- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৪
ধারাবাহিক: পাহাড়িয়া পথে পথে। পর্ব ১১
পাথরে হাঁটু ফুটিয়ে, ডালপালার চড় থাপ্পড় খেয়ে, কাঁটার প্রেম সহ্য করে হাতড়ে হাতড়ে যখন সোকা ক্যাম্পে পৌঁছালাম ঘড়ির কাঁটায় রাত আটটা, উষ্ণতা হিমাঙ্কের কাছাকাছি....তারপর
অলঙ্করণ: দেব সরকার
ভুবন পাহাড় আর গিরিশৃঙ্গের প্রতি তাঁর দুর্ভেদ্য আকর্ষণ উৎসবমুখর করে তোলে ভূগোলের বিদ্যাযাপন । পেশা আর নেশা যখন একাকার হয়ে ওঠে, তখনই তাঁর অনুভূতিকে অন্যভাবে জাগিয়ে তোলে— ‘শেষের কবিতার’ শোভনলালের পাহাড়ের পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর বেহিসেবিয়ানা । গন্তব্য জগতের এক শৃঙ্গ থেকে আরেক শৃঙ্গ
♦ পর্ব ১১ ♦
চোখের চাহনির অভিনিবেশে যাহাকে ক্ষণিক মাত্র দর্শনে মহাসমুদ্র বলিয়া বিভ্রম উদ্বেলিত হয়। গিরি পর্বতের সহিত সোহাগে আদরে ঢলিয়া পড়িয়া নীরদপুঞ্জের প্রেম সংরাগে ঢেউয়ের এইরূপ উত্থান পতন দেখিয়া চোখের পলক পড়িবার স্বাভাবিক অভ্যাস হারাইয়া যায়। মহাশূন্যের এই ত্রিসীমানায় হিমালয় পর্বতের নিগুঢ় অন্তরালে পৃথিবীকে মহাপ্লাবণের উচ্ছ্বাসে ভাসাইয়া এইরূপ চরাচর বিস্তৃত অতলান্তিক মহাসমুদ্র কোথা হইতে আসিল ?
২১ তারিখের এই ভোর পাঁচটায় বাইরে সহযাত্রীদের কিচিরমিচির শুনে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে টেন্টের বাইরে বেরিয়ে আকাশের বুকে এমন অকৃত্রিম সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি ঘুম আমার এখনো ভাঙেনি। এ-যেন ঘুমের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে গভীর স্বপ্নের মতো কেউ জাদু বাস্তবতা ছড়িয়ে দিয়েছে শরৎচন্দ্রের প্রেমের উপন্যাসের অলৌকিক বর্ণনায়। সপ্তর্ষি অর্পণ অতীন’দা ক্যামেরায় চোখ গুঁজে ‘ক্রনিকেলস অফ্ নার্নিয়া’র মতো হারিয়ে গেছে সময়ের অন্য কোন পাতায় অন্য কোন দেশে। ব্রতীন’দা, রথীন’দা মহাভারতে সঞ্জয়ের মতো মোবাইলের ওপারে তার ধৃতরাষ্ট্ররূপী প্রিয়জনদের বর্ণনা শোনাচ্ছে মহাবিশ্বের এই অপার্থিব সৌন্দর্য সমারোহ।
এই ট্রেক রুটের একমাত্র সোকা ক্যাম্প থেকেই প্রথমবার পান্ডিম পর্বতের বহু প্রতীক্ষিত সাক্ষাৎ পাওয়া সম্ভব। বিস্তৃত সমতল একটি মাঠের উপর হরেক রকমের রঙিন তাঁবু প্রজাপতির মতো বসে আছে পথিকের স্বপ্নের উড়ান সাজিয়ে। সকলেই একমত, এখানে এসে প্রথমবার একটু শান্তিতে ঘুমানো গেলো। কাঠের তৈরি সুন্দর ছোট ছোট বাড়ির মধ্যে পিট টয়লেটের ব্যবস্থা বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। সোকার এই ২৯০০ মিটার উচ্চতায় হাত মুখ ধোবার জল এতই ঠান্ডা যেন মুহূর্তে দাঁত খসে পড়বে। সারারাত হিম পড়ে পড়ে মাটির কাছাকাছি ঘাস গুল্ম পাতার উপর মাইনাস ডিগ্রি ঠান্ডায় ফুটে উঠেছে তুষার শুভ্রতা। দূর থেকে দেখে মনে হয় মাঠের উপর কেউ যেন সাবুর দানা ছড়িয়ে দিয়েছে।
