Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • ডিসেম্বর ৮, ২০২৪

ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ৫। নজরবন্দী সময়ের উপকথা

হেদায়েতুল্লাহ
ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ৫। নজরবন্দী সময়ের উপকথা


কৃত্রিম নাগরিকতা অথবা দূষিত অতীতমুখিতাকে অতিক্রম করে স্বতন্ত্র মানচিত্র সৃষ্টিতে ব্যস্ত ৭০ ছুঁইছুঁই লেখক। কোনো ‘ইজম’ নেই, চিন্তার স্বাধীনতাই তাঁর দিবারাত্রির অনুশীলন। এই সময়, সমকালীন সঙ্কট এবং চাকরিপ্রার্থী ছেলেমেয়েদের সংশয়, আরোপিত প্রতারণা নিয়ে ডা. হেদায়তুল্লাহ-এর উপন্যাসের পঞ্চম পর্ব

 

মাজার শরিফে বকুলের গন্ধ

 
কী গো ভায়া ! আজগে হাফ ছুটি।ব্যাপার কী ? মাঝে মাঝে অভিভাবক থেকে বন্ধুর পর্যায়ে নেমে যান সোমবাবু।
 
একটু লজ্জা পেয়ে সে বলে, পির গোরাচাঁদের মাজারে যাব।
 
দুহাত কপালে ঠেকিয়ে বলেন, দেব দ্বিজে ভক্তি থাকা ভালো।
 
সোমবাবুর জন্যে স্কুলটা ক্লান্তিকর মনে হয় না।এখানে সেকেন্ড টিচার জয়নাল দফাদারের বয়েস মাঝামাঝি।তিনি বললেন,স্যার ! ওকে অত ছাড় দিচ্ছেন ?
 
তোমাকে কি কম দিই ? সেবার কামোটে কামড়ালে তোমাকে ছমাসের ছুটি মঞ্জুর করেছি।
 
কবির প্রথমদিন থেকে দেখেছে, এই ভদ্রলোক তার ওপর ইর্ষা পরায়ণ। অবশ্য তেমন কোন কারণ খুঁজে পায় না। পরে বুঝেছে, মানুষের মন এক বিচিত্রগামী। কোন নিয়ম রীতির ধার ধারে না।
 
যা হোক তাকে দেখে খুশি হয় ডালিয়া।অটো থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে বলে, সেদিনের টপ সিক্রেট আজকে বলি। কবির কোন কথা বলে না ।চুপচাপ তার পাশে হাঁটতে থাকে। তারা প্রায় মাজার শরিফের কাছাকাছি পৌঁছেছে।বকুলের গন্ধ টের পাচ্ছে।
 
তার আগে আমি বাড়ি থেকে হোম ওয়ার্ক করে গেচলুম। টাকাপয়সার ব্যাপারটা কীভাবে সামলাব ? শ্যামলের কথা ভুলে যায়নি।
 
কী ভেবেচিলি ? আলতো করে জিজ্ঞেস করে সে।
 
টাকা তার হাতে সরাসরি দোব না ।তার বৌ-এর কাচে দোব।
 
তাতে লাভ কী ?
 
লাভের কথা শুনবি ?
 
বললে তো শুনব ?
 
টাকাপয়সার কোন কথাই উঠল না ।নারে ভুল বললুম।টাকার কথা একেবারে ওঠেনি তা না।সিরাজ বলল, তোমরা মেয়েরা এগিয়ে এলে আমরা খুশি।জানো তো আমরা নেতার চেয়ে নেত্রী পছন্দ করি।তুমি চাকরি পেলে আমি খুশি হব।
 
সে অন্তর্যামী নাকি ?
 
তা সে তুই যা বলিস !
 
আর ওই যে সাপের ছোবল ?
 
সাপ কি আর সবসময় ফণা উঁচিয়ে থাকে ?
 
