Advertisement
  • গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
  • জানুয়ারি ১০, ২০২১

বোতল বাবা

বিশ্বনাথ গরাই
বোতল বাবা

সিমেন্টর মুখ খোলা বস্তাটা আরও একবার ভালো করে চেপে ধরে বাঁ হাত থেকে ডান হাতে স্থানান্তরিত করে ভালোভাবে বাগিয়ে ধরল বিভূতি দাস। ওরফে বোতল বাবা। আজ যেন বস্তাটা একটু বেশিই ভারী লাগছে। সেটা সে প্রথম থেকেই বুঝতে পারছিল। আসলে খালি বোতলগুলো যখন সে গাঁয়ের পুবদিকে এই খেলার মাঠ থেকে ভোরের হালকা আঁধারে কুড়োচ্ছিল, তখন সে খুশিতে ডগমগ হয়ে গিয়েছিল। প্রতিদিনের চেয়ে আজ একটু বেশি সংখ্যক বোতল যে তার কপালে নাচছে তা’সে আন্দাজ করেছিল। বাজারের ভাঙা কাচ ও লোহা-লক্কড়ের পাইকার গুনতির হিসেবে অক্ষত বোতলের দাম দেয়। তাই মহনন্দে তা সংগ্রহ করে  সে বাড়ি ফিরছিল। আজ বাড়তি দু’দশ টাকা ইনকাম হবে। সুতরাং খুশি হওয়ারই কথা।

কে এই বোতল বাবা? কীসের বোতলই বা সে কুড়োয়? বিভূতি দাস জানে না, কবে থেকে সে বোতলবাবা-য় রূপান্তরিত হল। তার বয়স তিন কুড়ি দশ হবে সামনের বোশেখের চব্বিশ তারিখে। গাঁয়ের পাঠশালায় যখন তাঁর বাবা তার হাত ধরে ভর্তি করতে নিয়ে যায়, তখন পণ্ডিতমশাই নিকুঞ্জ চক্কোত্তি বিভূতির জন্মতারিখ জেনে হেসে হেসে তার বাবাকে বলেছিলেন, তোমার বউ একটা দিন সবুর করতে পারল না। পঁচিশ তারিখে জন্ম হলে এ ছেলে নির্ঘাৎ কেউকেটা হত। তবে ওতেই হবে। দেখি, ঘষে-মেজে কদ্দুর শান দেওয়া যায়। তার বাবা রাখহরি দাস হাঁ করে শুনছিল পণ্ডিতমশাই-এর অমৃতবচন। ছেলে বেয়াতে গেলে তারিখ দেখে একদিনসবুর করা য়ায় নাকি! তার মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুরছিল। পন্ডিতমশাই খোলসা করে তাকে বলেছিলেন, পঁচিশ তারিখটা কেন বল্লুম বলো তো? তারপর ছোট অফিস কাম ক্লাসঘরের দেওয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারে শ্মশ্রুমন্ডিত রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখিয়ে তাকে বলেছিলেন ওনার জন্মদিন হল গিয়ে পঁচিশে বোশেখ।  তোমার ছেলে তাহলে ওনার মতোই বিখ্যাত হতে পারত! এবার কথাটার মর্ম বুঝেছ তো? দাড়িওলা লোকটা আবার কে রে বাব। রাখহরি দাসের নিরক্ষর মাথা তখন উথাল-পাথাল করছে। তার ছেলে বিখ্যাত হবে, নাম যশ করবে তা আবার হয় নাকি! একটু আধটু লেখাপড়া শিখে  চাষবাস করবে, বাজারে গিয়ে ঝুড়িতে রাখা চাষের  আনাজপাতি নিয়ে দরদাম করে বিক্রিবাটা করবে, বাড়ি ফিরে বাপের হাতে পাইপয়সার হিসেব ঠিকঠাক তুলে দেবে, এই তো সে চেয়েছে! বাড়ি ফিরে ছেলেকে বলেছিল, পণ্ডিতের কথা ছেড়ে দে। মন দিয়ে অ আ ক খ, কড়াকিয়া, শতকিয়া শিখবি। তাহলেই হবে।

তো সেই থেকেই  পাঠশালায়  গমন তার। দড়িবাঁধা হাফ-প্যান্টুল, আধময়লা গেঞ্জি, তার অনিচ্ছুক শরীরটা ঠিক  পৌঁছে যেত এগারোটা বাজার আগেই। বছর খানেক বাদেই অ আ ক খ আর একে চন্দ্র দুই-এ পক্ষ পর্যন্ত দৌড়ে তার লেখাপড়ার ইতি। পণ্ডিতের বেধড়ক ঠ্যাঙ্গানি, নীল ডাউন, কান ধরে ওঠবোস, তারপর ক্লাসের বাইরে খোলা দাওয়ায় হাফ চেয়ার হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে তার কচি হাত পা দুটো  যেন ভেঙে পড়ার উপক্রম। এক ক্লাস উঁচুতে উঠে তার মনটা এমন বেগরবাঁই শুরু করল যে সে আর ওপথ মাড়াল না। প্রথম মাসখানেক বাঁশবাগান, নদীর ধার আর গাঁয়ের প্রান্তে শ্মশানে-মশানে সে লুকোচুরি খেলল নিজের সঙ্গে। একদিন ঠিক ধরা পড়ে গেল বাপের হাতে। কড়কানি, শাসানী, ঠ্যাঙানি কিন্তু কোনভাবেই তাকে পাঠশালামুখী করা গেল না। হাল না ছেড়ে রাখহরি একদিন তাকে জোর করে সঙ্গে নিয়ে পণ্ডিতের কাছে হাজির। জোর হাত করে সে মিনতি জানিয়েছিল, পণ্ডিতমশাই যেমন করেই হোক ছেলেটাকে একটু মানুষ করে দাও। একটু আধটু বিদ্যে না থাকলে গাঁয়ে মান থাকে? পণ্ডিত মশাই হি হি করে তিক্ত হাসি হেসেছিলেন, তারপর তরমুজবিচির মতো পান-দোক্তা খাওয়া দাঁত বের করে বলেছিলেন, কোনরকম টায়ে টায়ে পাশ করে ক্লাসে উঠেছে তোমার ছেলে, ওর পড়াশোনার মতিগতি নেই। আর ওর মাঠাটাও একদম পাথর। হাতুড়ি দিয়ে পেরেক পুঁততে গেলেও পেরেক বেঁকে যাবে। অন্য কাজে মন দিতে দিতে বললেন, ওকে মানুষ করা আমার কম্মো নয়। তোমার এঁড়ে বড্ড বেয়াড়া। যাও এবার বাড়ি যাও, দেখি । সেই থেকে বিভূতি আর কোনদিন পাঠশালার চৌকাঠ মাড়ায়নি। অতটুকু বছর থেকেই বাপের পিছু পিছু মরশুমের দাবি অনুযায়ী কখনও গরু-লাঙল, কখনও বা কোদাল-কাস্তে-নিড়ানি, কখনও বা শুধুই খালি হাতে মাঠে চলে যেত। তার বিবর্ণ মা একটা ত্যানায় কিছু মুড়ি আর গুড় বেঁধে দিত। বলত একটু বেলায় বাপ-ব্যাটায় খেয়ে নিবি।

