Advertisement
  • ব | ই | চ | র্যা রোব-e-বর্ণ
  • অক্টোবর ২২, ২০২৩

সিঙারের গল্প এবং জটিল মনস্তত্ব

কানাইলাল জানা
সিঙারের গল্প এবং জটিল মনস্তত্ব

 
স্বাভাবিক দ্রবণে ফরেন পার্টিকেল পড়লে যেমন দ্রবণের চরিত্র বদলে যায় ‘হামাস’ নামক সন্ত্রাসবাদী সংস্থা সেই ফরেন পার্টিকেল যার জন্য প্যালেস্টানীয়দের প্রতি আমাদের বরাবরের সহানুভূতি বদলে যেতে বসেছে। পিএলও নেতা ইয়াসের আরাফাতও পছন্দ করতেন না ‘হামাস’-কে। বিশ্বে মোট দেড় কোটি ইহুদির প্রায় অর্ধেকের বাস ইসরায়েলে, জ্ঞানে বিজ্ঞানে চিকিৎসায় ভাবনা চিন্তায় যাঁরা অনেক এগিয়ে। তেমনি উঁচুমানে তাদের চলচ্চিত্র। টিভি চ্যানেল দেখাচ্ছে এক সুন্দরী মহিলাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ‘হামাস’ বাহিনী। পরিণতি ভয়ঙ্কর। কলকাতার আন্তজার্তিক চলচ্চিত্র উৎসবে এক ইসরায়েলি চলচ্চিত্রে দেখেছি ওই ধৃত সুন্দরীর মতো এক ঠাকুমা তাঁর নাতনিকে বোঝাচ্ছেন সে যদি তার বেদে প্রেমিকের সঙ্গে চলে যায় তাহলে ঠাকুমার মতোই ভুল করবে: ফ্ল্যাসব্যাকে দেখাচ্ছে তরুণী ঠাকুমা ও তার প্রেমিক পালিয়ে গিয়ে রাতে খোলা আকাশের নিচে বালিভূমিতে শুয়ে আছে। সোনা রং বালিতে বাস করা নানা ডিজাইনের রঙিন ও বিষাক্ত সাপ তাদের শরীরের ওপর দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে । কী সাংঘাতিক শুট! গ্রাফিক্স নয়। ইসরায়েলি পরিচালকরা ইউরোপ সহ অন্যান্য দেশকে কবেই পেছনে ফেলে দিয়েছে। তাই তাঁদের সাহস হয় কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের সেমিনারে এসে বলতে যে রে’জ ফিল্ম ( সত্যজিৎ রায় ) তৈরির সময় প্রস্তুতি পর্ব থেকে তাঁদের যে আগ্রহ ছিল এখনকার বাঙালি পরিচালকরা সে আগ্রহের জন্ম দিতে পারছেন না কেন ?
 