তারা মাজার শরিফ চত্বরে ঢুকে পড়েছে।আগরবাতি আর পোড়া মোমবাতির গন্ধে চারিদিক পূর্ণ।সূর্য ডুবে গেছে।এখনি মগরেবের আজান শুরু হবে।বকুলগাছের নীচে এসে দাঁড়ায়। এখানে আলোআঁধারির মায়াজাল। তার ভেতরে দাঁড়িয়ে দিশেহারা হয়ে যায় ডালিয়া।বকুলের ডালে ডালে অসংখ্য লাল গুটিপোকার মতো কামনাফল ঝুলছে। কোনটা যে তার খুঁজে বের করা একরকম অসম্ভব। তার মনস্কামনা পূরণ হয়েছে। সে চাকরির জন্যে এ ঢিল বাঁধেনি। তার মনের আকাশে কালো মেঘ দেখা দিয়েছিল সে বোধহয় হেরে যাচ্ছে। সেদিন স্বপ্ন দেখে তার কালো মেঘ কেটে গেছে।কান্না নয়।অঝোর বিষ্টির পর মেঘমুক্ত হয়েছে আকাশ।কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হঠাৎ পেছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর, বেটি কী খুঁজচিস ?
 
চমকে তাকায় সে। একটা দীর্ঘদেহী লোক।পরণে সবুজ লুঙ্গি। গায়ে হলুদ পিরহান।বাবরি চুল।মাথায় সবুজ পাগড়ি।কবির ভেবেছে, ভিখিরি হয়তো পয়সাটয়সা চায়।পকেটে হাত দিতে গেলে লোকটা হাত তুলে থামায়। আমি বালান্দার ফকির।বেটিকে দেকে এসেচি।
 
ডালিয়া বিব্রত কণ্ঠে বলে,কিচু বলবেন ?
 
সেজন্যে তো এইচি। তোর মনের খবর তুই জানিস নে। কামনা ফল চিনবি নে।এই নে তোর জিনিস।আমি জানি তোর ইরাদা পূরণ হয়েছে।এই নে ! বকুলগাছের ডাল ধরে সে।

 
সাগ্রহে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে শেফালি।হয়তো আরো কিছু কৌতূহল প্রকাশ করবে।কেন সেদিন সে হলুদ রঙের জামদানি পরেছে ? কেন সে অন্যদিনের চেয়ে উচ্ছল বেশি ? কবির সেসব কথার মধ্যে দিয়ে গেল না । দূরে ধোঁয়াশাময় নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ওঠার আগে বলে, তোমার মায়ের রান্নার হাত বেশ ভালো

 
ফরিদের দোকানের সামনে যে রাস্তা গেছে তা ডানদিকে বাঁক নিয়ে মালঞ্চ হয়ে নিউাউনে ওঠা যায়।সেদিন রোববার বিকেলে তার দোকানের সামনে একটা বাইক টাল খেয়ে উল্টে গেল।মারাত্মক কিছু ঘটেনি।শুধু পেছনে বসা মহিলা অজ্ঞান হয়ে গেছে।চোখেমুখে জল দিতে জ্ঞান ফিরে এল।কথায় কথায় চালক বলে,সে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক।ইছামতীর ওপারে বরুনহাটিতে তার স্কুল।এ খবর বেশ ভালো লাগে ফরিদের।
 
স্কুল ছুটির পর তারা খেয়াঘাটে পৌঁছেছে।আজ বড়ো ভিড়।পরের খেয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।কবির বলে, চলো ! ওই চায়ের দোকানে বসা যাক।ঘাড় নাড়ে শেফালি।চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলে,সেদিনের তালের পায়েস অপূর্ব হয়েচে।
 
তাই নাকি !
 
কে রান্না করেচে ?
 
আমার মা।
 
সাগ্রহে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে শেফালি।হয়তো আরো কিছু কৌতূহল প্রকাশ করবে। কেন সেদিন সে হলুদ রঙের জামদানি পরেছে ? কেন সে অন্যদিনের চেয়ে উচ্ছল বেশি ? কবির সেসব কথার মধ্যে দিয়ে গেল না । দূরে ধোঁয়াশাময় নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ওঠার আগে বলে, তোমার মায়ের রান্নার হাত বেশ ভালো।একথায় খুশি হয় না শেফালি।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে।ততক্ষণে খেয়ানৌকা ঘাটে এসে লেগেছে।
 
