- পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
- জুন ৮, ২০২৫
পথ ভুবনের দিনলিপি। পর্ব ৮

লুব্ধ দুখী রে
রিহার্সাল সেরে বাড়ি ফিরছিলাম৷ সন্ধে হয় হয়৷ ফুটপাথের ওপর এক রুটিওয়ালা তোলা উনুনে আঁচ দিয়েছেন৷ আগুনপানা কয়লায় পাখা দিয়ে হাওয়া চালাচ্ছে৷ ধোঁয়া বেরোচ্ছে খুব৷ বড় রাস্তায় এসে ছড়িয়ে যাচ্ছে চারদিকে৷ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম৷
বহুদিন বাদে সন্ধেকালে তোলা উনুনের আঁচ জিভে রস এনেছিল আমার৷ তপ্ত লোহার চাটু বসিয়ে রুটি শুরু করলেন রুটিওয়ালা৷ অন্যমনস্ক হাত বাড়িয়ে আছি হেংলুর মতো৷
কতকাল আগের কথা ৷ বিকেল গড়ালেই পেট ভর্তি খিদে৷ তোলা উনুনে আঁচটি কেবল ধরিয়েছেন ঠাকুমা৷ কোক কয়লার ধোঁয়ায় চোখে জল গড়াত৷ তার মধ্যেই ছোটো ছোটো হাতে বেলে চলেছি হাতি ঘোড়া রুটি৷ ঘোড়ার শেপ হলেই তাতে লাগিয়ে দিতাম একতাল ময়দা চামর৷ আর হাতি হলেই তাতে দুটো ময়দার দাঁত৷ তারপর ” ঝোল বেশি আলু কমের ” আলুর দম দিয়ে পশুপক্ষী রুটি খেয়ে যাওয়া৷ হাতি ঘোড়া পাখির পাখা সব পেটে৷
মনে আসে৷
ওগো আমার সব যে মনে আসছে !
গাছের তলায় দুচারটে ফুল বাচ্চাগুলোর সিঁথিকাটা মাথায় বসিয়ে বললাম, হাসবিও না নড়বিও না৷ তাহলে কিন্তু ফুলগুলো ফের মাটিতে চলে যাবে৷ব্যাস৷ কলহীন পুতুলের মতো ফিক্সড হয়ে গেল৷ শুধু চোখ ঘুরিয়ে দেখছে নিজেদের চারপাশ৷
হাঁ করে দেখছে আমায়, নতুন জামা না হওয়া শিশু ৷
পথের শিশু কিংবা পথের ধারে ঘর …সবাই
আমার কাণ্ড দেখে হা হা করে হাসছে ৷
গাছের তলায় দুচারটে ফুল বাচ্চাগুলোর সিঁথিকাটা মাথায় বসিয়ে বললাম, হাসবিও না নড়বিও না৷ তাহলে কিন্তু ফুলগুলো ফের মাটিতে চলে যাবে৷
ব্যাস৷ কলহীন পুতুলের মতো ফিক্সড হয়ে গেল৷ শুধু চোখ ঘুরিয়ে দেখছে নিজেদের চারপাশ৷
পুজোর বাদ্য ও দৌলতের মাঝে নিজেকে এবং ওদের আরো দীন দেখতে ইচ্ছে জেগেছিল সেদিন৷
মনের ইচ্ছে টের পেয়ে বৈকাল স্তম্ভিত৷
•·••·••·•
হাতী নাচছে ঘোড়া নাচছে
শহরে আজকাল খুব আলো৷ গভীর রাতেও এত আলো, রাত যে আঁধার তা বোঝে কার সাধ্য ! বঙ্গের প্রশাসকরা বোধহয় রাতের অরিজিনালিটিকে ঢাকতে চাইছেন হাজার প্যান্ডেলের লক্ষ ঝাড়বাতিতে৷ কখনো রাস্তায় আলোর মাল্য ঝুলিয়ে৷ বাল্বের আলো – টুনির আলো৷
সেদিন ভোর চারটেতে নাগেরবাজার মোড়ে ওইরকম প্রচুর আলোয় দাঁড়িয়ে আছি৷ বাস ধরব – হাওড়া থেকে ছটায় আমার ট্রেন৷ রাস্তায় বসে চার ঢাকী ঢুলছেন৷ একজন বেশ বুড়োমানুষ৷ ইটকে বালিশ করে শোয়ার চেষ্টা করছেন দেখে বললাম – ওভাবে রাস্তায় শোবেন না৷ ভোররাতের বাস জ্যান্ত মরার তফাৎ করতে পারে না ৷ আমার কথায় মজা পেলেন মানুষটা ৷
বললেন – মড়াই হয়েছি৷ সাতদিন ধরে বাজনা বাজিয়ে আজ রাত আটটায় ঠাকুর জলে গেল৷ ব্যাস ঢাক শেষ৷ টাকাপয়সা মিটিয়ে দিয়ে বললে – যাও নাগেরবাজার স্ট্যান্ডে ছাউনি দেওয়া বসার জায়গা আছ৷ ওখানে বসে থাকো৷ প্যান্ডেলে কিছুতে থাকতে দেলে না ৷ সেই থেকে বসে৷ এখন পায়খানা পে গেল ৷ কোথায় টয়লেট বল দিকি !
