- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- জানুয়ারি ১৯, ২০২৫
নতুন ধারাবাহিক উপন্যাস : ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্রে অথবা ফিঙ-ফোটা-জ্যোৎস্নায়

অলঙ্করণ: দেব সরকার
অন্য এক প্রস্তুতি
সংযত রসিক। গদ্যপদ্যে সব্যসাচী। আটপৌরে নাগরিক এবং প্রান্তজনের নিবিড় বান্ধব। ভারতীয় কথাসাহিত্যের অন্যরকম ইমারতের ‘নির্মাণ আর সৃষ্টিতে’ — নির্মোহ, সজল, সংশয়হীন, আড়ম্বরহীন এবং সদৃঢ় তাঁর কর্ম এবং কর্মের উচ্চারণ। জন্ম, ১৯৬২ -র ২০ জুলাই, ওড়িষা সীমান্ত ছোঁওয়া জঙ্গলাকীর্ণ গ্রামে । একারণেই কি আদিবাসী জনগষ্ঠী আর দারিদ্র্যের হাসি, অট্টহাসি, ছুঁয়ে আছে তাঁর আমিত্বহীন সত্তাকে এবং লেখকতাকে ! এ পর্যন্ত প্রকাশিত উপন্যাস পঞ্চাশের অধিক, গল্প তিনশতাধিক, কবিতা চারশো-রও বেশি এবং পত্রস্থ প্রবন্ধ ছড়িয়ে আছে ত্রিবঙ্গের নানা কোণে এবং বঙ্কিম, বিদ্যাসাগর, আনন্দ পুরষ্কার ছাড়াও বহু সম্মানে সম্মানিত হয়েছে তাঁর মেধা, তাঁর লেখার প্রতিভা। বিরতিহীন লেখক। তবু অস্বস্তি, তৃপ্তিহীন আত্মতা এবং খুঁতখুঁতে অভিপ্রায় ঘিরে থাকে তাঁর স্বভাবকে। নলিনী এমন একজন জাত সহজিয়া লেখক, যা বলবার কিছুই বলিনি — অনায়াসে, হাসতে হাসতে বলতে পারেন যিনি, লিখতে চাই এমন একটা লেখা – যা হয়ে ওঠে নি এখনো ! তারমানে, নলিনীর ভিন্নতর প্রস্তুতি পর্ব শুরু হবে এবার !
বাহার উদ্দিন
প্রথম পর্ব
“ শ্লোকার্ধেন প্রবক্ষ্যামি যদুক্তং গ্রন্থকোটিভিঃ।
ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবঃ ব্রহ্মৈব নাপরঃ ।।”
• ১ •
সুবর্ণরেখা নদীধারে আমাদের সামান্য কিছু ‘পাল’ জমি । নদীর পলি জমে জমে তৈরি, তাই বলা হয় ‘পালজমি’ ।
আছে– তবে ওই নামেই । কেননা ফি বছর বন্যায় ধাস্ ধাস্ শব্দে নদীর ‘কাতা’ ভেঙে ভেঙে জমিকে গ্রাস করতে করতে ক্রমশ এগিয়ে আসছে নদী ।
একদা যা ছিল আড়ে-বহরে প্রায় একবিঘার উপর, এখন তা কাঠাকালীতে দাঁড়িয়েছে কাঠা তিনেক । এ অবস্থা খালি কী আমাদের ?
উঁহু, না । আমাদের বাছুরখোঁয়াড় গ্রামের বায়া, কালাচাঁদ, শম্ভুনাথ, হারান-পরাণ, অমূল্য, সর্বেশ্বরদের সরেজমিন পরিস্থিতিও তদ্রূপ।
তবে যেটুকু জমিজমা এখনও অবশিষ্ট আছে, তাতে আখ-অড়হর ছোলা-মুসুর খেড়ী তরমুজ বেগুন-বৈতালের চাষ হয় । চাষাবাদ না থাকলে প্রভা বিশুইয়ের ছেড়িছাগল চরে।
ছাগলগুলো মাথা নিচু করে খুঁটে খুঁটে মুথা, ঘলঘসি, ঘাস খায়। আহারে অরুচি হলে ঘাড় তুলে নদী দেখে।থেকে থেকে মুখে মৃদুস্বরে আওয়াজ দেয় — “ অ্যা-ড়-রে-এ-এ-এ !”
আর কেউ না হোক, জমির প্রান্তে পাকুড়ের ডালে বসা একলা চিল উত্তর দেয় – “ চি-ল-কু-ড়-ড়-ড়- !! ”
কে জানে সেসবের কী মানে !
ভূগোলে-ইতিহাসে আছে, সুবর্ণরেখা খুব প্রাচীন নদী। ছোটনাগপুরের মালভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে সিংভূম-মানভূম পুরুলিয়া-গোপীবল্লভপুর-নয়াগ্রাম-দাঁতন-সোনাকনিয়ার উপর দিয়ে গিয়ে ওড়িশার বালেশ্বর-জলেশ্বর ছুঁয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে ।
পুঁথিপত্রেও সুবর্ণরেখার বিস্তর বিবরণ আছে। শ্রীমদ্ গোপীজনবল্লভ দাস বৈষ্ণবাচার্য রসিকানন্দের জীবন অবলম্বনে সেই কোন ষোল শ সাতান্ন থেকে ষোল শ ষাটের মধ্যে ‘ শ্রীশ্রীরসিকমঙ্গল ’ নামের একটা আস্ত পুঁথি রচনা করেছিলেন, যার পাতায় পাতায় নদীর নাম —
‘ উৎকলেতে আছয়ে সে মল্লভূমি নাম ।
তার মধ্যে রোহিণী নগর অনুপমা ।।
কটক সমান গ্রাম সর্ব্বলোকে জানে ।
সুবর্ণরেখার তটে অতি পুণ্যস্থানে ।।
ডোলঙ্গ বলিয়া নদী গ্রামের সমীপে ।
গঙ্গোদক হেন জল অতি রসকূপে ।।
রোহিণী নিকটে বারাজীত মহাস্থান ।
যাতে সীতা রাম লক্ষ্মণ কৈলা বিশ্রাম ।।
দুয়াদশ লিঙ্গ রামেশ্বর শম্ভুবর ।
রঘুবংশ কুলচন্দ্র পূজিলা বিস্তর ।।
বারি লৈতে কোটি লোক আইসে তথায় ।
হেন পুণ্য নদী পুণ্যস্থান চারিদিকে ।
রোহিণী বেড়িয়া সবে রহে লাখে লাখে ।।’
( শ্রীশ্রীরসিকমঙ্গল ।। পূর্ব্ব বিভাগ ।। তৃতীয় লহরী )
আবার ‘ দক্ষিণ বিভাগ ।। তৃতীয় লহরী’ তেও আছে –
‘ সুবর্ণরেখার কূল অতি সুশোভিত ।
আম কাঁঠালের বন শোভে চারিভিত ।।
পুলিন সুন্দর নদী দেখিতে সুন্দর।
যমুনার জল যেন দেখি পরিমল ।।
অতি সুকোমল স্থান কেন না যায় ।
যতই বরষা করে কর্দ্দম না হয় ।।’
শাস্ত্রে বলে, “ অধিকন্তু ন দোষায়।” তবু অধিক উদাহরণ এখানে নিষ্প্রয়োজন। সাত-কাহন করে যেটুকু বললাম, তার কারণ এই যে -সংবৎসর এই দু-দুটো নদী, সুবর্ণরেখা আর ডোলঙ্গ বা ডুলুঙ, পেরিয়ে প্রায় সাড়ে তিনমাইল দূরবর্তী রোহিণীগ্রামে অবস্থিত ‘রোহিণী চৌধুরানী রুক্মিণী দেবী হাইস্কুলে-এ পড়তে যেতাম-আসতাম পায়ে হেঁটেই।
তবে একমাত্র বর্ষার মরশুম ব্যতীত তেমন আর জল কোথায় ! হেথা-হোথা বিক্ষিপ্ত দশ-বিশগজ জল ছাড়া বাকি সমস্তটাই তো মরীচিকার ভ্রম সৃষ্টিকারী ধূ ধূ বালিয়াড়ি।