দিনদুনিয়া সব সময় এক তারে চলে না। সব হজযাত্রীকে কাফনের কাপড় সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হয়। মক্কা থেকে সে সংবাদই এল। দেশে আর ফিরে আসেনি লাশ। এখানে গায়েবি জানাজার নামাজ পড়ানো হয়। কবির তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,তালুই আব্বার কপাল ভালো।
 
ফরিদ কোন জবাব দেয় না। জমায়েত হওয়া লোকজনের মধ্যে কে একজন বলে,তা ঠিক।
 
হজের মক্কায় ইন্তেকাল মানে সে জান্নাতবাসি।
 
এরকম বহু শুনলেও ফরিদের শোক কাটে না । অনেক কথা মনে পড়ে। আব্বাহুজুরের সঙ্গে কোথায় কোথায় ছলনা করেছে সেসব স্মৃতি ভেসে ওঠে।অনুতাপ হয়। মনে মনে দূরের পানে থাকিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেয়। কবির দেখে, ছটফটে ফরিদ যেন উধাও। বাপের অনুপস্থিতি তাকে আমূল পাল্টে দিয়েছে।
 
এখানে শহর ধীরে ধীরে মাথা চাড়া দিচ্ছে। প্রস্তাবটা কবিরের। রোববার বিকেলে তারা এসে ঢোকে । ঝকঝকে নতুন ফাস্টফুডের দোকান। দুটো এগরোলের অর্ডার দেয় কবির।ডালিয়া বলে,কী জন্যে ডেকচিস বল ?
 
সব সময় কী কাজের কথা বলতি হবে ?
 
তা ঠিক। অমন করে তাকাচ্চিস কেন ?
 
কবির মাথা নীচু করে ভাবে । বাপ মা খবর শুনে খুব খুশি।কিন্তু সে একটা দিক । আর ডালিয়াকে না জানালে হয় ? সে বলে, তোর মুখে দেক রঙিন আলোর ছাপ পড়েচে।
 
তুই আজকাল কবিতা টবিতা লিখচিস নাকি ?
 
তুই তো মূ্র্তিমান কবিতা !
 
কী রকম ?
 
তোর মুখটা বড়ো রহস্যময়। ক্ষণে ক্ষণে পাল্টে যায়। আলো আঁধারির এ এক অলীক খেলা।
 
ধোপদুরস্ত পোশাক পরা বয় প্লেটে রোল সাজিয়ে নিয়ে এল। সঙ্গে লাল রঙের সস।
 
খেতে খেতে কবির বলে, তোদের তো মৌখিক হয়ে গেচে।
 
তুই জানিস নে ?
 
কী ?
 
এস এস সির ওপর হাইকোর্ট হয়েছে।
 
কবির চুপ করে যায়।ডালিয়ার পীড়াপিড়িতে টেট পরীক্ষা দিলেও এইটা দেয়নি।তার কেমন মনে হয়েছে চাকরি বাকরি তার জন্যে নয়।এই নেগেটিভ মনোভাব একেবারে পছন্দ না ডালিয়ার।এখানেই মানসিক দ্বন্দ্ব ।যার যার পথ এখান থেকে পৃথক হয়েছে ।এটা অনেক সময় উপলব্ধি করতে পারে না কবির ।দিন চলে গেলেই হল। তাতে যদি পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনার মতো কিছু ঘটে তাকে সে পরম প্রাপ্তি মনে করে।
 
চা না কফি ? বয় এসে খোঁজ করে।
 
কফি ।কবির বলে।
 
না, চা। ডালিয়া বলে,কফি খেলে ঘুম আসে না।
 
তাহলি চা।
 
কেস উঠবে কবে ?
 
আমরা বিকাশ ভবনে গেচলুম। তারা বলে, কেস আজও উঠতে পারে কালও উঠতে পারে আবার অনন্তকাল ধরে চলতে পারে।
 
সবটাই ধোঁয়াশা ! কবিরের গলায় যেন কৌতূকের আভাস।
 
ডালিয়া আহত হয়ে বলে, ঠাট্টা করচিস নাকি !
 