সামনে একটি চোর্তেন পাশ কাটিয়ে পথের বাঁক ঘুরতেই চোখে পড়ল সুবিশাল সোকা পোখরি এবং তার পাড়েই একটি বৌদ্ধ গুম্ফা। জলাশয়ের মোট আয়তনের তুলনায় জল অনেক কমে এসেছে। লেকের মাঝখানে চারটি ছোট ছোট দ্বীপ ভেসে আছে যেন কোন বৌদ্ধ লামার ধ্যানমগ্ন হবার অপেক্ষায়। অসংখ্য বৌদ্ধ পতাকার ঘেরাটোপ জলাশয়টির পবিত্রতা জানান দিয়ে হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে উপরে আরও উপরে
সোকা একটি ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম। মাত্র কয়েক ঘর কৃষিজীবী পরিবারের বাস। সিকিমের প্রাচীন প্রথায় তৈরি সেকেলে ধরনের কাঠের বাড়ি। মলিন এবং খসে পড়া পেরেকের চেহারায় দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। ইয়াক চরে বেড়াচ্ছে নিজের মনে ঘাসে ঘাসে। তিন দিক থেকে নেমে আসা পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে কেটে কিছু সবজি এবং আনাজের চাষ। এই করুণ গ্রামীণ চিত্র থেকে শহরের পথে পালিয়ে গিয়ে কিছু মানুষ বেঁচেছে জীবনে মুক্তির আনন্দে। আবার অন্যদিকে শহর থেকে দু’দিনের জন্য পালিয়ে এসে ভাবছি আমরা বেঁচে গেছি। মুক্তির খোঁজে জীবনের কি আশ্চর্য্য পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, আহা!
আমাদের আজকের গন্তব্য ফেডং এবং দেওরালী টপ পেরিয়ে জংরী ক্যাম্প। উচ্চতা ১৩০২৪ ফুট। পথের দূরত্ব ১০ কিলোমিটার। অর্থাৎ বুকের কাছে চড়াই। সকাল ন’টায় রওনা দিতেই চড়চড়ে রোদ উঠেছে মাথার উপর। হাঁটতে হাঁটতে গায়ে গরম কাপড় রাখা দায়। একটু ধীর গতিতেই গাইডের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছি আমরা। পিঠের বোঝা পুনরায় তুলে নিয়ে আমাদের পাশ কাটিয়ে ইয়াক, মিউলগুলো উঠে গেল লম্বা সফরে। সামনে একটি চোর্তেন পাশ কাটিয়ে পথের বাঁক ঘুরতেই চোখে পড়ল সুবিশাল সোকা পোখরি এবং তার পাড়েই একটি বৌদ্ধ গুম্ফা। জলাশয়ের মোট আয়তনের তুলনায় জল অনেক কমে এসেছে। লেকের মাঝখানে চারটি ছোট ছোট দ্বীপ ভেসে আছে যেন কোন বৌদ্ধ লামার ধ্যানমগ্ন হবার অপেক্ষায়। অসংখ্য বৌদ্ধ পতাকার ঘেরাটোপ জলাশয়টির পবিত্রতা