Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • ডিসেম্বর ২৯, ২০২৪

ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ৮। নজরবন্দী সময়ের উপকথা

হাসিনা জাহানের কথা জানে ? তপসিয়ার বস্তিবাড়িতে থাকত । এখন বাংলা চিত্র জগতের সুপরিচিত সেলিব্রেটি। এরমধ্যে লোটন আঙ্কেলকে আধুনিক মনে হয়। সে তরুণ সমাজে স্বপ্ন বিক্রি করতে পারে...তারপর

হেদায়েতুল্লাহ
ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ৮। নজরবন্দী সময়ের উপকথা

অলঙ্করণ: দেব সরকার


কৃত্রিম নাগরিকতা অথবা দূষিত অতীতমুখিতাকে অতিক্রম করে স্বতন্ত্র মানচিত্র সৃষ্টিতে ব্যস্ত ৭০ ছুঁইছুঁই লেখক। কোনো ‘ইজম’ নেই, চিন্তার স্বাধীনতাই তাঁর দিবারাত্রির অনুশীলন। এই সময়, সমকালীন সঙ্কট এবং চাকরিপ্রার্থী ছেলেমেয়েদের সংশয়, আরোপিত প্রতারণা নিয়ে ডা. হেদায়তুল্লাহ-এর উপন্যাসের অষ্টম পর্ব

 

এবং অবরুদ্ধ দাহ

 
এক একটা খবরের দুটো দিক থাকে—ভালো আর মন্দ।এই খবর তাদের কাছে এমন মিশ্রিত রূপে এল।শেফালির মা মালতি বলে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।

 
কিন্তু মা।তোমার যে বোনপো হয় !
 
তুই চুপ করতো। খোদা আমার ফরিয়াদ শুনেচে।

হুনুমিয়ার পয়সার অভাব নেই। গাঁ ছেড়ে তিনি শহরের দিকে ব্যবসা বাড়িয়েছেন। রাজারহাট নিউটাউনে জমি কিনে প্রোমোটিংএর কারবার শুরু করেছেন। বাবলুও কালো টাকা সাদা করার জন্যে লাউহাটিতে একটা ইংলিশ মিড়িয়াম স্কুল খুলেছে।কিন্তু শেষ রক্ষে হল না।
 
থানার বড়োবাবু প্রবোধ রায় তাকে খাতির করে চেয়ারে বসান।তারপর বলেন, আপনার জন্যে কী করতে পারি ?

 
সবই তো জানেন।

 
এবার একটু গম্ভীর হন।নাকে একটু নস্যি নিয়ে বললেন, আপনারও তো অজানা কিছু নেই।

 
আপনার জন্যে এক হাজার স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাট রেডি করেচি।

 
প্রবোধবাবুর চোখদুটো দপ করে জ্বলে ওঠে। আবার মুহূর্তে নিভে যায়। নীচু গলায় বলেন, কেসটা আমাদের এক্তিয়ারের বাইরে। কেন্দ্রীয় দল হাতে নিয়েছে। জানেন তো খুব শিগগিরি গোরু আমাদের জাতীয় পশু হবে।তাহলে গুরত্বটা বুঝতে পারছেন তো।
 
জেলার নেতা তাহের আলির সঙ্গে ভালো দহরম মহরম। তার কাছে গেলে সে পরামর্শ দেয়, আপনি ভালো উকিল ধরুন।

 
তাহলি আপনারা ?

 
সহসা কোন জবাব দেয় না। তারাও বোধহয় ভয়ে ভয়ে আছে। কোন তালে না ফেঁসে যায়। কিন্তু মুখে কোন ভয়ের চিহ্ন ফুটিয়ে তোলে না। বাইরে বুঝতে দিলে কেউ আর সম্মান করবে না। সে বলে, এর চেয়ে যদি মানুষ খুন করত ?

 
 তোবা ! তোবা ! কী যে বলেন !
 
ব্যাপারটা বুজবেন না ।আমাদের কাজে সহজ।
 
তাই বলে মার্ডার ! বিরক্ত হয়ে উঠে পড়েন হুনুমিয়া।
 
বাইরে মোটর বাইকের হর্ণ। সফুরা বেরিয়ে দেখে একটা অচেনা লোক।
 
কী ব্যাপার ?
 