‘মরীচিকা’ বানানটাও যেমন খটোমটো, তেমনি তার অর্থও। শ্রীশ্রীহরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ তার তর্জমা করে লেখে যে –“ গ্রীষ্মে বালুকাপ্রতিফলিত জলবৎ প্রতীয়মান রবিকরমালা।”
তা, গ্রীষ্মের মধ্যাহ্নে সূর্যতাতা নদীবালিতে খালি পায়ে ক’পা হেঁটে গেলেই ‘মরীচিকা’ শব্দটির অর্থ বোধগম্য হতে বিলম্ব হয় না। যদিও দুই নদীর মাঝবরাবর কাঁটাকুল, ফণী-মনসা, আকন্দ আকীর্ণ পোয়ামাইলটাক ‘কদোপাল’ নামের একটি সুবিস্তৃত ডাঙা আছে । ডাঙা আর কোথায়, সেও তো এক বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি, সুবিশাল বালির স্তূপ।
অবশ্য আগে আগে, আগে আগে মানে প্রাচীনকালে, নদীর এরূপ দুর্দশা ছিল না। নদী তখন স-সাগরা । অর্থাৎ, সুবর্ণরেখায় তখন জোয়ার-ভাঁটা খেলত, সওদাগরি জাহাজ চলত।
“ এসব নগরে যত সওদাগর বৈসে ।
তরণী সাজায়ে তারা বাণিজ্যেতে আইসে ।। ”
একবার তো ‘ওক্কলবা’র ‘তপোসা’ আর ‘পালেকাথ’ নামের দুই সওদাগর নানারকম দ্রব্যাদি, বীজদানা ও মশল্লার জাহাজ নিয়ে ‘আদজেত্তা’ বন্দর থেকে ‘সুয়োমা’ বা ‘সুহ্মদেশ’-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল।
‘ওক্কলবা’ তৎকালীন উৎকলদেশ। ‘আদজেত্তা’ হল তাম্রলিপ্ত বন্দর। আর ‘সুয়োমা’ বা ‘সুহ্ম’ তো সে সময়ের মেদিনীপুরসহ এক সুবিশাল ভূখণ্ড।
সওদাগর ‘তপোসা’ ও ‘ পালেকাথ ’-এর জাহাজ সমুদ্রপথে এসে একদা ঢুকে পড়েছিল ‘সুয়োমা’ বা সুহ্মদেশের নদী সুবর্ণরেখার মোহানায়। তারপর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ মহাসমুদ্রের প্রচণ্ড জোয়ার ও বায়ুপ্রহারে সওদাগরি সেই মালবাহী জাহাজ আছড়ে ভেঙে পড়েছিল আমাদেরই গ্রামের অনতিদূরে থুরিয়ার মহিষাসুর ‘দঁক’-এ।
‘দঁক’ একটি আজেবাজে চলিত কথা । শ্রীশ্রী হরিচরণ বন্দ্যো’র ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ এর উল্লেখ নেই । তা বলে এটা কোন মতেই যোড়-তাড় করে বলা নয়। এর প্রচলিত অর্থ হল ‘কদর্মাক্ত জলাভূমি’।
আখমাড়াইয়ের মরশুমে এতদ্ অঞ্চলের আখ চাষীদের মাড়াইকলে ‘পঁড়াসুর’ বা পণ্ডাসুর অর্থাৎ মহিষাসুরের পূজা করতে হয় বেশ ঘটা করেই ।
সে কী আজকের কথা ! সেই কোন আদ্দিকাল থেকে আখের রস জ্বাল দেওয়ার ‘ডেগ’ বা কড়াইয়ের একপাশে উনুনের ধারেই মাটির ‘ঢেলা’ হয়ে পূজা পেয়ে আসছে মহিষাসুর—
“ পণ্ডাসুর ইহাগচ্ছ ক্ষেত্রপাল শুভপ্রদ ।
পাহি মামিক্ষুযত্রৈস্তং তুভ্যং নিত্যং নমো নমঃ ।।
পণ্ডাসুর নমস্তুভ্যামিক্ষু বাটি নিবাসিনে ।
যজমান হিতার্থায় গুড়বৃদ্ধি প্রদায়িনে ।। ”
আমাদের দেশে-ঘরের লোকেরা পুরুষ মোষকে ‘পঁড়া’ বলে। তদুপরি সুবর্ণরেখার খাঁড়িতে ‘মহিষাসুর দঁক’-এ অচেনা অজানা গাছ-গাছড়ার জঙ্গলে মহিষাসুরের পূজার ‘থান’ও আছে।
তাই জায়গাটা ‘মহিষাসুর দঁক’। এই দঁকেই একদা ডুবে গিয়েছিল সওদাগর ‘তপোসা’ ও ‘পালেকাথ’-এর অর্ণবপোত ।
ডুবে গেল । বালিপোত হল। মাটি চাপা পড়ল । অচেনা অজানা বীজদানা অঙ্কুরিত হল। চারা জন্মাল। চারাগাছ কালে কালে মহীরুহে পরিণত হল।
মহিষাসুর দঁক ভরে উঠল অর্জুন, পাকুড়, শাল, মহুলে নয়, অচেনা অজানা সেই সমস্ত মহীরুহে ।
নদীতীরের জনমানুষদেরও কী আর এই নিয়ে মাথাব্যথা ছিল, না আছে ? সভ্যতা মাথায় থাক, তারা বড়জোর চিন্তায় চিন্তায় মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলে আগ্রাসী বানবন্যা নদীর ‘কাতা’ ভেঙে ভেঙে এবার কার কতটা জমি গ্রাস করে ফেলবে !
ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্রে, ফিঙ-ফোটা-জ্যোৎস্নায়, এমনকী নিকষকালো অন্ধকারেও নাম-না-জানা গাছেদের জঙ্গলে দিনক্ষণ বুঝে সময় সময় ঝলসে উঠতে লাগল আছড়ে ভেঙে পড়া, ডুবে যাওয়া জাহাজের কানা !
ভাঙা জাহাজের কানা ঝলসানি আমরা অন্তত স্বচক্ষে কোনদিন দেখিনি। আমাদের গ্রামের হারান-পরাণ, রামেশ্বর-পৃথ্বীনাথ, বা আর কেউ কখনও দেখেছে বলেও তো শুনিনি।
তবে শুনেছি, যে-ই দেখেছে সে-ই নাকি উন্মাদ ও বিবাগি হয়ে দেশান্তরী হয়েছে। আমাদের ‘মহিষাসুর দঁক’-ও তাই লোকমুখে রূপান্তরিত হয়েছে রহস্যময় ‘জাহাজকানার জঙল’-এ।
নাকি খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০-২৬০০ সময়কালে আফগানিস্তানের হেলমান্দ নদীউপত্যকায় গড়ে উঠেছিল ‘হেলমান্দ সভ্যতা’।
আর খ্রিস্টপূর্ব ৩৮০০-৩২০০-র মধ্যে অধুনা পাকিস্তানের অন্তর্গত সিন্ধুনদের অব-বাহিকায় হরপ্পা ও মহেঞ্জাদড়োকে আশ্রয় করেই ‘সিন্ধুসভ্যতা’।
কিন্তু কস্মিনকালেও সুবর্ণরেখা নদীকে কেন্দ্র করে এমন কোন সভ্যতার হদিস ইতিহাসবিদদের কাছে নেই। এ নিয়ে তাঁরা মাথাও ঘামান না।
নদীতীরের জনমানুষদেরও কী আর এই নিয়ে মাথাব্যথা ছিল, না আছে ? সভ্যতা মাথায় থাক, তারা বড়জোর চিন্তায় চিন্তায় মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলে আগ্রাসী বানবন্যা নদীর ‘কাতা’ ভেঙে ভেঙে এবার কার কতটা জমি গ্রাস করে ফেলবে !