ছেলের দশ পেরোতেই শরীরে বেশ তাকত লক্ষ্য করল রাখহরিদাস। দাওয়ায় বসে হুঁকোয় টান দিতে দিতে খুশি হয়ে মনে মনে বলল চাষার ব্যাটার এমন শরীর না হলে হয়। তা না হলে মাঠে সকাল থেকে সন্ধ্যে অব্দি খাটবে কী করে! এখন বিভূতি গ্রীষ্মকালে সকাল সকাল পান্তাভাত আর শীতকালে কড়কড়ে ভাত পেঁয়াজ,কাঁচালঙ্কা সহযোগে খেয়ে বাপের সঙ্গে মাঠে যায়। তাদের মাত্র দশ-বারো কাঠা জমি। বাকি প্রায় দু’বিঘে জমির ভাগচাষী তারা।  গাঁয়ের সম্পন্ন ব্যবসায়ী জনার্দন রায় রাখহরির করুন আবেদনে সাড়া দিয়ে তাকে চাষে অনুমতি দিয়ে বলেছিলেন, দেখিস, ভাগে ফাঁকি দিস নে যেন। তাহলে পরের দিনই তোর কপাল পুড়বে, মনে রাখিস। রাখহরি মন দিয়ে চাষ করে সেটুকু জমি।

এভাবেই তো কতগুলো বছর কেটে গেল। মাটির দেওয়াল, টালির ছাউনি আর তৎসংলগ্ন দুয়ার, দুয়ারের এক কোনে মাটির উনুনে বউয়ের রান্নাবান্না-এই একখানা ঘর আর একফালি উঠোন নিয়ে রাখহরির সংসার। বিভূতি স্বপ্ন দেখে, রায় বাবুর মতো তারও প্রকাণ্ড দোরদালান হবে, ক্যারিয়ার লাগানো সাইকেল হবে বিকেলে মাঠ থেকে ফিরে ইস্ত্রি করা ধুতি  ফুলশার্ট পরে, পাউডার মেখে,  সাইকেলে চেপে ঘুঘুডাঙ্গার গঞ্জে ঘুরে বেড়াবে, সবাই তাকেও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে। বাড়ির অদূরে জমির ধারে বাঁশগাছের ছায়ায় জিরেন নিতে নিতে এইসব ভাবে সে। তারপর উদাস হয়ে দূরে কালো পিচ রাস্তার  দিকে শূন্য দৃষ্টি মেলে দেয়। দু’একটা বাস আর মাঝে সাঝে দু’চারটে ট্রাকের যাতায়াত সে লক্ষ্য করে, তার ইচ্ছে ঐসব গাড়ির কোনও একটাতে চেপে ভিনদেশে পাড়ি দিতে। অনেক অনেক টাকা রোজগার করে একদিন সে বাড়ি ফিরে আসবে।  তারপর পুষি ওরফে পুষ্পর বাবার কাছে সটান বিবাহপ্রস্তাব দেবে। তার জেল্লা দেখে পুষির বাবা আর না করতে পারবে না, সে নিশ্চিত। হঠাৎ সে শুনল তার বাপের দূরাগত কড়কানি, কী রে, স্বপন দেখছিস বুঝি? এখনও জমিটার অর্ধেক ভিতে ছাঁটা হয়নি, আর তুই এখানে বসে আছিস?

বস্তবের জমি যে বড়ো রুক্ষ ! সে হঠাৎ রেগে গেল বাপের কড়কানিতে, বলল, সারাদিন কাজ আর কাজ। আমার বুঝি ইচ্ছে অনিচ্ছে নেই। রাখহরি হাঁ হয়ে গেল  ছেলের আস্পর্ধায়। হারামজাদা মুখে মুখে চোটপাট করতে শিখছ। বলেই গজগজ করতে করতে নিজেই কোদাল হাতে জমিতে নেমে পড়ল।

এখন গরমকাল। দরজা খোলা রেখে  ঘরে তক্তপোশে বিভূতি শুয়ে আছে। বাইরে দুয়ারে মাদুর পেতে রাখহরি ও তার বউ। রাখহরি ঠেল দিল তার বউকে, বলল শোনো ছেলের মতিগতি ভালো ঠেকছে না। কাজে মন নেই। ওর কি কাউকে মনে ধরেছে ? বউ খুব আস্তে আস্তে বলল, ব্যাপারটা তোমাকে বলব বলব করেও বলিনি। বয়েস তো কুড়ি পার হতে চলল—এবার বিয়ে না দিলে হয়? ও পাড়ার হাঁদু সাঁতরার মেয়ে পুষিকে ওর খুব পছন্দ। দুজনে ফাঁক পেলেই গল্প-গুজব করে, পাড়ার মেয়-বউদের মুখে কানাঘুষো শুনেছি। রাখহরির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, আমতা আমতা করে বলল, সে কী গো হাঁদুর মেয়ে? ওর কত বিঘে জমি জানো? ওরা আমাদের ঘরে মেয়ে দেয় কখনো? তুমি ওকে বোঝাও। শেষে একটা কেলেঙ্কারি না ঘটে!

