Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • ডিসেম্বর ১৫, ২০২৪

ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ৬। নজরবন্দী সময়ের উপকথা

মহিম ঘটক মাঝে মাঝে তার কাছে এসে বসে।বলে, মিঞা ভাই, তুমি একবার রায় দাও।কত টাকা চাই ? মেয়ের বাপেরা লাইন দেবে। এ ব্যাপারে নিজের মন থেকে কোন সাড়া পায়নি...তারপর

হেদায়েতুল্লাহ
ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ৬। নজরবন্দী সময়ের উপকথা

 
কৃত্রিম নাগরিকতা অথবা দূষিত অতীতমুখিতাকে অতিক্রম করে স্বতন্ত্র মানচিত্র সৃষ্টিতে ব্যস্ত ৭০ ছুঁইছুঁই লেখক। কোনো ‘ইজম’ নেই, চিন্তার স্বাধীনতাই তাঁর দিবারাত্রির অনুশীলন। এই সময়, সমকালীন সঙ্কট এবং চাকরিপ্রার্থী ছেলেমেয়েদের সংশয়, আরোপিত প্রতারণা নিয়ে ডা. হেদায়তুল্লাহ-এর উপন্যাসের ষষ্ঠ পর্ব

 

ঝড়ো বৃষ্টির পূর্বাভাস

 
সাহস তার নয়, বাপ জব্বার মুনসির।জব্বারমিয়া সে আমলের পিইউ পাশ।তখন অন্য সময়।চব্বিশ পরগণায় একজন দুঁদে কংগ্রেস নেতা।তাঁর সঙ্গে নাকি ইন্দিরা গান্ধির দহরম মহরম।এখানে অন্য রকম কোন ব্যাপার স্যাপার ছিল না।তিনি আর সকলের মতো জব্বার মিয়াকে প্রাইমারি স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।দিনকাল পাল্টেছে।যাই করো, সেদিন আর নেই।এখন ফেলো কড়ি, মাখো তেল।প্রাইমারি শিক্ষক সংগঠনের নেতা ভজনবাবুর সঙ্গে ব্যাপক খাতির জব্বারমিয়ার।তবে তা এমনি এমনি হয়নি।রিটায়ারমেন্টের প্রায় পুরো টাকা খসাতে হয়েছে।অনেক দর কষাকষির পর পনেরো লাখে রফা হয়।
 
মধ্যমপুর স্টেশানে থেকে ভ্যানরিক্সায় কুড়ি মিনিট সোলাদানা। গাঁয়ে ঢোকার মুখে মুনশিপাড়ায় তাদের বাড়ি। সেদিন বাড়ি ফিরে আতান্তরে পড়ে শেফালি।দুর্বল মুহূ্র্তে সব কিছু খুলে বলা কি ঠিক হল ? নিজের ওপর যেন রাগ হয়।এই তার বদ অভ্যেস, নিজেকে সংযত করতে পারেনা।সবাইকে বিশ্বাস করে মনের কথা খুলে বলে।রাতেরবেলা মালতিবিবি তার ঘরে টোকা দেয়।উনি ডাকচেন।
 
জব্বারমিয়া কাজের মানুষ।অবসর গ্রহনের পরও বাড়িতে বসে থাকতে চান না।সোলাদানা বাজারে কাপড়চোপড়ের দোকান খুলেছেন।বাড়ি ফিরতে  সেদিনও রাত হল।তিনি জিজ্ঞেস করলেন,মা ! দিন কেমন কাটলো ?
 