পাগল ! পূর্ণিমা ম্যাডামের কথা।
 
হুম ! গম্ভীর হয় সে।
 
চা এসে গেছে।এ চা বটতলা কিংবা নদীর ঘাটে দোকানের না। রীতিমতো সুগন্ধ ছড়িয়ে যাচ্ছে।চায়ে এক লম্বা চুমুক দিয়ে কবির বলে, তিন মাসের মাইনে একসাথে পেলুম।
 
তো–!
 
ভাবচি সফুরাবেটির সঙ্গে দেখা করতি যাব।
 
সে তোর ইচ্ছে।
 
তোর মা যা আমার মা তা।আমার বাপ মায়ের জন্যি নতুন কাপড়চোপড় কিনেচি।
 
সে তোর ইচ্ছে।
 
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সে।হয়তো ভেবেছিল আপত্তি করবে ডালিয়া।করল না।মানুষের ভাবনা চিন্তা সবসময় বাস্তবের সঙ্গে মেলে না।
 
সোমবাবু বলেন, ওপর মহল থেকে অর্ডার এসেচে।
 
কী অর্ডার দেকি ? জয়নাল সন্দেহের গলায় জিজ্ঞেস করেন।
 
লিখিত না, মৌখিক । শুক্রবার বিগ্রেড যেতে হবে।
 
আমি যেতে পারব না।
 
কেন ?
 
আমার বড়োছেলের দেকাশোনার কাজ আচে।
 
কবিরুল ! তোমার ?
 
আমার আবার কী ?
 
ঠিক আছে।হাসনাবাদ থেকে আমাদের গাড়ি ছাড়বে।দশটা নাগাদ এস আই অফিসের সামনে চলে এসো।
 
ঠিক আচে ঘাড় নাড়ে কবির।তার দিকে অসন্তুষ্ট চোখে তাকিয়ে থাকে জয়নাল।
 
যথা সময়ে পৌঁছে অবাক হয়ে যায় কবির।জিজ্ঞেস করে, আপনি ?
 
কেন, তোমার আপত্তি আচে ?
 
আপনি নিজেই তো বললেন।
 
পানিতে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করব ?
 
কবির আর কথা বাড়ায় না।বাইরের কোন আচরণ নয়, মানুষের ভেতরে যে নিরন্তন ভাঙচুর চলে তাতে সে অবাক না হয়ে পারে না ।
 
আরো এক ব্যাপার ঘটে।শেফালি কবিরদের বাসে উঠতে যাচ্ছিল,লোটন কোথা থেকে ছুটে আসে।মাতব্বরি করে বলে,শেফালি ! তুমি ভুল করচ।
 
কেন ? জিজ্ঞাসু দৃ্ষ্টিতে তার দিকে তাকায়।
 
আমাদের বাস ওদিকে।সামনের দিকে দেখায় সে।
 
মনে মনে বিরক্ত হলেও কিছু বলতে পারে না। সেই নীল রঙের নির্দিষ্ট বাসের দিকে এগিয়ে যায় সে। একটু পরে সেই বাসে ওঠে লোটন। তবে তার পাশে বসার সুযোগ পেল না। অন্য একজন ভদ্রমহিলা শেফালির পাশে জাঁকিয়ে বসেছে।
 
তাদের গাড়ি এসে পর পর দাঁড়িয়েছে।সভা শুরু হতে দেরি আছে।এখনই লোকে লোকারণ্য।শেফালি বোধহয় লুকোচুরি খেলছে। লোটন একটু চোখের আড়াল হতে সে কবিরের হাত ধরে,আমার বড়ো ভয় করচে !
 
কীসের ভয় ?
 
কী জানি ? ঠিক বুজতি পারচি নে।
 
কবির অবাক হয়।বিরক্ত বোধ করে।এটা তো দক্ষিণ রায়ের বাদাবন না।কুমিরের রায়মঙ্গল না।
 
তোমাকে এখানে কে টেনে নিয়ে যাবে ?
 
যদি নিয়ে যায়, কে খোঁজ পাবে ?
 
কবির তার দিকে তাকায়।এ যেন চেনা শেফালি না।বিহ্বল তার দৃ্ষ্টি।মেয়েটা কি ভয় পেয়েছে বোধহয় ? ওদিকে মুহুর্মুহু শ্লোগান উঠছে।শেফালি কান চেপে বলে,কবিরদা ! চলো, এখান থেকে চলে যাই।
 
কোথায় যাবে ?
 