শেষে কেলেঙ্কারি ঘটলই। গাঁয়ের মোড়ল কালীপদ বিশ্বাস লোক পাঠিয়ে তাকে জানিয়ে গেছে, সামনের রোববার সন্ধ্যে সাতটায় মানসতলার চাতালে বিচারসভা। তার ছেলে, হাঁদু সাঁতরার মেয়ের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করছে। ছেলেকে নিয়ে যেন সে হাজির থাকে সেখানে।

যথারিতী বিচারের দিন আগত। মনসাতলায় হ্যাজাক জ্বালানো হয়েছে। আর পাঁচজন মাতব্বর ও হাঁদু সাঁতরা চাতালের একপ্রান্তে উঁচু বেদির উপর বসে আছে।  বাকি অংশে রাখহরি আর বিভূতি এবং বেশকিছু উৎসাহী লোকজন ও ছেলেছোকরা জমা হয়েছে, মজা লোটার জন্য। কালীবাবু প্রসঙ্গটি তুলে বললেন, আপনারা সকলেই জানেন রাখহরির ব্যাটা বিভূতি একটা ঘোরতর অন্যায় করেছে। সে হাঁদুর বাড়িতে টোপ ফেলেছে। মেয়ের চিন্তায় হাঁদুর ঘুম উবে গেছে। এর একটা বিহিত চাই। আপনারাই বলুন, কী করা যায় এখন। তার কথা শেষ না হতেই নিজের জায়গা ছেড়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে হাঁদু বিভূতির  দিকে চোখ পাকিয়ে বলল, চুনকালি লাগিয়ে কান ধরে সারা গাঁ ঘোরালে তবেই ও জব্দ হবে। সভায় এই ফরমানে প্রচণ্ড গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। কালীপদ বিশ্বাস ও অন্যান্য মাতব্বরেরা হাত তুলে কিছু বলতে চাইছেন, কিন্তু রাখহরি অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে চিৎকার করে  উঠল, ইয়ারকি নাকি। আমার ছেলের একারই দোষ। পুষিকেও ডাকা হোক এখানে।

কালিপদ দেখলেন এ তো মহা ফ্যাসাদ। মেয়েছেলে ডাকা মানেই আরও কত না ট্যারাবেঁকা মন্তব্য। এবার কড়কানি না দিলেই নয়। তাই রেগেমেগে চিৎকার করে বললেন, যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা! বোস বোস বলছি। রাখহরিও তেড়িয়া হয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাল, শুনুন, আপনাদের এই একপেশে বিধান মানছি না।  আসলে এই ব্যাপারে ছেলের যদি দোষ ও থাকে, তা এখন বিবেচ্য নয়।  গাই-বাছুরে ভাব থাকলে গাই বনে গিয়েও দুধ দেবে। কিসসু করতে পারবে না তোমরা। সভার উপস্থিত সবাই ফিচেল হাসি হাসতে লাগল তার এই বচনে। এদিকে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে হাঁদু রীতিমতো তোতলাতে তোতলাতে উচ্চারণ করল, কি বললি তুই, ছোটলোক কোথাকার। রাখহরিও যেন আজ মরিয়া হয়ে উঠেছে। ছেলের হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে তাকে টেনে তুলল, চল এখান থেকে। এরা সব বড়োলোকের দালাল। তারপর হঠাৎই পেছন ফিরে হাঁদুর প্রতি মোক্ষম বাণটি সে ছুঁড়ে দিল, এখানে সবার সামনে বলে যাচ্ছি আমার এঁড়ে ছাড়া থাকবে তুমি তোমার গাই সামালাও।


এখন সে আর বিভু কাকা বা বিভু জ্যাঠা নয়। কচিকাঁচা বা উঠতি বয়সীদের কাছে সে বোতলবাবা। সে খুব মজা পায়। ওদের সঙ্গে হাসে। ফোকলা দাঁতের হাসি।


হাঁদু তার গাই সামলানোর অবকাশ পায়নি। দু’দিন পর গ্রামময় রটে গেল, পুষি আর বিভূতি তারকেশ্বরে শিবের মন্দিরে গিয়ে একজন পান্ডার তত্ত্বাবধানে মালাবদল করেছে। তারা এখন স্বামী-স্ত্রী। রাখহরি মহাখুশি। হাঁদু সাঁতরার মুখের উপর যোগ্য জবাব দিয়েছে বিভূতি। এই না হলে বাপের ব্যাটা।

রিক্সায় করে বউকে নিয়ে বাড়ি ঢুকে বিভূতি ভেবেচিল, কী দুর্ভোগই না কপালে লেখা আছে তার; তার বদলে যে কদম ফুলের বাস। সুতরাং সদ্য আঠারো পেরুনো পুষিকে মা হতে হল। ঘটনার পুনরাবূত্তি ঠিক এক বছর তিন মাস বাদে। রাখহরি এবার মহা বিরক্ত। পুষির উদ্দেশে মনে মনে ক্ষোভ উগড়ে দিল, বড়টা এখনও মাই ছাড়েনি, তার মধ্যে তোকে আবার বেয়াতে হল! লজ্জাশরম নেই। রাতে বউয়ের কাছে নিজের বিরক্তি উগড়ে দিয়ে বলল, তোমার ছেলে কি এবার বউমাকে বছর বেয়ানি করে ছাড়বে? তুমি বউমাকে সাবধান করে দাও। এখানেই যেন থামে ওরা।