বিশেষত বর্ষায়, আর যাদের নদীধারে জমি আছে, তাদের । কথায় বলে না- “নদীর ধারে বাস ভাবনা বারোমাস । যতই ‘কড়া ধাতের দেশ’ বলা হোক না কেন, ডাক-পুরুষের বচন এদেশের ক্ষেত্রেও খাটে বৈকি ।
তা, নদী-সেপারের বড় ইস্কুলে যেতে আসতে রোজ দুবেলায় আমাদের চোখে পড়ে ‘জাহাজকানার জঙ্গল’, তার বনঝাড় ।
আর আর সঙ্গীসাথীরা, মানে আমাদেরই গ্রামের ইস্কুলপড়ুয়ারা, পারতপক্ষে সেদিকে চোখ তুলেও দেখে না । কিন্তু আমার আগ্রাসী চোখদুটো বড় বড় করে কেন জানি সেদিকেই তাকিয়ে থাকে ।
ভাঙা জাহাজের কানা ঝলসানি তো দূরঅস্ত্, দৈবাৎ একটা-দুটো পাখির ডানা ঝাপটানি যা চোখে পড়ে, বা কানে আসে। হয় তারা ডানা ফেটিয়ে জাহাজকানার জঙ্গলের দিক থেকে উড়ে আসছে, নয় তো সন্ধ্যা হব-হব সময়ে জাহাজকানার জঙ্গলে বাসায় ফিরছে ।
কদোপালের ডাঙার মাথায়, একেবারে পশ্চিমে, একলা একলা একটা ছাতিম গাছ। গ্রামে-ঘরে লোকে তো বলে ‘ছাতনা গাছ’। সেই ছাতনা গাছে সকাল-সন্ধ্যায় রাজ্যের দাঁড়কাক এসে মজলিশ বসায়। বড়োই কর্কশ কন্ঠে তারা তখন মুহুর্মুহু ডাক ছাড়ে ।
সে-ডাক শোনামাত্র সুখীগৃহস্থরা অমঙ্গল আশঙ্কা করে । তবে আমাদের দেশে-ঘরের লোকেরা এ-ডাক নিত্যদিনের আয়োজন মনে করে এক কান দিয়ে শোনে, আরেক কান দিয়ে তৎক্ষণাৎ বের করে দেয় ।
আমাদের নদীধারের ‘ পাল জমি ’ থেকে সোজা পশ্চিমে ক’পা হেঁটে গেলেই পড়বে সীতানালা ‘খাল মুহ্’ অর্থাৎ সীতানালা খালের মোহানা আর পড়বে ‘ মশানির দহ ’।
মুহ্, তারমানে মুখ। সীতানালা খালের মুখ। সীতানালা নাকি রামায়ণের জনমদুঃখী সীতারই অশ্রু দিয়ে গড়া এক ছোট নদী।সত্যিসত্যিই ছোটনদী মালিনীরই তুল্যমূল্য। সেই আছে না –“মালিনীর জল বড় স্থির -আয়নার মত। তাতে গাছের ছায়া, নীল আকাশের ছায়া, রাঙা মেঘের ছায়া -সকলি দেখা যেত। ”
সীতানালা যেখানে এসে সুবর্ণরেখায় মিশেছে, তাকে যদি সীতানালার মুহ্ বা মোহানা ধরা যায়, তবে তার উৎসস্থল অবশ্য অবশ্যই ‘তপোবন’। তপোবন জঙ্গলমহাল। জে. এল. নং ৩৮। খেলাড় নয়াগ্রাম পরগণা।
নাকি –“এই সেই জনস্থানমধ্যবর্তী প্রস্রবণগিরি…” বাল্মিকীরই তপোবন আশ্রম। রাম কর্তৃক সীতা এখানেই বনবাসে বিবর্জিতা হয়েছিলেন।
অতঃপর এখানেই লব ও কুশের জন্ম হল। প্রসূতি তথা পোয়াতি সীতা গায়ে হলুদ মেখে স্নান করলেন। সীতানালা খালের উৎসমুখের জল তাতেই হয়ে গেল ‘হলুদ-গাবা’।
শাল ডাঁটির দাঁতনকাঠি দিয়ে দাঁত মাজলেন। দাঁত-মাজা সেরে দাঁতনকাঠি চিরে দু-ভাগ করে জিভ ছুললেন। ফেলে দেওয়া, চিরে দু ভাগ করা দাঁতনকাঠি থেকে দু-দুটো মহীরুহ শালগাছ জন্মাল। তাদের একটা তো এখনও আছে। আরেকটা জঙ্গলের কাঠ-চোরেরা এতদিনে লোপাট করে দিয়েছে।
তবু পাহাড় পর্বত না থাক, বড়-বড় বট, সারি সারি তাল, তমাল, শাল, পিয়াশাল, ধ, আসন, মহুল, মেহা, কেঁদ, কইম, কুড়চি, ভেলা, বাদভেলা, ভাদু -আছে বৈকি ।
জঙ্গলের বুক চিরে সীতানালা খাল চাষাবাদের জমির দিকে এঁকে বেঁকে অগ্রসর হলে তার ‘হলুদ-গাবা’ বা হরিদ্রারঞ্জিত জল আর থাকে না । ভেলভেটের তুল্য চিরোল চিরোল শুশনি, সরন্তি শাকের দঙ্গল সরালেই কাকচক্ষুর মতো পরিষ্কার জল। তাতে গাছের ছায়া, নীল আকাশের ছায়া, রাঙা মেঘের ছায়া যেমন দেখা যায়, তেমনি পুঁটি-দাঁড়িকিনি-চাঁদ-কুড়ি, ইত্যাদি ছোট ছোট মাছও খেলে বেড়ায়।
তারপর তো সীতানালা খাল বা ছোট নদী তপোবন জঙ্গলমহালের সীমানা ছেড়ে পিতাম হাঁসদা আর শীতল জানার ডিহিবাড়ির পাশ দিয়ে উত্তরে প্রবাহিত হয়ে মিশেছে ‘মশানির দহ’-এ, সুবর্ণরেখায়।
আর এতক্ষণে এতদূর এসে সীতানালা যেন তার পুরাণ-মর্যাদা অনেকটাই ক্ষুন্ন করেছে।দুধারের পাড় বেঢপ উঁচু হয়ে গিয়েছে ।
পাড়ে সারি সারি তাল, তমাল, শাল, পিয়াশালের পরিবর্তে চাষীদের ‘ত্যাঁড়া’ বসেছে ।
‘ত্যাঁড়া’ — তারমানে জমিতে সেচের জন্য জল তোলার কাঠ ও দড়ির ঘড়রি বিশেষ ।
চাষীরা ত্যাঁড়া-কাঠে হরদম ঘড়রি ঘুরিয়ে জল তুলে ফুলকপি-বাঁধাকপি বেগুন-মুলো বৈতাল-বরবটি আখ-অড়হরের জমিতে ‘বাতান’ দিচ্ছে। তাতে সীতানালার আয়নার মতো জল অনবরত ঘোলা হচ্ছে।
তার উপর ‘মশানির দহ’-এর ঠেস-মারা জলে ধাক্কা খেতে খেতে উছুক-ডুবুক হয়ে ইতস্তত ভেসে বেড়ায় আধ-পোড়া-মড়াকাঠ। কাছেই, সীতানালা খাল-মোহানার চবুতরায় আমাদের গ্রামের মড়া-পোড়া-শ্মশান আছে যে !
মড়া পুড়ল পুড়ল, তার পারলৌকিক ঘাট-কামানোয়, বালিতে যত্রতত্র গোঁজা হয়ে পড়ে থাকল স্তূপীকৃত মাথার চুল, ভাঙা কলসির খাপরা, ঘাটে-ওঠা-নরনারীর ফেলে যাওয়া পরনের ছেঁড়া শাড়ি, ধুতি-গামছা ।
সুনসান মধ্যাহ্নে, অলস অপরাহ্ণে, অথবা ভর-সন্ধ্যাবেলায়, অথবা ঘোরতর তমসা-লগ্ন নিশীথেও সীতানালার জলে গাছ থেকে টুপটাপ ছপাৎ ছপাৎ করে অঝোরঝর আছড়ে পড়ে ফাটতে থাকে পাকা যজ্ঞিডুমুরের ফল ।
চাষীদের বেকার ত্যাঁড়ায় বসে একলা একলা দোল খায় কালো ভুসভুসে ঢ্যাপচু । অর্থাৎ ফিঙেপাখি। আচমকা তীক্ষ্ম স্বরে সে ডেকে ওঠে – “ ভু-ই-চু-ঙ! ভু- ই-চু-ঙ !!”