তুমি কি পথ দেকাতে পারবে না ?
 
কবির চুপ করে ভাবতে থাকে।তারও যে খুব ভালো লাগছে তা নয়।তবে এভাবে চলে যাবে ? আর গেলেই বা ক্ষতি কি ? লাখ লাখ লোকের ভেতর কে তাদের দু’জনকে শনাক্ত করবে ?
 
তারা হেঁটে শেয়ালদায় হাজির হয়।স্টেশানে চার নম্বর প্লাটফর্মে তখন বারাসাত লোকাল দাঁড়িয়ে আছে।
 
এখানে এসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে শেফালি।তারপর বলে, এখনই বাড়ি ফিরবে ?
 
বারাসাত মানে প্রায় বাড়ির কাছাকাছি। স্টেশানের ঘড়িতে আড়াইটে বাজে।হাসনাবাদ লোকাল মানে আরো ঘণ্টাদেড়েক বসা।কী করা যায় কবিরও ভাবছে।হঠাৎ স্টেশানের বাইরে বড়ো একটা হোর্ডিংএর দিকে আঙ্গুল তুলে ধরে শেফালি।
 
তা মন্দ নয়।ঘাড় নাড়ে কবির।বিকেলের শেষে ঘন ঘন ট্রেন আছে ফেরার।
 
এখন আগের অবস্থা নেই।এককালের বিখ্যাত রূপালি সিনেমা হল এখন মাল্টিপ্লেক্স।হরেক রকম দোকানের সঙ্গে ছোট হল।টিকিটের দাম বেশ চড়া।তা হোক দুজনে পপকর্ন নিয়ে হলে ঢোকে।
 
ঘণ্টাদুয়েক বাদে তারা বেরিয়ে আসে।নতুন বাংলা ছবি। ভালোমতো বোঝা গেল না।তবে সময় কেটে গেল।বেরোনোর পর হাঁটতে হাঁটতে একটা অদ্ভুত কথা বলে শেফালি।
 
তোমাকে একটা কথা বলব ?
 
বলো।আলগোছে কথাটা ছুঁড়ে দেয় কবির।হয়তো ভেবেছে, সিনেমার কোন দৃশ্যের কথা বলবে।
 
অনেকদিন ধরে চেপে রেকেচি।
 
তবে আজগে বলচ ?
 
তোমার কাচে কথাটা না বললেই না।
 
ঠিক আছে,বল।
 
তুমি চাকরির জন্যি কতো টাকা দিয়েচ ?
 
হঠাৎ এ প্রশ্ন ?
 
তারপর তার কথা শুনে থমকে দাঁড়ায় । স্টেশানের কাছাকাছি এসে গেছে তারা ।একটা ট্রেন যেন শাঁখ বাজিয়ে তার মাথার ভেতর দিয়ে চলে যায়।শ্যামলের কথা মনে পড়ে। নিজেকে সামলে নিয়ে কবির বলে, তোমার তো সাহস আচে ।আমার ধারণা বদলে যাচ্ছে।
 
একথা বলচ কেন ?
 
তুমি ভাগ্যবতী।
 
আর তুমি ?
 
সব সময় ভয়ে থাকি।এই বুজি মেসেজ এলো, তোমার নাম ভুল করে তালিকায় উঠেছে।এই মাত্র ভুল সংশোধন হল।
 
তুমি কাউকে টাকা দাও নি ? বিস্মিত শেফালি প্রশ্ন করে।
 
কবির প্রশ্ন করে, ভয়টা আমার স্বাভাবিক না ?
 
উত্তর দিতে পারে না শেফালি। শুধু দুদিকে মাথা নাড়ে। তারা স্টেশানের প্লাটফর্মে পা রেখেছে।
 
বেশ কিছুদিন কেটে গেছে।এখানে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে।তবে সুখ দুঃখ শান্তি অশান্তি সব চক্রাকারে মানুষের জীবনে আবর্তিত হয়।এসব কোন আপ্ত বাক্য নয়।নিজের জীবনে উপলব্ধি করে টগর বেগম।হাসনুর বিয়ের পর বেশ প্রশান্ত মনে ছিল।চারিদিক থেকে বাঁকা বাঁকা সব কথা ভেসে আসত।এখন তো সেসব কিছু নেই। তবে শূন্য মন ব্যথা দেয় কেন ? শূন্যতা বুঝি শূন্যকে পছন্দ করে না ?
 
