Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • ডিসেম্বর ২২, ২০২৪

ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ৭। নজরবন্দী সময়ের উপকথা

হেদায়েতুল্লাহ
ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ৭। নজরবন্দী সময়ের উপকথা

অলঙ্করণ: দেব সরকার


কৃত্রিম নাগরিকতা অথবা দূষিত অতীতমুখিতাকে অতিক্রম করে স্বতন্ত্র মানচিত্র সৃষ্টিতে ব্যস্ত ৭০ ছুঁইছুঁই লেখক। কোনো ‘ইজম’ নেই, চিন্তার স্বাধীনতাই তাঁর দিবারাত্রির অনুশীলন। এই সময়, সমকালীন সঙ্কট এবং চাকরিপ্রার্থী ছেলেমেয়েদের সংশয়, আরোপিত প্রতারণা নিয়ে ডা. হেদায়তুল্লাহ-এর উপন্যাসের সপ্তম পর্ব

 

স্বপ্ন বিক্রির বাজার কেন বাড়ছে ?

 
ট্রেকার ধর্মঘট একদিন।নদী পার হয়ে আতান্তরে পড়ে তারা। হেঁটে স্কুলে পৌঁছাতে অনেক দেরি হবে।পলিদি আবার কদিনে ছুটি নিয়েছে।শরীর ভালো যাচ্ছে না। হঠাৎ তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় লোটন আলি।তার মোটরবাইকের পেছনে একটা সিট। চলো আমার সঙ্গে। সে শেফালির দিকে ইঙ্গিত করে।শেফালি আবার অসহায়ভাবে তাকায়। কবির বলে, কোন উপায় নেই। আমি বরং হেঁটে যাচ্ছি। তার পেছনে উঠে বসে শেফালি। ঝড়ের বেগে বাইক ছোটায় সে। লোটনের গায়ে উৎকট সেন্টের গন্ধে তার মনে পড়ে, স্বপ্ন কি কখনো সত্যি হয় ?
 
পলিদির গাম্ভীর্যকে হয়তো মনে মনে ভয় করে।আজ সে নেই। যেন খোলা মাঠ পেয়েছে লোটন। যেমন মুক্ত মাঠ তেমনি হাতাহাতি কাজও করতে হচ্ছে।নইলে ক্ষুধার্ত ছাত্রছাত্রীরা কিছুই মানবে না।ফিটফাট জামাকাপড় সব লন্ডভন্ড করে দেবে।একসময় ফুরসত আসে।লোটন বলে, তোমাকে কি একটা কথা বলতে পারি ?

 
কী কথা ?
 
তোমার মুখটা বেশ !
 
এই গোল গোল চশমা পরা ?
 
তাতে আলাদা একটা বিউটি আচে।

 
নিজেকে কোনদিন সুন্দরী ভাবেনি। লোটন যাই হোক, পুরুষ তো ! ধন্দে পড়ে যায়। মনের কোণে সুপ্ত বাসনা জাগিয়ে তুলতে চায় ? সে ধরা গলায় বলে, আপনার কথা ঠিক বুজতি পারচি নে।

 
কথাটা আমার নয়।
 
তবে ?
 
বাংলা সিরিয়াল একজন প্রতিভাকে হারাবে।
 
আমি তো অভিনয় জানিনে।
 
কে আর জানে ! জীবন মঞ্চ তো বড়ো রঙ্গমঞ্চ।
 
অত ভেবে দেখেনি। তাছাড়া আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেচে।
 
তাতে কী হয়েচে।আমার কথাডা ভেবে দেকো।
 
ডালিয়ার ফোন,পূজার বিয়েতে যাবি নাকি ?
 
তুই ?
 
