Advertisement
  • গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
  • জানুয়ারি ১২, ২০২৫

বড়ো গল্প : ফেরার । শেষ পর্ব

মম্মদ কাঁদে না দম ফেলে বোঝা যায় না । জিভ বের করে সে চোখ দুটোর মধ্যে আবার গড়িয়ে পড়লে, জৈগুন মুখটা মম্মদের মুখের পর রেখে তোষামোদ করে বলল, ওই বাইরের দিকে দ্যাখো, সকাল এবার আসছে । আমরা ছ্যান করে তেল মেখে বেড়াতি যাবো দূরের এক গাঁয়ে । ওখানে তোমার এক খালা আছি, কপিলা খালা, তানিই নিতি আসবে আরেকটু বাদ । তুমি যাবা তো বাপ, খালা ওষুধও দেবে, তুমি ভালো হয়ে যাবা মানিক,  দেখে নিও...! ... তারপর

লুৎফর রহমান
বড়ো গল্প : ফেরার । শেষ পর্ব

অলঙ্করণ: দেব সরকার

শেষ পর্ব

 হাসপাতালের চাতালে বসে, হাতে রুটি আর আলুর তরকারি, একটু কোঁচড়ে বাগিয়ে নিতে গিয়ে জৈগুন টের পেল, তার বস্তরখান কোঁচড় বরাবর ফেড়ে গেছে অনেকটা, সেটা দেখে কপিলাও খুব আপশোসে পড়ে গেল, শোধাল –এই কাপড়টাই…?

হ্যাঁ দিদি, আমার আইবুড়ো কালের কাপড় !

এটাই তোলাকাপড় ? তুমার ?

হ্যাঁ দিদি । মরার আগে আমার বাপের কিনে দেয়া শেষ কাপড় !

কপিলা মম্মদকে কোলে আরেকটু গুছিয়ে নেয় । এঁটো হাতেই, দেখে, জৈগুন মুখ মোছে আঁচলে, বলে, সাবধানে দিদি, ছেলে আমার হাগার দলা…!

গলে গলে হাসল কপিলা, নাকি, নিজের মনের ভুলের খেসারত ঢেকে নিল নিজের দুচোখে, তা সেই জানে !

মাথায় কড়াটে চুল তার ভরা, কেমন ফসকে গিয়েছে কাঁধের নাবালে, বুকটা মাংসে বয়সে যেমন টুনকো তেমন দৃষ্টি পাওয়া, নিজের ছেলেকে আরেকটু রুটি দলা ধরিয়ে দিয়ে কপিলা জায়গা নড়া হয়ে সরে বসল আরেকটু, পা দুটো জুৎ মতন ছড়িয়ে নিল সামনে ! শোধাল, গুয়ের দলাটার নামকি রেখেলে দিদি ?

মহম্মদ গাজি।

ওর বাপও কি গাজি ?

ঝোলায় ভরা কাগজের তাড়া, গড়াগড়ি খাচ্ছিল পাঁচিলের গা ঘেষে, সেটা বাঁ হাতে কোচড়ে নিয়ে জৈগুন বলল, হু মফিগাজি, বাহাদুর এক লোক !

কি করে ?

ভ্যান চালায় !

নিজেদের ?

হু, তবে আয় যা হয় লোক লস্করের পাছায় দিয়ে আসে !

নেশা ভাঙ করে ?

ওই টাই করে, বাকি সময়টুকু বাজারে সদরে মর্দানি করে কাটায় !

মদ্দা লোক তাহলি, কী বলো দিদি ?

জৈগুন এবার মুখ ঠোসে নিজের, কপিলা আলাপে যে কমা নয়, এটা টের পায় সে, তবে গায়কাপড়ে যে দশা তাতে বোঝা যায় মেয়েমানুষটুকুই হয়ে কপিলা বেঁচে আছে, জুতেও আছে, রোগালা ছেলেটাও কাপড় জামার বহরে বেশ খানিকটা কমা, তাও জৈগুন বোঝে।

তবে পুরুষ নোলা সামলানোর মুরোদ কজনেরই বা থাকে ?