হয়তো তখনই খেড়ী-তরমুজ মুগ-মুসুরের জমির উপর দিয়ে, আখ-অড়হরের খেতি-খামারে হুড়্ ঝুড়্ আওয়াজ তুলে, সীতানালা খালমোহানার চবুতরায় উড়ে এসে জুড়ে বসে জাহাজকানার মন্দ বাতাস ! আর – অদূরে ছাতিনা গাছে গোল গোল চোখ ঘুরিয়ে চামড়ায় চোখ ঢেকে দাঁড়কাকরা মটকা মেরে পড়ে থাকে । রা কাড়তে তারা আর ভরসা পায় না ।
• ২ •
‘মশানির দহ’।
‘দহ’ -শ্রীশ্রী হরিচরণ শর্ম্মার ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ পুনরপি তর্জমা করে যে, দহ, অর্থাৎ কালীদয় সাগর।“ দহতে পেলায়িরো; দহ বুলী ঝাঁপ দিলো সে মোর সুখাইল।” গভীর দহ, ইত্যাদি।
মনসামঙ্গলের ‘কালীদয় সাগর’ , শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ‘দহ’ বা গঙ্গামঙ্গলের ‘গভীর দহ’ –
আর আমাদের কোথায় ! মাটিতে অবিরল জল পড়তে পড়তে একসময় জলের ধারাবেগ কর্ষণে গভীর গর্তের সৃষ্টি হয় ।
তেমন আর কী ! বছরের পর বছর বর্ষায় সীতানালা খালের প্রবল প্লাবনের তোড় তার ‘খাল মুহ্’ অর্থাৎ মোহানায় সুবর্ণরেখার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে পড়তে গভীর খাদ রচনা করে। কালে কালে তাই হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘মশানির দহ’।
তার সন্নিকটে আমাদের গ্রামের শ্মশান। আর কথাতেই তো আছে ‘শ্মশান-মশান’। যোড়-তাড় করে বানাতেও হয় না। শ্মশানই মশান, মশানই শ্মশান।
মশানির দহ তারমানে শ্মশানেরই দহ । শ্মশানের যাবতীয় বর্জ্য — পোড়া কাঠকয়লা, আধপোড়া মড়াকাঠ, দড়ির চারপাই, ভাঙা কলসি, ছেঁড়া মশারি, বাঁশের কুলো, ছেঁড়া জুতো, ভাঙা ছাতা, ডাঁটি ভাঙা ফাটা কাচের চশমা—
— সব, সব এসে দহের জলের ঊরাল ঘূর্ণিতে আছড়ে পড়ে ঘুরপাক খায়।পাক খেতে খেতে কতক তলদেশে থিতিয়ে পড়ে স্তূপীকৃত হয়।আর কতক অনুকূল স্রোতোপ্রবাহে ভেসে যায়।
যারা ভেসে গেল তারা তো গেলই । আর যারা পড়ে থাকল তাদের গায়ে ছ্যাতলা পড়ল। তারমানে শ্যাওলা ধরল।
জল জমে বরফ, আঁধার জমে ভূত। কিন্তু জলের তলদেশে স্তূপীকৃত শ্মশানের পোড়া আংরা, আধপোড়া মড়াকাঠ, ভাঙা কলসি, ছেঁড়া জুতোয় শ্যাওলা ধরলে যে কী হয়— এত- দিন জানা ছিল না।
জানতে পারি উনিশ শ সাতষট্টির এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে । ততদিনে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষাটাও শেষ, হাতে বিস্তর অবসর । কী করি, কী করি !
সুবর্ণরেখা নদীধারের পালজমিতে সেবছর চাষীদের আখ চাষেরও প্রাচুর্য খুব। এপ্রিল শুরু হয়ে মাসের মাঝামাঝি এসে গেল, তবু তাদের মাড়াইকলের উড্ডীয়মান কালো ধোঁয়া তখনও থামেনি, অনর্গল উড়ে চলেছে ।
আমাদের গ্রাম থেকে বাঁকে করে কুমোরদের মাটির কলসি, যাকে বলে ‘কুঁদা’, মাড়াইকলে আসছে তো আসছে আর নতুন গুড়ে ভরতি হয়ে গরুর গাড়ি করে একে একে চলে যাচ্ছে বেলদা-খাকুড়দা-কেশিয়াড়িতে। সেখান থেকে আড়তদারেরা ট্রাক-কে-ট্রাক পাঠিয়ে দিচ্ছে কলকাতার পোস্তা-রাজাকাটরা-বঢ়াবাজারে।
আমরা কতিপয় পরীক্ষার্থী বন্ধুরা বড়জোর অপরাহ্ণে নদীর পাড়ে বসে গুড়াখু সহকারে দাঁত মাজতে মাজতে নতুন গুড়ের গন্ধ শুঁকি। আর, হয়তো তিথি-নক্ষত্র মিলিয়ে দিন-ক্ষণ দেখি -কখন ওদিকে চাষীদের একলা ‘ত্যাঁড়া’য় বসে কালো ভুসভুসে ঢ্যাপচু তারস্বরে ডেকে উঠবে –“ ভু-ই-চু-ঙ ! ভু-ই-চু-ঙ !! ”
কখন জাহাজকানার জঙ্গল থেকে মন্দ বাতাস উঠে এসে শম্ভু, সর্বেশ্বরদের, কালাচাঁদ, হারান-পরাণ, এমনকি আমাদের জমির উপরও তার গরম শ্বাস ফেলে খাল-মোহানার শ্মশান- চবুতরায় আছড়ে পড়বে, তার ধাধসে চামড়ায় চোখ ঢেকে মটকা মেরে পড়ে থাকবে ছাতিনা গাছের দাঁড়কাকেরা।
মধ্যাহ্নে, আঁইঠু দঁড়পাটদের ‘ভাতুয়া’ ভুজু-ডিবরা যখন তাদের চরানে পঁড়ামোষগুলো নিয়ে নদীর জলে ফেলে খড়ের নুড়ো দিয়ে ঘষে ঘষে গা-গতর সাফা করে, পঁড়ামোষের গা-গতরে ‘বসি বসি’ করে পা ঝুলিয়ে ধারেকাছে উড়ে বেড়ায় একটি-দুটি কাক, তখনই জনা-কতক আমরা নদীর পাড় থেকে ঝুপঝাপ ঝাঁপ দিয়ে পড়ি ‘মশানির দহ’-এ।
ডুব-সাঁতার, চিৎ-সাঁতার, এমনকি ডুব দিয়ে জলের তলা থেকে তুলে আনি বালি, কখন বা হাতমুঠোয় বেঘোরে উঠে আসে শ্যাওলা-ধরা পোড়া-আঙরা, মড়াকাঠ, খাটিয়ায় বাজু -দহ ছাড়িয়ে উত্তরে গেলেই নদী খুব অগভীর, প্রায় হাঁটুজল। আমরা বন্ধুরা, এবং আর আর সঙ্গীসাথীরা, সময় সময় স্রোতের উল্টো দিকে মাছ ধরার তাগিদে ঘন সারিবদ্ধ হয়ে মানববন্ধনে বসি, তখন আমাদের ফাঁক-ফোকর দিয়ে জল বৈ মাছ গলে যাওয়ার কোনও জো থাকে না ।
মাছ ধরাও পড়ে। বাটা, খয়রা, ‘দাড়ুয়া’ অর্থাৎ দাড়িওয়ালা চিংড়া। ছির্ ছার করে ছিটকে উঠে মাথার উপর দিয়ে লাফিয়ে-ঝাপিয়ে স্রোতের অনুকূলে পালিয়েও যায় দুটো-একটা ।
কখনো কখনো বেলা আড় হয়ে আসে তবু আমাদের জলে ঝাঁপাঝাঁপি সহজে থামে না । বাড়ি থেকে ডাক এসে যায় -“অ রে অমুক রে-এ-এ-অ রে তমুক রে-এ-এ-এ- মশানির দহে অর্গলা ভূত আছে রে-এ-এ-এ- অত ঝাঁপাস না রে-এ-এ-এ-…”
ধুত্ ! অর্গলা ভূত ! জাহাজকানার জঙ্গলের মন্দ বাতাস ! কোথায় কী ! বড়জোর নদীধার দিয়ে যাতায়াতকারী মুনিশ-মাহিন্দররা, ওড়িয়াভাষী ‘হাটুয়া’ জনমানুষরা আমাদের কিত্তি- কাণ্ড দেখে হাসে।
হয়তো কেউ কেউ জরপ করে বলেও –“ বাছুর খুঁয়ার্ড়্যা টকামানে কুক্কুল্যা খরাবেলা মশানির্দয় ঝাপাসি ঝুরেঠ্যা, হা দ্যাক্ ! ”
কী বলল ? “ ওঁ হ্রীং হ্রীং ” করে ভূত তাড়ানোর কোনও মন্ত্র বলল কী ? না, না । হাটুয়ারা তাদের ‘হাটুয়া’ অর্থাৎ ওড়িয়া-বাংলা মেশামেশি একরকম ভাষায় যা বলল তার তর্জমা করলে দাঁড়ায় —
বাছুরখোঁয়াড় গ্রামের ছেলেছোকরারা এই কুল কুল করে ঘাম ঝরানো দ্বিপ্রহরবেলায় মশানির দহে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে জল তোলপাড় করে সাঁতার কাটছে -ওই দ্যাখো !