মেয়ে তাঁর শান্তশিষ্ট। সেটাই অস্বস্তির কারন।পদে পদে মেয়ের জন্যে আশঙ্কা হয়।
 
ভালোই কেটেচে।
 
যাকগে ! নিশ্চিন্ত হলুম।এখন তো তোমাকে নিজের মতো বুজে চলতে হবে।
 
মাথা নেড়ে আবার নিজের ঘরে ঢুকে যায়। রাতেরবেলা সে এক স্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে। কে একজন ঝড়ের বেগে বাইক ছুটিয়েছে, তার পেছনে সে বসে আছে। চালকের মুখ চেনা চেনা মনে হচ্ছে অথচ ধরতে পারছে না। সে ভয় পাচ্ছে। এই বুঝি ছিটকে পড়ে যাবে। চালক বেপরোয়া। তখনই ঘামে সারা শরীর ভিজে যায়। তখন বাইরে একটা রাতজাগা পাখি ডেকে ওঠে।ঘুম ভেঙে গেলে আর ভয় থাকে না।হাসি পায় তার।স্বপ্ন কত বিচিত্র হতে পারে ! সারাদিনের উত্তেজনায় বুঝি এমন হয়েছে।সিনেমাহলে পাশাপাশি বসার জন্যে এরকম হয় নাকি ? কবিরদার স্পর্শ কি তেমন ছিল ? এবার এক সুখ স্বপ্নের ঘোরে সে ঘুমোতে চায়।
 
আমিরমিঞার কূলখানির দিন হাজার খানেক লোকের নেম্নতন্ন।এক লাখ চল্লিশ হাজার কূল পড়ার দোয়া বকসানো হল।বাড়ির লাগোয়া মস্ত উঠোনে।প্যান্ডেল করে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা।চেনা অচেনা পরিচিত অপরিচিত অনেক আত্মীয় স্বজন এসেছেন।তার মধ্যে একজনকে বেশ মনে ধরে।মেয়েকে জিজ্ঞেস করে,ওটা কে রে, হাসনু ?

 
আমি ঠিক চিনি নে, হয়তো শ্বশুরবাড়ির দিককার আত্মীয় হবে।
 
ঠিক আচে।জামাই এখন ব্যস্ত।পরে খোঁজ নিলে হবে।
 
যদ্দূর জানি, চুলবুলমিয়ার মেয়ে।অবস্থাপন্ন খুব ওরা।
 
তাদের ভেতর আর কোন আলোচনা হয়না।
 
ছেলেকে এবার চেপে ধরে টগর।আমার কথা কি একবার ভেবেচিস, খোকা ?
 
সেটা আবার কী ? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে সে।
 
মনের কথা ভেঙে বলেন ।সব শুনে কবির বলে,আর কডা দিন সবুর করো।
 
সবুর করেই তো আচি।

 
মায়ের ম্লান মুখের তাকিয়ে তার কেমন যেন মায়া হয়।বাপের বাউন্ডুলে স্বভাব।চাষবাস নিয়ে থাকলেও ভেতরে ভেতরে একটা অগোছালো।ইদানীং বয়েসের ভারের দরুণ পরিপক্কতা এসেছে। সবকিছু ফেলে হজে যাওয়ার জেদ ধরেছেন। বাধা দেওয়ার কোন প্রশ্ন নেই।

 
ঠিক আচে। তোমরা যখন বলচ আমি রাজি আচি।
 
এই তো বেশ কথা ! খুশি হয়ে বলে টগর।
 
তবে আমার কথা শুনতি হবে।
 
কী কথা ?
 
দুদিন পরে বলব।

 
ছেলের দিকে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন।খোকা কি দখিনপাড়ার সেই মেয়ের কথা ভাবছে ? মেয়েটার কী যেন নাম ? অনেকদিন এদিকে আসে না।তাদের মধ্যে কি মন কষাকষি চলছে ? সেজন্যে খোকা সময় চাইছে ? মেয়েটা এমন কিছু আহামরি না।মামার বাড়িতে মানুষ।মা খিচুড়ি স্কুলে বোধহয় রান্নাবান্নার কাজ করে। ছেলের মতিগতি কোনদিকে চলে দেখা যাক।এই মেয়েটির চেয়ে চুলবুলমিঞার মেয়েটি অনেক ভালো।শুনছি তারা অবস্থাও।বেশি আর চিন্তা করে না।একটু ভাবলে আজকাল মাথা ঘোরে।

 
যা ভালো বুজিস, খোকা।

 
এমন সময় ফোন বেজে ওঠে।কবির সবুজ বোতাম টেপে, হ্যাঁ ! বল।

 
তোকে একটা শুভ খবর দিই।
 
কী ?
 
