Advertisement
  • ব | ই | চ | র্যা রোব-e-বর্ণ
  • জুন ১১, ২০২৩

অবরুদ্ধ সময়ের নাতিদীর্ঘ বৃত্তান্ত

অরিন্দম গোস্বামী
অবরুদ্ধ সময়ের নাতিদীর্ঘ বৃত্তান্ত

 
বইচর্যা:

এই তো কয়েক বছর আগেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল গোটা পৃথিবীর মানুষ। ভয়ার্ত মানুষের অসহ্য বার্তালাপ, হাসপাতালে ভর্তি হতে চেয়েও সুযোগ না পাওয়া অসুস্থতা, মিডিয়ায় মৃত্যুর পরিসংখ্যানের বহর – আমরা এখন আর হয়তো রোজ মনে করিনা। অথচ এই সময়টা কাটিয়ে এসেছি আমরা সবাই। দক্ষিণ বাংলার এক মানুষ ( লেখক অমিত মুখোপাধ্যায়) চাকরিসূত্রে উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়িতে অবস্থান করে কীভাবে দেখেছেন চারপাশের পরিবেশ ও ঘটনাক্রম – তারই অনুপুঙ্খ বিবরণ – ‘থমকে থাকার দিনকথা’। এই নিয়ে গত এক বছরে আমাদের দেশে লেখালেখি বড়ো কম হয়নি। লেখা হয়েছে অনেক গল্প, কবিতা – সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে অজস্র – বেরিয়েছে অনেক জার্নাল। তবুও এই বইটা আলাদা, অনেকগুলো বিষয়েই অনন্য তার আলোকপাতের পরিধি।

 
বইটিতে, আমাদের কাছের মানুষকে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে দুনিয়া জোড়া ভয়াবহতার পরিপ্রেক্ষিতে – আঞ্চলিক সমস্যার চিত্রায়ণ করা হয়েছে বৈশ্বিক চালচিত্রের সামনে। অতিমারী সময়ের শিশু-কিশোর-বৃদ্ধ অথবা কৃষক-মধ্যবিত্ত বা জিপসি – আলোচনা করতে করতে লেখক কড়া নেড়েছেন সবক’টা দরজায়। প্রতিদিনের সংবাদপত্র, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত লেখা যেমন তিনি উল্টে দেখেছেন, তেমনি নেটদুনিয়া থেকে সংগ্রহ করেছেন ইউনেস্কো-সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্ট। তুচ্ছ খবরের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে ভয়ংকর সত্য।
 
অবরুদ্ধ সময়ের পরিবেশ ও প্রকৃতির পরিবর্তন অস্বাভাবিক স্বচ্ছতায় আঁকা হয়েছে। দূষণহীন সবুজের আভা, নির্জনতার অভিব্যক্তি, দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘা কখন যেন নিকটবর্তী হয়ে আসা – সবকিছুই অন্যরকম ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। শিলিগুড়িতে পথের দখল নিয়েছে অপরিমেয় সারমেয়ের দল। গরুমারা থেকে বেরিয়ে পড়া বাইসনের ঝাঁক, বড়দিঘির চা-বাগানে চিতাবাঘের শাবকদের খুনসুটি অথবা সুকনার পাকা রাস্তা ধরে হাতির পালের সারিবদ্ধ রুটমার্চ সবটাই উল্লেখ করে দেখানো হয়েছে। এর পাশাপাশি ফাঁকা রাস্তায় ইতস্তত পাগলের পদচারণা, ঝাঁপফেলা সারি সারি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দু-একটি ছোকড়া – রেললাইনের মাঝে জেগে ওঠা ঘাস আর আগাছার মতোই যেন ব্যতিক্রমী।
 
ঘরবন্দী নেটিজেনদের বিষন্নতা, বিমুখতা, কর্মহীনতার আশঙ্কায় আত্মহত্যার প্রবণতার প্রতিফলন ফুটে উঠেছে এই লেখার মাধ্যমে। ফুটে উঠেছে কচি-কাঁচাদের ভয়াবহ মানসিক চাপ, মায়েদের দুশ্চিন্তা-ছটফটানি – সবটাই। এর সঙ্গে বিদেশি বাচ্চাদের তুলনা – খেলতে যেতে না পেরে তাদের ওবেসিটি অথবা ভারতের পথশিশুদের ধুলোবালিছাই মেখে দুরবস্থা, অদক্ষ ফেরিওয়ালার ঠেলায় সবজি – সাইকেলে মাছ – কারোর সংগ্রহে শুধুমাত্র বিভিন্ন ধরনের শাক – এগুলোও ধরেছেন তিনি।
 
