Advertisement
  • গল্প
  • মে ৩, ২০২২

ইঁদুর

পাগল নই, আমি আসলে একটু বেশি দূর দেখতে পাই। আমার কথাবার্তা শুনে মনে হতে পারে যা মুখে আসে তাই বলি

কণিষ্ক ভট্টাচার্য
ইঁদুর

চিত্র: দেব সরকার

।। আদি।।

সিনিক! সিনিক তুমি; বলেও যখন ওর রাগ মিটল না তখন পছন্দসই বিষয়ে চলে এল, পাগল! পাগলের গুষ্টি! বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পাশের ঘর থেকে ওর গলা পেলাম, সম্বোধন বদলে গেছে তাতে; ওর মা ছিল পাগল, ছেলেও তেমন। ওদের বাড়িতে এসে থেকে জ্বলছি।

যদিও ও ঘরে সম্বোধন করার মতো আর কেউ নেই। এত বছরেও ছেলেপুলে হয়নি আমাদের। টোনাটুনির সংসারে তাই বউ রেগে গেলে গোটা ঝালটা আমাকেই গিলতে হয়। তার ওপর মাথা গরম থাকলে আবার আমার বউয়ের মুখের তেমন আগল থাকে না। কিন্তু ওই যে, রেগে যায় মানে মানুষটা ভালো। আর মনের কথা চট করে বেরিয়ে আসে মানে, আসলে ও সরল লোক। আমার মতো নয়। কথাগুলোও তেমন ভুল বলেনি ভেবে দেখতে গেলে। বিয়ে হয়ে আসার পর থেকে আমার মা ওকে জ্বালিয়েছে কম না। সে জ্বালা তো মিটেও গেছে অনেক বছর।

কিন্তু ওই যেটাকে পাগলামি বলল! ওটা ঠিক পাগলামি নয়। সেটাকে দূরদর্শিতা বলা যায়। মানে কোনো ঘটনা কী ঘটবে সেটা আগে থেকে বুঝতে পারি বা আন্দাজ করতে পারি। সেটা ঠিক হাওয়ায় হয় না। অনেকে দিন অনেক কিছু দেখে ভেবে সেসব সিদ্ধান্তে আসি আমি, আর অনেক সময়ে ঠিক সেটাই ঘটে। গণ্ডগোলও হয়ে যায় কখনও কখনও। কিন্তু আগে বুঝতে পারি বলে ভবিষ্যতের ঘটনাকে ম্যানিপুলেট করতে চাই। মানে যা ঘটবে সেটাকে আসলে আমিই নিয়ন্ত্রণ করব, কিন্তু লোককে সেটা বুঝতে দেওয়া যাবে না। মাঝে মাঝে সেসব এমন নিখুঁত পরিকল্পনা মাফিক ঘটে যে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিতে ইচ্ছে করে। সেই কোন একটা সিনেমার না কীসের ডায়লগ চলছিল মার্কেটে, কভি কভি লাগতা হ্যায় কে আপুন হি ভগবান হ্যায়। ওটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু ওটা কখনও মুখে বলতে নেই, অন্তত লোকের সামনে। তাহলে লোকে সন্দেহ করে।

বউ যে রেগে যেতে পারে এটাও আমি আশঙ্কা করেছিলাম তবু কথাটা তুলে ফেলেছি। আসলে ভগবানেরও তো ভুল হয় কখনও কখনও। টাইমিংয়ের ভুল। ভগবানের আইডিয়াটা জব্বর। পাবলিক কোন কালে তৈরি করে সব ভালোর দায় তার ওপরে চাপিয়ে বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে আছে। আর সব ভুলের দায় পাবলিকের। আর এত বছরে ভগবান টাইমিং প্র্যাকটিস করার ঢের সময় পেয়ে গেছে। ফলে ভুলচুক তার বিশেষ হয় না। হলেও দায় তার ঠেকে না। দায় পাবলিকের। তবে বউ কতক্ষণে থামবে সেটা আমার একটা আন্দাজ আছে। কখনও সেটা আমাকেই থামাতে হয় কখনও আবার আপসেই থিতিয়ে যায়। নির্ভর করে কী বিষয়ে ও কতটা রেগেছে তার ওপর। ওই যে, দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ আর আর তার থেকে আসা সিদ্ধান্ত। ওই পর্যবেক্ষণ আর সিদ্ধান্তের পর্বটা লোকে দেখতে পায় না বলে সেটাকে পাগলামি ভাবে। অফিসে অবশ্য বলে আমি সেয়ানা পাগল। কেউ কেউ বলে অতীব খচ্চর। সেসব আমি জানি। কিন্তু কিছু বলি না শুধু হাসি। কারণ ওই বলে ফেলাটুকুতেই ওদের প্রেশার কুকারের সিটি বেজে যায়। বার্স্ট করে না। ওসব তাই ভালো জিনিস। বার্স্ট করা ভালো নয়। বিশেষত কদিন বাদে প্রমোশন যখন।

ঘরে ইঁদুর হয়েছে, বউ একথা বলার পরে আমার দিক থেকে কদিন বিশেষ হেলদোল না দেখে একদিন খিচখিচ করে উঠল। তার মানে এই নয় যে আমি চুপচাপ বসে ছিলাম কদিন। ওই সময়ে আমি আসলে পড়াশোনা আর পর্যবেক্ষণের মধ্যে ছিলাম। সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি। বরং ইঁদুর বিষয়ে আমি কী কী জানি তার একটা তালিকা করছিলাম। ডায়েরিতে সব লেখা আছে। দেখা গেল এতটা বয়েসে এসে আমি ইঁদুর বিষয়ে প্রায় কিছুই জানি না। তালিকাটা এরকম হলো–