ইহুদি লেখক আইজাক সিঙারের আলোচ্য গল্পগুলি শুধু দীর্ঘ নয়, এতই গভীর ও জটিল মনস্তত্ত্বের যে অনু গল্পের স্রষ্টা বনফুল যদি এ গল্প পড়তেন প্রতি ক্ষেত্রেই তাঁকে বেশ কয়েকবার দম নিতে হত। বৌধায়ন মুখোপাধ্যায় অসীম ধৈর্য ও মুন্সিয়ানার সঙ্গে যেভাবে অনুবাদ করেছেন তার জন্য অনেক ধন্যবাদ তাঁর প্রাপ্য। যেমন সিঙারের চতুর্থ গল্প ‘আয়না’: ক্রাকোতে মানুষ হওয়া সুন্দরী ও বিদূষী জিরেল যদিও বিবাহিত একা থাকত চিলেকোঠার ঘরে যাকে সে বলত শৃঙ্গার কক্ষ। সেই ঘরে ঝোলে একটি আয়না যার রং সমুদ্রের জলের মতো নীল এবং সে জল বরফ হওয়ার মুখে। বন্ধ ঘরে আয়নার সামনে বসে জিরেল ঘন্টার পর ঘন্টা নিজের সৌন্দর্য উপভোগ করে এবং কল্পনা করে কোনো রাজপুত্র, শিকারী নাইট বা কবি প্রবেশ করবে কারণ প্রতিটি লুকোনো বস্তু উন্মোচিত হতে চায়, প্রতিটি ঘটনা প্রকাশিত হতে চায়, প্রতিটি ভালোবাসা কামনা করে প্রতারিত হতে, পবিত্রতা চায় কলুষিত হতে। কিন্তু কক্ষে ঢুকল শয়তানের দূত যার গায়ের রং আলকাতরার মতো কালো, ব্যাঙের মতো মুখ ,বোকামি যার ব্যবসা। সে এসেছে জিরেলকে খুশি করতে কারণ সে একাকিনী। দূত জানায় প্রথমে সে খাবে জিরেলের দেহের সুঘ্রাণ, চুলের ঔজ্জ্বল্য ,চোখের আলো ও মুখমন্ডলের বিষণ্ণতা। দূত আরো জানায় খচ্চরের মতোই সে উৎপাদন ক্ষমতাহীন কিন্তু তার মধ্যে নেই কামনার খামতি। শুনে জিরেল কক্ষ ত্যাগ করে। সাত দিন পরে আবার শৃঙ্গার কক্ষে এলে দূত বলে ইহুদিদের আইন গ্রন্থ ‘ট্যালমাড’ অনুযায়ী একজন নারী দশ দফা সংযমের চেয়ে একবার অবৈধ কামে নিমজ্জিত হতে বেশি পছন্দ করে। শয়তানের দূত জিরেলকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে মরুভূমির সেই প্রান্তর দিয়ে যেখানে সাপেরা পন্ডিত, হায়নারা গায়ক, কাকেরা প্রচারক এবং যেখানে চোরেদের কাছে গচ্ছিত থাকে দাতব্যের টাকাকড়ি। এবং যেখানে যাবে সেখানে নারী-শয়তান জল ছাড়া কাপড় কাচে, গরম বালিতে মাছ ধরে, বাড়িতে থেকে রাস্তায় ঘোরে, পাথর থেকে মাখন বানায়। ক্ষুদে শয়তানদের কচ্চিৎ পদোন্নতি হয় তবু জিরেলকে অনুসরণ করে আরেক জিরেল, অগুন্তি প্রতিবিম্বে অগুন্তি আয়নায়…
 

দূত বলে ইহুদিদের আইন গ্রন্থ ‘ট্যালমাড’ অনুযায়ী একজন নারী দশ দফা সংযমের চেয়ে একবার অবৈধ কামে নিমজ্জিত হতে বেশি পছন্দ করে। শয়তানের দূত জিরেলকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে মরুভূমির সেই প্রান্তর দিয়ে যেখানে সাপেরা পন্ডিত, হায়নারা গায়ক, কাকেরা প্রচারক এবং যেখানে চোরেদের কাছে গচ্ছিত থাকে দাতব্যের টাকাকড়ি