তা থেমেছিল ওরা। সদ্য চালু হওয়া তারেকেশ্বর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে পুনরায় বাপ হওয়ার রাস্তা বন্ধ করে এসেছিল বিভূতি। এদিকে দুই নাতি পুকুরের জলকলমির মতো তরতর করে বেড়ে উঠছিল। গাঁয়ের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয়েছিল কিন্তু যেমন বাপ, তেমনি দুই ব্যাটা। লেখাপড়ায় মন নেই। সুতরাং মাঠে-ঘাটে ধুলো ঘাঁটা, কাদা মেখে বীজ রোওয়া আর দিনান্তে মাদুর পেতে অকাতর ঘুম ছাড়া আর কি করে! রাখহরির ভারী শখ  নাতবউয়ের মুখ দেখে যাবে। বয়স তো কম হলো না। কিন্তু কপালে নেই কো ঘি ঠকঠকালে হবে কি! একদিন ধানজমিতে কীটনাশক স্প্রে করত গিয়ে ঘটল সেই অঘটন-ঘাসভর্তি আলের আড়ালে পাকানো সাপের ছোবলে সূচ ফোটানোর তীব্র যন্ত্রনায় উপুড় হয়ে পড়ে গেল রাখহরি। প্রথমে ওঝা, তারপর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। শেষে রাখহরির নিথর দেহ নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল বিভূতি।

একদিন মা-ও চলে গেল চিরকালের জন্যে। দুই ছেলের বিয়েও দিয়েচে বিভূতি। লেখাপড়ার দৌঁড়ে পিছিয়ে পড়লেও জমিতে বেদম খাটতে পারে তার ছেলেরা।  বেশ চলছিল জীবন। কিন্তু গোল বাঁধল চৈত্রের এক শেষ রাতে। খেতে বসে দুই ভাই বলল, বাবা আমরা আর মাঠে চাষবাস করবুনি। মাত্র কাঠাদশেক জমি, এরপর পরের জমিতে ভাগচাষ করে ভাতের জোগাড় করতেই তো হিমশিম। বিভূতি শেষ রুটির টুকরোটা পাকিয়ে মুখে তুলতে গিয়ে হাঁ হয়ে গেল। বলল কি করবি? ছোট ছেলে সুনীল বলল, ও পাড়ার অজিত ঢ্যাং-সঙ্গে কথা হয়েছে। ওর সঙ্গে কাল সক্কালের ট্রেনে লিলুয়ায় যাব। ওখানে একটা ঢালাই কারখানায় হপ্তাচুক্তিতে কাজ করব। চাষ-বাস ছেড়ে বিদেশ-বিভুঁয়ে চলে যাবি, তাহলে এই বুড়ো বয়সে সবদিক একা সামলাব কী করে? রান্নাঘরে বাঁশের আগর ধরে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল পুষ্প। এবার সে স্বামীকে অভয় দিল, অতো চিন্তা করছ কেন? এ গাঁয়ের আরও অনেক ছেলেপুলে ঢালাই কারখানায় কাজ করে গো-আমি জানি। কম করে দুশো টাকা রোজ। সুনীল মায়ের কথা শুনে খুশি হল। বলল, হ্যাঁ, মা, ঠিক বলেছ। বছরখানেক বাদে মাইনে বাড়ে। সুতরাং বিভূতির গাঁইগুঁই টিকল না।

ভোর ভোর পুষির হাঁকডাকে বিভূতি বিছানায় উঠে বসল। দুই ছেলেকে ডাকছে ওদের মা। ছেলেরা তাকে জানিয়েছে, অত সকালে ভাত খাওয়া অসম্ভব। তারা টিফিন নিয়ে যাবে। অজিত ঢ্যাং এর কথামতো গতকালই টিফিন ক্যারিয়ার কিনে এনেছে বাজার থেকে। স্নানটান সেরে তারা বাড়ি ফিরতেই দুকাপ চা আর একবাটি মুড়ি এগিয়ে দিল ওদের মা। তা খেয়েই টিফিন ক্যারিয়ারে ভাত-ডাল-তরকারি নিয়ে সাইকেলে করে বেরিয়ে পড়ল তারা। বাড়ি থেকে স্টেশন এর দূরত্ব ছ’কিলোমিটার সেখানে স্ট্যান্ডে সাইকেল রেখে তারা ছটা ছাব্বিশের ট্রেন ধরবে।

দুয়ারে ঠ্যাং ঝুলিয়ে ঘুঁটের ছাই দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে বিভূতি ছেলেদের ও তদের মায়ের ব্যস্ততা লক্ষ্য করছিল। মনে মনে হিসেব কষছিল দুশো গুন দুইসমান চারশো। তার মানে মাস গেলে বারো হাজার। তার চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। এতোখানি বয়স হল তার এতোগুলো টাকা তো একসঙ্গে দেখেনি সে। দুই ব্যাটা তাকে পয়সাকড়ি দেবে তো? তাহলে সে আর পরের জমি ভাগচাষ করবে না। এবার থেকে নিজের দশকাটা জমি নিয়েই বেঁচেবর্তে থাকবে।

