Advertisement
  • কে | রি | য়া | র-ক্যা | ম্পা | স ধা | রা | বা | হি | ক
  • ডিসেম্বর ৩, ২০২৩

ধারাবাহিক আত্মকথা: আমাদের বিদ্যানিকেতন

জাকির হোছেন্
ধারাবাহিক আত্মকথা: আমাদের বিদ্যানিকেতন

আমিত্বহীনতার বৃত্তান্ত

 
কীভাবে, কোন পরিস্থিতিতে, সামাজিক অভিপ্রায়ক সঙ্গে নিয়ে, দূরশিক্ষা কর্মসূচি থেকে শুরু করে, পরপর বহু শিক্ষাঙ্গন গড়ে তুললেন ।এনইএফ এর স্থপতি, এবার তারই বিস্তৃত চেহারার বয়ান আর উৎসকথা শোনালেন ধারাবাহিক আত্মবৃত্তান্তের চলতি পর্বে ।
 
বিদ্যানিকেতনের বাড়ি তৈরির জন্য । এখন যেখানে তাঁদের আইন মহাবিদ্যালয় অবস্থিত । ঋণের আবেদন করেছিলেন ব্যাঙ্কে । বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিতে রাজি হননি ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ । তখনই সদাশয় ব্যাঙ্ক ম্যানেজার জয়দেব দাস তাঁর ব্যক্তিগত সঞ্চয় থেকে ১০ লাখ টাকা আমানত জুগিয়ে সরাসরি সাহায্য আর আশ্বাসে ভরে দিয়েছিলেন জাকির হোছেনকে । জাকির জয়দেব দাসকে ভোলেননি । কল্যানবোধের নিকটাত্মীয় শ্রী দাস এখনো তাঁর স্মৃতিসঙ্গী ।

 

সম্পাদক

৩/১২/২০২৩

 

• পর্ব-১৭ •

ভাবনাচিন্তা আর কাজের মধ্যে সাধারণত আমি ফারাক তৈরি হবার সুযোগ দিই না, সে যে-কোনো ব্যাপারেই হোক না কেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করে দিই, সঙ্কল্পকে তার স্বপথে নিয়ে যেতে থাকি, কাউকে কথা দিলে একইভাবে প্রতিশ্রুতিকে অব্যর্থ করে তোলবার প্রস্তুতিতে সাড়া দিই, বিনীতভাবে বলছি, এটা আমার স্বভাবধর্ম, এই স্বভাব যে-ভাবে অর্জিত, তেমনি জন্মগত, কৃষিজীবী জনপদের ত্যাগ আর তিতিক্ষা আমাকে শিক্ষা দিয়েছে যে, ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে মাঠে পড়ে থাকতে হয়। বীজতলায় গুঁটি ছাড়লেই চারা হবে না, সে চারাকে লালন করতে হয়, প্রয়োজনীয় সার, ওষুধ প্রয়োগ করা জরুরি। প্রাকৃতিক বিপর্যয় আসতে পারে, ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে ফসল–খোর পতঙ্গ, এসব মোকাবিলা করতে করতে যথাসময়ে কৃষকরা প্রত্যাশিত ফয়-ফসল ঘরে তোলেন। আমার মানব–চাষের হরেক ইচ্ছায়, কৃষকের ঘামের স্পর্শ আর তাঁদের আবহমান অভিজ্ঞতার ছায়া, উড়ন্ত পাখির ডানার মতো আমাকে ঋদ্ধ করছে।
 