সে ভাতা পাওয়া লোক, বয়স্ক ভাতা। জৈগুন জানাল

তাহলিই বোঝো সে কেমন মরদ !

বলো কী ? কপিলা যেন জলে পড়ল থপাস করে, গা কাঁপল।

বলল, মহম্মদের মায়ের যে এখনো নাক ফোলে বেশ দেখা যায়, তাহলি এ জ্যোস্না কোন পগারে গিয়ে ধোও দিদি ?

রুটিটুকু সারা করল জৈগুন, চাতালজুড়ে গন্ধটা বাড়ছিল, কপিলার ছেলেকে আর নিজের ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে জৈগুন এবার উঠে দাঁড়াল, পেছন কাপড়ে ফাড় লেগেছে কিনা কপিলাকে শুধিয়ে বলল, মম্মদ আমার বুকির আজড়, এরে যদি একটু চুল আঁচড়ে খেলা করতি পাড়ায় পাঠাতি পারতাম, আমার জনমডা বত্তে যেত দিদি ।

একেবারে ধা করে জৈগুন এখন কথা ঘুরানোর মন-খেলায় ব্যস্ত

কপিলার বুকটা হুহু করে উঠল, নিজের বলতে তারও তো এই ছেলেটা, তবে হাসপাতাল করে আর দশজনের আশীর্বাদে ছেলেটা এখন গা ধরা হয়ে উঠেছে বেশ, আউটডোরে আজ আর কাগজও লিখল না, ওষুধও দিল না, চেক আপ করে বলল– পথ্য বহাল রাখতে। দিনে দুধ, রাতে ফল…!

তখনি সে আসল কথাটায় এল ! কথায় কথায় বলতেই ভুলে গিয়েছিল এতক্ষণ ! অথচ মুখালাপ ধরলে মাত্র তো একটা ঘন্টা, কপিলা যেন নিসাড়ে কথাটা এবার পাড়ল…!

হাসপাতালের ত এই হাল দিদি, একটা কথা বলি !

বলে নিজের ছেলেটাকে ভালো করে বুক বোঝাই করে নেয় কপিলা, তারপর স্টেশন মুখো চওড়া রাস্তার পাশ ধরে হাঁটতে হাঁটতে জৈগুনকে বলল, আমার কপাল হল চঞ্চলা দিদি ! এই যে ছেলে এর আরেকটা বড়ো ছিল, তাকে আমি হেরিয়েছি ! তাই ইডার যখন টাইফয়েড জ্বর হলো, ছেলে আমার ফ্যাকসা মেরে গেল, রক্ত পরীক্ষা করালাম, ধরা পড়ল জন্ডিস, সাথে শরীরে রক্ত দাঁড়ায় না সেই অসুখ ! এর বাবা তখন ঘর নড়া মানুষ !

মানষির চোখে স্বপ্ন থাকে, ঠাকুর দেবতা ধরে, কি করে বড়ো হব, তার মানসা থাকে ! এর বাপের ঠিক উলটো, মানুষটার দুচোখ যদি খন্তা দিয়ে শাবল দিয়ে খোড়া যেত, তাহলি হয়ত পাওয়া যেত শুধু গন্ডায় গন্ডায় মেয়ে মানুষ !

জানো দিদি মানুষটার ভাব ভালোবাসা তবু আমার খুব ভালো লাগত ! গোঁপ রঙ করত মানুষটা মাসে মাসে ! তা সেই আমার মানুষ, শলাকী বিলের কথা নিশ্চয় শুনেচ, সেই বিলে একটা খুন হয়েছিল শুনেছিলে ? গলা কেটে খুন ? ডাহা ডবকা মেয়ের, শুনেলে ? স্কুলের মেয়ে, শুনেলে ? এর বাবাও ছিল সেই খুনিদের দলে, তা তানি যেদিন পুলিশের হাতে পড়ল, বড়ো ছেলেটা তখন উত্তম মধ্যম জ্বর, না পারলাম ডাকতারের কাছে যেতি, না পারলাম হাসপাতাল গিয়ে উঠতি, বিকেল গায় ছেলেটার আমার মুখে রক্ত উঠে, আর থাকে না…থাকলোও না…! রেখে আসলাম তাকে মাখাগির শ্মশানে ভোরবেলা !