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সে দুই ছেলের চালাঘরের দিকে তাকাল। যথারীতি দরজা ভেজানো। দু’বউ-ই ঘুমোচ্ছে। উঠবে সেই বেলা সাতটায়।বড় বউ মা হয়েছে গত বছর। ছোটটা পাঁচ মাসের পোয়াতি।  বিভূতি জানে পুষ্প একটু বেশি স্নেহপ্রবন। সে নিজেই সংসারের প্রায় সব কাজকম্মো করে। পুষ্পর দৃষ্টি আকর্ষণ করে সে ছেলেদের বন্ধ ঘরের দরজার প্রতি ইঙ্গিত করল নিঃশব্দে। ঠোঁটে আঙুল চেপে পুষি তাকে কোনও কথা বলতে নিষেধ করল। বিভূতি চুপ করে গেল। একটা প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরছিল। স্বামীরা কাজে বেরুচ্ছে, ফিরবে কখন সেই রাত্তিরে, অথচ তাদের বৌয়েরা বিছানায়। মুখ্যসুখ্য মাথায় এই জটিল অঙ্কটা কিছুতেই ঢুকছিল না। বসে না থেকে উঠে পড়ল, তাকে মাঠে যেতে হবে।

প্রথম দিকে মাস পাঁচ ছয় বিভূতির হাতে হাজার করে দুহাজার টাকা দিয়েছিল দুইছেলে। কিন্তু তারপরই তা নেমে এল জনপ্রতি পাঁচশো টাকায়। বাপের জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে দু’ছেলেই জানাল এর বেশি পারবনা। এবাড়িতে যা খাওয়ার ছিরি! আমাদেরও তো মাগছেলে নিয়ে ঘর-সংসার। কম খরচ। ওদের মা  কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল। বিভূতির বিস্তারিত দু’চোখ দুই ছেলেকে কত কিছু বলতে চায় সে। এখন সে সম্পূর্ণ বাকহারা।

বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আসল দুঃসংবাদটা শোনানো হল। দুই ছেলে এবং তাদের বৌয়েরা আলাদা হাঁড়ি করেছে। এবার থেকে তারা আলাদা খাবে। বিভূতি ও পুষির মাথয় বাজ ভেঙে পড়ল। পুষি ঘরে এসে খিল তুলে দিল। বিভূতি জানে খুব অভিমান হলে কিংবা মনে আঘাত পেলে পুষি এমন কান্ড ঘটায়। তাই এ ঘটনায় সে গা করল না। বুকের কষ্ট বুকে নিয়ে জমিতে চলে গেল।

ঘোর দুপুরে জোর খিদে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসল। পুষি নিশ্চয় অভিমান ভুলে গিয়ে রান্না করছে। কিন্তু উঠোনে পা রেখে সে দেখল, উনুন জ্বলেনি। ওদিকে দুই ছেলের বউ তাদের চালাঘরের লাগোয়া নিচু দাওয়ায় তোলা উনুনে কড়াই চাপিয়ে রান্না করছে। বুড়ো বাপ-মার কথা একটুও ভাবল না ওরা। আলাদা রান্না শুরু করে দিল। এই অন্তর্গত বিলাপ শেষেই চোখ ফেরাল নিজের ঘরের দিকে। দেখল দরজা বন্ধ। এবার সে একটু ভয় পেল। খিল দিয়ে ঘরে এতক্ষণ কী করছে পুষি! কয়েকবার ডাকাডাকি, সঙ্গে দরজায় ধাক্কা, কিন্তু কোনও প্রতিক্রিয়া না পেয়ে ছেলে-বৌমাদের হাঁক পাড়ল, একবার তোরা আয় না। তোদের মায়ের যে কোনও সাড়া নেই।

দরজা ভাঙার পর দেখল বিছানায় অসাড় হয়ে পড়ে আছে পুষ্প। তার মুখ থেকে বিজাতীয় এক গোঁ গোঁ শব্দ বেরিয়ে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে বিভূতির চিৎকারে পাড়াপড়শিরা দৌড়ে এলো। ভ্যান জোগাড় করে সোজা হাসপাতালে। বিভূতির উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে ডাক্তার সটান বলে দিলেন, সেরিব্রাল অ্যাটাক। পারলে বড় কোনও হাসপাতালে কিংবা নার্সিংহোমে নিয়ে যান। আমি রেফার করে দিচ্ছি। বিভূতি অসহায়ভাবে চারদিকে তাকাল। কাদের যেন খুঁজছে। তার দুই ছেলে তখন হাসপাতাল বিল্ডিং এর অদূরে প্রশস্ত খোলা পরিসরে একটা জামগাছের নিচে বাঁধানো বেদিতে বসে অন্যান্য অনেক দর্শনার্থীদের সঙ্গে গল্পগুজবে ব্যস্ত। সে দৌঁড়ে গেল, তাদেরকে জানাল ডাক্তারের নিদান। অবাক হয়ে দেখল তারা কোনও গুরুত্ব দিল না। উল্টে ডাক্তারের কাছে গিয়ে নিপাট ভালোমানুষের মতো জানিয়ে দিল, ডাক্তারবাবু, আমাদের সে সামর্থ্য নেই। এখানে যদ্দিন চিকিৎসা হয় হোক, তারপর আমরা মাকে বাড়ি নিয়ে যাব।