জানান দিয়ে হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে উপরে আরও উপরে। সময়ের অভাবে ফেরার পথে গুম্ফায় প্রবেশের মনস্কামনা তুলে রেখে আমরা ধরলাম ফেডং-এর রাস্তা। সংকীর্ণ জলবিভাজিকার দুই প্রান্তে বইছে রাথং-চু এবং প্রেক-চু নদী। সোকা ছাড়িয়ে একটু উপরে উঠতেই পাল্টে গেছে স্বাভাবিক উদ্ভিদের চরিত্র। পাহাড়ের উপরে কম বৃষ্টিপাতের কারণে নিচে সাচেন জঙ্গলের তুলনায় এখানে পাইন জঙ্গল অনেক বেশি সরলবর্গীয়। আকাশের গায়ে পাইন ডালপালার বিস্তার যেন অলৌকিক আলপনার আঁকিবুঁকি। জঙ্গলের দুটি স্তর এখানে খুব স্পষ্ট। আকাশের কাছাকাছি রয়েছে পাইনের সাম্রাজ্য এবং মাটির কাছাকাছি শুধুই রডোডেনড্রনের রাজত্ব। জ্বালানির চাহিদায় স্থানীয়রা কেটে নিয়ে গেছে পাইনের বড় বড় গদি। অবশিষ্ট সেই গাছের গোঁড়ায় শ্যাওলার উদ্ভিদজন্ম যেন সার্থক হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয়ে এই যে মৃত গাছের গদি পরবর্তী প্রজন্মকে খাদ্য সরবরাহ করে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে। পাইন গাছের গোঁড়ার অবশিষ্ঠে প্রতিপালিত হয়ে নিষেকের ফলে জন্মেছে একটি দীর্ঘ রডোডেনড্রন গাছ। এও সম্ভব? প্রকৃতির কী অসীম লীলা !
প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেহেতু কেটে গেছে, মালবাহক এবং পাহাড় কর্মীদের মধ্যে উৎসাহ বেড়েছে দ্বিগুণ। তারা খুব দ্রুত পায়ে উপরে উঠছে, কেউ আবার দৌড়ে নেমে আসছে ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে। রুটের এই অংশে পাথরে বাঁধানো পথ শেষ হলে গাছের ডাল কেটে কেটে বানানো হয়েছে রাস্তা, তাই হাঁটা তুলনামূলকভাবে সহজ। জায়গায় জায়গায় মাটি ক্ষয়ে গিয়ে রাস্তা প্রায় এক মানুষ গভীর এবং গিরিখাতের মতো সংকীর্ণ। তখন রডোডেনড্রন গাছগুলি মাথার উপর ছায়া জোগায় চাঁদোয়ার মতো। পাইন এবং রডোডেনড্রন যেভাবে একে অপরের সঙ্গে কানে কপালে জড়িয়ে মড়িয়ে আছে পারস্পরিক বোঝাপড়ায়, তাতে এই জঙ্গলের নাম ‘পাইনড্রন’ রাখলে অত্যুক্তি হবার নয়। বয়স্ক অগ্রজদের মতো নবীন রডোডেনড্রনকে জীবনের পথে এগিয়ে দেবার কাজ নীরবে করে যাচ্ছে পাইন গাছ। শ্যাওলার আধিপত্যে ক্ষয়রোগে নাজেহাল বয়স্ক পাইনের গায়ে হাত রেখে এ-অনুভূতি নেহাতই আমার ব্যক্তিগত।