আমি এস এসসিতে চাকরি পেয়েচি।মনির বলে।
 
তোদের হাইকোর্ট চলচে না ?
 
উঠে গেচে।
 
আর ডালিয়া ?
 
সে খবর তো তুই ভালো জানিস।ফোন রেখে দেয় মনির।

 
এবার ফোন করে কবির। বিকেল পড়ে এসেছে। আজ তার স্কুলে বনবিবি পরবের ছুটি। ফোন রিং হয়ে কেটে যাচ্ছে। বুঝতে পারে ডালিয়া ফোন ধরছে না।ঠিক আছে। তার খবর কী ? ভালো খবর থাকলে নিশ্চয় জানাত। খবর যাই হোক না কেন, একটা হেস্তনেস্ত তাকে করতে হবে। মায়ের মুখের দিকে আর তাকাতে পারে না। যদিও ডালিয়া চেতাবনি দিয়েছে, তবুও সফুরাবেটির সঙ্গে পাকাপাকি কথা বলবে। দরকার হয় তার মামা রহমতমিয়ার সঙ্গে কথা বলবে।
 
বেশ রাতের দিকে ফিরতি ফোন করে ডালিয়া।কবির গম্ভীরভাবে বলে, তখন যে ফোন ধরলি নে ?

 
তোর ফোন সব সময় ধরতে হবে, এমন কোন্ দিব্যি দিয়ে রেকেচি।

 
একটু ঢোঁক গেলে সে।তারপর গলা নামিয়ে বলে, কোনো কাজে ব্যস্ত ছিলি ?

 
কী জন্যি ফোন করেচিলি বল ?
 
মনির ফোন করেচিল।
 
জানি।আর কিছু বলবি ?
 
ভাবচি রহমতমিয়ার সঙ্গে কথা বলব।
 
সে তুই বলতি পারিস।
 
তোর কোন আপত্তি নেই তো ?
 
আমার কেন আপত্তি থাকবে। মামার বড়ো মেয়ে আমার দু’এক বছরের ছোট হবে কিন্তু জেসমিন আমার চেয়েও সুন্দরী।

 
কবির হতাশ হয়ে বলে, কী কথার কী উত্তর !

 
তুই যেমন বলেচিস তেমন উত্তর।
 
তোর সঙ্গে কথা বলে শান্তি পেলুম না।
 
তাহলে কথা বলতি আসিস কেন ?
 
সেইটা বুজি আমার ভুল।
 
ভুল সংশোধন করে নে।
 
তাহলি আর জীবনে দাঁড়ায় কী ?
 
কেন ?
 
জীবন তো ভুলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আমার চাকরিটা দেক ? শুধু ভুলের ওপর ভুল।অথচ দিব্যি মানিয়ে গেল।
 
ওসব বাদ দে।তুই যা জানতি চেয়েচিস বলি।
 
বল্।
 
তুই যখন ফোন করেচিস তখন আমি পার্টি অফিসে।জানিস তো কোর্টের কেস উঠে গেছে।
 
মনিরের কাচে শুনলুম।
 
সেজন্যে সিরাজের সঙ্গে কথা বলচিলুম।
 
কবির একটু চুপ করে থাকে।তারপর বলে,ওসব চক্র ছেড়ে দে।
 
তার মানে ?

 
এবার থমকে যায়।তাকে কি সরাসরি বলবে, আমি তোকে বিয়ে করতি চাই।সেটা কি খুব সঠিক হবে ? মনে জোর পায় না।কিন্তু এই না বলা কথা সে মনের মধ্যে কতদিন পুষে রাখবে ? তবু সে বলতে পারে না। অন্যকথার দিকে চলে যায়। সে বলে, রাজনীতি করা লোকগুলোকে কি ঠিক মনে হয় ?

 
আচ্ছা জ্বালাতন ! আমরা কী ?
 
সাপের বিষ ?
 
