্ধে ঘর মম করে।
— মেয়ে ছেলেরা আসে এখানে ? গা ভোলানাথের দুরন্ত কৌতূহল।
— আসবে না কেন ! ওরাই তো বেশি আসে। শাড়িপরা, ফ্রক পরা, চুড়িদাড় পরা — কত রকমের কত সাজের সুন্দরীরা যে ঢোকে ! তাদের গায়ের গন্ধে, আঁচলের হাওয়ায়, চোখের চাওয়ায় মন একদম ভালো হয়ে যায় রে ! মনে। কর ছোটোবেলায় ‘জফলা আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে ওই যে সাইকেল চালিয়ে গিয়ে দাঁড়াতাম, যেমন ভাল লাগত, এখানেও তেমন। এখানে অবশ্য আমাকে যেতে হয় না। ভালো লাগা কাছে চলে আসে।
ভোলানাথ আর পারছিল না। যে ঝকমকে জীবন বন্ধু বিধাতা কাটায় এই ঠাণ্ডা ঘরটায় বসে বসে, তা কি সে পেতে পারে না ! ঝপ করে বলে বসে, বিধাতাদা, হেথায় আমার একটা কাজ হয় না ! ঝদি কিছু করি ম্যানেজ দিতি পার তো আমাদের মা-ছেলের দুটো পেরাণ বাঁচি যায়৷
এই ভয়টাই পাচ্ছিল বিধাতা। এখন কী বলবে ভেবে উঠতে পারে না। জলের বোতল সামনেই ছিল, ছিপি খুলে দু’ঢোক গলায় চালান করে দেয়। বোতলের মুখ আটকাতে আটকাতে মিনমিন করে বলে, তুই এখানে কাজের কথা বলছিস ?
— হ্যাঁ বিধাতাদা। যদি এটুস চেষ্টা-চরিত্র করে জুটোয় দাও তো আমি তোমার কেনা গোলাম হয়ে যাই।
যতটা সম্ভব নত হওয়া যায়। ততটাই হয় ভোলানাথ। সে ঝপ্ করে বিধাতার দু-হাত চেপে ধরে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু দেখল, একজন সুন্দরী নিজেই গাড়ি থামিয়ে বিধাতাদার এটিএম-এ ঢুকে পড়ল। কিন্তু মিনিট খানিকের ভেতর বের হয়ে এসে বলল, আচ্ছা, ও দাদা, একটু দেখুন তো মেশিন কি হ্যাং হয়ে গেল ! বিধাতা দাস ছুটতে ছুটতে কাছে গিয়ে বলল, সারাদিনই তো ঠিক ছিল ম্যাম। কই আসুন তো ভেতরে। আমার সামনে একবার করুন।
কিছুক্ষণ বাদে দুজনেই হাসি মুখে বেরিয়ে এল। মহিলার কাজ উদ্ধার হয়েছে মনে হয়। আর বিধাতা দাস। তাকে সাহায্য করতে পেরে খুশি।
মহিলা গাড়ি চালিয়ে চলে গেলে ভোলানাথ গুটি গুটি এগিয়ে এসে আবার বলল, আমাকে একটা ব্যবস্থা করে দিতেই হবে বিধাতাদা। তোমার কত মান্যিগণ্যি মানুষের সাথে যোগাযোগ ! তুমি বললে কেউ না করবে না। কীকরে কাটাবে ভোলাকে । অনেক অনেক দিনের বন্ধু যে সে । সরাসরি না বলে দিলে হয়। কিন্তু তাতে তো ভোলা খুবই কষ্ট পাব। তাহলে উপায় কি ! বিধাতা নিজের মুখ চুলকোতে চুলকোতে ভোলাকে কাটিয়ে দেবার জন্য বলল, জানিস তো ভোলা, আজকাল টাকা ছাড়া কেউ কোনো কথাই শুনতে চায় না !
— হ্যাঁ জানি তো দা। এমন কি আমাদের স্টান্ডে ভ্যান চালানোও যায় না টাকা না দিলি। আমি জানি তা। সেই কথাই তো বলছি ভোলা। বলেটলে হয়ত তোর জন্য একটা ম্যানেজ করব। কিন্তু তার জন্য তো টাকা ঢালতে হবে রে।
— সে তা কত দিতি হবে গো। আমি কলকেতায় আসার আগে মা তার লক্ষ্মীর ঘট ভেঙে হাজার খানেক টাকা আমার হাতে দিয়ে কলো, নে যা ভোলা। বিদেশ-বিভূঁই। কোথায় কখন কাজে লাগে। নে যা।
বলতে বলতে ভোলানাথ কর্মকার তার হাতের নাইলনের বাজারের খলির ভেতর রাখা একটাকা, দু’টাকা, পাঁচটাকা, দশটাকার কয়েন সব ঢেলে দিল এটিএম-এর সামনের চাতালে। তারপর সাফারি পরা বিধাতা দাসের হাত চেপে ধরে বলল, “ তুমি আমার বিধাতা, একটু দেখো দা। এহানে হাজার টাকা আছে। কাজ হলি প্রথম মাসের বেতনের থে আরো দেবানে।
ভোলানাথ চলে গেলে ওই কয়েন নিয়ে এসে এটিএম মেশিনের পেছনে যে এক চিলতে বসার জায়গা আছে, সেখানে রেখে দিল। তারপর বাইরে ঝকমকে আলোয় সেজেওঠা শহরের যে রাস্তা দিয়ে ভোলানাথ ফিরে গেছে, সেদিকে তাকিয়ে এটিএম-এর কাচের দেয়ালে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল বিধাতা দাস। তার বুকের ভেতর থেকে তখন উথাল-পাথাল গোঙানি বেরিয়ে এসে নিজেকে খালি করে দিতে চাইছে। ওই গোঙানিতে কান পাতলে হয়ত শোনা যেত বিধাতা বলছে, আমি বিধাতা নই রে ভোলা। তুইই আমার ভগবান। এই টাকা না পেলে আমি যে আজ কী করতাম জানি না। গত পাঁচ মাস মাইনে দেয় না সিকিউরিটি কোম্পানি। জিজ্ঞেস করলে বলে, ব্যাংক আর গার্ড রাখতে চায় না। তাদের কাছে টাকা নেই বেতন দেবার। কোম্পানি বলেছে আমি যেন অন্য ধান্ধা দেখে নিই। কিন্তু বল ভোলা, এতদিন এরকম সাহেবের পোশাকে পাহারাদারের চাকরি করে এখন কি বাজারে বসে মাছ বিক্রি করতে পারব ! সারাদিন না খেয়ে থাকলেও ঠান্ডা ঘরে কোম্পানির ড্রেসে বসে থাকার ভেতর যে মুরুব্বিয়ানা, তা আর কোথায় পাব ! ভাই,তুই আমারে ক্ষমা করে দিস। তোর টাকাটা না নিলে আজ যে আমার প্রাণ বাঁচত না !
♦—♦—♦
লেখক পরিচিতি: কবি ও গল্পকার। কলকাতার বাসিন্দা।
❤ Support Us