নিজেকে কথা দিয়েছিলাম, চাকরি করব না, স্বাধীন সংগঠন গড়ে তুলে শিক্ষার বিস্তৃত জমি গড়ে তুলব। পুরোপুরি সফল কিংবা সাফল্যের গতি অপ্রতিরোধ্য এরকম দাবি করছি না। যা চেয়েছি, সব হয়ে গেছে, তা বলবার অধিকার নেই। চারপাশের মানুষ আমার কাজকর্ম, আমার গতিপথ, আমার অঙ্গীকারের প্রবাহ দেখছেন, তাঁরাই পূর্ণতা কিংবা অসম্পূর্ণতার সাচ্চা বিচারক। কালের ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়া আমি আমার ঘোষিত প্রকল্প দিয়ে সাজাতে চাইছি। ভয়শূন্য কৃষক অথবা যুদ্ধরত সৈনিকের মতো এক সময়কার পতিত জমিতে মানুষ গড়ার ক্যাম্পাস তৈরি করছি। গন্তব্য অনেক দূর, বহু পরিশ্রম অসমাপ্ত, সম্মুখে ঠেলে দিচ্ছে নৃত্যরত প্রত্যাশা। আমি এখানে নিছক অনুচ্চাকাঙ্ক্ষী কারিগর, সংগঠক সেবক মাত্র। অমর হয়ে থাকার অভিপ্রায় নেই। ইচ্ছের সারাংশ একটাই, উত্তর পূর্বাঞ্চলের এক শহর থেকে আরেক শহরে, গঞ্জ থেকে গঞ্জে, গ্রামে গ্রামে যুযোপযোগী শিক্ষা পৌঁছে দেওয়া। নিজেকে শুনিয়ে শুনিয়ে পরমাত্মার উদ্দেশে বলতে পারি— কোন্ আলোকে প্রাণের প্রদীপ ছুঁইয়ে দিলে প্রাণে।
 

৯৮ সালে, ঘাসিদাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন পেয়ে আমরা এনইএফ- এর আওতায় স্টাডি সেন্টার গড়ে তুললাম। সমাজের বৃহৎ অংশ, বিশেষ করে অনগ্রসর গ্রামীণ অভিভাবক ও পড়ুয়ারা ব্যাপক আলোড়িত বোধ করলেন, তাদের চাহিদার ভিড় বাড়ল

 
এরকম আগ্রহ বা অভিপ্রায় কীভাবে তৈরি হল, তার বাহ্যিক উৎসকথা, প্রেরিত আদর্শ এবং ভাবান্তরের প্রেক্ষাপট আগে কিছুটা বলেছি, নিজের বৃত্তান্ত বলতে অব্যস্ত নই বলে সবটা বলা হয়নি, এবার যতদূর সম্ভব আর শোভনীয় ততটুকু বলবার চেষ্টা করছি। আমার প্রচেষ্টায় যাঁরা সাড়া দিয়েছিলেন, নানাভাবে প্রেরণা যুগিয়ে, সাহস আর পরামর্শ দিয়েছেন, তাঁদের উদারতার গল্প বলা দরকার, না বলা অন্যায়। দ্বিতীয়, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একক আধিপত্যের পাশাপাশি, কোন্ অনুর্বর ভূমিতে, আমাদের প্রয়াস কীভাবে দানা বাঁধল, সে সব চিত্র জানানো জরুরি।
 