আমি তোকে জিজ্ঞেস করচি।
 
একসঙ্গে যাব তাহলি।
 
নারে ! মনির বাইক নিয়ে আসবে।
 
ওঃ ! আশাহত গলায় বলে ফোনন রেখে দেয় কবির।

 
চুলবুলমিয়া এ অঞ্চলের নামকরা লোক।কয়েকটা মেছোভেড়ি আছে। মুরারিশা থেকে একমাত্র তাঁর মেয়ে কলেজে পড়ে। এই নিয়ে গর্ব আছে।অহংকারের সেই বেলুন মাঝে মাঝে চুপসে যায়। মেয়ে যে কী করে ? ভালো ঠেকে না তাঁর। ফরিদের কথাগুলো মনে ধরেছে।তাকে বিশ্বাস করা যায়।
 
রোববারের বিকেল। রোজি সেজেগুজে কোথাও যাচ্ছে। চুলবুলমিয়া ডেকে বললেন, মা ! তোর সঙ্গে একটা কথা আচে।
 
পাপা ! আমি এখন বেরোচ্চি।
 
ফিরবি কখন ?
 
কেন ?
 
এরকম অনিয়ম করলে চলে ?
 
রোজি তাঁর দিকে ভুরু কুঁচকে তাকায়। তুমি কি কৈফিয়ত চাইচ ?
 
তিনি চুপসে যান। মেয়ের উগ্র সাজগোজ পছন্দ না। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেন না। গাঁয়ের চারিদিকে মানসম্মান আছে। সামনাসামনি কেউ কিছু বলে না। তবে সেটা তো বড়ো কথা না। মেয়ে সামনে দিয়ে গটমট করে বেরিয়ে যায়।
 
ফুলজানবিবি আড়ালে দাঁড়িয়ে নাটক দেখছিল। মেয়ে চলে যাওয়ার পর মুখ বের করে।

 
মেয়েডার একটা বিয়েশাদি দিয়ে দাও।

 
এই সরল সমাধানে তাঁর অমত নেই। শুধু কি তাই ? অনেক ঘাটের পানি খেয়েছেন তিনি। সময় এখন তাঁদের কালে দাঁড়িয়ে নেই। একমুখি সমাধান সহজ নয়। তিনি একটু বিরক্ত হয়ে বলেন, মেয়ে তোমার কী করে জানো ?

 
আমি তো বাইরি বেরোই নে।
 
তোমারও তেমন ইচ্চে নাকি ?
 
কী যে বলো !
 
তবে মেয়েকে ঘরে রাকতে পার না কেন ?
 
তুমি তো আশকারা দিয়েচ। মেয়েকে লেখাপড়া শেকাবে।লাও ঠ্যালা !
 
আমি কি অন্যায় করেচি ?
 
সে তুমি বোঝ !

 
বুঝে পান না চুলবুলমিয়া ।বটি দিয়ে সাংসারিক কাজ সারা যায়।আবার তা দিয়ে হাত কাটা যায়।তা বলে বটি তুলে রাখতে হবে ? সময়ের রথে তো চড়তে হবে। নইলে পেছনে পড়ে থাকতে হবে। বারান্দায় বসে জলকরের হিসেব নিকেশ করছিলেন। আঁধার এখনও নামেনি।পশ্চিমের রঙিন আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
 

রোজি আজ কলেজে যাবে না। দুপুরে ইছামতী হোটেলে তার প্রোগ্রাম আছে। লোটন আলি, অভিনয় শেখানোর জন্যে একটা কোম্পানি খুলেছে।আজ অভিনয় জগতের নামকরা কিছু হোমরাচোমরা আসবে। কিছু কিছু সিরিয়ালের জন্যে নতুন মুখ বাছতে পারেন তারা। সকাল থেকে একটা ঘোরের মধ্যে আছে

 
আজকাল শেফালি তাকে এড়িয়ে চলছে।ডালিয়ার সঙ্গে তার কী সম্পর্ক সেটা কি জেনে ফেলেছে ? তাতে কী হয়েছে ? সে কি সবটুকু জেনেছে ? মনির বারাসাত কাজিপাড়ার হাইস্কুলে জয়েন করেছে। জীবনপুর বিয়েবাড়িতে তা নিয়ে উচ্ছ্বাস দেখা গেল। যতটা মনিরের তার চেয়ে বেশি ডালিয়ার।তাতে দুঃখের চেয়ে কবির অবাক হয়েছে বেশি।রাত ভারি হওয়ায় অবশ্য ফিরতি পথের শেষটা তাকে এগিয়ে দিয়েছে কবির।
 
তবে সেসব কথা ভাবছে না শেফালি।সংশয় তাকে ঘিরে রেখেছে।সবকথা খুলে বলে ধন্দে পড়ে গেছে। লোটনকে বিয়ের কথা বলা কি ঠিক হয়েছে ? সে হয়তো অন্যরকম ভাববে।যা নয় তাই সত্যি বলে মনে করবে।কলিগ আর বন্ধু।তার বাইরে তাদের সম্পর্কে অন্য কোন রঙের পোঁচ পড়েছে ? পড়েছে কি !
 