‘ক্রনিকেলস অফ্ নার্নিয়া’র কথা হচ্ছিল। এখন আমার নিজেরই মনে হচ্ছে আলমারির ভেতর খেলতে খেলতে নিজেকে হারিয়ে কোন এক বিভ্রমের পথে এসে পড়েছি সময়ের অন্য কোন অধ্যায়ে, মহাবিশ্বের অন্য কোন গ্রহে। যেখানে সৌন্দর্য একটি অবাস্তব অনুভূতি, বনভূমি একটি পুরাতত্ত্বের জাদুঘর, ইকোসিস্টেম একটি মিথোজিবি উপন্যাস, আর সবুজ যেন রামধনু থেকে চুরি করে আনা। জীবনে শেষবারের মতো ভেঙে পড়বার আগে পাইনের ভঙ্গুর শাখা-প্রশাখায় যে ‘আর্ট ফর্ম’ জেগে উঠেছে স্বচক্ষে না দেখলে শুধুমাত্র লিখিত বর্ণনায় ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব।
কাঠের সিঁড়ি ভাঙার মতো পথ ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে চলেছি অজানার পথে। গাইড এবং দলের সদস্যরা কে কোথায় আছে আমার জানা নেই। বিপর্যয় এখানেও কম হয়নি। উল্টানো গাছ, রাস্তা আটকানো বোল্ডার, পাথরের বড়ো বড়ো চাঁই জানান দিচ্ছে পরিস্থিতির ভয়াবহতা। নির্জন এই রাস্তায় আশার আলো সাজিয়ে কেউ ঝুলিয়ে রেখেছে বৌদ্ধ পতাকার বিশ্বাস। রাস্তায় বোল্ডারের যা পরিস্থিতি তাতে চিমনি ক্লাইম্ব টেকনিক ব্যবহার প্রয়োজন পড়তে পারে হয়তো। গ্যালিভারের মতো বড় বড় গাছ লিলিপুটের মতো টপকে চলেছি অবলীলায়। চারপেয়ে মালবাহকদের পথ আলাদা, তাই নির্জন এই পথে ইয়াকের ঘন্টা ধ্বনি নেই, মিউলের খুরের শব্দ নেই। বেলা এগারোটা বাজতেই মেঘ নেমে আসে মাটির কাছাকাছি। কুয়াশাময় এই নিঃশব্দ কল্পলোকে পাইন গাছ দাঁড়িয়ে আছে ভূতের মতো। গাছের টুকরো গদি মাটিতে পড়ে আছে যেন জলজ্যান্ত কুমির। মচকানো গাছ দাঁড়িয়ে আছে অসমাপ্ত স্মৃতিসৌধের মতো। চিত্রনাট্যের এমন একটি দৃশ্যে পরিচালক অব্যর্থভাবে ক্রু মেম্বারদের ডেকে এখানে একটি সাদামাটা আরামকেদারা রাখতে বলবেন। সেখানে নায়ক এসে বসবেন ক্লান্ত পায়ে হেঁটে। জাত অভিনেতার মতো তাকাবেন লাইট এবং ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল বুঝে। এই বিরল কাব্যময় মুহূর্তে দেবী সরস্বতী আসবেন অথবা আসবেন না চিত্রনাট্যে সে কথা পরিষ্কার বলা নেই। কিন্তু সুনীল গাঙ্গুলী তার ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ উপন্যাসে পরিষ্কার লিখছেন — “বনের মধ্যে ঢুকেই অন্য রকম লাগলো। স্পষ্ট বোঝা যায়, এটা আলাদা জগৎ। বনের ভিতরটা সব সময় নিঃশব্দ। আসলে অনেক রকম শব্দ আছে, কিচকিচে পাখির ডাক, হাওয়ার শো শোঁ, লুকানো কাঠবিড়ালির চিড়িক চিড়িক, ঝিঝির কোরাস, শুকনো পাতার খরখর, দূরে কোথাও কাঠ কাটার একঘেয়ে শব্দও ভেসে আসছে। তবু মনে হয় অরণ্য নিস্তব্ধ। ওসব শব্দ নিস্তব্ধতারই অলঙ্কার। জঙ্গলে ঢুকলে সত্যিকারের একটা বিশাল জিনিসকে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা হয়।”