আমার প্রথম সন্তানের জন্মের (১৯৯৮) পর আমার কাজের পরিধি আর সাহস দুটোই বেড়ে গেল ? এটা কি কেবল ঘটনাক্রম ? না বাইরের ঘটনা প্রবাহ দেখে ভেতরের আমি নতুন প্রত্যাশা নিয়ে, সঙ্কল্প নিয়ে, ভাবাবেগ নিয়ে জেগে উঠলাম ? পেছনের সমস্ত অন্ধকার আর আলো-আঁধারি রহস্যকে দূরে সরিয়ে দিয়ে আমাকে প্রদীপ্ত করে তুলল। ক্ষণে ক্ষণে অনুভব করছি, দুহাতের সঙ্গে জড়ো হয়ে গেছে একশ হাত, হাজার হাত। বাড়ছে প্রভূত দায়িত্ব। একে একে স্বপ্নের তরজমা আরম্ভ হল। ওই ৯৮ সালে, ঘাসিদাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন পেয়ে আমরা এনইএফ- এর আওতায় স্টাডি সেন্টার গড়ে তুললাম। সমাজের বৃহৎ অংশ, বিশেষ করে অনগ্রসর গ্রামীণ অভিভাবক ও পড়ুয়ারা ব্যাপক আলোড়িত বোধ করলেন, তাদের চাহিদার ভিড় বাড়ল। এতদিন ভাড়া বাড়িতে পঠন – পাঠন চলত। স্থানাভাবে সব আগ্রহী ছাত্রকে সুযোগ দেওয়া সম্ভব হত না। আমাদের প্রতিষ্ঠান তখন অনেকটাই স্বনির্ভর। আয়-ব্যায়ের তফাত কমছে। এনইএফের আয়ে গুয়াহাটির ভাঙ্গাগড়ে ৮ লাখ টাকার বিনিময়ে এক টুকরো জমি কিনলাম। পরে ঋণ নিয়ে বাড়ি তৈরি শুরু হল, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। বাড়িটি আমাদের আয় আর স্বাবলম্বনকে চওড়া করল। বুঝতে পারলাম, ভুল পথে ছুটছি না। আদর্শ আর লক্ষ্য থেকেও বিচ্যুত নই। সঙ্কল্প নিজ পথে এগোচ্ছে।
 
ভাঙ্গাগড়ের ওই বাড়ির একাংশে ক্লাস ও অফিসিয়াল কাজকর্ম চলত। অন্য অংশ ভাড়া দিয়ে সঞ্চয় বাড়ানো হল। এসব উত্তরণ নাটকীয় না হলেও ভাষাকে মিলনাত্মক নাটকের খোরাক জোগাল।
 
পরে গুয়াহাটির খ্রিস্টানবস্তিতে আরেকটা জমির খোঁজ মিলল। কেনার টাকা সংগ্রহ হয়ে গেল। এখনকার মতো নয়, তবে তখনকার পরিস্বিতিতে উন্নত এলাকা। কোনো একসময়, সম্ভবত ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানরা বসবাস করতেন, তাই খ্রিস্টানবস্তি বলে সুপরিচিত। পানবাজার, ফাঁসিবাজার আর দিসপুরের মধ্যবর্তী এলাকা। দ্রুত চেহারা পাল্টাচ্ছে। বাড়িঘর উঠছে। বাইরের লোকদের আনাগোনা বাড়ছে। এরকম জমি খালি রাখা উচিত নয়, স্বপ্নসম্ভব বাড়ি নির্মাণ শুরু করতে হবে। কিন্তু টাকা কোথায়? যৎসামান্য সঞ্চয় জমি কিনতে গিয়ে ফুরিয়ে গেল। শিক্ষাঙ্গন চালানোর খরচ ঊর্দ্ধগামী। খরচের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্রমাগত আমাদের স্বপ্নের আয়তন বিস্তৃতির ঝুঁকি নিচ্ছে। বাড়ি তৈরির ঋণের জন্য ব্যাঙ্কে আবেদন করলাম। ব্যাঙ্ক বেঁকে বসল, প্রশ্ন তুলল, কোলেটারেল সিকিউরিটি কোথায় ? অর্থ ফেরত দেওয়ার দায় কে নেবে ?  যেহেতু এনইএফ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান নয়, শুধু এডুকেশনাল সোসাইটি বলে নথিভূক্ত, সে কারণে ব্যাঙ্ক ঋণের আবেদন খারিজ করে দিল।
 