একই সঙ্গে নিত্যদিন চলাফেরা। সংশয়ের পালা কতদিন চলে ? শেফালি বলে,আগামি রোববার তোমার কোন কাজ আচে ?
 
কেনো বলো তো ?
 
মা তোমার জন্যি তালের পায়েস রান্না করবে।
 
তাহলি তো যেতি হয়।উচ্ছ্বসিত হয় কবির।তবে এ উচ্ছ্বাস অন্য কারণে।পায়েসের জন্যে নয়।যে অকপটে সব কথা খুলে বলছে মনে কোন সন্দেহ রাখে না।তার আবেগে আঘাত দিতে চায় না।
 
একটু দূর হলেও সে ট্রেনে যাবে না। ইনস্টলমেন্টে মোটরবাইক কিনেছে কবির। তাতে বোরবার বেরিয়ে পড়ে।
 
মালতিবিবি বিব্রত হয়। দেখ মেয়ের কাণ্ড ! শুধু তালের পায়েসের জন্যে এতদূর থেকে একজনকে ডেকে এনেছে ? সে বলে, তোমার কথা শুনতে শুনতে মনে হয় তুমি আমার সামনে ঘোরাফেরা করচ।
 
এখন কি আমাকে অন্যরকম মনে হচ্চে।
 
বালাইষাট ! তা মনে হবে কেন।
 
জুব্বার মুনশি একটু আলাপ করে চলে গেল।রোববারের বাজার তাকে ধরতে হবে।
 
কথায় কথায় অনেক কথা ওঠে। শেফালি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, তুমি চুপ করোতো মা।

 
আমি চুপ করলি সত্যিটা মিথ্যে আর মিথ্যেটা সত্যি হয়ে যাবে ?
 
এরকম বলচ কেন ?
 
তুই বাবলুকে নে ঘর করতি পারবি ?
 
সে তো পরের কথা।
 
তুই চিরকাল চোখের পানি ফেলবি। আমি মরেও শান্তি পাব না।

 
কবির চুপ করে থাকে। এদের মধ্যে কথা বলা কি মানাবে ? হঠাৎ তার দিকে তাকিয়ে মালতিকে সাক্ষি রেখে জিজ্ঞেস করে, তুমি কী বল, বাবা ?
 
কবির আমতা আমতা করে।কী বলবে সে ? এ তো এদের একান্ত পারিবারিক কথা। শেফালিকে সে মনে মনে প্রশংসা না করে পারে না। বাবার অসম্মান না হয়, তার জন্যে নিজের ভবিষ্যত নিয়ে এমন পাশা খেলতে রাজি ? সে ধীরে ধীরে বলল, শেফালির সংস্পর্শে এসে তার মনের পরিবর্তন ঘটতে পারে।

 
এ তোমার অলীক কল্পনা।
 
চমকে উঠে মালতির দিকে তাকায় সে।তারপর জানতে চায়, আপনার কি এই ধারণা ?
 
কী আর বলব ? কম দিন ধরে সে এখানে আসচে না। আমার মেয়ে তার সঙ্গে কথা বলেনি বুজি ?

 
আর কী বলবে বুঝতে পারে না। সে যেন এক বিভ্রমে আটকা পড়ে যায়।এখানে সে কেন এসেছে ? কী জন্যে এসেছে ? সব শূন্য হয়ে যায়।শেফালির কথায় চটকা ভাঙে।কী ভাবচ, কবিরদা ?
 
এক লহমায় কবির উত্তর দিতে পারে না। পরে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলে, ভাবচি অনেক কথা। নিজের বিভ্রম সরিয়ে দিয়ে তাদের মাঝে ফিরে এসেছে।

 
যেমন ?
 