রয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের খবর। উপগ্রহ উৎক্ষেপণ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ক্রিপ্টোকারেন্সি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন খবর সংগ্রহ করে এখানে এনেছেন তিনি। ছোটবেলায় আমরা পড়তাম রিপ্লে-র আজব খবর। এইযুগে প্রবল দৌড়ে এগিয়ে চলেছে যে মানবসম্পদ – হঠাৎ ছুটি আর ঘরবন্দী হয়ে গিয়ে – তাদের সৃজনশীল মেধা কতো না অভিনব কর্মসূচি নিয়েছে – হঠাৎ একসাথে পড়লে সেই আজব খবরের কথাই মনে আসে। মানুষের নির্মমতা, নিরাপত্তা হীনতা, নৃশংসতা – এসব ঘটনাও তো কম ঘটেনি এইসময় – লেখক তুলে ধরেছেন সেগুলোও। রোজ পাল্লা দিয়ে রেকর্ড সংক্রমণ ও রেকর্ড মৃত্যুর পরিসংখ্যানের পটভূমিতে এই হিংস্রতার উদাহরণ গুলোও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। আবার ডাক্তারদের অমানুষিক পরিশ্রম ও অকল্পনীয় চাপের মধ্যে কাজ করতে করতে কাছের সহকর্মীদের মৃত্যু দর্শন, চিকিৎসা কর্মীদের ঘরভাড়া দিতে অস্বীকার, দিনের পর দিন বাড়িতে ফিরতে না পারা – আবার পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন সেইসব করুণ কাহিনী।
 
সমকালীন প্রতিবেদন রচনা করতে গিয়ে দেশি ও বিদেশি সাহিত্যের প্রচুর উদাহরণ তুলে এনেছেন। কাম্যুর ‘দ্য প্লেগ’ থেকে শুরু করে ট্রয়ের যুদ্ধ, পার্ল এস বাক-এর উপন্যাস ‘দ্য গুড আর্থ’, রেমার্ক-এর ‘দ্য নাইট ইন লিসবন’ যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে মার্কেজের ‘লাভ ইন দ্য ডে’জ অফ কলেরা’ বা জ্যাক লন্ডনের ‘দ্য স্কারলেট প্লেগ’ বা নিকস কাজানজাকিস-এর উপন্যাস’ক্রাইস্ট রিক্রুসিফায়েড’, এমনকি এসেছে শ্লোভাক দার্শনিক স্লাভোই জিজেকের লেখা ‘প্যান্ডেমিক’ নামের একটি বই। এরকম অসংখ্য কালজয়ী রচনার অনুষঙ্গ ব্যবহৃত হয়েছে রচনার পরতে পরতে। তেমনি মনসমীক্ষার অনুষঙ্গে টেনিস তারকা নোভাক জোকোভিচের শাস্তি পাওয়ার জন্য আসল কারণ খুঁজতে ব্যয় করা হয়েছে গোটা একটা অধ্যায়, এবং তা এসেছে অতিমারিতে ঘটা তাঁর জীবনের ঘটনা নিয়েই।
 
সবকিছুই আলাদা আলাদা হয়ে থাকতে পারতো – যদি না লেখক দক্ষ হাতে এদের পারম্পর্য সমেত একসাথে মেশাতে অপারগ হতেন। আমাদের সৌভাগ্য যে, তেমনটা ঘটেনি। অনায়াস ক্ষমতাবলে লেখক বিচরণ করেছেন বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে। পাঠককেও সঙ্গে নিয়ে করিয়েছেন মানস-ভ্রমণ। আজ থেকে ধরা যাক একশো বছর পরে কোনো গবেষক যদি পরিমাপ করতে চান গত শতাব্দীর অতিমারীর অতিমানবীয় ক্ষয়ক্ষতি, মানবসম্পদের ভয়াবহ অপচয় বা সার্বিক মূল্যসূচক অবনমন সম্পর্কে – তখন হয়তো সঠিক পথ দেখাতে খোঁজ পড়বে অমিত মুখোপাধ্যায় রচিত এই নাতিদীর্ঘ গ্রন্থের-ই।
 
থমকে থাকার দিনকথা। অমিত মুখোপাধ্যায়

 


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!