- গ | ল্প
- ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২২
ছাই চাপা আগুন
পুড়ে যাওয়া এই কাঠের প্রতিটি অংশ আমার অতীত স্মৃতি বহন করে। আমার মেয়ের হাসির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। এই কাঠটা দেখতে পাচ্ছ? এই কাঠে আমাদের পরিবারের হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের গায়ের গন্ধ জড়িয়ে আছে। আমার পুরনো বাড়ির স্মৃতি গন্ধ মিশে আছে ওই কাঠের টুকরোয়।
চিত্র : দেব সরকার ।
আফগান গল্পকার কাদের মুরাদির জন্ম ৫-ই জুন, ১৯৫৮ সালে । আশি ও নব্বই দশকের প্রথমদিকে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন । আফগান নিউজ এজেন্সিতে কাজ করার সময় আফগানিস্তানে প্রথমে মুজাহিদিন এবং পরে তালিবানদের ক্ষমতামত্ত বর্বরতা, স্বৈরাচার, সাধারণের ওপর দমন পীড়নের নানা ঘটনা সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছেন। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত আফগানিস্থান, অসহায় নারী ও শিশুদের জীবন, সামাজিক ও মানসিক ব্যাধি পরে গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছে তাঁর । ১৯৯১ কাবুলে তাঁর প্রথম গল্প সংকলন প্রকাশ পায় । এপর্যন্ত দুটি উপন্যাস ও এক শতাধিক ছোট গল্প রচনা করেছেন তিনি । দাড়ি ভাষার এই লেখকের বর্তমান গল্পটি (A voice from the ashes) ইংরেজি তে তর্জমা করেছেন দাউদ রজায়ি ।
কাদের মুরাদি
যেদিকেই আমি তাকাই না কেন সেই মানুষটার চোখ আমার মুখের সামনে ভেসে ওঠে। রাস্তায় হোক আর বাজারে সব জায়গায় সে যেন আমাকে অনুসরণ করছে। যখনই পথচলতি কারো ওপর চোখ পড়ে আমি তাকেই খুঁজতে শুরু করি যে মানুষটা কাঠের ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটছে ,হাঁটুর নিচ থেকে কাটা পা, পরনে সাদা রংয়ের নোংরা কাপড় যেটাতে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ আর মাথায় পাগড়ি জড়ানো।
এই অদ্ভূত, ভয় জাগানো মানুষটা কখনোই আমাকে ছেড়ে যায় না, এমনকি ঘুমের মধ্যেও। সব সময় সে আমার পিছু পিছু হাঁটে । আমি তাকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলেও পারি না। সব জায়গায় সে আমার সঙ্গে থাকে, কানে কানে কী যেন বলে চলে সারাক্ষণ। আমাকে একটুও শান্তিতে থাকতে দেয় না। সে অস্পষ্ট ভাবে ফিসফিস করে আমার কানের কাছে বারবার কী যেন বলে চলে।
মাঝেমাঝে ভাবি তাকে খুঁজে বের করব এবং অনুরোধ করব আমাকে একা ছেড়ে দেওয়ার জন্য। আমি তাকে বলতে চাই আমি নিরীহ, আমি কোনও অন্যায় করিনি। কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পেলাম না।
তাকে প্রথম বার দেখি এই শহরের নতুন কাঠ গোলার ওদিকে। এবং সেই রাতেই আবার আমার শোওয়ার ঘরে তাকে দেখি। তার দিকে উঠে ছুটে গিয়েও তার দেখা পাই না, মাঝেমাঝে হয়তো একটু দেখতে পাই।
সেই রাতে একটি নারীর আর্ত চিৎকারে আমার ঘুম ভেঙে যায়। তখন মাঝরাত। আমি ভয়ে কেঁপে উঠি ।ঘরটি ছিল অন্ধকার। হন্তদন্ত হয়ে লাইটের সুইচটা খোঁজার চেষ্টা করি। কিন্তু আলোর সুইচটা খুঁজে পাবার আগেই একটা বুলেটের বিদঘুটে আওয়াজে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে যায় এবং নারী কণ্ঠের চিৎকার ও কান্নায় সেই রাত ভরে ওঠে ।
আমি আলো খোঁজার চেষ্টা করছিলাম। ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। সম্ভবত রাস্তায় কেউ কাউকে গুলে করেছে। কিন্তু আলোর সুইচটার কী হলো? আমি লক্ষ করলাম আমার ঘরের কাঠের হিটারটা আগুনে কাঁপছে ।হতবম্ব হয়ে হিটারের দিকে তাকালাম। আমার সারা শরীর ভয়ে কাবু হয়ে গেল। কীভাবে হিটারটা আপনা আপনি জ্বলে উঠল? আমি হিটারের আগুনকে ঘৃণা করতাম। যদিও আমার ঘরটা ঠাণ্ডা ছিল তবুও আমি কখনোই হিটারটা চালু করতে চাইনি।