পুষ্প শুয়ে আছে বিছানায়। নিজের ঘরে। বিভূতি তাকিয়ে আছে। তার বাড়িতে এতকাল পর গ্রামীণ বিদ্যুৎ যোজনার কল্যাণে বিদ্যুৎ এসেছে। তাই রক্ষে। মাথার ওপর পাখা চলছে ফুলস্প্রিডে। ভাগ্যিস ছেলেরা লাগিয়ে দিয়েছে। আজ বিকেল থেকে সে লক্ষ্য করেছে রোগের বাড়াবাড়ি। পুষি কেমন যেন উথালপাথাল করছে-বিকৃত মুখের বিজাতীয় শব্দে তার অনুমান হল। ঠোঁট নড়ছে তার কিন্তু কোনও কথা বোঝা যাচ্ছে না। তারদিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিভূতির মনে পড়ে গেল বিবাহপূর্ব কত কথা। নিঝুম দুপুরে বাড়ি থেকে দূরে বাঁশবন পেরিয়ে কুলগাছে চড়ে পুষিকে কুল পেড়ে দিত। একবার বিভূতির আঙুলে কুল কাঁটা ফুটে যায়। সেখান থেকে রক্ত পড়তে দেখে পুষি তার হাতটা নিজে হাতে নিয়ে  তার আঙুল সোজা নিজের মুখে তুলে চুষতে লাগল। বিভূতি হাঁ হাঁ করে উঠেছিল, এই পুষি করছিস কী, করছিস কী? আমার যে সুড়সুড়ি লাগছে! পুষি চোখ পাকিয়ে বলেছিল, এক্ষুণি রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যাবে দেখো। ঘটলও তাই। এক একদিন মাদার গাছে উঠে বিভূতি মাদার ফল পেড়ে দিত তাকে। বাঁশবাগানের ঠিক মধ্যিখানে পানায় ভরা এঁদো ডোবার পাড়ে বসে তা খেতে খেতে কত আবোলতাবোল গল্প করত তারা। সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া পুষি একদিন তার গায়ে গা ঘেঁষে তাকে বলেছিল, তুমি খুব ভালো। বিভূতির মনে হয়েছিল তার হাতে আস্ত একটা চাঁদ। বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করার পর পুষি একদিনও বাপের বাড়ি যায়নি তাকে ছেড়ে। তার বাপের কাছে মাথা নিচু করেনি। দারিদ্রের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধে সে কোনও অভিযোগ জানায়নি। এসব স্মৃতি তাকে বড্ড বেশি পীড়া দিতে লাগল এখন। সেই পুষি আর কোনদিন তার দিকে পূর্ণচোখ মেলে তাকাবে!

মশারিটা না খাটালে চলছে না। বিভূতি দেখল একটা দুটো মশা উড়ছে। মশারি টাঙিয়ে গুঁজতে গিয়ে সে দেখল, বিছানার নীচে কাঁথার ভাঁজে বেশ কয়েকটি নোটের উঁকি। সে সাগ্রহে তা তুলে নিল। প্রায় দুহাজার টাকা। এতগুলো টাকা! কী কষ্ট করেই না পুষি এই কটি টাকা সারাজীবন ধরে জমিয়েছে, সে জানে! বাড়িতে হাঁস পুষে ডিম বিক্রি করে, গরুর দুধ বিক্রি করে কিংবা কখনও সখনও সম্পন্ন চাষিদের বাড়িতে ঢেঁকিশালে ধান ভেনে দিয়ে অর্জিত পয়সায় তার এই সঞ্চয়। এখন এই চরম টানাটানিতেও সে অসীম মমতায় এই অর্থ আবার যথাস্থানে রেখে দিল।
মাথার পাশে তক্তাপোষের ধারে বসে থাকতে থাকতে কখন যেন তন্দ্রা এসে গিয়েছিল তার। সে তার পুষির মাথার পাশে বালিশে মাথা রেখে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙতেই ধরমড় করে সে উঠে পড়ল। নিশ্চিন্ত হল সে যখন দেখল পুষি ঘুমোচ্ছে। তার মুখে যেন অতল প্রশান্তি। তার এলানো হাত বুকের উপর তুলে দিতে গিয়ে মনে হল হাতটা ভীষণ ঠান্ডা। এবার সে তার কপাল, মুখ অনাবৃত তলপেট, পা ছুঁয়ে দেখতে লাগল অত্যন্ত ব্যগ্রতায়-কী ঠাণ্ডা পুষির শরীর! এবার সে সজোরে ধাক্কা দিতে দিতে ডাকল পুষি, পুষি। নিরুত্তর পুষির বুকে এবার সে মাথা রেখে অসহায়ভাবে হাউ হাউ করে কাঁদতে লগল। কাঁদতেই লাগল।

একটু শান্ত হয়ে দরজা খুলে বাইরে উঁকি দিল বিভূতি। পূর্ণিমাচাঁদ পশ্চিমমুখী। বাড়ির পাশে বাঁশবাগানে একদল শেয়াল হুক্কা হুয়া শব্দে তীব্রভাবে ডেকে উঠল। একবার তার মন হল, ছেলেদের সে ডেকে তুলবে। পরক্ষণেই নিজেকে সংযত করল। এত রাতে ওদের ঘুম ভাঙানো ঠিক হবে না। ওরা যদি বিরক্ত হয়। তাই সে ফিরে দরজা ভিজিয়ে ঠায় বসে রইল পুষির পায়ের কাছে-নির্নিমেষ নয়নে দেখতে লাগলো তাকে। এখন কেন জানিনা তার মনে হল, সে বড্ড অবিচার করেছে পুষির প্রতি। সংসারের জন্য খেটেখুটে, অভাবে ও দারিদ্রে সমস্ত জৌলুস উবে গেছে পুষির শরীর থেকে। কোনদিনও কোন অভিযোগ জানাল না মেয়েটা। এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না বিভূতি একটু ঝুঁকে পুষির দুই গালে দুই তালু রেখে কান্নায় ভেঙে পড়ল সে-তারপর নিজেকে নিংড়ে নিয়ে অপরাধীর মতো তাকে বলল, আমাকে মাপ করে দাও, পুষি।