তার থেকে ওষুধও তৈরি হয়।
 
তার সঙ্গে তর্কে পেরে ওঠে না কবির। শেষে বলে, যা ভালো বুজিস তাই কর।
 
আমি তাই ভেবেচি।
 
কী ভেবেচিস ?
 
চাকরি পেলে মাসে মাসে একটা করে খাম সিরাজের দরবারে নজরানা দোব।কিরে ভালো হবে না ?
 
সে তোর ইচ্ছে।
 
তোর ইচ্ছেটা আমি বুজেচি, সত্যি কথা বলতি, তোর সম্পর্কে এখনও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি।ফোন কেটে দেয় সে।

 
অন্যান্য রোববারের মতো দোকানের বাইরে বসে আছে। এদিন ফাঁকাই থাকে। ফরিদ দেখে, সেদিনের লোকটা।তাকে দেখে হাত তোলে।সেদিন ফরিদের কোন সন্দেহ হয়নি। ভেবেছে তার মিসেস হয়তো কিন্তু আজকে অন্য এক মহিলা। দেখতে দেখতে তারা অদৃশ্য হয়ে যায়। তার মনে একটা জিজ্ঞাসা ঝুলতে থাকে।
 
ঝড়ের আশঙ্কায় দুপুরের পর স্কুলে ছুটি। পারঘাটায় এসে কোন লাভ হয় না।এখন ভরা জোয়ার। বড়ো বড়ো ঢেউ উঠছে। পারাপার হবে না। সেই চায়ের দোকানে বসে আছে দুজনে। তাদের সামনে দিয়ে মোটরবাইক নিয়ে বেরিয়ে গেল লোটন। তারা একটু গা ঢাকা দিয়ে বসে থাকে।নইলে দেখতে পেলে আবার কাছে এসে বকর বকর জুড়ে দেবে। বিরক্তিকর মানুষটার মাত্রাজ্ঞান কম। বাইকের শব্দ মিলিয়ে যেতে শেফালি বলে,আজগে বড়ো চুপচাপ?
 
কবিরের মন ভালো নেই।ডালিয়া বুঝি একরকম ফিরিয়ে দিয়েছে তাকে। এসব কথা কাউকে বলতে পারেনি।কাকেই বা বলবে ? তাকে নিয়ে প্রতিদিন স্বপ্ন দেখেছে।তাকে যে সে ভালোবাসে, একথা বোঝে না ডালিয়া ? তার মন বলে কিছু নেই ? নাকি সব জেনেশুনে তার সাথে নিষ্ঠুর খেলায় মেতেছে ?আকাশে কালো মেঘের খেলা।এই মুহূর্তে হয়তো বৃষ্টি নামবে না।আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে বলে, তুমি ডালিয়া বলে কোনো মেয়েকে চিনতে?
 
কোথায় ? কলেজে ?
 
মাথা নাড়ে কবির।তার দিকে তাকিয়ে শেফালি বলে,ঠিক মনে করতি পারচি নে।
 
ঠিক আচে।বলে চুপ করে যায় সে।তাকে আর পীড়পিড়ি করে না শেফালি।সে বলে, আজকের বড়ো উদাস দিনটা।আমার নিজেকে মেলে ধরতে ইচ্ছে করচে।
 
আমাকে বলবে ?
 
কেন ? আমরা কি কাছাকাছি হয়নি ?
 
চমকে ওঠে কবির।নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,হ্যাঁ ! বন্ধুর মতো কাছাকাছি হয়েচি অবশ্য।
 
শেফালি চুপ করে।শুধুই বন্ধুত্ব ? কবিরদা ডালিয়ার কথা বলতে গিয়ে থেমে গেছে।মেয়েটা তাকে কোনো আঘাত দিয়েছে ? আজ তাকে ভীষণ আনমনা দেখাচ্ছে। মনের কথা আর কাকে শোনাবে শেফালি ? কিছু কথা তো বলেছে।বাকিটা বললে আর ক্ষতি কী ? সে তো কবিরদার কাছে কোন সমাধান চাইছে না।
 