বন্ধন থেকে মুক্তি নেই ?
 
ম্লান হাসে শেফালি।
 
আর নয়।দুপুরের খাওয়া অনেক আগেই সারা হয়েছে।তালের পায়েসও বাদ যায়নি।বেলা পড়ে এসেছে।অনেক পথ যেতে হবে।বিদায় নিতে দেরি করে না কবির।
 
এতদিন বাদে ফোন করলি ?
 
তোর কোন অসুবিধে আচে ? ডালিয়া জিজ্ঞেস করে।
 
সেকথা বলিনি।
 
তবে ?
 
আমরা কি পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্চি না ?
 
ডালিয়া কোন উত্তর করেনা।বলে, তোকে একটা খবর দেওয়ার আচে।
 
কী খবর ?
 
সিরাজ আমাকে ডেকেচিল।
 
ওর পেছনে ঘুরে ঘুরে তোর বয়েস বেড়ে যাবে।

 
ডালিয়া রাগ করেনা। ঠান্ডা গলায় বলে, তা যা বলেচিস ! আমার কথাটা শেষ করতি দে।

 
ঠিক আচে বল।
 
কে যেন খবর দিয়েচে, তোমাদের লিস্ট বেরিয়েচে। তা খোঁজ নিতে কয়েকজন মিলে বিকাশ ভবনে গেচলুম আজ। তারপর চুপ করে যায় ডালিয়া। কবিরও কোন কথা বলে না। ব্যর্থ হয়ে হয়তো সান্ত্বনার খোঁজে তাকে ফোন করেছে ডালিয়া।
 
ভেঙে পড়িস নে। আমাদের জীবন দুর্ঘটনাময়। তাই স্বাভাবিক।
 
ভালো বলেচিস ! সেখানে তালিকায় আমার নাম দেকলুম।
 
সত্যি বলচিস ! কবির উত্তেজিত হয় আবার বিষণ্ণ হয়। এই বিষণ্ণতার স্পষ্ট কোনো কারণ নেই।সে কি তাকে হিংসে করে ? কী আবোল তাবোল ভাবছে ? খুশির খবর দেওয়ার জন্যে তো তাকে ফোন করেছে।তারও খুশি হওয়া উচিত।সে শুকনো গলায় বলল, তোর চেষ্টা এতদিনে সফল হল।
 
কাল বারাসাত ডি আই অফিসে যাব। তুই আমার সঙ্গে যাবি ?
 
কেন ? এরকম প্রশ্ন মনে উঁকি দিলেও বলতে পারে না। হয়তো তার ভুল হচ্ছে।মনিরের সঙ্গে সেরকম কোন সম্পর্ক নেই। নিজের কাছে ছোট মনে হয় নিজেকে। সে জোর দেখিয়ে বলে,অবশ্যই যাব।

 
রোজি আজ কলেজে যাবেনা। দুপুরে ইছামতী হোটেলে তার প্রোগ্রাম আছে। লোটন আলি, অভিনয় শেখানোর জন্যে একটা কোম্পানি খুলেছে।আজ অভিনয় জগতের নামকরা কিছু হোমরাচোমরা আসবে। কিছু কিছু সিরিয়ালের জন্যে নতুন মুখ বাছতে পারেন তারা। সকাল থেকে একটা ঘোরের মধ্যে আছে। এমন সময় মা এসে খবর দেয়, পাপা ডাকচে।
 
একটু বিরক্ত হয়।এইসব ওল্ড মডেলের মানুষদের নিয়ে যত ঝামেলা। এরা দুনিয়ার হালহকিকত জানে না। শুধু বকুনি ঝেড়ে জীবন উদ্ধার করে দিচ্ছে। হাসিনা জাহানের কথা জানে ? তপসিয়ার বস্তিবাড়িতে থাকত । এখন বাংলা চিত্র জগতের সুপরিচিত সেলিব্রেটি। এরমধ্যে লোটন আঙ্কেলকে আধুনিক মনে হয়। সে তরুণ সমাজে স্বপ্ন বিক্রি করতে পারে।
 
উত্তেজনায় টানটান হয়ে বাপের সমুখে দাঁড়ায়।

 
কী বলচ ?
 