আপনি কি ডালিয়া খাতুনের মা ?
 
ঘাড় নাড়ে সে।
 
বাড়ি আচে ?
 
না।
 
এলে বলবেন,সাহেবের সঙ্গে যেন দেখা করে।
 
মোটর বাইক হাঁকিয়ে সে চলে যায়।
 
রোজি বলে,আংকেল ! আর কতো দেরি হবে ?
 
তুমি এত অধৈর্য্য হচ্চ ?
 
আমাদের সমাজের কথা জানেন না ?
 
ভালো রকম জানি।
 
পরিবারের চাপ আর কতদিন ঠেকিয়ে রাকব।

 
তুমি আর বল না। আমার সঙ্গে চাকরি করে একজনকে বলি, তুমি অভিনয় করবে ?  সে আমাকে পাত্তাই দিল না । আমাদের সমাজ কত পিছিয়ে আচে।সিনেমা দেখো সিরিয়াল দেখো । কোথায় তোমরা ? অথচ মুম্বাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখো ।
 
তার কথা গোগ্রাসে গেলে রোজি । লোটন আংকেলকে বড়ো আধুনিক মনে হয় । শুধু খাওয়া পরা আর বিয়ে করাই জীবনের মূল মন্ত্র ?
 
তোমার অডিশান পাঠিয়েচি। আশা করি একটা সুখবর আসবে। মনে যেন জোর পায় রোজি।
 
জীবনের প্লাটফর্ম যে বদল হয়েছে তাদের। চাঁপাপুকুরের উত্তরপাড়ার ছেলে স্টেশানের দক্ষিণ প্লাটফর্মে দাঁড়ায় আর দক্ষিণের মেয়ে উত্তরে দাঁড়ায়।দুজনের সময় আলাদা। মাঝপথে কবিরের সঙ্গী হয় শেফালি আর ডালিয়ার হয় মনির।দিন কাটে দ্রুত।পুরোনো স্বপ্ন আবার জেগে ওঠে কবিরের। সে বলে, পিরের দরগায় যাবি নে ?
 
আমার মানত তো পুরো হয়েচে।
 
এটা তো মানত নয়।খুশির ব্যাপার।
 
ঠিক আচে।তুই যখন বলচিস।
 
রোববার বিকেলে তারা পির গোরাচাঁদের মাজার শরিফে যায়। এখন ভিড় নেই। একুশ টাকার বাতাসা কিনে আতরমাখা টুপি মাথায় খাদেমদারের বাড়ানো হাতে তুলে দেয়। আবার তারা বিদ্যাধরীর তীরে বটগাছের নীচে বসে। আজকে লোকজন নেই। এদিক আরো নির্জন। তাকে চুমু খেয়ে কবির বলে,কী ভাবলি এখন ?

 
এখনও কিচু ভাবিনি।
 
আমার দিকটা দেকবি নে।
 
অত তাড়া থাকলি অন্য মেয়ে বিয়ে কর।
 
একথায় একটু গুটিয়ে যায় কবির। তারপর সে মনের জোর এনে বলে, তুই কী অন্যরকম কিচু ভাবচিস ?
 
ঘরদোর আবার নতুন করে বাঁধব। মামার বাড়িতে আর কতদিন ?
 
আমি সে কথা বলিনি।
 
তবে ?
 
কবির একটু ইতস্তত করে।বলতে যেন সাহস পায় না।তবু শেষে মরিয়া হয়ে বলে,তুই অন্য কাউকে কথা দিয়েচিস নাকি ?
 
সে তো দিয়েচি।
 
কাকে ? মনিরকে ?
 
তুই মনিরকে হিংসে করিস নাকি ?
 
লজ্জা পায় না। বরং তেড়েফুঁড়ে বলে,তুই শেফালিকে হিংসে করিস ?
 