জৈগুন হাঁটছিল আর কপিলার কথায় সায় দিচ্ছিল, হাসপাতাল তো কম বড়ো নয়। কল্যাণী শহর তো হিসেবের খাতা, রাস্তা ঘাট এদিক ওদিকে ছুটছে, ডানের পথ কখন বাঁয়ে গিয়ে মিলেছে খেয়াল ছিল না কারোরই, হাঁটাও ভুল হয়েছিল অনেকক্ষণ,পথ বুঝতে দেরি হয়ে গেল।

একটা কথা, এতে পথ হালকা লাগে। জৈগুন সায় দিলে কপিলা বলল, এডারও বছরখানেক পর হাল, আবার একই, জ্বর আসে কথায় কথায়, হাসপাতাল আসি ওষুধ পড়ে, কিন্তু ছেলের আমার হাল ফেরে না…!

… তাহলি ?

… তেখন কিডা যেন খবর দেলে এক বাবার, আস্তানা বাবার, পুর্নির ঘাট নাম, গেলাম সেখেনে, সবার মতো হত্তে দিয়ে পড়লাম ছেলে কোলে, জলপড়া তেলপড়া কিছু নয়, তার একদম ডাইরেক একশন– মন দিয়ে মন্ত্র নিতি বলে! নেলাম দু বার, একে শনি দুয়ে মঙ্গল, আজ ছেলে আমার উঠতি, কমাস বাদে ক্লাস টুতে উঠবে সরকারি স্কুলে ! কোলের মধ্য মম্মদ একবার মোড়া মেরে উঠলে, জৈগুন তাকে আগলায়, ঝকমারি হয়, সামলে নিয়ে শোধায়, মন দিয়ে মন্ত্র নিতি বলে ?

… হ্যাঁ দিদি, কপিলা আউলিয়ে ওঠে যেন আরেকটু, বলে, সহজ খুব, তিন পদের ফলে, তিন সন্ধের জল দিয়ে ফুটিয়ে পায়েস করা আর দিনে তিন দফা তা ছেলেকে খাওয়ানো, সাতদিন, তাতেই ছেলে আমার সুস্থ !

এত উত্তম এক কথায় জৈগুন কেমন চুপ মেরে গেলে, কপিলাও একটু বেকুব হলো !

মনের ভুলের তার শেষ নেই, কি বলতে কখন কুকথা বেফাঁস বলে ফেলে সে— নিজেরও তার তাল থাকে না, তেমন কিছু কি বলে ফেলল সে, তখনি তার খেয়াল হয়, মম্মদের মা মেয়েমানুষ হলেও জাতে তো ভিন্ন, ওদের ধর্মে মন্ত্র নেয়া আছে কি নেই, তাও তো সে জানে না।

আস্তানা বাবা পুর্নিঘাটের সাধু হলেও ধর্মে তো মুসলা না,…সেও কি মন্ত্র দেবে ভিন ধর্মের মেয়ে মানুষে ! সাক্ষাৎ ভগবানের মন্ত্র, এই মুসলা মেয়েমানুষ নেবেই বা কোন মুখে !

স্টেশনে উঠে কপিলা না চাইতেও জল দিল জৈগুনকে, কীসের এক গন্ডগোলে আপের সব ট্রেন আজ লেট, প্ল্যাটফর্মের জায়গা কম মানুষ অনুপাতে !

ওভার ব্রিজের সিঁড়িও মানুষের ভরে টনটন করে উঠছে, কদমগাছটার ওদিকে ভিড় একটু কম, মেঝেতে–কপিলা আর পারছিল না–জৈগুনকে নিয়ে বসে পড়ল সে পাছা থাবড়ে, আর কথাটা আবার পেড়ে বসল সে !