আমরা কি তোর ভালোমন্দ বুজি নে ?
 
হঠাৎ একথা কেন ?

 
চুলবুলমিয়া একটু ভাবতে থাকেন। তারপর নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলেন, ভাবচি তোর বিয়ে দে দোব।

 
এমন অসময়ে ?
 
ভালো পাত্র পেলুম। চাকরি করে।
 
কী চাকরি ? বাপের কথা অম্লান বদনে শুনে যাবে, তা নয়। যাচাই করে নিতে চায়।

 
মালতিবেগম আরো মুসড়ে পড়ে। কাঁদে আর দোয়া চায়। দুনিয়া কি তাদের জন্যে এত ছোট হয়ে গেছে যে নিশ্বাসটুকু ফেলার জায়গা নেই ? ওপরওয়ালার এ কী বিচার ? বাবলুকে কয়েকবার অনুরোধ করেছে, আমার মেয়েকে মুক্তি দাও। প্রত্যেকবার সে অট্টহাসিতে তার বুকের ভেতর কাঁপন ধরিয়েছে।আর বলেছে, আমাকে আপনার অপছন্দ কেন ?

 
আমি দুঃস্বপ্ন দেকচি ?
 
কী দেকচেন ?
 
বাবা ! তোমার তো পয়সার অভাব নেই।
 
কী বলতে চাইচেন ? মেয়ের অভাব হবে না ?

 
মালতি কোন জবাব দেয় না। বাবলু তীব্র কণ্ঠে বলে, আমি খারাপ আর কেউ ঘুষ দিয়ে চাকরি কিনলে ভালো ? মোটরবাইক দাবড়ে সে চলে যায়।
 
মালতি নিজের কপালকে দোষে না। সবই বাড়ির মানুষটার কর্ম ফল। অতিরিক্ত অস্থিরতায় সে বিপদ ডেকে এনেছে। শেফালি ঘুষ দিতে রাজি ছিল না। বাপের মুখের ওপর কোন কড়া প্রতিবাদ করতে পারেনি। জব্বারমিয়া বলেছিল, এটাই সুযোগ। তার ঘনিষ্ট প্রশান্ত মিত্র এবার স্কুল বোর্ডের হোমরা চোমরা হয়েছে। শুধু কথায় তো চিঁড়ে ভেজে না। প্রশান্তবাবু বলেছিল, তোমার কাছ থেকে টাকা নিতে খারাপ লাগছে।
 
জব্বারমিয়া বলে, আমারও চুল পেকেচে। একেবারে অবুজ না। তবে একটা কথা দিতি হবে।

 
কী এমন কথা ?
 
অন্য কারবারের মতো টাকা যেন গ্যাপ না হয়।
 
প্রশান্তবাবু একটু অভিমানের সঙ্গে বলল, এতদিনে আমাকে এই চিনলে ?

 
বাজারে অনেক লোক আছে। সেজন্যি তো তোমার কাছে ছুটে আসা।
 
ভিড় খুব বেশি নেই। ছিমছাম চারিদিক। ডিআই সাহেব বয়স্ক মানুষ। তিনি ভুরু কুঁচকে বললেন, তুমি তো বড়ো গাছে ভেলা বেঁধেছ।
 
ঠিক বুজলুম না, স্যার ! ডালিয়া বলে।
 
তোমার বোঝার ব্যাপার না। ঘনঘন আমার কাছে ফোন আসছে। তোমাকে একটা কথা বলতে পারি। তোমার কাগজপত্র সব দেখেছি। তোমার যোগ্যতাকে খাটো করা যাবে না। ভালো স্কুলে দেবো তোমাকে।
 
ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে কাজ মিটে যায়। ডালিয়ার চোখেমুখে উচ্ছ্বাস।বাইরের ওয়েটিংরুমে অপেক্ষা করছে কবির।তাকে বেরোতে দেখে এগিয়ে যায় সে, কোথায় পোস্টিং দিল ?