ভীষণ আলো মানুষটার মুখে৷ কেবল চোখের কোলদুটো কালো কালো লাগল৷ গরীবকে নজর কমিয়ে রাখতে হয়৷ তার বর্জ্য ফেলার জায়গা নির্দিষ্ট নয় – হয়ত খাবারও সারাবছরের নয়৷ তার চোখে লোভ ঝিকোলে চোখেরও ক্ষতি, লোভেরও বিপদ৷ তাই হয়ত চোখের গর্তদুটো ছোট হয়ে যায় গরীবের৷ ছোটতে ছটা পৌঁছয় না
আমাদের ছেলেবেলায় দেখেছি – পুজো শেষ হলেও ঢাকিরা উদ্যোক্তাদের ব্যবস্থাপনায় দু তিনদিন ভাঙা প্যান্ডেলের এদিক সেদিক থেকে যেতেন৷ পুজো শেষের পরেও কমিটি থেকেই তাঁদের সারাদিনের খাবার ব্যবস্থা হয়েছে – এমন দেখেছি৷ মাঝে মাঝে গেরস্তের বাড়ির দাওয়ায় বাদ্যও বাজাতেন৷ আমার মা বলতেন -ও হল ঠাকুর জলে যাবার বাদ্য৷ আমি বলতাম – জলে গিয়ে ঠাকুর কি ঢকঢক জল খেয়ে মরে যাবে মা?
মা বলতেন – ডুবতে চাইলে ঢাকিকাকারা বাজনা বাজিয়ে দুগ্গাকে ঠিক পাহাড়ি বরের কোলে দিয়ে আসবে৷ তার নাম শিবচন্দ্র৷
সে ভোররাতে পায়খানা পেয়ে যাওয়া বুড়ো ঢাকিকে এতকথা বলা সঙ্গত মনে হল না৷ ভোরের বেগে দাঁড়াতে পারছে না৷ চুপচাপ সাতগাছির টয়লেট নির্দেশ করলাম৷ ঝটকা মেরে দৌড় দিল সেদিকে৷ বুড়ো দেহে জোরে পায়খানা পেলে হাঁটা খুব মুশকিল৷
সেই ভীষণ আলো মানুষটার মুখে৷ কেবল চোখের কোলদুটো কালো কালো লাগল৷ গরীবকে নজর কমিয়ে রাখতে হয়৷ তার বর্জ্য ফেলার জায়গা নির্দিষ্ট নয় – হয়ত খাবারও সারাবছরের নয়৷ তার চোখে লোভ ঝিকোলে চোখেরও ক্ষতি, লোভেরও বিপদ৷ তাই হয়ত চোখের গর্তদুটো ছোট হয়ে যায় গরীবের৷ ছোটতে ছটা পৌঁছয় না৷
তবু ঢাকির পদক্ষেপ বড় হচ্ছিল৷
গ্রহণের জন্য না হলেও ত্যাগের জন্য তো বটেই৷
আলো যেন কয় প্রকার ?
হরেক৷
আর আঁধার ?
নেই আকার৷
♦·♦–♦·♦♦·♦–♦·♦
ক্রমশ..
আগের পর্ব পড়ুন: পথ ভুবনের দিনলিপি । পর্ব ৭
❤ Support Us