স্কুল মাস্টারিতে মাইনে কম।দিন আনা দিন খাওয়া।ইছামতীর ভাঙনে একলপ্তে পাঁচ বিঘে আমবাগান চলে গেল।আব্বা দমবার পাত্র না।শাঁকচুড়ো বাজারে চালের কারবার শুরু করলেন। বড়ো বড়ো পাইকাররা টাকা মেরে চলে গেল।পাওনাদারের উৎপাতে তখন বাড়িছাড়া অবস্থা।শেষে আমার মেজো খালু মাসুদমিয়া এগিয়ে এল।
 
বাঃ ! বেশতো ! চমকপ্রদ গল্প শুনছে সে।
 
আর এখানেই ট্রাজেডি।
 
তার মানে ? অবাক হয়ে তাকায়।শেফালি কিনা অন্য কোন অচেনা মেয়ের কথা শুনছে ?
 
মানে এখানেই তো আমাকে দায় বইতে হবে।
 
কীসের দায় ?
 
তাদের পরোপকারের দায়।
 
হঠাৎ হাঁক ডাক শুরু হয়ে যায়। খেয়া পারের নৌকা চালু হয়েছে। আর দেরি নয়। তারাও তাড়াতাড়ি লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে।
 
দুদিন পর রাতেরবেলা ফোন করে পূজা।কী রে ! চমকে উঠলি নাকি !

 
তা অবশ্যি। খবর কী বল ?
 
তোদের কী খবর ?
 
আমাদের—! একটু বিস্মিত হয় সে।
 
তোদের কাজ পাকাপাকি হবে কবে ?
 
ঠিক বুজতি পারচি নে।
 
আহা ! ন্যাকা ! তোদের বিয়েটা কবে হবে ?
 
কবির বিরক্ত হয়ে বলে,এজন্যে ফোন করেচিস ?
 
আরো একটা কারণ আচে।আগামী রোববার নহবতে আসতে হবে।
 
নহবত ?
 
হ্যাঁ রে ! জীবনপাড়া চৌরাস্তার মোড়ে।বুজলি তো !
 
কই আর বুজলুম !
 
আরে বোকা ! তোকে আর কী করে বোঝাব ?
 
বুজেচি।তাহলি কেশবের সঙ্গে তোর বিয়ে ?
 
দূর পাগল !
 
সে তো তোর বয়ফ্রেন্ড।
 
ওরকম অনেক থাকে।আমার সম্বন্ধ করে বিয়ে।ফোন রেখে দেয় সে।

 
একটু বিষণ্ণ হয়ে পড়ে কবির। বন্ধু হলেই বিয়ে করতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। সে কী মরিচীকার পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছে ? ডালিয়া কি আলেয়া তার কাছে ? এগিয়ে গেলে নিভে যাবে ?
 
টগরবেগম জিজ্ঞেস করলেন, খোকা ! তোর ভাবনা চিন্তা শেষ হয়েছে ?

 
কেন,বলতো ?
 
তোর জন্যে মেয়ে দেকি ?

 
কবির কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।তারপর নিমরাজি হয়ে মাথা নাড়ে।

 
আর দেনাপাওনা ?
 
সে তোমাদের যা ইচ্ছে।

 
টগর খুশি হয়। এই তো, ছেলে তাদের ফিরে এসেছে। খোকার বাপও খুশি হবে।হজে যাওয়ার টাকাগুলো বেঁচে যাবে।
 
ভাইয়ের কথা শুনে আতান্তরে পড়ে।হতাশা আর দুঃখে নিজের কপাল ঠুকে মরতে ইচ্ছে করে।রহমতমিয়া বলে,দ্যাক সফুরা আর কতদিন বাড়িতে বসিয়ে রাকবি ?আমার দুদুটো মেয়ে।তাদেরও বয়েস বাড়চে।
 