… তুমরা তো মসজিদে যাও শুক্রবারে, নামাজ পড়ো, না ?

… হু।জৈগুন সায় দিল !

বলল, কথাটা ওরমভাবে নয় দিদি, মেয়েমানুষির মসজিদ নেই, তবে নামাজ আছে সমান সমান, বাড়িতে বসেই, মেয়েমানুষের জামাত হয় না দিদি !

… তুমি বাড়িতে নামাজ করো ?

… না।

… তুমিও ত মুসলমান ?

… হ্যাঁ মুসলমান !

… তাহলি ?

জৈগুনের কাছে প্রশ্নগুলো যত কঠিন লাগে, তার চে বেশি লাগে ভয়। তবু কপিলাকে মনের কথা বলতে বেগ পেতে হয় না এতটুকু, এটা চাগিয়ে তোলে জৈগুনকে ! সে চারিদিকে কান খাড়া রেখে গলা অনেকটা কমিয়ে কপিলাকে বলে,…মুসলারা দুতরফ, একতরফ বেন্নে আরেক তরফ হল সুন্নে ! আমরা হলাম বেন্নে দিদি !

…তাই ? তোমরা তবে আলাদা ?

কপিলা যেন জুত পেল কথাটা শুধিয়ে ! আর তাতেই বেন্নে শব্দটার মানে না বুঝেও কপিলার মনটা কেমন মায়ায় পড়ে গেল, আরো, বুঝল ধর্মে ও কপালে– জৈগুন খুব অভাগী !

জৈগুন মম্মদকে কোলের মধ্যে আঁচল চাপা দিয়ে বলল, … নামাজ রোজা মসজিদ এসব খুব বাহাদুরির ব্যাপার, বুঝলে দিদি ! আমাদের ওসব বাহাদুরি নেই, রমজান বলে একটা মাস আছে, তারও বাহাদুরি আমাদের নেই, তারপর ধরো কুরবানি, সুন্নেদের জ্যান্ত গরুর কুরবানি আছে, আমাদের আছে শুধু সে গোস্ত কুড়ানির জ্বালা, বুজেছ দিদি !

কথাটুকুর বারোয়ানা না বুঝলেও কপিলা টের পেল, বেন্নেজাতির মানুষে মেয়েমানুষ হওয়া আরো জ্বালা, রোগ শোক অভাব অভিযোগ আর ওই জ্বালায় পড়ে জৈগুন কেমন তুবড়ে গিয়েছে হাঁড়ির মতো।

ধরতে গেলে কপিলা মথুরগাছির ঘোষপাড়ার মধ্যে সবচে ধগনে পড়া মেয়েমানুষ, কিন্তু শাঁখা পলার জোরে এখনো তার হাঁড়ির অবস্থায় কামাই নেই !

রেশন চালও সে রেশনে বসেই বিক্রি করে দেয় ২৫ টাকা কেজি দরে ! তাছাড়া, করোনার লকডাউনের পর মথুরগাছি বলো আর মথুরাপুর বলো, চলা চলতিতে অভাব পড়লেও পুরুষ মানুষে কোনো অভাব নেই।কপিলা নেহাত গোছানির নয়, নাহলে রাত আসতে দেরি করলেও পরপুরুষ ঘরে ঢোকাতে তার দেরি হত না, সংসারও থগবগ করত হালে চালে ! আর এখন তো সে মন্ত্রও পেয়েছে আস্তনাবাবার, গুরু ধরে ভাই কিংবা মরদ, অভাব তার হবারও নয় !

মম্মদের নড়াচড়া কেমন বেড়ে গেলে, জৈগুন আবার দুহাতে নিজের গালটুকু ধরে নিজের মুখে বলে ওঠে – আমি একবার সভা শুনতে গিয়েছিলাম, আমার ওই বাপের গ্রামে। বুজেছ দিদি, সভা মানে জলশা–শীতকালে হয়– তুমাদের মধ্যে যেমন কীর্তণ হয়– ওই রাম একটা কীর্তন ! – তারপর ? কপিলা মন দিয়ে সব শোনে ! – সে সভায় এক মৌলবি এসেল আর ওয়াজে বলেছিল, মাজলুমে আর আল্লায় কোনো পর্দা নেই !