ভয়ে ভয়ে আমি হিটারের ভিতরের জ্বলন্ত শিখাটার দিকে তাকালাম।বারবার চোখ কচলে কচলে নিশ্চিত হতে চাইলাম আমি জেগে আছি কিনা। হ্যাঁ আমি জেগে ছিলাম এবং হিটারটাও জ্বলছিল। হিটারের মধ্যেকার আগুনের শিখাগুলি ছোটো গর্তের মধ্যে দিয়ে জ্বলছিল এবং তার প্রতিফলন কম্বলের উপর পড়ছিল। হিটারে পুড়ে যাওয়া কাঠের শব্দ আরো ভয় ধরাচ্ছিল।
আমার হৃদস্পন্দন এবং শরীরের কাঁপুনি কয়েকগুণ বেড়ে গেল। আবারও আমি আলোর সুইচটা খোঁজার জন্য হাত বাড়ালাম, তখনই আচমকা একটা মানুষের চিৎকার আমাকে হতচকিত করে দিল-
‘ভয় পেয়ো না…কোনও ভয় নেই”
সঙ্গে সঙ্গে আমি হিটারের দিকে তাকালাম। আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সেই আগন্তুক লোকটা আমার ঘরের ভেতরে, ঠিক হিটারটার কাছে দাঁড়ানো। আতঙ্কে আমি চিৎকার করে লাফিয়ে উঠে বলি, ‘কে তুমি?’
লোকটার পাগড়ি তার ঘাড়ের চারপাশে গলায় পেঁচানো । মৃদুস্বরে সে বলল, ‘ভয় পেয়ো না”।
বগলের তলায় ক্রাচ নিয়ে লোকটা দাঁড়িয়ে ছিল, হাঁটুর নিচ থেকে তার একটা পা কাটা। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কী করব। বোধহয় সে আমাকে খুন করতে চায়। আমি ভাবছিলাম এখনই পালাব। কিন্তু তখনই সে আমাকে অবাক করে দিয়ে কাঁদতে শুরু করল।
অবশেষে আমি আলোর সুইচটা খুঁজে পেলাম। আলোটা জ্বালিয়ে লোকটার দিকে তাকালাম। তার মুখটা পরিচিত মনে হলো। মনে হলো আগে কোথাও যেন তাকে দেখেছি। কিন্তু ঠিক কোথায় দেখেছি সেটা মনে করতে পারলাম না। তড়িঘড়ি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে তুমি?’
লোকটা সম্ভবত অতটা বিপদজনক না। হয়তো সে কোনো না কোনো বিপদের মধ্যে পড়ে আমার কাছে নিরাপত্তার জন্য এসেছিল।
পুড়ে যাওয়া এই কাঠের প্রতিটি অংশ আমার অতীত স্মৃতি বহন করে। আমার মেয়ের হাসির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। এই কাঠটা দেখতে পাচ্ছ? এই কাঠে আমাদের পরিবারের হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের গায়ের গন্ধ জড়িয়ে আছে। আমার পুরনো বাড়ির স্মৃতি গন্ধ মিশে আছে ওই কাঠের টুকরোয়।
সে কাঁদতে শুরু করল আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে। তার পরনে সাদা রঙের জোব্বা, ভীষণ নোংরা, যেটাতে রক্তের শুকনো ছোপ ছোপ দাগ লেগে আছে। হিটারের পাশ থেকে সে একটা কাঠের চেলা তুলে নিল, আর ওটার দিকে তাকিয়ে কাঁদতে শুরু করল। চোখের জল তার মুখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। তাকে এভাবে কাঁদতে দেখে আমার ভয় কমে গেল অনেকটাই। আমি তাকে চিনতে পারলাম। ওই যে কাঠের গোলার ওদিকটায় যাকে দেখেছিলাম এই লোকটা তো সেই-ই। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। আমি আবারও ভয় পেলাম। সেদিন কাঠগোলায় যখন কাঠ কিনেছিলাম, দূর থেকে এই লোকটা আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। ভেবেছিলাম অন্য কারও সঙ্গে হয়তো সে আমাকে গুলিয়ে ফেলেছে। হয়তো সে আমাকে খুন করতে চায়! আমি তাকে বলতে চাই যে সে আমাকে অন্য কারও সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছে। সে যাকে খুঁজছে সে লোক আমি নই।
কিন্তু লোকটি কাঁদতে কাঁদতে তার হাতে থাকা কাঠটা দেখিয়ে আমাকে বলল, ‘তুমি কি জানো যে এই কাঠের টুকরোটা আমাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়ির জানালার একটা ভাঙা অংশ?’