আলোআঁধারিতে তার চাহনি টের পেল না কবির।সেখানে এক বক্র ভুরু ভঙ্গিমা।সে শ্লেষ টেনে বলে,তোর মাথা গেচে।
 
আমি পাগল ? গলায় কবিরের একটা অভিমান।
 
সেটুকু পাত্তা না দিয়ে বলে, কার সঙ্গে কার তুলনা করচিস ? সে একজন সামান্য প্রাইমারি স্কুলের টিচার।

 
কথাগুলো যেন শেলের মতো বেঁধে তার বুকে ।শ্বাস নিতে কষ্ট হয় তার। একথা শেফালি নয় তাকে যেন ঠারে ঠারে শুনিয়ে দেয় ডালিয়া। নদীর দিক থেকে হিম বাতাস ভেসে আসে। কিন্তু সারা শরীর জুড়ে দাহ নেমেছে তার। বিদ্যাধরীর ঘোলা জলে তার স্বপ্ন টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। ডালিয়া তার পাশে বসে আছে।অথচ মনে হয় সে এক নির্জন আঁধারে নিঃসঙ্গ মানুষ।
 
নীরবতা ভেঙে কথা বলে ডালিয়া, রাগ করলি নাকি ?
 
কোন জবাব দেয় না। নিজেকে গুটিয়ে নেয়।ডালিয়া বলে, তুই ঠিক বলেচিস। আগে তাকে হিংসে করতুম।
 
একথায় কবির কি সান্ত্বনা পেল ? আঁধারে ঠিক বোঝা গেল না।
 
একসময় পাশাপাশি বসে থাকা দুর্বিসহ হয়ে পড়ে। চরাচরের নীরবতা বুকে চেপে ধরে। অথচ এই শব্দহীন সময়ের আকাঙ্খায় এখানে এসেছে। অসীম কল্লোলহীন মনের বিক্ষেপে তারা উঠে পড়ে।

 
তোমাকে বড়ো চুপচাপ দেকচি ? কবির নৌকায় যেতে যেতে বলে।আজকে ট্রেন ঠিক সময়ে হাসনাবাদে ঢোকার জন্যে আগের ফেরি পেয়ে গেছে তারা।তাড়াহুড়ো করতে হবে না। তার প্রশ্ন শুনে একটু চুপ করে থাকে শেফালি। কী বলবে তাকে ? অবশ্য সে তাদের অনেকখানি ভেতরে ঢুকে পড়েছে। মা প্রায় সবকথা খুলে বলেছে তাকে। কবির কী তার ভেতরটা পড়তে চাইছে ? সে কি তাকে উচ্ছ্বসিত দেখতে চায় ? সে শান্ত গলায় বলে,তুমি কি জানতে চাও ?
 
টিভিতে যে খবর দেখলুম।

 
নৌকায় আরো অনেক সহযাত্রী রয়েছে। হয়তো সেদিকে ইঙ্গিত করে বলে, ঠিক আছে ! নেমে বলচি।
 
হাতে এখনও সময় আছে।তারা একটা ঝাঁকড়া আমগাছের নীচে দাঁড়ায়।তখন শেফালি বলে, কবিরদা ! তোমাকে একটা কথা বলব ? তারপর সে ইতস্তত করতে থাকে।
 
সে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি কিন্তু কিন্তু করচ কেন ?

 
তুমি কীভাবে নেবে ঠিক বুজতি পারচি নে।
 
আহা ! বলেই ফেলো।
 
আমি কি যথেষ্ট সুন্দরী না ?

 
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। ঠিক বুঝতে পারে না শেফালি এমন বলছে কেন ? সে এখন বন্ধন থেকে মুক্ত । এক অযাচিত মুক্তি। বলে, তোমার তো এসব কথা বলার সময় নয়।
 

 
বিশ্বাস করো, কবিরদা ! আমি এমন মুক্তি চাইনি।
 
তবে একথা বলচ কেন ?
 
আমি কি টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করতি পারিনে ?
 
লোটন কি মাথা খেয়েচে ?
 