…মাজলুম কি দিদি ?

…বেন্নে মানুষ হল মাজলুম !

…তাহলে যে বললে তোমার বড়ো বৌদি তোমারে বসতে ত দূরের কথা, ঘরে উঠতেই দেয়নি ?

…আমার বাকের ভাইয়ের কথা বলছ ?

জৈগুন কপাল ছড়িয়ে একটু হাসল। বলল, উরা এখন সুন্নে মুসলা দিদি !

কি করে হয় ? তোমার বাপের ঘর সুন্নে হল কেবা করে ?

হয় ! জৈগুন হাসল আবারও। বলল, তোমাদের মধ্যি যে মুচি সে গরিব হলেও মুচি বড়োলোক হলেও মুচি। আমাদের মধ্যি যার টেকা আছে সে সুন্নে আর যাদের তা নেই, তারা গ্রামে গ্রামে দেশে দেশে কোটি কোটি হলিও বেন্নে, বুজলে ?

ও এই ব্যাপার। কপিলা খুব যেন বুঝল, শোধাল– তারপর ? কি বললে সেই মৌলবি ?

মৌলবি বললে, মাজলুমে আর আল্লায় কোনো পর্দা নাই, কারোরই দল নাই, গুষ্টি নাই, সীমাও নাই, দোয়া চাইলে আল্লা কবুল করবে না, করবে না হে মাজলুমরা…!

তাই বললে ? হায়রে কপাল !

…জানো দিদি আমার মতো বেন্নে মানুষে আর আল্লায় কোনো মিলমিশ হয় না, ধকলই আমাদের কপালের ধন !

কথাটা যেন খুব অসহায় ঠেকল কপিলার, ব্যথাও পেল ! চাল চলনে মেলে, পাশাপাশি গ্রামের মানুষ, ধরতে গেলে পড়শি, অথচ কপিলা কেমন এক অদৃশ্য পর্দা যেন টের পেল এখন, যা উঁচু আর হবে না হয়ত– আবার নিচু হওয়ারও জো আর নেই, অথচ হাঁকে ডাকে জৈগুন যেন তার চিরকালের নিজের বলে পাওয়া এক মেয়ে মানুষ ! কপিলা এবার গলা চওড়া করে বলল– শাঁখা পলার কোনো বিঘ্ন নেই দিদি ! মম্মদ তো আমারও পেটে আসতে পারত। তাই বলি, তুমি আস্তানা বাবার কাছে চলো দিদি, মন্ত্র নেও,দরকার হলি আমার কপালের জিনিস– আমি তোমারেও দেব, তবু চলো, মম্মদ শেয়ানা হয়ে ওঠবে, খেলা করে বেড়াবে, সব অসুখ তার সেরে যাবে দেখো !

♦•♦♦•♦  ♦•♦♦•♦

মম্মদ আজ পাছার গোণে পড়েছিল সবচে বেশি,  ভড়ভড় করে পরে একদম নিঃসাড়ে সে হাগল…, বিকালে চালে কলায় আর দুফালি পেঁপে দিয়ে যেটুকু সে খেয়েছিল, পেটে নয় পড়েছিল পাছায়, চালে কলায় পেঁপেসহ সব বেরল রাতে পালা করে, কত আর কাঁথা কাপড় বদলাবে, একটু যে জলেপানিতে ধুইয়ে মুছে নেবে, তারও উপায় নেই, জল যেন জীবজাহান মম্মদের– মট মট করে সব ভাঙে, মুখে তা ফোটে না, শুধু নাকমুখে কোৎ পাড়ে !

সে মুখে খিল একদম এঁটে গেল যখন, তখন তাদের এই ঘরটা পেঁচিয়ে পুকুর পাড় হয়ে আরো ডানে সেলিম মন্ডলের পলট্রি খামার হয়ে মফি গাজি ফিরল, গায়ে যেন জ্বর !