এটা শুনে আমার মনে হলো আমার মাথায় কে যেন কাঠের টুকরো দিয়ে সজোরে আঘাত করল । এই কাঠের টুকরোটা তার বাড়ির জানালার অংশ? এবার বুঝতে পারলাম সে কী বলতে চাইছে। সে এখনে প্রতিশোধ নিতে এসেছে। সেই কাঠের টুকরো দিয়েই আমার ঘরের হিটার জ্বলছে। বুঝতে পারলাম কী ভয়ংকর অবস্থায় আছি এখন। যেভাবে হোক এখান থেকে পালাতে হবে। লোকটার কান্না দেখে আবেগপ্রবণ হলে চলবে না। হয়তো সে দুঃখী মানুষের অভিনয় করছে।উদ্ভট মানুষ যুক্তি দিয়ে সব কিছু ভাবতে পারে না। এই কাঠের চেলা দিয়েই সে আমাকে খুন করতে চায় এটা আমি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম। ভয় মেশানো জড়ানো গলায় আমি শুধু বলেছিলাম, ‘এই কাঠটা কিন্তু আমি বাজার থেকে কিনে এনেছিলাম’।
এসব শুনে সেই আগন্তুক মানুষটি পাগলের মতো হাসতে লাগল। তারপর সে রেগে আরও রেগে গিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘আমি জানি তুমি এগুলো বাজার থেকে কিনে এনেছ। আমি জানি সেটা। কিন্তু তুমি কি জানো ওই কাঠের টুকরো আমারই ঘরের অংশ?’
তারপর আবার সে কাঁদতে শুরু করে। লোকটি জামার হাতা দিয়ে সেই কান্না মুছতে শুরু করে। সে আরেকটা কাঠের টুকরো হাতে তুলে নিল। আরো জোরে কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বলল, ‘হে খোদা ও খোদা, আমার ঘর…আমার ছেলের বইয়ের তাক…আমার ছ’বছরের মেয়ের রক্তের দাগ লেগে আছে ওই কাঠে। হা খোদা…আমার ঘর…আমাদের ঘর…আমাদের ঘর আমার মাথার উপর ভেঙে পড়ল। তুমি জানো না আমরা কেমন বুলেট- বৃষ্টির মধ্যে ছিলাম।সেকেন্ডের মধ্যে সব তছনছ হয়ে গেল। আমার পরিবার কোথায় হারিয়ে গেল। বুঝতে পারলাম না পৃথিবী চৌচির হয়ে তার মধ্যে তারা হারিয়ে গেল নাকি আকাশে উঠে গেল । সর্বত্র আমি তাদের খুঁজলাম …বউ, ছোটো মেয়ে, ছেলে, আমার কাটা পা, দরজা, জানালা। তুমি জানো না তারা কোথায়? হু? তুমি শুধু কাঠ জ্বালিয়ে তোমার ঘর গরম করতেই ব্যস্ত? আহা! কী আরামদায়ক উষ্ণ তোমার ঘর’।
আবার সে সেই বিকট ভয় ধরানো হাসি শুরু করল। আমি জানতাম সে পাগল নয়। ওর একটা কথাও পাগলের প্রলাপ নয়। হাসি, কান্না, ক্রোধ ও ঘৃণা মিশে আছে তার কণ্ঠে ।
আমি আবারও বললাম, ‘আমি কিন্তু কাঠগুলো বাজার থেকেই কিনে এনেছিলাম’।
আর তারপরই আমি ঘর থেকে বেরিয়ে দৌড় দিয়ে পালালাম। লোকটার কাছে বন্দুক বা ছুরি কিছু একটা থাকতে পারে ভেবে ভয় পেয়েছিলাম। দৌড়তে দৌড়তেই তার হাসি আর চিৎকার শুনতে পেলাম। রাস্তায় উঁচিয়ে থাকা একটা পাথরে পা লেগে হোঁচট খেয়ে ছাই আর জঞ্জালে মাখামাখি হওয়া পর্যন্ত আমি ছুটতে লাগলাম।
লোকটার কন্ঠ আবার একবার শুনতে পেলাম । শিউরে উঠে দেখলাম আওয়াজটা ছাইয়ের ভেতর থেকে আসছে, ‘পালাও পালাও। আগুন আগুন আগুন’।