নাগো ! আমি নিজে থেকে বলচি। তার কথায় তো রাজি হইনি।

 
মানুষের মন ঠিকমতো বুঝতে পারে না।বিশেষ করে মেয়েদের।কী ভাবে ? কী বলে ? আর দেরি করা যাবে না।তারা একটা চলন্ত ট্রেকার দাঁড় করায়।
 
আমদরবারে পৌঁছে দেখে, আজ সিরাজ বাইরে বসে নেই। ছুটি বলে সকালে এসেছে। অপেক্ষা করতে হল।একজন তাকে খাতির করে নিয়ে গেল ভেতরে। সেখানে গম্ভীর মুখে বসে আছে সিরাজ। তার সামনে বসে আছে মাথা নীচু করে দুটি ছেলে। সে ঢুকতে সিরাজ তাকে খাতির করে বলে, ওই চেয়ারে বসো ডালিয়া। তারপর ছেলে দুটোর দিকে তাকিয়ে বলে, তোদের জন্যি সবাই ফেঁসে যাব।
 
ডালিয়া ভাবে, এখানে কী আলোচনা হচ্ছে তা জানে না। কোন আলোচনার মধ্যে ঢুকে পড়েছে ? তার অস্বস্তি হয়। সে বলে, আমি তাহলি পরে আসি ?
 
না ।না । বসো ।এদের কাণ্ডখানা শুনে যাও।
 
সে আর ওঠার চেষ্টা  করে না ।বসে থাকে চুপ করে ।
 
সিরাজ বলে, এরা দোষ করে আমাকে ফাঁসিয়েচে। তোদের শূলে চড়ানো উচিত। আমরা অত লেখাপড়া করিনি।তাই বলে জালিয়াতি করবি ?
 
তারা ধমকধামক খেয়ে কোন কথা বলে না।সিরাজের বুঝি এতক্ষণে হুঁশ হয়।সে ডালিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,তুমি মাস্টার হয়েচ।আর এরাও তাই।এদের কী করা উচিত ?
 
আপনার কথা ঠিক বুজতি পারচি নে।
 
কী আর বলব ! তোমার সঙ্গে তো কোন লুকোচুরি নেই।আমি তো তোমাকে বলেচি, মেয়েদের সঙ্গে আমার কোনো লেনদেন নেই।
 
ঘাড় নাড়ে ডালিয়া । একথা অস্বীকার করতে পারে না। তবে এখনও সে ধোঁয়াশার মধ্যে আছে। সিরাজ কী জন্যে ডেকেছে ? এখন কি তার পাওনাগন্ডা বুঝে নেবে ? ছেলেদুটোকে বিদেয় করে বলে, এদের জন্যি তোমাকে ডাকিনি । এরা মাধ্যমিকও পাশ না । জাল সার্টিফিকেট নিয়ে পরীক্ষায় বসেছে। কত বড়ো আস্পর্ধা ! হ্যাঁ ! যেজন্যি তোমাকে ডেকেচি।

 
বলুন।
 
আমার একটাই মেয়ে। নাইনে উঠেছে।আমি পড়াশুনো অত বুজিনে। শুনেচি তার মাথা ভালো। কিন্তু তোমার কথাও জানি।
 
রোববার ছাড়া তো সময় দিতি পারব না।
 
তাই হবে। মেয়ে আমার ইঞ্জিনেয়ার হতি চায়।
 
আর একটা কথা।
 
কী ? বলুন।
 
তোমাকে আমি যৎসামান্য পারিশ্রমিক দেবো।
 
একথা বলেন কেন ? আপনি যে উপকার করেচেন !
 
তা হবে না।মেয়ের ব্যাপারে আমি লেনদেন পছন্দ করিনে।

 
মাথা নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে আসে ডালিয়া। মানুষের কত বিচিত্র রূপ !  সে নিজেকেও কি চিনতে পেরেছে ?
 
বাইরে মোটর বাইকের হর্ন। মকবুলমিয়া সবে মাঠ থেকে ফিরেছে। এবারে বেগুন ভালো জালি ধরেছে। আবার বাজার বেশ চড়া। বাইরে বেরিয়ে বেশ অবাক হয়।
 
জামাইবাবাজি যে !
 
হ্যাঁ ! এদিকি ইঁটভাঁটায় এসেচি।দুপুরে নেমন্তন্ন আচে।তাই ভাবলুম একবার ঘুরে যাই।
 
তা !বেশ ! বেশ !
 