গামছায় গা মাথা মুড়িয়ে দুয়োর মওড়ায় সে যখন দাড়াল– রাত বেশ ফরসা !

পুকুর পাড়ের গাছে আর তলার অন্ধকারে মানুষের গলায় কে যেন কলেমা পড়ছে, জৈগুন শুনল। গলাটা কারো চেয়ে আলাদা নয়, একও নয়, এটুকু বুঝে জৈগুন মম্মদের পাশ থেকে উঠে দরজায় এসে দাঁড়াল।মফি গাজির চোখ দুটো এখন মম্মদকেই ঘরের আড়ালে খোঁজে, হাতে ছোটো একটা টোপলা, দেখেই বুকটা ডেকে উঠল জৈগুনের !

ভোটেও নাম কাটা গেছে, শোনা যায়, কেমন করে গেল জানা যায় না ! লোকটা বড়ো অপয়া, তার কলেমা পড়া প্রথম যেদিন কানে এসেছিল সেদিনও এমন রাত, মম্মদ জ্বরে পড়ল। মফি গাজির জাবদা ইঞ্জিন ভ্যান, এগারো ঘড়ার ইঞ্জিন এক্সেল ভেঙে থুবড়ে থাকল চুয়োডাঙার বাজারে, ভ্যানে কম্পানির মালের লোড ছিল, তার খেসারত দিতে বারো হাজার টাকার ইঞ্জিন ছয় হাজার টাকায় বেচে সে টাকা গচ্ছিত করে আসতে হয়েছিল বনগাঁর গোডাউনে

আলেমান তাহলে এই অবধি উঠে এসেছে ! পুকুরপাড়ে তার ঘর ছিল ছোটো, ভিটে ছিল আরো ছোটো, সেই ঘর কীভাবে পুকুরপাড়ের মাটিতে মিশে গিয়েছিল আপনমনে, যারা জানে তারা মুখ খোলে না।তবে কবে কবে যেন উদয় হয় লোকটা, চোখেও পড়ে না, রাত গভীর হলে কলেমা কানে আসে !

ভোটেও নাম কাটা গেছে, শোনা যায়, কেমন করে গেল জানা যায় না ! লোকটা বড়ো অপয়া, তার কলেমা পড়া প্রথম যেদিন কানে এসেছিল সেদিনও এমন রাত, মম্মদ জ্বরে পড়ল। মফি গাজির জাবদা ইঞ্জিন ভ্যান, এগারো ঘড়ার ইঞ্জিন এক্সেল ভেঙে থুবড়ে থাকল চুয়োডাঙার বাজারে, ভ্যানে কম্পানির মালের লোড ছিল, তার খেসারত দিতে বারো হাজার টাকার ইঞ্জিন ছয় হাজার টাকায় বেচে সে টাকা গচ্ছিত করে আসতে হয়েছিল বনগাঁর গোডাউনে…!

কিডা ও কলেমা পড়ে ? আলেমান বলে লোকটা না ? জৈগুন চিল্লায়।

হবে হয়তো, তোমার মাথার বেরামের কথা জানছে কিডা, বলো ?

মাথার বেরাম, আমার ? জৈগুন চোয়াল এঁটে কাঠ মেরে আসে !

না তো কি ! মফি গাজি গায়ের জামাটা খোলে, খুলে টান মারে ঘরের আড়ায়।বলে, আলেমান কবে মরে ভূত হলো, জান তা ?

এই ভোর বেলা তুমি তাহলি কনথে আসলে ?

… আসলাম তোর বাপের বাড়ির তে !

মফি গাজি হুড়মুড় করে আবার ভাঙল নিজের মুখে, ভেঙে পড়া ছাড়া সে নিরুপায়! নিরুপায় সে জৈগুনের কথার জবাব দিতেও!

আমার বাপের ঘরে তোর মতো মানষির মুখে মোতে !

তা মোতে ! মফি গাজি ধপ করে বসল মেঝেতেই, বলল– তোর মুখেও তো মুতে দিয়েছে বাকেরের বউ, মনে নেই, লজ্জা করে না বলতি ?