পুষির মৃত্যুর পর বিভূতি দিন দিন অথর্ব হয়ে পড়তে লাগল। বয়সও তো হয়েছে। এখন আর জমিতে খাটাখাটনির  মতো জুত পায়না সে। তা ছাড়া শরীরে নানান ব্যাধির উপসর্গ দেখা দিচ্ছে, তা সে প্রতিনিয়ত টের পাচ্ছে। বিশেষ করে হাঁটুর আর কোমরের ব্যাথাটা মাঝেমধ্যে যখন চাগাড় দেয়, তখন সে বড্ড কাবু হয়ে পড়ে। স্থানীয় ডাক্তার তাকে প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ওষুধ কিনবে কোত্থেকে। তার তো জমানো কোনও টাকাও নেই। তার মনে পড়ল পুষির জমানো টাকাটার কথা! সঙ্গে সঙ্গে কে যেন তার অন্তর থেকে বলে উঠলো, না না, বড় পাপ হবে। একদিন রবিবার দেখে ছেলেদের কাছে ওষুধের প্রসঙ্গ তুললে তারা জানালো, জমিটা রেখে কী হবে শুনি। ওটা বেঁচে দাও।

বড্ড আঘাত পেয়েছিল বিভূতি। প্রকৃত চাষী শত অভাবে, দুঃখকষ্টেও, জমি আঁকড়ে বেঁচে থাকতে চায়। এটাই তার পরিচিতি। এ কথা সে ছেলেদের বোঝাবে কী করে! দু’পাঁচদিন ভাবতে ভাবতে অন্য এক উপায় ঠাওরালো সে। মনটা ও খুশিতে ভরে উঠল।  ভোরবেলা প্রাতঃকৃত্য সারতে সে প্রতিদিন পাকা রাস্তার পুবদিকে একটা ছোটখাটো ফুটবল মাঠ পেরিয়ে খালপাড়ে যায়। সে দেখেছে খেলার মাঠের এদিকে সেদিকে এবং খালপাড়ে কিংবা খালের জলে অনেক খালি বোতল পরে থাকে। আসলে এখনকার উঠতি ছেলেছোকরারা আঁধার নামলেই এসব জায়গায় দল বেঁধে হাজির হয়, অনেক রাত পর্যন্ত হুল্লোড় করে, মদের বোতল খুলে মোচ্ছব করে। সন্ধ্যের পর অন্য কেউ ওপথ মাড়ায় না। তার মাথায় সঙ্গে সঙ্গে একটা বুদ্ধি খেলে গেল-যদি এগুলো ভোর ভোর কুড়িয়ে বাড়িতে বয়ে নিয়ে যাই, তারপর একদিন বস্তাভর্তি করে বাজারে  বাতিল শিশিবোতলের পাইকারের কাছে বিক্রি করি, তাহলে তো ভালোই রোজগার হয়। ওষুধপত্রও একটু আধটু কিনতে পারি!

এখন সে আর বিভু কাকা বা বিভু জ্যাঠা নয়। কচিকাঁচা বা উঠতি বয়সীদের কাছে সে বোতলবাবা। সে খুব মজা পায়। ওদের সঙ্গে হাসে। ফোকলা দাঁতের হাসি। শুধু ভোরবেলা নয়, সন্ধের ঠিক আগে আরও দু’একটা মদের ঠেকে নাইনলের ব্যাগ হাতে সে ঢুঁ দিতে শুরু করল। প্রতিদিন আগের রাতের ছুঁড়ে দেওয়া খালি বোতল ব্যাগে ভরে সে বাড়ি নিয়ে আসে। তারপর সপ্তাহের শেষে যুবা বয়সের প্রায় বাতিল সাইকেলের ক্যারিয়ারে বস্তায় ভরা বোতল চাপিয়ে গঞ্জের দিকে হাঁটা দেয়। মাস শেষ হলে হিসেব কষে দেখে তার উপার্জন প্রায় চারশো টাকা। মনটা খুশিতে ভরে উঠল। বিপত্তি দেখা দিল নিজের বাড়িতেই। দুই ছেলে একদিন কারখানা থেকে ফিরে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর, বলি ভেবেছটা কি শুনি! কী আরম্ভ করেছ তুমি! বড় ছেলে সুশীল প্রায় তেড়ে এলো তার দিকে, শুনলে গা রিরি করে ওঠে। চারদিকে ‘বোতলবাবা’ শুনে শুনে কানে তালা লাগার জোগাড়। এবার ছোট ছেলে সুনীল দাদার সঙ্গে যোগ দিয়ে বলল, কী বলব, ট্রেনেও কী হাসাহাসি! ও পাড়ার রণো দাস যখন এনিয়ে রোজ ঘোট পাকায়, তখন সবাই আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। এবার সুশীল এগিয়ে এসে কাঁধ ধরে সজোরে এক ঝাঁকুনি দিল, তারপর সাবধান করে দিল তাকে, তোমাকে পই পই করে বলছি, এসব ছাড়ো নইলে পথ দেখো।

নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে সে, প্রচণ্ড অভিমানে দুঃখ ও বেদনায় চোখের কোন বেয়ে আসা অশ্রুকে সংবরণ করার চেষ্টা করে। একটা মুখ বারবার তার চোখের সামনে বেসে উঠল। তার উদ্দেশে সে অভিযোগ ও বঞ্চনার ঝুলি উজাড় করে সাময়িক শান্তি খোঁজে। বিভূতি যে কতক্ষণ এভাবে তার পুষির সঙ্গে একান্ত কথোপকথনে ব্যস্ত ছিল, সে নিজেই জানে না। তার ঘোর ভাঙল তার ভিটে থেকে কিছুটা দূরে মোরগ ডাকার শব্দে।