ভেতর থেকে বেরিয়ে এল টগরবেগম। দাঁড়িয়ে কেন বাবা ? ভেতরে এসো।
 
বারান্দায় পাতা চেয়ারে বসতে বসতে সে বলে, সময় বেশি হাতে নেই। শুধু একটা খবর দিতি এলুম।

 
কী খবর ?
 
দাদাভাইয়ের কোনো ব্যবস্থা হল ?
 
ঘটক তো আসা যাওয়া করচে।
 
চুলবুলমিয়া সেদিন আমাকে ফোন করেচিল। মেয়ে তার কাচে স্যারেন্ডার করেচে।

 
মকবুলমিয়া আর টগরবেগম পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর টগরবেগম গলা ঝেড়ে বলে, তোমাকে তাহলি একটা কথা বলি ?

 
বলুন ?
 
অত বড়োলোকের মেয়েকে কি সামলাতে পারব ? তার দেমাক হবে না ?
 
দেনাপাওনা তো অনেক মিলবে।

 
তুমি আমাদের লোভ দেকাচ্চ।মকবুলমিয়া বলে।

 
এর আগে আপনারাই তো—
 
আমাদের ভুল ভেঙে গেচে।
 
এ কী বলচেন ?
 
সুখের চেয়ে স্বস্তি ভালো।

 
এমন সময় ফরিদের মোবাইল বেজে ওঠে। সেখানে জেলার কোন হোমরা চোমরা লোক আসবে।আর দেরি করে না।ইঁটভাঁটায় বেশ বড়োসড়ো অনুষ্ঠান।এখান থেকে সে ইঁট নিয়ে বিভিন্ন সাইটে সাপ্লাই দেয়।
 
আবার কিন্তু আসবে বাবা। টগর আন্তরিকভাবে বলে।
 
তারা নিজেদের মধ্যে আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে। জামাইবাবাজি রাগ করেনি তো ?
 
যে মানুষটাকে কথা দিয়েছে ডালিয়া সে আর কেউ না স্কুলের হেডমাস্টার। মামার কাছে সে চিরকাল অনুকম্পা পেয়ে এসেছে। স্নেহ পায়নি।ছোটবেলার স্মৃতি বেশ ঝাপসা। বাপের কথা আর মনে পড়েনা। তবে কখনো কখনো মনে হয়, দুটো সবল হাত তাকে কোলে তুলে নিয়ে আকাশে লোফালুফি করছে আর সে আনন্দে খিলখিল শব্দে বাতাস ভরিয়ে তুলছে। মানুষটা পটলখেতের আলে সাপের ছোবল খেয়েছিল। এতকিছু তার মনে নেই। শুধু উঠোন জুড়ে গাঁয়ের লোক ভেঙে পড়েছিল।
 
মনোয়ার আলি খুব গুণী ব্যক্তি।অংকে পিএইচডি করেছেন। কলেজের ঝক্কি পোয়াবেন না বলে স্কুলের চাকরি নিয়েছেন। এই রিটায়ারের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা সৌম্য ভদ্রলোক তার স্মৃতি ও আবেগকে উসকে দিচ্ছেন ? নিজেকে সে ধরে রাখতে পারেনি। যেদিন তিনি বলেছিলেন, মা ! তুমি একবার আমার বাড়িতে যাবে।
 
ঘাড় তাকে নাড়তে হয়েছিল। সে না। তার ভেতর থেকে অন্য কেউ সায় দিয়েছে।
 
যেন এক কুৎসিত স্বপ্ন দেখছে রোজি। অলীক নয় যা বাস্তব তাই হয়েছে। সে কোথায় যাবে ? কে তাকে সান্ত্বনা দেবে ? সে কলেজের বান্ধবী কামিনির সঙ্গে বসে আছে ইছামতীর উত্তর গায়ে রবীন্দ্র পার্কে। রোজির ফর্সা মুখে বিকেলের পড়ন্ত রোদ এক বিষণ্ণ কোলাজ তৈরি করেছে। সে বলে, আমি পরিস্কার বুজতি পারচি।
 