সকাল হলেই হাসপাতাল, হাত একদম ফাঁকা জৈগুনের, ভ্যানে তার গিয়ার অয়েল করতে গেল পুরো পঞ্চাশটা টাকা– তাও ঘর থেকে সরানো অথচ গেল যে দিনটা ভ্যান নিয়ে সে বসেই ছিল, বাজারের দুদুটো গোলায়, আয় ইনকামের কোনো ব্যবস্থাই হলো না, কলের জল খাওয়া আর কাজের জন্য হত্তে দেয়া– সারই হলো ! যারা কাজ পেয়েছে তাদের ভ্যানের সব ডাবল ভকসেলের ইঞ্জিন, লম্বায় দশফুট, স্টিয়ারিং-এর হেড। বাংলা ব্রেকের ছফুটি ভ্যানে ভাড়া বড়ো অমিল, নিলও না কেও।

অথচ সে কাজের কুড়ে না – ভয়ও পায় না কাজ করতে!

গাছের গোলায় বসে বসে বিকেল ফুরাল, শিলিন্দায় !

ম্যানেজার বলল, কাজ আছে, হাতির কাজ, তোমার এ যন্তরের নুনু নাড়াচাড়া হাজার বার করলিও সে হাতিকে পোঁয়াতি বানাতি পারবে না, বুজলে মফি, কাজ করো একটা, তোমার এই বাংলা ভ্যানটাকে ভাঙড়ি করে দেও, লোহার এখন দরও ভালো, ঠকবা না !

তখন থেকে মাথাটায় আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে, ম্যানেজারের মুখে জুত মতন জবাব দিয়ে আসতে পারলে বুকটা তার জুড়াতো, কিন্তু তাতো তার কর্মে হবার নয় মোটেও ! অগত্যা মফি গাজি চুপ করে বসে পড়ল মম্মদের বিছানায়, পাশে পড়ে থাকা বোতল থেকে জল খেল দুঢোক, তারপর মাথা মুখ ঘোর করে নিয়ে এল সে মম্মদের একদম মুখের কাছে–… আব্বা ? আমার মহম্মদ ? আবার হেগেচ বাপ ?

জৈগুন পুকুরপাড়টা বরাবর দ্রুত হাঁটে, যাতে মফি গাজির কোন কথাই তার কানে না আসে। পরনে শুধু সায়া, তাও ধুকড়ি ! কাপড় সে অঙ্গ করে রাখে ফি রাতে, তোলা করে রাখা কাপড়টা হাসপাতালে গিয়ে পাড় ফেঁসেছে, বাড়ির পরাটারও জমি যাতে আর না ফাঁসে সে তরাসে– সন্ধে হলেই খুলে রাখে !

পলট্রি খামার থাকল ডান হাতে, বাঁয়ে দখিন মাঠে নামার পথ, সে পথে কাউকে একদম স্পষ্ট সে টের পেল এদিকেই আসছে ।মাথায় আগুন জ্বলে উঠল জৈগুনের, দপাস দপাস করে, আলেমান কবে নাকি মরেছে, শোনা যায়, তাহলে এখনো তার এত বৃদ্ধি।

তার তো ওই মম্মদ ছাড়া, মম্মদের বাপটুকু ছাড়া আর কিছ নেই, তাহলে মরে গিয়েও এ ব্যামো তার কপালে আগুন দিতে, কোলটুকু খালি করে দিতে এত বেগবান কেন !

… ওরে ও গুখেগোর বাল, জৈগুন দুহাতে রাত আর রাতের সলক ছিঁড়ে খুড়ে এক করে চিল্লায়– ওরে ও পগারে পড়া, ওরে ও পেট ফেলানির ছেলে–একবার তুই সামনে আয়, আজ তোর কলেমায় আমি আগুন দোব, আয় !