যাহোক, আধপোড়া মড়াকাঠ, পোড়া আংরা, শ্মশানের ভাঙা কলসি, ভাঙা ছাতা মশানির দহে জলের তলায় পড়ে ছ্যাতলা ধরলে, আর তা মানুষের পায়ে জড়ালে যে কী হয়- জানা ছিল না ।
জানা ছিল না। জানতে পারলাম উনিশ শ সাতষট্টির এপ্রিলের মাঝামাঝি, সম্ভবত তেরই কী চৌদ্দই এপ্রিল। দিনটা ছিল বোধকরি শনিবার।
তার আগের বছর আমরা খবর পাচ্ছিলাম, সম্ভবত আগস্ট মাসে সন্তরণপটু মিহির সেন জিব্রাল্টার প্রণালী অতিক্রম করলেন । ফের সেপ্টেম্বরে পেরোলেন দার্দানেলস প্রণালী।
সাঁতারে বাঙালির রেকর্ডের পর রেকর্ড। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই পক প্রণালী সন্তরণ প্রতিযোগিতায় বৈদ্যনাথ নাথ আবার
প্রথম !
কোথায় জিব্রাল্টার, দার্দানেলস, কোথায় বা পক প্রণালী— আমাদের সঠিক ধারণা ছিল না । তবু সুবর্ণরেখার মশানির দহে আমাদের দাপাদাপি যার পর নেই বেড়ে গেল।যাকে বলে ‘ঝাপাসি ঝুরেঠ্যা’।
ডুব-সাঁতার, চিৎ-সাঁতার তো জানা ছিলই, শুরু হল ‘ফ্রি স্টাইল’ ‘ ব্রেস্ট স্ট্রোক ’ ‘ বাটার ফ্লাই ’ ও ‘ ব্যাক স্ট্রোক ’ ।
তবে গ্রীষ্মের নদীতে দৌড় ওই বড়জোর মশানির দহ। নচেৎ দহের উপরে গেলেও হাঁটুজল, নিচে গেলেও হাঁটুজল, সমুখে গেলেও হাঁটুর নিচে বৈ উপরে ওঠে না। কবিতাতেই তো আছে —
“ আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে,
বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে । ”
“ চলে বাঁকে বাঁকে” – কথাটাও আমাদের সুবর্ণরেখা নদীর ক্ষেত্রে খাপ খেয়ে যায় বেশ। গোপীবল্লভপুর-নয়াবসান থেকে নদী এসে ওই তো বাঁক নিয়েছে তালডাংরা-মলতাবনীতে।
তারপর পাতিনা-দেউলবাড়ে । মহাপাল হয়ে রগড়া-কাঠুয়াপালে। আমাদের ঘাট ছুঁয়ে নদী ফের বাঁক নিয়েছে থুরিয়া-নরসিংহপুরে –
কিন্তু ঘনঘোর বর্ষায়, মহাপ্লাবনে, সেসমস্ত বাঁকঢাঁক মুছে নিয়ে এ-কূল ও-কূল দুই কূল একাকার ও সমান্তরাল হয়ে নদী দুরন্ত বেগে ছুটে চলে সমুদ্রের দিকে ।
তখন ভারি কষ্টকর ও দুঃখজনক হয়ে উঠলেও বাঁকা নদী যেন আমাদের জীবনের খাপে খাপেই এঁটে থাকে। সেই একটা গান আছে না—
‘ বাঁকা নদী বড়ই দাগা দ্যাল্ ব
বাঁকা নদী বড়ই দাগা দ্যাল্ ।
হেলা কান্তে চেলা কান্তে, মায়ে ঝিয়ে দুই কান্তে
চলিতে চলিতে মোদের জ্যাং ধরি গ্যাল্ ।।
জ্যাং ধরি গ্যাল্ ।।
বাঁকা নদী বড়ই দাগা দ্যাল্ ব
বাঁকা নদী বড়ই দাগা দ্যাল্ ’
শনিবারের বারবেলায় মশানির দহের জলে বিস্তর সাঁতার কেটে স্নানান্তে পাড়ে উঠে দু পা দস্তুরমতো ঝাড়তে লাগলাম – ডান পায়ের বুড়ো আঙুল আর মেজো আঙুলের মাঝখানে শ্যাওলার মতো কী যেন একটা জড়িয়ে আছে না ?
কী যেন ?
কী আবার, শ্যাওলাই তো ! ঝাড়াঝাড়িতে কতক ঝরে গেল আর কতক এঁটুলির মতো সেঁটে থাকল। থাক, থাক।শুকনো হলে এমনিতেই ঝুর ঝুর করে ঝরে পড়বে। যেমন কীনা চাষাবাদের কালে চাষীদের পায়ে, হালের বলদের গায়ে কাদা লেপ্টে, শুকিয়ে চাগাড় বাঁধে।
ঘরে এসে ভরপেট খেয়ে একঘুম ঘুমোলাম। তারপর তো আমাদের গোঠটাঁড়ের মাঠে গিয়ে ফুটবল নিয়ে ফের একপ্রস্থ দাপাদাপি।শ্যাওলার অবশিষ্ট যেটুকু এখনও লটকে আছে, সেটুকুও উবে যাবে না কর্পূরের মতো !
আর আমাদের ফুটবল তো আদপেই চামড়ার নয়, বুনো ওলডাঁটার। অজগর সাপের মতো গায়ে ছাপছোপ আঁকা বুনো ওলগাছ কেটে এনে রৌদ্রে শুকিয়ে ছনের দড়ি দিয়ে পোঁটলা করে বাঁধা।
হাওয়া ভরে ফুলটুস করা চামড়ার ফুটবল নয় যে পায়ের সামান্য ‘টাচ’-য়েই উড়ে উঠবে, ওলডাঁটার বলকে তিন-তালগাছ-সমান উচ্চতায় ‘হাই-শট’ মারতে গেলে রীতিমতো পায়ের টেংরির জোর লাগে।
কাদা তো কাদা, শ্যাওলা তো শ্যাওলা -সে- গোল্লাছুটের ধাধসে সবকিছুই ছিন—
ছাতুর হয়ে ঝরে পড়বে না ? কিন্তু না, খেলা শেষে পা ধোওয়ার কালেও আঙুলদুটি ফাঁক করে দেখি— সবুজ বরণ বিন্দুর মতো একটা কিছু তখনও লটকে আছে না ?