অনেকটা হেঁটে আসার পর পাথরের দেওয়ালের গায়ে একটা রেস্ট পয়েন্ট। অনেকেই একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন এখানে। একে ‘ক্লাউড কলোনী’ ভেবে তর্ক করা যেতে পারে। নিখাদ আড্ডার ‘বসন্ত কেবিন’ অথবা ‘কফি হাউস’ মনে হতে পারে কিন্তু চা অথবা কফির কোন আয়োজন নেই। গাছের গদির চেয়ার এবং পাথরের টেবিল এখানে সাজানো আছে বহু কোটি বছর ধরে। একটু বিশ্রাম এবং শুকনো গলায় কয়েক ঢোক জল খেয়ে আবার চড়াই ভাঙা শুরু।
কুয়াশাকে আমি দোষ দিই না। প্রখর তেজের বেলা এগারোটাকে সে ঢেকে দিতে পারে ভোরের প্রথম আলো ফুটবার হিমেল পরশের নরম স্নিগ্ধতায়। আমরা আজ তার বাড়িতে অতিথি। আদরে আপ্যায়নে সে ভুলিয়ে দিতে পারে আমাদের পথের ক্লান্তি। এই প্রথম দেখলাম একটি দল নেমে আসছে অভিযান শেষে। তাদের সাথে সৌজন্য বিনিময় সেরে কিছু কথা হলো পাহাড়ের উপরের পরিস্থিতি নিয়ে। ওদের মতে ফেডং (১২০৮৩ ফুট) সামান্য দূরেই।
এই বৃষ্টির প্রশ্রয়ে শ্যাওলার সাম্রাজ্য যেন পাথর মাটি গাছপালা সবকিছু গোগ্রাসে গিলে ফেলছে পরজীবীর সন্ত্রাসে। কিন্তু আমি এই সন্ত্রাসের গায়ে শিল্প খুঁজছি। নানান অবয়বে তারা কখনো একটি সুবিশাল ম্যামথ, কোথাও মেলে আছে ময়ূরের মত পেখম, কোথাও মাথা তুলে বসে আছে চারপেয়ে ওরাং ওটাং। প্রকৃতির এই আশ্চর্য খেলাঘরে আমার মনন সেজে উঠছে নানান আজগুবি কল্পনায়।
ভূগোলের বইয়ে এক ধরনের জলাভূমির কথা পড়েছিলাম যার সাহেবি নাম বোগ (Bog)। আজ প্রথম স্বচক্ষে দেখলাম। জঙ্গলের মধ্যেই নিচু অথচ প্রায় সমতল জায়গায় আগাছা এবং জল জমে তৈরি হয়েছে এই জলাশয়। এর মধ্যে দিয়েই এঁকেবেঁকে উঁচু কাঠের পাঠাতন বিছিয়ে সুন্দর রাস্তা চলে গেছে লাক্ষাদ্বীপের সমুদ্র সৈকতের মতো। রাস্তা শেষ হতেই দেখি একদল স্থানীয় ছোকরা মালবাহক গঞ্জিকা সেবনে ব্যস্ত। আমাকে দেখে তাদের অদ্ভুত খিলখিলিয়ে হাসি। অবশেষে বেলা বারোটা নাগাদ যখন ফেডংয়ের ত্রস্ত বুগিয়ালে পৌঁছালাম ঘন কুয়াশার চাদর তার গলা টিপে ধরেছে। এমন চাপানউতোরে সামান্য সুযোগ পেতেই সেও মেঘকে উড়িয়ে দিল এক ফুঁয়ে! পৌঁছে আবিষ্কার করলাম গাইড এবং আমি ছাড়া দলের বাকিরা এখনো অনেক নিচে। একটি মাত্র অস্থায়ী দোকানে লাঞ্চের ব্যবস্থা। সময় প্রায় এক ঘন্টা অতিক্রান্ত। বিভিন্ন দলের যাত্রীরা এলো বসলো খেলো আড্ডা দিলো আবার চলেও গেল গন্তব্যের পথে কিন্তু আমাদের সদস্যদের দেখা নেই। গায়ে আমার ফিনফিনে পাতলা টি শার্ট। ঠকঠক করে কাঁপছি ঠান্ডায়। নিরুপায় বসে না থেকে অ্যাকলিমাটাইজেশন হয়ে যাবে এই ভেবে আবার নামতে শুরু করলাম ওদের খোঁজে। অনেকটা নেমে আবিষ্কার করলাম ব্রতীন’দার অভিনব চায়ের দোকানে চা খেয়ে ওরা গুটিগুটি পায়ে উঠে আসছে। বেলা দুটো নাগাদ শেষতম দল হিসেবে আমরা জংরীর পথে রওনা দিলাম।