কিন্তু মাথা যত পটপট করে ফাটে, চোখ দুটো তত অচল হয়ে আসে জৈগুনের।

দখিনের নাবাল থেকে উঠে এসে–যেন আস্কার পেয়ে–জৈগুনকে জাপটে ধরে ফেলল কপিলা।

… এ দি, আমি, এই দেখ আমি কপিলা–তোর বুন !

জৈগুনের যেন মাথা থেকে, খোলা আলগা বুক ও পিঠ থেকে, কি যেন দড়দড় করে নেমে গেল নীচে, সে শায়া সামলে নিল সবার আগে, মাথার বাসি হয়ে আসা চুলগুলো খোঁপা করে নিল, আলেমান তাহলে ভড়কি দিল তাকে, কপিলার হাত দুটো নিজের হাতে আগলে নিল সে জুড়িয়ে গিয়ে ! বলল– আয় দি, ঘরে আয়, রাতভর জেগে আছি বুন তোর জন্যি।

গ্রামটুকুর আড়ালে হোক সদরে হোক, রাত হলেই এই পুকুরপাড়ে শিয়াল কুকুর তো আসেই, চরে খাওয়া পুরুষও আসে, কপিলা এ নিয়ে আর কথা বাড়ায় না, তবে জৈগুনের হাত দুটোকে নেড়ে চেড়ে সে দেখে অনেকবার ! শোধায়– এই তোদের ঘাট নাকি, ও দিদি, সকাল হলো বলে, ডুবডাও তুমি দিয়ে নাও, হাজার হোক মন্ত্র বলে কথা, তারপর চলো পুর্নির ঘাট, সেও ত কম পথ নয় !

ডুব দিয়ে ঘরে এল জৈগুন, অঙ্গ করে রাখা কাপড়টা পরল বেশ তর করে।মফি গাজি কোলে নিয়ে বসেছে মম্মদকে, দেখে কপিলা এবার কোঁচড় থেকে বের করল ছোটো একটা কোটো, সিঁদুরের।

ঘরে বেশ সলক এসেছে, ফজরের আজান হলো, কপিলা সিঁদুর পরিয়ে দিল জৈগুনের সিঁথি জুড়ে  টিপ করে দিল কপালেও, তারপর নিজের হাত থেকে খুলে একটা পলা আর একটা শাঁখা পরিয়ে দিল জৈগুনের হাতে !

শাঁখায় সিঁদুরে জৈগুনকে কেমন যেন অধরা লাগে, মন জুড়ে তা দেখে মফি গাজি মুখটা মুছে নিল বেশ করে ! বউ হয়ে তার ঘরে কবে যেন এসেছিল জৈগুন ! মনে করার আনন্দে চোখ জুড়ে তার জল এল, হাত দুটো কপালে তোলার বদলে সে ভড়কে গিয়ে জলের বোতলে জল ভরে দেয় তড়বড় করে, কাগজপত্রের ব্যাগটা এগিয়ে রাখে জৈগুনের সামনে।

মফি গাজি লোকটার মুখে কবে কবে ভেঙে পড়েছে চাবালি, তা সেই জানে।ট্যাঁক থেকে প্লাসটিকের একটা টোপলা বের করল সে, চাবালি আর মুখ লুকিয়ে, একটু যেন ফুঁপিয়ে।কপিলাকে সে হয়তো চিনতেও পারল, অথবা পারল না।

মথুরগাছী কনকপুর সুটরোর সামনে পিছনে পথে ঘাটে এমন কপিলাকে হেঁটে চলে ফিরতে দেখলে দরকারও তো পড়ে না আলাদা করে চেনার।

টোপলাটা জৈগুনের হাতে আর মম্মদকে তার বুকে বোঝাই করে দিয়ে মফি গাজি কপিলাকেও বলল– এখেনে কডা টেকা আছে মম্মদের মা।

পুর্নীরঘাটে আস্তনা বাবা চাইলে দিও, আর তোমরা দুজন, খিদে লাগলে, যাহোক কিছু কিনে খেও !

♦–•–♦♦–•–♦♦–•–♦

আগের পর্ব পড়ুন: ফেরার

বড়ো গল্প: ফেরার


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!