মকবুলমিয়া বুঝি হজে যাওয়ার দিন গোণে কিন্তু আমির মিঞার ইন্তেকালের ঘটনা তাকে বিমর্ষ করে ।মৃত্যুর ভয় তার নেই ।বেলা ঢলে এসেছে ।তবে ছেলে বৌ বোধহয় রাজি হবে না । আরো কিছু সময় যাক । সময় একমাত্র সবকিছু ভুলিয়ে দিতে পারে । এই সময় বৌএর কথায় তার টনক নড়ে।তাইতো ! তাইতো !
 
বাড়ির মানুষ যে তার কথা গুরত্ব দিয়ে শুনবে তা কোনদিন ভাবেনি ।চিরকাল টগর অবজ্ঞা সয়ে এসেছে । স্বামীর কাছে মনের কথা কোন সময় খুলে বলতে পারেনি।আজ তার কথায় সায় দিয়ে বলে, সত্যিই তো খোকার বয়েস বাড়চে ।
 
বিয়ের ব্যাপারটা ভেবে দ্যাক।
 
এবার থমকে যায় মকবুলমিয়া । সে ব্যাপার মানে খরচার বহর।রেস্ত সবখানি চলে যেতে পারে।আর জমি বেচা সম্ভব না।
 
কী ভাবচ, তুমি ? টগর জিজ্ঞেস করে ।
 
ভাবচি খরচপাতির কথা।
 
ভাবনা কী ?
 
কেন ?
 
ছেলে আমাদের চাকুরিজীবি।
 
তা ঠিক ! বৌএর ইঙ্গিত ধরতে অসুবিধে হয় না।এই তো, মহিম ঘটক মাঝে মাঝে তার কাছে এসে বসে।বলে, মিঞা ভাই, তুমি একবার রায় দাও।কত টাকা চাই ? মেয়ের বাপেরা লাইন দেবে। এ ব্যাপারে নিজের মন থেকে কোন সাড়া পায়নি।সেও তো ভুক্তভোগী।তবে আজ বৌএর কথায় মনে সাড়া জাগে।যে যন্ত্রণা সে ভোগ করেছে অন্যে তা কেন ভোগ করবে না ?তবু আমতা আমতা করে বলে, এখনকার ছেলেমেয়েদের মতিগতি ভেন্ন।
 
আমাদের খোকা সেরাম না।
 
কী জানি ?
 
এরাম বলচ কেন ?
 
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মকবুলমিয়া ।বাঁশবাগান বিক্রি করে সে যেন ঠিক স্বস্তিতে নেই ।মাঝে মাঝে বাপটা খোয়াব দেখায় ।বাঁশ মানুষের দুটো ঘর বাঁধে।দুনিয়ায় আর কবরে ।এরাম বোকামি করে মকবুলমিয়া ।বাপ গফুর আলি গম্ভীর আলোচনার সময়ে এরকম সম্বোধন করত ।তবে ছেলের জেদের কাছে তার হার মানতে হয়েছে ।তখন অবশ্য মা ছেলেকে সাথ দিয়েছিল ।এখন দেখ যাক ।ব্যাপারটা কী দাঁড়ায় । ছেলে এবার মাকে সঙ্গ দেয় কিনা ? একটা বিড়ি ধরিয়ে দূরের আকাশের দিকে তাকায় ।ওদিকটা পশ্চিম । কাবাঘর এখান থেকে কত দূর হবে ? খোদার ইচ্ছে না হলে সেখানে কেউ যেতে পারে না ।তার কপালে কী আছে ? বেয়াই আমির মিঞার কথা মনে পড়ে ।এমন মৃত্যু বুঝি সৌভাগ্যের !
 

♦·♦–♦·♦♦·♦–♦·♦

ক্রমশ..
 
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ৪

ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ৪। নজরবন্দী সময়ের উপকথা


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!