ঠিক সাতটায় চা দিতে এসে বড় বউ প্রথম আবিষ্কার করে, বাবা ঘরে নেই। দরজাটা ভেজানো ছিল। ছোট বউ ঠোঁট উলটে জানাল দেখ গে ভোর ভোর খাল পাড়ে গেছে কি না। অতএব উদ্বেগহীন অপেক্ষা। রাতে বাড়ি ফিরে দুইছেলে যখন বাবার অন্তর্ধানের সংবাদ শুনল, তারা কোনও গুরুত্ব দিল না। উঠোনের টিউবওয়েলে মুখ ধুতে নিস্পৃহ গলায় জানিয়ে দিল, কোথাও রাগ করে পোদ উল্টে পড়ে আছে! যাবে কোথায়, আসতে তো হবেই!
পাশের গা হরিরামপুরে আজ লাফরা-ব্যঞ্জনা উৎসব। ভোর থেকে গাঁয়ের মহাপ্রভু মন্দির তলায়  হৈ  হৈ কান্ড। মন্দিরের পিছনে বিশাল বিশাল কড়াইয়ে রান্না হচ্ছে। উদ্যোক্তরা জানেন, বেলা দশটা থেকেই জনসমগম শুরু হবে। এখানে সবার আগমন বহুকাল ধরে। মন্দির সংলগ্ন বিশাল আঙিনা আগের দিন বিকেলে গাঁয়ের বউ-ঝি-রা গোবরজল দিয়ে ভাল করে নিকিয়ে রেখেছে। এখন ঝকঝক করছে। আয়োজকদের হাকডাকে, ছেলেপুলেদের কলকলানিতে চারদিকে উৎসবে মেজাজ। ভাত সহযোগে এই ব্যঞ্জন আহারও পুণ্যার্জন বলে মনে করে সবাই।
প্রথম ব্যাচ খেতে বসেছে। মালকোচা মারা ধুতি ও স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে কয়েকজন ছেলে খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত। ভিন গাঁ থেকে বিভূতির বড় বউমা তার ছেলেকে নিয়ে এসেছে। এখন সে বেশ ডাগর হয়েছে।  তাদের উল্টোদিকে পংক্তিতে বেশ কয়েকজন হতদরিদ্র মানুষ ও ভিখারি, ভবঘুরে রবাহূত ও অন্তজ শ্রেণীর মানুষ গোগ্রাসে গিলছে তাদের পাতের খাবার। হঠাৎ ছেলেটি তার মাকে ঠেলা দিয়ে বলে উঠল মা, ওই দেখ বোতলবাবা। তার মা উদ্দিষ্ট ব্যক্তির দিকে তাকাল একবার। খালি গা, কুঞ্চিত চামড়া, তার উপর কালো কালো ছোপ, এক মাথা এলোমেলো সাদা জটাজিট সেই ব্যক্তি ঘোলাটে দুই চোখ দিয়ে একবার তাদের দিকে তাকিয়েই আবার সম্মুখের অন্নব্যঞ্জনপূর্ণ কলাপাতার দিকে তড়িঘড়ি চোখ নামাল। মহিলা তাকে দেখামাত্রই ছেলেকে এক দাবড়ানি দিল, চুপ কর চুপ কর। তারপর চারিদিক ইতিউতি তাকিয়ে যখন দেখল কেউ তাকে দেখছে না, তখন সে নিশ্চিন্ত হল।

বোতলবাবা হাঁটছে। ভাঙা মোড়পথ উজিয়ে তাকে যেতে হবে ওই দূরে পিচ রাস্তায়। তারপর আরও আরও হাঁটাপথ।  তার শিরদাঁড়া নুয়ে পড়েছে। দুই শীর্ণ হাঁটু আর ধকল নিতে পারে না, পথ হাঁটার। হাতের লাঠিটার ওপর ভর দিয়ে ঠকঠক করে হেঁটে চেলেছে সে। কতদিন আধপেটা খেয়ে, কোন কোনও দিন না খেতে পেয়ে, আজ সে নোলা সামলাতে পারে নি। বড্ড বেশি খেয়ে ফেলেছে।  খেতে খেতে নাতি ও বউমার কথোপকথন শুনতে পেয়েছিল। প্রায় বছর তিনেক পর প্রিয়জনদের দেখা পেয়ে তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তারপরই এক অসীম নৈরাশ্য। যে অভিমান, স্বপ্নভঙ্গের বেদনা ও অতলস্পর্শী বিষাদ নিয়ে সে ঘর ছেড়েছিল, তা এখন আরও গভীর ভাবে চেপে বসল তার বুকে। তার হাঁটার গতি শ্লথ হয়ে এল।

বোতলবাবা দেখল যেন চারদিকে সন্ধ্যে নেমে এল। এখন তো বিকেল! তাহলে? আকাশপানে ঘাড়টা উঁচু করে সে দেখতে পেল, সারা আকাশজুড়ে মুশমুশে কালো মেঘ। বেশ জোরে হাওয়া বইতে শুরু করেছে। কেউ কোথাও নেই। একটু ভয় পেয়ে গেল । যদি ঝড়-জল একসঙ্গে ঝেপে আসে! বাস্তবে ঘটল তাই। ঝড়ের ঝাপটায় সে টাল সামলাতে পারল না।  তার হাত থেকে লাঠি ছিটকে পড়ে গেল। এই আকস্মিক বিপর্যয়ে তার মুখ থেকে কোনও শব্দ বেরুলো না। এদিকে শুরু হয়েছে তুমুল বৃষ্টি। বৃষ্টি তাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে । আঃ কতকাল পর এই স্নান। বৃষ্টির জলের তুমুল ধারা আলপথ টপকে ধেয়ে আসছে তার দিকে। অনেক কষ্টে সে তার বন্ধ চোখ খুলল। সে দেখল তার সর্বশরীর সেই জলে ডুবে যাচ্ছে। একবার কোনক্রমে ঊর্ধ্বাকাশে তাকাল সে। তারপর মন্দিরতলায় দেখা ঈশ্বরকে মনে মনে পেন্নাম জানিয়ে বিড়বিড় করে বলতে চাইল, মহাপ্রভু, তুমি কত কৃপাময়।


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!