ভাইয়ের কথা অমান্য করার সাধ্য নেই।কজনের এমন ভাই আছে ? স্বামীকে হারিয়ে যখন চারিদিক অন্ধকার দেখছে তখন সে বৌএর কথা অগ্রাহ্যি করে তাকে ঠাঁই দিয়েছে।বাপ মরা মেয়েটা ভয়ানক জেদি। ছোট থেকেই দেখে আসছে। ভেবেছিল, বড়ো হলে শুধরে যাবে কিন্তু ? একই রকম রয়ে গেছে। বাপের ধারা পেয়েছে। ওর বাপেরও অকারণ গোঁয়ার্তুমি ছিল। তিনি পুরুষ মানুষ। আমার ওপর রাগ ফলিয়ে না হয় চলত কিন্তু তোর কী হবে? আমি আর কদ্দিন ? আমি হয়তো আর বাঁচব না।বেশ বুজতে পারচি।ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্চি।আহা ! কবির যেন সোনার চাঁদ।কী আলাপ ব্যবহার! অনেকদিন থেকে সে এদিকি আসেনা। মেয়ের যা দেমাক আর জেদ ! ঘুম আসে না। চোখের জলে বালিশ ভিজে যায়।
 
সেদিন সকালবেলা ভাইয়ের খাতিরে কিছু কথা বলতে গেল।ডালিয়া ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে, বিয়েটা কি সব ?
 
তোর কাচে হয়তো না।
 
সে ভুরু কুঁচকে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, কবির আবার এসেচিল নাকি ?

 
তার বুজি খেয়ে দেয়ে আর কাজ নেই।
 
তবে এমন কথা বলচ ?

 
এবার গলা নামিয়ে সফুরা বলে, আমরা পরের আশ্রয়ে আচি।

 
সেজন্যি তো এখন বিয়ের ভাবনা নেই। আগে নিজের ঠিকানা তৈরি করি।
 
মেয়েদের আবার ঠিকানা কী ?
 
কেন ?
 
বাপের বাড়ি তো চিরকেলের নয়।
 
আমি আমার নিজের পথে চলতে যাই।
 
তাতে যদি অন্যের অসুবিধে হয় ?
 
নিজের পথ খুঁজে লোবো।

 
সফুরা চুপ করে যায়। সে বেশ বুঝতে পারে আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে ফুলজান। মা মেয়ের সব কথা শুনছে।ভাইকে গিয়ে লাগাবে। আজকাল ভাই ভাবির কথা ছাড়া অন্য কারোর কথা শুনতে চায়না। মেয়েটাকে নিয়ে তার যত জ্বালা। সংসারের ভালো মন্দ সে বোঝে না।
 
সেদিন ফিরতি ট্রেনে বসে বাকি কথা বলে শেফালি।
 
আমার মেজো খালা একদিন এসে হাজির। মাকে বলে,বু ! তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আচে।
 
মা সব শুনে বলে, নিজেদের মধ্যে কাজ করা কি ঠিক হবে ?
 
খালা অভিমান করে বলে, এসব তোমার বাহানা।তুমি আমার ছেলেটাকে পর করে দিতি চাইচ।
 
বালাই ষাট। এমন কথা বলচিস কেনো ?
 
আমার ছোট ছেলে মন্দ কী ?
 
সেকথা না।
 
তবে ?
 
বাড়ির গার্জেন আসুক।তার মতামত তো শুনতে হবে।
 
আব্বা সব শুনে আমতা আমতা করতে লাগলেন।তাদের মুখের ওপর না বলেন কী করে ? তাঁরা  একসময় ভয়ানক উপকার করেচে।
 
কবির এবার বলে, সবই তো বুজলাম, তোমাদের আপত্তি কীসের জন্য, নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে কুটুম্বিতা করবে না ?

 
তাহলি তো ল্যাটা চুকে যেত।
 
অন্য কোন কথা আচে নাকি ?
 
বাবলুভাই অগাধ পয়সা করেচে।
 
সেটা কোন অপরাধ ?
 
গোরুপাচার করে এত টাকা !
 
তাই নাকি ! ঢোঁক গেলে কবির।

 
ট্রেন মধ্যমপুর এসে গেছে। তাড়াতাড়ি গেটের দিকে উঠে যায় শেফালি।
 

♦·♦–♦·♦♦·♦–♦·♦

ক্রমশ..
 
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ৫

ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ৫। নজরবন্দী সময়ের উপকথা


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!