তাড়াহুড়ো করে উঠে আবার দৌড় দিলাম। সেই মানুষটা ক্রাচ নিয়েই আমার পিছু নিল। আমি ছুটতে লাগলাম কিন্তু কানের ভেতর লোকটার কণ্ঠ বাজতে লাগল। যেন সেই মানুষটা সারাক্ষণ আমার মাথায়, কানে বসে আমার সঙ্গে কথা বলছে। সেই লোকটা কাঁদছিল এবং মাঝে মাঝে চিৎকার করে একই সুরে হাসছিল।
“আমরা কী এক পৃথিবীতে বাস করি। বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের কাঠ ভাঙতে কুড়াল দেয়।যুদ্ধে ক্ষত বিক্ষত ঘরের দরজা-জানালা ভেঙে কাঠের বাজারে বিক্রি করার কথা বলে। তুমি এসব জানবে না। তুমি শুধু নিজের ঘর গরম করার জন্য ওগুলো বাজার থেকে কেনো। চেলাকাঠ, ভাঙা জানালা দরজাগুলো দাঁড়ি পাল্লায় বেচাকেনা হয়। কিছু লোকের জানালা দরজার কাঠ, ছবির ফ্রেম সবকিছু বোমা বন্ধুকের আগুনে পুড়ে তছনছ হয়ে গেছে। এগুলোই মানুষের জীবন আর স্মৃতি, যা দাঁড়িপাল্লায় যায় এবং কেনাবেচা হয়। এই ভাঙা পোড়া কাঠ সুখী পরিবারের হাসি ও স্মৃতি বহন করে। না না ভয় পেয়ো না। আমি তোমাকে পাকড়াও করতে পারব না। দৌড়বার মতো পা-ই নেই আমার! ওরা আমার পা কেড়ে নিয়ে এই ক্রাচ ধরিয়ে দিয়েছে। ভাবছ আমি পাগল, মাথা খারাপ তাই না? জানো এই বাড়িটা ছিল আমার বাবার নিজের হাতে বানানো বাড়ি। পুড়ে যাওয়া এই কাঠের প্রতিটি অংশ আমার অতীত স্মৃতি বহন করে। আমার মেয়ের হাসির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। এই কাঠটা দেখতে পাচ্ছ? এই কাঠে আমাদের পরিবারের হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের গায়ের গন্ধ জড়িয়ে আছে। আমার পুরনো বাড়ির স্মৃতি গন্ধ মিশে আছে ওই কাঠের টুকরোয়। তোমার বাড়ির রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলেই আমি আমার বাড়ির গন্ধ পেতাম। সেই গন্ধটা আসত তখনই যখন তুমি ওই কাঠ দিয়ে হিটার জ্বালাতে। আমি আমার সেই বাড়িটা দেখতে এসেছিলাম, দেখতে এসেছিলাম আমার হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের। তোমার হিটারে পোড়ানো এই কাঠের মধ্যে দিয়ে আমার পুরনো বাড়ির স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পেয়েছিলাম। তোমার কি কখনও নিজস্ব ঘর বাড়ি ছিল? সারাদিনের খাটুনি শেষে বাড়ি ফিরলে যে শান্তি আর আরাম পাওয়া যায় তা কি তুমি কখনও অনুভব করেছ? আমি এই কাঠগুলো ফেরত চাই, যে কোনো মূল্যেই হোক। ওগুলো আমার সাথে রাখতে চাই হারিয়ে যাওয়া জীবনের শান্তির ঘর ও সন্তানদের স্মৃতি হিসেবে। খোদা গো! হায় খোদা”।
আমি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়লাম এবং এক দল নারী ও শিশু পেরিয়ে গেল। তাদের বেশভূষা আলুথালু এবং তাদেরকে আহত দেখাচ্ছিল। তাদের হাত এবং মুখে ব্যান্ডেজ বাঁধা ছিল। তাদের পোশাকে শুকনো রক্তের দাগ। তারা কিছু একটা বলাবলি করছিল এবং চিৎকার করে কাঁদছিল কেন জানি না। আকাশ মাটি চাঁদ তারা সব কাঁপছিল যেন। ওদের প্রত্যেকের হাতে ধরা ছিল কাঠের টুকরো…জানালা দরজার ভাঙা টুকরো।