ধূসর ছাইরঙা জলদ মেঘ পেরিয়ে ছোট্ট গোলকের ভেতর বরফের হিমবাহ। গাইড বললো ওটাই কাঞ্চনজঙ্ঘার দেওয়াল। শুনেই এক্কেবারে বোবা বনে গেলাম! পায়ের তলায় মাটি যেন কেঁপে উঠলো। চোখের পলক ফেলতেই ভুলে গেলাম। ওই দেওয়ালে কেউ হেঁটে গেলে যেন স্পষ্ট দেখা যাবে, কাঞ্চনজঙ্ঘা আমাদের এতোটাই কাছে! এমন নৈসর্গিক দৃশ্য আমি জীবনে কোনদিন দেখিনি
জঙ্গল প্রায় শেষ । স্বাভাবিক উদ্ভিদ বদলে গেছে কাঁটা এবং গুল্মের বৈচিত্র্যে। মাটির রং ধূসর এবং ছাই বর্ণের। ইতি-উতি ছড়ানো সাদা সাদা বোল্ডার। ভূমিক্ষয়ের ধরন দেখলেই বোঝা যায় প্রচন্ড বৃষ্টিতে এখানে হড়পা বান আসে হামেশাই। প্রায় দু’ঘণ্টা কঠিন পরিশ্রম পেরিয়ে দেউরালি টপ পৌঁছালাম তখন বেলা চারটে। এখানেও কুয়াশার বিরতি নেই। জায়গাটিতে অসংখ্য বৌদ্ধ পতাকার মিছিল কেউ যেন সাজিয়ে রেখেছে থরে ধরে। গাইডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গোটা দল যখন এক জায়গাতেই আছে অপেক্ষায় সময় নষ্ট করে আর লাভ নেই। এখানেও দেখা মিললো তুলনায় পরিচ্ছন্ন সেই বোগ জলাভূমি।
হটাৎ সিনেমার নায়কের এন্ট্রির মতো মেঘের চাদর ভেদ করে একটা সাদা গোলক ভেসে উঠলো উত্তর-পূর্ব আকাশে। প্রথমে ওটাকে সূর্য ভেবে যে-কারোর ভুল হওয়া স্বাভাবিক। আর একটু পরিষ্কার হতেই দেখে মনে হচ্ছে দূরবীন যন্ত্রের অবজেক্ট ভিউ পয়েন্টে জুম করা কোন দৃশ্য ধরা পড়েছে। ধূসর ছাইরঙা জলদ মেঘ পেরিয়ে ছোট্ট গোলকের ভেতর বরফের হিমবাহ। গাইড বললো ওটাই কাঞ্চনজঙ্ঘার দেওয়াল। শুনেই এক্কেবারে বোবা বনে গেলাম! পায়ের তলায় মাটি যেন কেঁপে উঠলো। চোখের পলক ফেলতেই ভুলে গেলাম। ওই দেওয়ালে কেউ হেঁটে গেলে যেন স্পষ্ট দেখা যাবে, কাঞ্চনজঙ্ঘা আমাদের এতোটাই কাছে! এমন নৈসর্গিক দৃশ্য আমি জীবনে কোনদিন দেখিনি। উৎরাই পথে অনেকটা নিচে নেমে গোলাকার বাটির মতো উপত্যকায় একটি জলাশয়কে ঘিরে পুনরায় রডোডেনড্রন জঙ্গল ফিরে এলো। জলাশয়ের পাড়ে পাড়ে কেউ যেনো অলিভ রঙের শুকনো মরা ঘাসের মখমলে গালিচা পেতে রেখেছে। মেঘ পুরোপুরি কাটতেই জলাশয়ের স্বচ্ছ জলে ফুটে উঠলো কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ সৌন্দর্য। মনে হলো ধন্য এ-জীবন!