কামিনির সঙ্গে তার সব কথাবার্তা চলে। সেই তাকে বারণ করেছে। সপ্তাখানেক আগে লোটন আলি প্রস্তাব দিয়েছে, তোমাকে একবার নিউটাউনে প্রাইড হোটেলে যেতে হবে। আবার অডিসান দিতে হবে।
 
স্বপ্নের জন্যে সে যা খুশি তাই করতে পারে। কামিনির কথা অগ্রাহ্য করে গিয়েছিল সে। মদ্যপদের হাত থেকে কোনমতে ছিটকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে।

 
থানায় যাবি ? গম্ভীর মুখে বলে কামিনি।
 
সে যাওয়া যেতে পারে।
 
তবে ?
 
ভয় পাচ্ছিস ?

 
সে পরিস্কার বুঝে যায় তাদের স্বপ্ন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে।আঘাত কাটিয়ে উঠে সে গিয়েছে তার কাছে।
 
কুৎসিত হেসে সে বলেছে, জিভের আড় ভাঙেনি এখনও। ছ ছ উচ্চারণ করে কথা বলে তারা করবে অভিনয় ?
 
কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে। সে বুঝে যায় লোকটা মুখোশ পরে অনেক কিছু করতে পারে। ততক্ষণে সে লাখখানেক টাকা খরচা করে ফেলেছে।

 
ভয় তো একটা আচে তবে থানায় গেলে বাড়িতে মুখ দেকাব কী করে ?
 
আমার বাড়ির পরিবেশ তুই বুজবি নে। আমার সমস্ত অহংকার ধুলোয় মিশে যাবে।
 
তার জন্যে লোকটার কোন শাস্তি হবে না ?
 
পাপ পুরে এলে শাস্তি পাবে।
 
এ তো হেরে যাওয়া মানুষেরর কথা।
 
আমি কি জিতে গেচি ?
 
শেষ বিকেলের আলোয় তার চোখ দুটো চিকচিক করে ওঠে।
 
তুই কাঁদচিস ? কামিনি তার মাথায় হাত রাখে।
 
সে চোখ মুছে বলে, এখন আমি কী করি বলতো ?
 
তাহলি সবকিছু ভুলে যা। মনে কর এটা একটা দুঃস্বপ্ন। যা ক্ষণস্থায়ী বিভ্রমমাত্র।

 
কামিনির সঙ্গে কথা বলে মনের সান্ত্বনা পায় সে। দুদিন ঘর থেকে বেরোয়নি। তিনদিনের মাথায় বেরিয়ে বাপের মুখোমুখি বসে। চুলবুলমিয়া একটু অবাক হয়। যার সঙ্গে ডেকে ডেকে কথা বলতে হয়, আজ সে নিজে এসেছে ?

 
কী ব্যাপার ?
 
তোমাকে একটা কথা বলার জন্যি এসেচি।

 
হিসেব থেকে মুখ তুলে বলে, গুরুতর কিছু ?
 
ততক্ষণে ফুলজান আড়ালে এসে দাঁড়ায়।কী  জানি ? কী না ঘটে ? মেয়েটা দুদিন ওঠেনি।খায়নি।কাছে গেলে বিরক্ত হয়েছে।
 
রোজিও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।তারপর বলে,গুরুতর ? ঠিক বুজতি পারচিনে।
 
মেয়েটা সব সময় কাটা কাটা কথাবার্তা বলে। আজ কী এমন হয়েছে ? পিতা হয়ে সে সহানুভূতির গলায় বলে,তোর কি কোথাও ধাক্কা লেগেচে ?তার অভিজ্ঞ মন যেন একথা বলে।
 
কামিনির সামনে যত খোলামেলা হওয়া যায় এখানে তা হয়না । সব সময় একটা আড়াল কাজ করে।সে অন্যমনস্ক গলায় বলে, আমি আর পড়াশুনো করব না।
 
তাহলি কী করবি ?
 
সে মাথা নীচু করে বলে,তোমরা যা বলবে।
 
আড়াল থেকে ফুলজান স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।
 

♦·♦–♦·♦♦·♦–♦·♦

ক্রমশ..
 
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ৭

ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ৭। নজরবন্দী সময়ের উপকথা


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!