গম্ভীর সঙ্কট। চারদিকে ঘনঘটা। আগেই বাড়ি তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেছে। ব্যক্তিগত ধার নিয়ে – ইট – বালু – সিমেন্টের, মিস্ত্রিদের পাওনা মেটাতে হচ্ছে। ভরসা ছিল, আমাদের ত্যাগ আর গ্রোথ খতিয়ে দেখে ব্যঙ্ক সরাসরি ‘না’ বলবে না। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ক যখন মূলপ্রস্তাব নাকচ করে দিল, তখন এক ধরনের হতাশা গ্রাস করল। ফাঁক পেয়ে ঘুম উধাও। পরিবার ছাড়া পাশে কেউ নেই। বন্ধুরা সরে গেল, তবু আমি না- ছোড়, স্বপ্ন দেখার বিরতি নেই। এঁর – ওঁর কাছে ধারা চাইছি, সবাই হাতগুটিয়ে নিচ্ছেন, রিকস নিতে রাজি নয়, ভাবছেন ধরে দিলে হয়তো ফেরত দেব না, আমি যে ঝুঁকিপ্রবণ, কথার খেলাপ করি না কখনো, অনেকেই এরকম সদভাবনাকে, পজিটিভিটিকে আমল দিলেন না, আমিও গোঁ ধরে ছুটছি, আমার ছুটন্ত গতি আর জেদ দেখে তাৎক্ষণিকের অন্ধকার বিনাশে এগিয়ে এলেন একজন সদাশয়। ব্যাঙ্ক ম্যানেজার জয়দেব দাস। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত পুঁজি থেকে ১০ লাখ টাকা বিনা শর্তে ঋণ দিতে স্বতঃস্ফুর্ত আগ্রহ প্রকাশ করলেন। অফুরন্ত উৎসাহ আর ভাবাবেগে আমি আপ্লুত। কাজ পুরোদমে এগোচ্ছে।  ২০০৬ সালে খ্রিস্টানবস্তির শিক্ষাভবনের দুটি ফ্লোর সম্পূর্ণ হয়ে গেল। একটি ফ্লোরে এনইএফ আইন মহাবিদ্যালয়, অন্য ফ্লোরকে ঘিরে সব ধরনের বিধি মেনে বহুমুখী শিক্ষাসূচি দ্রুত ভিন্নতর বাঁক নিল।
 

দুর্দিনে যদি হতাশায় থমকে যেতাম, যদি বড়ো অঙ্কের ব্যক্তিগত ঋণ না মিলত, তা হলে কি এনইএফ এখনকার চেহারায় উপনীত হতে পারত? আমি আমার ছেলেমেয়েকে, ছাত্র-ছাত্রীদেরও বলি, কখনো থামবে না, থামতে নেই, নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করো, এগোয়, এগোতে থাকে, তোমাদের অগ্রসরমুখী পা দেখে আরো, শত শত পদক্ষেপ পাশে এসে সমবেত হয়ে বলবে, চরৈবেতি।
 
জয়দেব দাসের কাছে আমি কৃতজ্ঞ, তিনি আমার নির্ণীয়মান ভুবনডাঙ্গা দেখতে পেয়েছেন। প্রেরণা জুগিয়েছেন। শুধু যে ঋণদান করে, তা অবশ্যই নয়। পরামর্শ দিয়ে, সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, কখনো সম্মুখে, কখনো পাশে, কখনো আড়ালের নেপথ্য নায়কের মতো স্বেচ্ছা প্রণোদিত বিনয় আর দুঃসাহসকে সঙ্গে নিয়ে। আমার জয়-পরাজয়ের সঙ্গে জয়দেব মহোদয়ের বিজয়গাঁথা আশা করি, কখনো অলিখিত; অব্যক্ত থাকবে না, বেসরকারি শিক্ষাঙ্গন গড়ার সামাজিক ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে, লিখবে তাঁর বন্ধুসুলভ সহমর্মিতার কাহিনী, যা গল্প নয়, বানিয়ে তোলা সত্য নয়, সত্যের মতো আপোসহীন বিশ্বাসে যাঁর আস্থা এক অতি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।
 

ক্রমশ…

♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦

 

লেখক: উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রথম বেসরকারি কলেজ গোষ্ঠী এন.ই.এফ-এর চেয়ারম্যান। গুয়াহাটির বাসিন্দা

 
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ১৬

ধারাবাহিক আত্মকথা: আমাদের বিদ্যানিকেতন


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!