‘ যানে দো ’ বলে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে হেরিকেন জ্বেলে পড়তে বসে গেলাম।পরীক্ষা তো হয়েই গিয়েছে, তাহলে আবার পড়া কিসের ? তবু প্রশ্নপত্রগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করে কোন দাগে সর্বোচ্চ কত নম্বর পেতে পারি, তাই নিয়ে চুলচেরা পর্যালোচনায় মেতে উঠলাম ।
কাটাকাটির পর কাটাকাটি । দরাজ হস্তে খাতা দেখলে কোনটায় কত, ফের কড়াকড়ি করে নম্বর দিলে কতয় কত । পদার্থবিজ্ঞানের একটা প্রশ্ন ছিল:
নিউটনের গতিসূত্রগুলি বিবৃত কর এবং প্রথম ও তৃতীয় সূত্রের উদাহরণ দাও । কিরূপে প্রথম সূত্র হইতে বলের সংজ্ঞা এবং দ্বিতীয় সূত্র হইতে বলের পরিমাপ পাওয়া যায়, ব্যাখ্যা কর ।
খুবই কমন কোশ্চেন। ঝেড়ে মুখস্ত লিখেছি। সংক্ষিপ্ত উত্তরের প্রশ্ন ছিল একটু বেয়াড়া ধরনের। অনেকক্ষণ ভাবতে হয়েছে। যেমন :
• কোন উচ্চতা হইতে হাঁটু ভাঁজ না করিয়া মাটিতে লাফাইয়া পড়িলে যত ব্যথা লাগে হাঁটু ভাঁজ করিয়া পড়িলে কম ব্যথা লাগে কেন ?
• জনৈক মজুরকে ঠেলাগাড়ি ঠেলিতে বলায় সে উত্তর করিল, “তৃতীয় গতিসূত্রানুযায়ী আমি যে বল গাড়ির উপর প্রয়োগ করিব গাড়িও সেই বল আমার উপর প্রয়োগ করিবে । তাহা হইলে ঠেলিয়া লাভ কি?” এই উক্তি সম্বন্ধে তোমার বক্তব্য লেখ ।
অথবা
• একটি জালিতারের খাঁচায় একটি পাখি আছে । খাঁচাটি একটি স্প্রিং-তুলার হুক হইতে ঝুলানো । পাখি খাঁচার ভিতর উড়িয়া বেড়াইলে স্প্রিং-তুলায় যে পাঠ পাওয়া যাইবে পাখি খাঁচায় বসিয়া থাকা অবস্থায় পাঠ কি তাহা অপেক্ষা বেশি হইবে, কি সমান হইবে ?
[ যে কোন ১টি ]
হিসাব মিলুক ছাই না মিলুক । মোটের উপর নম্বর কম হবে বলে তো মনে হল না । অতএব মহানন্দে কুরথির ডাল সহযোগে রাতের ভাত হাঁপরে খেয়ে ঘুমাতে গেলাম ।
ঘুম ঘুম ! আয় ঘুম যায় ঘুম ! ঘুম যেমন এল, ঘুম ভেঙেও গেল। ঘুম ভেঙে গেলে স্পষ্ট শুনলাম— আমাদের মাটির ঘরের দোরগোড়ায় ব্যাঙ ডাকছে, টুরি ব্যাঙ। টু-ট্টু-র্ ! টু-ট্টু-র-র-র ! রিঁ-রিঁ-আ পোকা ডাকছে— “রিঁ-ই-ই-ই! রিঁ-ই-ই-ই !!”
অঝোরঝর রাত । অকস্মাৎ মনে হল -কে যেন আমার ডান পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলে ও তার অব্যবহিত পরের আঙুলে ঝিঁজরি বেঁধে অমোঘ টান দিচ্ছে।‘ ও কে !’
— ‘ ও কে! ও কে গো !’
কই ? কাউকেই তো দেখতে পাচ্ছি না ! খালি যা আমাদের গোহালঘরে গবাদি পশুগুলো লত্ পত্ করে কান ঝাড়ছে। নাসিকা দিয়ে হেঁসফেঁস শব্দে মাঝেমধ্যে লম্বা শ্বাস ছাড়ছে। গোহালঘরের দোরগোড়ায় কালো ধোঁয়া উগরে একটা ডিবরি জ্বলছিল। কখন নিভে গিয়ে এখন চুপ মেরে আছে।
ঝিঁজরির টানে খাটের উপর উঠে বসলাম। খাট থেকে নেমেও পড়লাম । হাঁটছি না । তবু নিস্তার নেই— কে যেন টেনে নিয়ে চলেছে, কে যেন ! হ্যাঁ, হ্যাঁ -দরজার দিকে। মুহূর্তে আপনাআপনি হাট করে খুলেও গেল দরজাটা ।
উঠোনে বাহির হওয়া মাত্রই মরা জ্যোৎস্নায় কোত্থেকে একটা কাক ডেকে উঠল। “ দাঁড়াও! দাঁড়াও !!” – আমিও চিৎকার করে উঠলাম। এসময়ই কীনা ‘জনৈক মজুর ও ঠেলা —
গাড়ি’র অঙ্কটার সমাধানসূত্র কত সহজেই পেয়ে গেলাম।
নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্র অনুযায়ী মজুর ঠেলাগাড়িতে বল প্রয়োগ করবে, ঠেলাও সমান ও বিপরীতমুখী বল প্রয়োগ করবে, তাহলে সত্যিই তো ঠেলা গড়াবে না । মজুর পা দিয়ে মাটিতে যে তির্যক বল প্রয়োগ করবে, তা যদি –
কত করে মা-কাকিমাদের ডাকলাম ! বাবা ও কাকাদের । তারা কী আমার ডাক শুনতেই পেল না ? নাকি গলা দিয়ে আমার কোনও আওয়াজই বেরুল না ?
রাস্তায় নেমে এক-দুজনের সঙ্গে দেখাও হল আমার। হয়তো ‘জলঘাট’ সারতে এতরাতেও ঘর ছেড়ে তারা বেরিয়েছে । আমাকে দেখেও তারা যেন দেখতে পেল না ।
ঝুঁকে পড়ে পায়ের আঙুলদুটিতে হাত বুলালাম । কোথায় শ্যাওলা ? শ্যাওলার চিহ্নমাত্র নেই, তার পরিবর্তে লোহার ঝিঁজরি !