 
একটু পরে শুনিস। চল, কোথাও যাওয়া যাক।
 
কোথায় যাবি ? এখন তো একটা বাজে।
 
খিদে পেয়েচে রে ! টেনশানে কাল থেকে ঠিকমতো খেতে পারিনি।
 
ঠিক আচে। খরচা আমার।

 
খুশিতে ডগমগ ডালিয়া কোন আপত্তি করে না।
 
কলকাতা শহর বাড়তে বাড়তে এদিকে চলে এসেছে। আগে যেখানে টালিচালের জলখাবারের দোকান আজকে সেখানে ঝাঁ চকচকে রেস্তোরা। বিরিয়ানি অর্ডার করে তারা এক আলোআঁধারি কোণে বসে। ডালিয়ার আনন্দ দেখে তৃপ্ত হয় সে। নিজেকে আগের চেয়ে সংযত করেছে। অন্ধ আবেগের প্রকাশই শুধু ভালোবাসা নয়। তার অনেক মাত্রা আছে। এই মুহূ্র্তে সে কি তাকে ভালোবাসছে না ?
 
ঘোরের মধ্যে উড়ছে ডালিয়া। চাকরি পেয়েছে, সেটা একটা বড়ো ব্যাপার।তার চেয়েও মনের গভীরে, তাকে স্পর্শ করছে শান্তি । ডিআই সাহেবের কথাগুলো বারবার অনুরণন হচ্ছে। নিজের যোগ্যতার ওপর তার আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ একটা বিষণ্ণতা অনুভব করে। তুই পরীক্ষাটা দিলি নে ?

 
তাতে ক্ষতি কী হয়েছে ? কবির মুখের দিকে তাকায়।
 
তুই যদি ওখানে না পেতিস ?
 
অনেকে তো পায়নি।

 
ওয়েটার দুপ্লেট সুগন্ধি বিরিয়ানি নিয়ে এল। খেতে খেতে কথা বলে ডালিয়া, তোর মনে এত নেগেটিভ চিন্তা কেন ?
 
কোনও জবাব দেয় না। নিজের ভাবনা হয়তো বুঝতে পারে না কবির। তবে একথা ঠিক, সে অল্পে সন্তুষ্ট। তাতে হয়তো যন্ত্রণাবোধ কম। অথবা জীবন সম্পর্কে তার প্রতাশ্যা কম। ধরা ছোঁয়ার বাইরে যেতে চায় না। আচমকা সে জিজ্ঞেস করে, তুই তো বললি নে।

 
কী ?
 
তোর পোস্টিং ?
 
শুনলে তুই অবাক হবি।গান্ধি স্কুলে।

 
সত্যি অবাক হয় কবির। জেলার মধ্যে খুব নাম করা স্কুল। এমন পোস্টিং ভাগ্যের ব্যাপার। সে একটু যেন বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। কোন হিংসা নয়। ডালিয়া কি তার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে ?

 
কী রে ? চুপ করে গেলি ?
 
খুব খুশি হয়েচি।
 
যাকগে ! চল এবার উঠি।
 
এখনই বাড়ি ফিরবি ?
 
আবার তুই কী করতে চাস ?
 
সেটা তোর ইচ্ছে।
 
অন্যদিন ঘোরা যাবে।আকগে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।মাও বড়ো টেনশানে থাকে।

 
কবির বাড়ি ফিরে শোনে, ফরিদ ফোন করেছিল। সব শুনে টগর বলেছে, এখনকার মেয়েদের বাড় বেশি।বাপ মাকে টপকে যায়। মেয়ে বলে কিনা বিয়েটা এযুগের ধর্ম না। মানুষের ধর্ম তাহলে মুছে যাবে। কত বড়ো আস্পর্ধা !
 
মায়ের কথা শুনে কৌতূক বোধ করে কবির। মা ঠিক বুঝতে পারছে না।এখন মানুষের জীবনতৃষ্ণা একই মাপকাঠিতে ফেলা যাবে না।আজ তার মন ভালো আছে।অনেকদিন পর ডালিয়াকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবে।

 

♦·♦–♦·♦♦·♦–♦·♦

ক্রমশ..

আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ৬

ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ৬। নজরবন্দী সময়ের উপকথা


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!