ওরা ফিসফিস করে বলছিল, ‘আমাদের বাড়ি, আমাদের ঘর”।
হাওয়ায় ছড়ি ঘোরানোর মতো ওরা চেলা কাঠগুলো ঘোরাচ্ছিল । আমি ভয় পেয়ে গেলাম। দৌড়ে অন্য একটা রাস্তায় ঢুকে পড়লাম এবং দেখলাম যে আমি বাজারের কাঠ গোলায় ঢুকে পড়েছি। চাঁদের আলোয় ব্যস্ত বাজার রঙিন তখন। শয়ে শয়ে গরিব শিশু নারী, শয়ে শয়ে ঠেলা গাড়ি, শ’খানেক দাঁড়িপাল্লা, শয়ে শয়ে বন্দুক এবং শয়ে শয়ে ক্রেতা বিক্রেতায় বাজার মুখরিত তখন। সবকটা চেহারা কেমন ধুলো মাখা। দাঁড়িপাল্লায় একের পর এক চেলাকাঠ উঠছে নামছে এবং টাকার বিনিময়ে মালিকানা বদলে যাছে।
“দ্যাখো দ্যাখো কী করে ওরা বেচে দিচ্ছে আমার জীবন আর পুড়িয়ে ফেলছে সব কিছু। পালাও। হ্যাঁ তোমাকেই বলছি, পালাও এখান থেকে শিগগির”।
হঠাৎ সেই খোঁড়া লোকটা ভীড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। ছুটে এসে ক্রাচ দিয়ে আমাকে আক্রমণ করল। মাথায় খুব জোরে ব্যাথা পেয়ে আমি ঘুম থেকে জেগে উঠলাম । সঙ্গে সঙ্গে আমি আলো জ্বালালাম এবং দেখলাম সব জিনিস ঠিক মতো আছে কিনা। ঘর জুড়ে শুনশান নীরবতা। এমনকি বাইরের গোলাগুলি ও বোমার শব্দ পর্যন্ত কমে গেছে। হয়তো যুদ্ধ বিরতি শুরু হয়েছে।
পরদিনই আমি বাকি কাঠগুলো পাড়ার মুদির দোকানে দিয়ে এলাম কিন্তু দুঃস্বপ্নটা আমার একদণ্ডও শান্তি দেয়নি। যেখানেই যাই সেই লোকটা আমার পিছু পিছু ঘুরতে লাগল। দ্বিতীয়বার আর কাঠগোলার ওদিকে গেলাম না, এমনকী মুদিখানার ওদিকেও। আমি ওই কাঠের ছাইটুকুও দেখতে চাইনি। এর কদিন পর আমি আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠলাম ।
একদিন ভোরে তখনো বসন্ত ততটা আসেনি, আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডা, এমন সময় আমি হাঁটতে বেরোলাম। অসময়ের ঝড় রাস্তাঘাট সব তছনছ করে দিয়ে গেছে দেখলাম।
আমি রাস্তার শেষ প্রান্তের একটি কবরখানার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। একটা লাশ ঘিরে কিছু মানুষ জটলা করছে দেখলাম। সেই লাশটা পঙ্গু, পা নেই তার। মাথায় পাগড়ি জড়ানো। ময়লা সাদা পোশাকে রক্তের দাগ। মুখের বেশ কিছুটা অংশ কুকুর খুবলে নিয়েছে। দেখে মনে হলো ওই লোকটাকে কেউ গুলি করে হত্যা করেছে। লাশটার হাতে আছে কয়েক টুকরো ভাঙা কাঠ। নীল রঙের কাঠ। দেখে মনে হলো কারো বাড়ির জানালা ও বইয়ের তাকের অংশ। কেউই তাকে চিনতে পারেনি। কেউ বুঝতে পারেনি তার হাতে কেন কাঠের টুকরো। ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল আমার। কবরখানার দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটি একাকী গাছে ভরপুর ভর্তি ফুল ফুঠে উঠেছে।–♦––♦–
❤ Support Us