ছিঁড়ে ফেলতে আপ্রাণ চেষ্টা চালালাম । ছিঁড়ল তো না-ই ! উল্টে ‘সরণ’ ও ‘ত্বরন’ দুই-ই আরও দ্রুততর হল ।
দেখতে দেখতে রাতের গ্রাম পেরিয়ে ফের সেই নদীধারে শ্মশান চবুতরায় এলাম। হায় ! গ্রামের চেনাজানা এতগুলো কুকুর— তাদের একটাও হ্যাল্ হ্যাল্ করে আমার পিছু পিছু আসা তো দূরঅস্ত্, ভুঁকলো পর্যন্ত না ! বার্ক অ্যাট দ্য মুন।
ওই, ওই তো জাহাজকানার জঙ্গল। আমাদের সামান্য কিছু ‘পাল জমি’। শুধু কি আমাদের— বায়া, কালাচাঁদ, শম্ভুনাথ, হারান-পরাণ, সর্বেশ্বরদেরও । আখ-অড়হর ছোলা- মুসুর খেড়ী-তরমুজের খেত।
শ্মশান চবুতরা।
দূরের ছাতিনাগাছে গোল গোল চোখ ঘুরিয়ে চামড়ায় চোখ ঢেকে হয়তো মটকা মেরে পড়ে আছে দাঁড়কাকেরাও। ভয়ে-ত্রাসে তারা এখন রা কাড়ছে না।
‘ অর্গলা ভূত ’-এর ঝিঁজরি আমাকে নিয়ে মশানির দহে নামল । জলে পা ফেলার স্পষ্ট আওয়াজও পেলাম – “ হ ব্ ল স্ ফ ব্ ল স্- ”
পাগলা মেহের আলির মতো একটা কেউ আর জাগ্রত নেই। যে কীনা থেকে থেকে চিৎকার করে বলে উঠবে –
তফাত যাও, তফাত যাও ! সব ঝুট হ্যায়, সব ঝুট হ্যায়।
• ৩ •
এ যেন জল কেটে জলের ভিতরে চলে যাওয়া । তবে স্বেচ্ছায় কী আর ? আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ‘অর্গলা ভূত’-এর ঝিঁজরি পায়ে জড়িয়ে আমাকে টেনে নিয়ে চলেছে ।
— হ ব্ ল স্ ফ ব্ ল স্-
পায়ের পাতা ডুবছে। ডুবে গেল ! এবার জল উঠবে হাঁটু অবধি। হাঁটুও ডুবে যাবে।তারপর কোমর। বুক, গলা –
‘টেন্টেলাস কাপ’-এর মতো জল এখন চিবুক পেরিয়ে ঠোঁটের তলায় খেলা করছে, ছোট ছোট ঢেউ তরঙ্গ । আওয়াজ উঠছে –
— খল্ বল্ খল্ বল্ –
সে আর কতক্ষণ ! একটু বাদেই তো ঝিঁজরির টানে চোখ-কপাল-মাথাও ডুবে যাবে! তবুও চাঁদের মরা আলোয় ক্ষয়াটে জ্যোৎস্নায় রাতের নদীকে দু চোখ ভরে দেখে নিচ্ছি । আর যে কখনও দেখতে পাব -তেমন ভরসা কই ?
কার যেন একটা কবিতা পড়েছিলাম, আবৃত্তিও করেছি। লাইন কটা এখনও মুখস্ত আছে –
‘ ঢলে আছে জলছবি, ডিমের হলুদ চাঁদ, কলার মান্দাস
ঝুরো বাঁশপাতা কান্নিক মেরেছে জলে উছুক ডুবুক
জলতল ঢেকে আয়নায় পেতেছে মুখ রাতটুকু
সে কেমন চেয়ে থাকা বলো, মদালস আর কাকে বলে
জলের ভেতরে জলেরও নিজস্ব খেলা আছে; ক্রীড়াময়
জলগুল্ম ভেসে যায়; মনোহর রাজহংস ডুবে গেলে
উঠে আসে নদীর বুদ্বুদ ; সে কেমন শতদল বলো
হেমবৃন্তে ধরে আছে প্রেক্ষাপট জলের বৈভবমালা ’
তবে রাতের হোক দিনের হোক, আমাদের সুবর্ণরেখাও কম সুন্দর না । সোনা যেমন তেমন, দিনভর নদীর বালিয়াড়িতে সূর্যের আলো পড়ে অভ্র চিক চিক করে।
এমনকি চরাচরে ফিঙ-ফোটা-জ্যোৎস্না থাকলে রাতেও তার ব্যত্যয় হয় না । এখন তো মরা আলো । জ্যোৎস্নায় ভাঁটার টান ।
নদী এখানে পূর্বগামিনী। পশ্চিম থেকে চলেছে পুবে। পুবে,পুবে।দাঁতন-সোনাকনিয়াকে উত্তরে রেখে ফের ঢুকেছে দক্ষিণে, বালেশ্বরের ওলমারার দিকে। তারপর তো সাগরে !
এখান থেকে অতদূর দেখা যায় না বটে, তবে লাউদহ-কাঁটাপাল-কুলবনীর মাছমারা জেলেদের রাতের আলোর ‘ফুড়গুনি’ এতদূর থেকেও দেখা যায় বৈকি ।
ওই, ওই তো ওই, ‘হাটুয়া’ মাছমারাদের ‘হ্যাজাক লাইট’ ‘টর্চ লাইট’-এর আলোর ঝলকানি নদীবক্ষে !
‘ পড়িবু শুনিবু রইবু দুখে ।
মাছ-অ ধরিবু খাইবু সুখে ।।’
সত্যি সত্যিই তো । লেখাপড়া শিখে আমার কী দুর্দশা হল ! ‘অর্গলা ভূত’-এর পাল্লায় পড়ে এখন আমি দুঃখের সাগরে ডুবে যাচ্ছি। অথচ ওরা – মাছমারারা । কাঁটাপাল, কুলবনী কী ঢেরাছাড়ার হরি-মধু-যদুরা । আজ সারারাত রাতভোর সুবর্ণরেখায় ‘উকা’য় মাছ মারবে । ধরামাছ কতক সকাল হলেই নদীর পাড়ে বসে বেচে দেবে । কতক এ-গাঁয়ে সে-গাঁয়ে ফেরি করবে। আর কতক মহাসুখে বাড়ি নিয়ে যাবে খাওয়ার জন্য।
পুবের ন্যায় পশ্চিমেও। পাতিনা-ফুলবনী-মলতাবনীর ওদিক থেকেও ‘বাঘযুগনি’ পোকার আলোর মতো টি-পি-ক টি-পি-ক করে মাছমারাদের একটি-দুটি আলো ।
এরা আজ আমাকে পায়ে ঝিঁজরি বেঁধে ধরে এনেছে বলেই কি নদীপথের মাঝবরাবর মশানির দহে মাছমারাদের একটাও আলো নেই ! এদিকে নদীধারের গ্রাম খান্দারপাড়ার মাধব পানি আর ঝাড়েশ্বর পানি তো জলের পোকা । হরবখত, কী দিন কী রাত, নদীর বুকেই পড়ে থাকে। আজ তাদেরই বা হল কী ?
আরেকটু বাদেই আমার চোখদুটো ঢেকে যাবে জলে। আচমকা দেখতে পাচ্ছি -ওই তো ওই, নদীজলে ছায়া পড়েছে জাহাজকানার জঙ্গলের ! ছোট ছোট তরঙ্গাভিঘাতে সে ছায়া এতই কম্পমান যে স্পষ্টত কিছুই বুঝা যাচ্ছে না ।
অথচ কী অদম্য আগ্রহ অন্ধকারময় অরণ্যের খাঁজে খাঁজে তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখার !
কোথায় আত্মগোপন করে আছে সলিলসমাধিপ্রাপ্ত সওদাগর ‘তপোসা’ আর ‘পালেকাথ’-এর সেই অর্ণবপোত ! যার ভাঙা কানার ঝলসানি হঠাৎ-দেখে-ফেলা-অন্যমনস্ক-পথচলতি-মানুষকে করে তোলে জন্মের মতো ‘উধাস’, ঘরছাড়া ও বিবাগী ।
মাছেদের সে ডর-ভয় নেই । জল যত নাচে তারাও তত নেচে বেড়ায়, জল যত খেলে তারাও তত খেলে বেড়ায় । খেলতে খেলতে নাচতে নাচতে তারা অনায়াসে হাত- মুঠোয় এসে যায়, বাটা-খয়রা-তেলাপিয়া । অর্থাৎ, যাকে বলে ‘মাছধরা’ বা ‘মাছমারা’।
এখনও যতটুকু অবসর-পরিসর আছে ‘জাহাজকানার জঙ্গল’-এর জলে পড়া ছায়াটুকু থেকে আবিষ্কার করার – তাই খুঁজে দেখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি । ছাতিনাগাছে চামড়ায় চোখ ঢেকে মটকা মেরে পড়ে থাকা অলম্ভুস দাঁড়কাকটা কী এসময়ই উড়ে এসে ঝপ্ করে বসল ‘জাহাজকানার জঙ্গল’-এ ?
কিছুই বুঝতে পারলাম না । তার আগেই এক হ্যাঁচকা-টানে কে যেন মুণ্ডুটা জলের তলায় টেনে নিল ! জলে কতই তো ডুবে থেকেছি, কতই তো ডুব-সাঁতারে এপার-ওপার করেছি— প্রথম প্রথম ঝুঁজকো আলো, তারপরই তো অন্ধকার । একটা নিরেট দেওয়াল !