অবশেষে বেলা পাঁচটা নাগাদ যখন জংরী ক্যাম্পে পৌঁছলাম হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সারাদিনে প্রায় আট ঘণ্টা হেঁটে দশ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে উঠে এলাম ৪২০০মিটার উচ্চতায়। এখান থেকে রাস্তা দুদিকে ভাগ হয়ে গেছে। বাঁদিকে আরও দশ কিলোমিটার এগিয়ে রাস্তা শেষ হয়েছে ‘হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট’-এর বেস ক্যাম্পে। উচ্চতা ৪৫৭২ মিটার। এখান থেকেই HMI-এর যাবতীয় পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণ পরিচালিত হয়। আমাদের গন্তব্য ডান দিকের রাস্তা ধরে। এই রাস্তা সোজা চলে গেছে সমিতি লেক পেরিয়ে গোচেলার পথে।
সন্ধ্যার আড্ডায় পপকর্ন এবং কফি হাতে প্রায় গুঁতোগুঁতি করে আমরা সবাই ঢুকে পড়লাম একই টেন্টের ভেতর। স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে কোমর অব্দি সেঁধিয়ে ঠান্ডাকে যতসামান্য আয়ত্ত করবার চেষ্টায়। স্বাভাবিকভাবেই সেই স্পর্শকাতর বিষয়টি আলোচনায় উঠে এলো। কে ঠিক কে ভুল ? বিষয়টা খানিক তর্কের দিকেই এগোচ্ছিল। আমি মূলত চুপ করেই ছিলাম। সপ্তর্ষি গ্রামপ্রধানের মতো পরিণত মানসিকতার পরিচয় দিয়ে একেবারে হাসি ঠাট্টার ছলে জটিল বিষয়ের বাষ্প যেভাবে তার যুক্তির বাহুল্যে সহজ করে দিলে, কারোর আর কিছু বলার রইলো না। অনেক রাত পর্যন্ত চেষ্টা করেও আমরা আমাদের এই দলটির একটি সুযোগ্য নামকরণ করে উঠতে পারলাম না।
টেন্টের চেন টেনে গাইড এসে বলে গেল জংরী টপের উদ্দেশ্যে আমরা রওনা দেবো ভোর চারটে নাগাদ। আমরা সেই মতো মানসিক প্রস্তুতি নিলাম। খাওয়া দাওয়া সেরে তখন অনেক রাত। কলকাতার বদভ্যাস এত দ্রুত বদলে তাড়াতাড়ি ঘুম আসতে চায় না। টেন্টের বাইরে একা একা পায়চারি করছি। ওদিকে কেউ গো-প্রো বসিয়ে ব্রহ্মাণ্ডের গতিবিধি মাপছে। ঝোড়ো ঠান্ডা বাতাসের শনশন আওয়াজ কানে বাজে। বাকি সব নিস্তব্ধ। এই মুহুর্তে রবীন্দ্রনাথের গানই আমার প্রিয়তম আশ্রয়। মনে হলো গ্রামের বাড়িতে এসেছি। এমন পরিচ্ছন্ন নির্মল মেঘমুক্ত রাতের আকাশ বহুদিন মনকে উদাস করেনি। খোলা আকাশের নিচে রঙিন টেন্টের ভেতর টর্চের আলো জ্বললে বাইরে থেকে দেখে মনে হয়, মানুষের এই একটি মাত্র অমূল্য জীবনে মৃত্যু কেনো এতো মহার্ঘ্য। তারাদের এতো কাছাকাছি চলে এসেছি মনে হয় হাত বাড়িয়ে আকাশ থেকে পেড়ে আনি নক্ষত্রের বিরল লকেট। কালপুরুষের গলায় পরিয়ে দিই সপ্তর্ষিমণ্ডলের সাতনরী বিজয়মালা। আকাশগঙ্গায় ভেসে বেড়াই নক্ষত্রপুঞ্জের ভেলায় চেপে।
❤ Support Us