 
সিঙারের পঞ্চম গল্প ‘ভাগ্য’: পঞ্চাশের কোঠায় বয়স, হলুদ চোখের বেসী গোল্ডের চেহারা ছোট খাটো , ইউরোপে জন্ম। বাবা মা কথা বলতেন ইডিশ ভাষায়। যদিও বাবা পোল্যান্ডের মা লিভাকের। বাবা দিনে পনের ঘন্টার বেশি হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতেন। মাও তাই। বেসীর একটা ভাই ও একটা বোন ছিল কিন্তু তারা ছিল স্বার্থপর। অল্প বয়সে বাড়ি ছাড়ে। বেসীর ছিল চিরকাল দায়িত্ববোধ। নিজে যথেষ্ট উপার্জন করে সে রুমানিয়ার ছেলেকে বিয়ে করে, মধুচন্দ্রিমা সারে নিজের অর্থে, এমনই ভাগ্য । ভালো বর কিন্তু সে ছিল অলস । একদিন সে বেসীর জমানো টাকাকড়ি ও গয়না নিয়ে উধাও হল। বেসীর মেয়ে হল। কষ্ট করে বড় করাল, স্মিথ কলেজ থেকে বিএ পাশ মেয়ে ন্যান্সি। সেও হার্ভাডের স্নাতক ছেলেকে নিয়ে মাকে ত্যাগ করে। এখন থেকে মায়ের খুঁত খোঁজে এবং বলে তার বাবা মাকে ছেড়ে ঠিক কাজই করেছে। ভেঙে না পড়ে মিপার্টমেন্টাল স্টোর খোলে। যখন বেসী ভেবে নিয়েছে এখন থেকে একার জীবন, এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়। বহুদিন ভাবনার পর বিপত্নীককে সঙ্গী করে সুখে কাটছিল দিন, এমন সময় হৃদরোগে মারা গেল ভাল মানুষটি যার ছিল একটি প্রিয় কুকুর ও অনেক বন্ধু । বন্ধুরা সরে যেতে কুকুরটি ছাড়া তার বলতে কিছুই রইল না। কুকুরটার মানুষের মতো দৃষ্টি। বেসী তার সঙ্গে কথা বলত। কিন্তু বেসী সম্প্রতি জেনেছে পশুরা অতীন্দ্রিয়দর্শী। যে প্রিয় কুকুরকে খাওয়ানো, চান করানো, বেড়ু করানো সব সেবাই করেছে, সেই কুকুরও এখন থেকে হিংস্র ও খিটখিটে স্বভাবের হয়ে গেল। একদিন র্ঘ -র্ঘ আওয়াজ তুলে বেসীর নাক খুবলে নিল। দীর্ঘদিন হাসপাতালে থেকে সেরে ওঠার পর তার পরিচিত একজন তাকে একটি টিয়াপাখি দিতে চাইলে বেসী ভয় পেল। টিয়া যদি তার চোখ খুবলে নেয় ! সে তো জানে তার ভাগ্য এমনই..
 

ষষ্ঠ গল্প ‘চিমনি জমাদার’: বাবার মতোই কেলে ইয়াস লুবলিন শহরের বাড়িতে বাড়িতে চিমনি পরিষ্কার করে। যতদিন ওর চিমনি পরিষ্কারের কাজ ছিল চিমনিতে আগুন লাগেনি। রোববার এলে অন্যান্য অ-ইহুদিদের মতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে মায়ের সঙ্গে চার্চে যেত। এক সোমবার জল দেওয়ার ভারী ফিটেল এসে খবর দিল কেলে ইয়াস টেভী বোরুচের ছাদ থেকে পড়ে গেছে। এবং সেটা শহরের সব থেকে উঁচু বাড়ি। চোট পাওয়ার পর শহরের বাইরে জীর্ণ কুঁড়ে ঘরে থাকা কেলে ইয়াস তখন থেকে অন্যের মনের কথা বলতে পারে। শহরের মেকেলেস বলে এক শিক্ষক রায় দিলেন ইয়াস ঈশ্বরের দূত। পরীক্ষার জন্য কেউ একজন নিজের পকেট থেকে একমুঠো খুচরো পয়সা বের করে জিজ্ঞেস করে তার হাতে কী আছে ? ইয়াসের ঝটিকা উত্তর : এতগুলো তিন কয়েক, এতগুলো চার ছয় এবং গ্রোসেন পর্যন্ত মিলে যেত। আর একজন জিজ্ঞেস করে গত সপ্তাহে এই সময়ে লুবলিনে সে কী করছিল? যাদের সঙ্গে গল্প করছিল হুবহু লোকগুলোর বর্ণনা মিলে গেল। ডাক্তার, পৌর কতৃপক্ষ প্রশ্ন করে সঠিক উত্তর পেয়ে বিস্মিত। সকলে বলতে থাকে ইয়াস সাধু।পুরোহিত আতঙ্কিত কারণ গ্রামের লোকজন এবার ইয়াসকেই ঠাকুর মানবে। সবথেকে অসুবিধা হল চোরেদের এবং ঘুষখোরদের কারণ এখন থেকে ইয়াস বলে দিচ্ছে কোন্ চোর কী চুরি করে কোথায় রাখছে বা কার কাছ থেকে কে কত ঘুষ নিচ্ছে। সবার বুক যখন কেঁপে উঠল, এক গন্যমান্য ব্যক্তিত সাহস করে বলল যে ইয়াসের মাথায় ছিল…
 

আন্তজার্তিক গল্পসম্ভার

অনুবাদ: বৌধায়ন মুখোপাধ্যায়


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!