জলতলের সামান্য নিচে, ঝুঁজকো সে-আলোয় যাও বা কিছু দেখা যায়, এই যেমন ব্যাঙ, মাছ, ইত্যাদি। ব্যাঙগুলো পিছনের দু-পা ঝুলিয়ে জলের ভিতর এক অদ্ভুত কায়দায় ঝুলে থাকে। মাছগুলো সততঃ সঞ্চরমাণ থেকে চোখের সামনে এসে পড়লে তাদের মাথাগুলো দেহের তুলনায় বেশ বড় দেখায়।
কারণে-অকারণে জল ঈষৎ আন্দোলিত হলে জলে-ঝুলে-থাকা মৃতবৎ ব্যাঙগুলোও চোখের সামনে তাদের ঝুলন্ত পায়ে জল ঠেলে যৎকিঞ্চিৎ উপরে উঠে যায়।
মাছেদের সে ডর-ভয় নেই । জল যত নাচে তারাও তত নেচে বেড়ায়, জল যত খেলে তারাও তত খেলে বেড়ায় । খেলতে খেলতে নাচতে নাচতে তারা অনায়াসে হাত- মুঠোয় এসে যায়, বাটা-খয়রা-তেলাপিয়া । অর্থাৎ, যাকে বলে ‘মাছধরা’ বা ‘মাছমারা’।
তাছাড়া, ওই যে কবিতা – “ জলের ভেতরে জলেরও নিজস্ব খেলা আছে ; ক্রীড়াময় জলগুল্ম ভেসে যায় -”
হ্যাঁ, কাতাধারে, নদীর কিনারে হাঁটুজল ডুবজলে, এমনকী জলের অতলেও শ্যাওলা, ঝাঁজি, নানাবিধ জলগুল্ম, সবুজ উদ্ভিদ থাকে। তাদের কিছু কিছু পায়ে জড়ায় । আর কতক তো ভাসমান !
তবু দিনমানে জলতলের ঝুঁজকো আলোয় ব্যাঙ, মাছ, ঝাঁজি দেখা গেলেও রাতের, সে মরা জ্যোৎস্না কী ফিঙ-ফোটা-জ্যোৎস্নাই হোক অথবা ঘুটঘুটে অন্ধকার– কোনকিছুই স্পষ্ট দেখা যায় না ।
তাই, স্বভাবতই দেখতে পাচ্ছি না । চোখের সামনে এখন তো কেবলই ভয়াবহ মায়া-ময় অন্ধকার ।
মশানির দহের জল। এ তো আর আমাদের সীতানালা খালের ‘পায়রা-চঁচরা-জল’ কী আমাদের গ্রামের চিনিবাস কুমহারের গাড়িয়া বা পুষ্করিণীর জল নয় যে তলদেশে যা আছে সবকিছুই দেখা যাবে। এই যেমন -পাঁক, পাঁকাল মাছ, কেঁচো, কেঁচোর গমনপথ, গেঁড়ি-গুগলি, শামুক, সাপের খোলস, টুট্টুরি ব্যাঙ, ছেঁড়াখোঁড়া কাপড়, জলঘুন্নিপোকা –
জলকলমি, নুড়নুড়ি পাথর, চুড়িভাঙা, কাচভাঙা, আঙরা, ঘুঙুর, নিমসাবানের খোপ ফেতিকাঁকড়া, লুবুকাঁকড়া, বাঁশকাঁটা, পচা পাতা, খড়ের মানুষ, মেঘ-চাঁদ-সূর্য, ভালবাসা, হত্যা, আত্মহত্যা— আরও যে কত কী !
আমাদের লোকায়ত একটা টুসুগানেও আছে –
‘ জলে জলে যাইও টুসু জলে তোমার কে আছে ।
মা-বাপ ছাড়া সবাই আছে গো জলে শ্বশুরঘর আছে ।।’
টুসু। কোথাও দু-হাত, কোথাও বা চারহাত। মাটির নারীমূর্তি। আমাদের ঘরের মেয়ে। অঘ্রাণসংক্রান্তি থেকে পৌষসংক্রান্তি পর্যন্ত সে শ্বশুরঘর থেকে বাপের ঘরে আসে। আমাদেরই তল্লাটের কুমারী মেয়েরা মাটির একটি সরার মধ্যে ধানের তুষ আর গোবরের নাড়ু রেখে তার আবাহন ও পুজো করে।
মাথায় খোঁপা, চুলে বেলকুঁড়ি কাঁটা। হাতে টিকলি আর রাঙতার ফুল। আ হা ! কী অপরূপ তার সাজ ! তদুপরি গানে ও কথকতায় ‘জল জল’ -তার যেন উপরন্তু একটা ‘বাঈ’ আছে। মেয়েরাও নদীপাড়ে মশানির দহে পৌষসংক্রান্তিতে তাকে বিসর্জন দিতে এসে অভিমান ভরে “ জল জল যে কর টুসু” বলে সমস্বরে একযোগে তাকে খোঁটাও দেয়।
টুসু প্রতিবছর আসে, প্রতিবছরই জলের তলায় তলিয়ে যায় । আজ আমি যাচ্ছি জলে,‘জল জল’ কি আমারও বাঈ ?
জলের তলায় নাকি একবার ঢুকে পড়েছিল আমাদেরই গ্রামের বকড়ি সাধু শ্রীশ্রীঁ-নিত্যানন্দ বেহেরা । উঁহু, ঢুকে পড়েছিল বলাটা ঠিক না । তাকে ইশারা আর ছলনা করে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল রূপসী ‘সাতভউনী’রা।
আমাদের গ্রামের পশ্চিম দিগরে কদমডাঙা ‘হুড়ি’ । ‘হুড়ি’ – তারমানে ছোটখাটো পাহাড় । পাহাড়ের সানুদেশে এক পাতালফোঁড় কুণ্ডি বা ঝর্ণা । অহোরাত্র সেখানে “ভুড় ভুড়’ করে জল ওঠে । সে জল শীতে উষ্ণ, গ্রীষ্মে হিমশীতল ।
সেখানেই থাকে ‘সাতভউনী’রা । ‘সাতভউনী’ -তারমানে এক মায়েরই গর্ভজাত পিঠোপিঠি সাতবোন । সুনসান মধ্যাহ্নে কী ফিঙ-ফোটা-জ্যোৎস্নারাতে দিনক্ষণ দেখে ও বুঝে সাত-সাতটা সোনার গাগরা কাঁখে তারা বেরোয় ।
বকড়ী নিত্যানন্দও ঝর্ণার জলে স্নান ও আচমন সেরে পূর্বাহ্নে ভোর ভোর আর সায়াহ্নে ঝুঁজকো অন্ধকারে সেখানেই জপতপ করে।
পায়ে নূপুরনিক্কন, নৃত্যায়িত দেহবল্লরী, কাঁখে সোনার গাগরা, মুখে গীত— সাত-সাতটা অসাধারণ সুন্দরী রমণীকে একদিন দেখে ফেলল নিত্যানন্দ! ইশারায় তারা তাকে ডাকল।
যত না ইশারায় তার থেকেও সোনার গাগরার লোভে লোভে বকড়ি সাধু নিত্যানন্দ নাকি ঢুকে পড়েছিল জলের তলায় সাতভউনিদের ডেরায়।
মাত্রই একরাত।পরের দিন ভোর ভোর তাকে নাকি অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল ভুড়ভুড়ি ঝর্ণাতলায় !
হয়তো কেউ বিশ্বাসই করেনি। কিন্তু কী আশ্চর্য ! যে লোকটা গীত বা গানের ‘গ’ও জানত না, সে কী করে তাদের সে-ই গাওয়া গানটাই নির্ভুল ভাবে গেয়ে দিল ? এখনও গেয়ে বেড়াচ্ছে —
একজন পথে মথুরা হইতে,
আইল তাহারে দেখি।
সেই হতে মন করে উচাটন
সঘনে ঝূরএ আঁখি ।।
♦–••–♦ ♦–••–♦ ♦–••–♦ ♦–••–♦
ক্রমশ…
❤ Support Us