১। ইঁদুর ঘরের খাবারদাবার চুরি করে খায়। এমনকি বইপত্র খেয়ে নেয়। (শুনেছি কাঠের জিনিসও খায় কিন্তু দেখিনি। বউ দেখিয়েছে মুসুর ডালের প্লাস্টিকের কৌটোর ওপর ইদুরের দাঁতের দাগ। তাতে অবশ্য প্লাস্টিক খায় এমন সিদ্ধান্ত করা যায় না। তবে তাতে পয়সা নষ্ট হয় সেটা ঠিক।)

২। ইঁদুর পাকাবাড়ির মেঝে আর দেয়ালের কোনা দিয়ে দৌড়োতে পছন্দ করে। এর কারণ ইঁদুর জ্যামিতি পড়েনি বা কর্ণ দিয়ে দৌড়লে পথ কম হতো এটা জানে না এমন নয় বরং অন্য প্রজাতির আর যে প্রাণী দুটি এই বাড়িতে থাকে থাকে তাদের ইঁদুর ভয় পায় এবং বিশ্বাস করে না। আমি আর আমার বউ।

৩। ইঁদুর লোমশ আর ল্যাজবিশিষ্ট প্রাণী। কিচকিচ করা ডাকে।কিন্তু এটুকু সিদ্ধান্তে আসতে আসতে বাড়িতে ইঁদুরের সংখ্যা বেড়ে গেছে। তার থেকে পরের সিদ্ধান্ত এসেছে যে,

৪। ইঁদুরের ঘনঘন বাচ্চা হয়।

আমার জানার তালিকায় লেখা হয়নি ইঁদুরের কলের কথা, যদিও সেটা আমি জানতাম। আর হ্যাঁ ইঁদুর মারার বিষ। আসলে এখন তথ্যই হলো সম্পদ। আমি কাজে লাগানোর জন্য কেবল তথ্য সংগ্রহ করছিলাম তখন ইঁদুর বিষয়ে, কিন্তু আমার বউ ডায়রিতে সেই তথ্যপঞ্জি লেখার সময় ঢুকে এসে ওই ইঁদুরের কল আর বিষের কথা বলল। আসলে যা বলল তা হলো, এত বিদ্যে না ফলিয়ে একটা কল বা বিষের প্যাকেট নিয়ে এলেই তো হয়! এটা যে আমি জানতাম না এমন নয়। কিন্তু বলে ওর ক্ষোভ মিটল কিছুটা। আমি আরও কটা দিন সময় পেলাম।

অবনী ঘোষের ইঁদুর মারা বিষ। ঘরে খাবে। মরবে বাইরে গিয়ে। আপনার ঘর নোংরা হবে না। ঘরে ইঁদুর পচা দুর্গন্ধ হবে না। একেবারে অব্যর্থ। কোনো খাবার দিতে হবে না। কোনোকিছুর সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে না। কেবল ইঁদুরের যাতায়াতের পথে ওষুধটা ছড়িয়ে দিতে হবে। আর হ্যাঁ, জল যেন জলে না থাকে। বাজারের সামনের রাস্তায় একটা ভ্যানে ছোটো একটা অ্যামপ্লিফায়ার বক্স লাগিয়ে লোকটা বিক্রি করছিল। সেদিন আমার আবার বাজারে যেতেও খানিকটা দেরি হয়ে গেছিল। অফিসে দেরি করা যাবে না সামনে প্রমোশন। তবু লোকটার ভ্যানের সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনিই কি অবনী ঘোষ? লোকটা হেসে ফেলল। না দাদা, আমরা ক্যানভাসার। সেলসম্যানও বলতে পারেন। মাল কিনে বেচি। লোকটার লাউডস্পিকারের বক্সে তখন ঠিকানা বলা হচ্ছে। অবনী ঘোষের ইঁদুর মারা বিষ যদি কাজ না করে তাহলে আপনি ওই ঠিকানায় যোগাযোগ করলে পয়সা ফেরত পাবেন। আমি লোকটাকে বললাম, ওটা কি অবনী ঘোষের ঠিকানা? গেলে দেখা পাব? কখন যেতে হবে? লোকটা এই কথায় একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল প্রথমে। কিন্তু কামাল সেলসম্যান লোকটা। বলল, ওষুধ কাজ না করলে আমাকে এসে প্যাকেট দেবেন। আমি পয়সা ফেরত দেব। সারা বছর সকালে এখানে থাকি আর বেলায় পাড়ায় ঘুরি। তবে আম্নাকে আসতে হবে না। গ্যারান্টি। এই যে কথা বলার সময় আত্মবিশ্বাস মিশিয়ে দেওয়া, সেটা ফাঁপা হোক বা সত্যি কিংবা বুক ঠুকে জেনেশুনে মিথ্যে বা না-জেনে ভুল কথা বলা, এটা আমি কিছু লোকের মধ্যে দেখেছি। তারা সাধারণত নেতানেত্রী হয়। অফিসের বস হয়। এই কথা বলার ভঙ্গিটা শেখার মতো। একদম নিঃসংশয় ভাবে মিথ্যে বলতে পারা, এটা নিশ্চয়ই অনেকদিনের অভ্যাসে গড়ে ওঠে। এরাও নিশ্চয়ই প্রথমদিকে একটু ইতস্তত করত বলে আমার বিশ্বাস। একটু তুৎলে যেত। তারপরে বহু লোকের সামনে বারেবারে বলে বলে এই নিঃসংকোচে কিন্তু বিশ্বাসযোগ্যভাবে মিথ্যে বলাটা আয়ত্ত করে ফেলেছে। শুনেছি উকিলরা এমন বলতে পারে, কিছু ডাক্তারও পারে। আর সেলসম্যান। মানে যেখানেই পাবলিক একাবোকা হয়ে কারো ওপর নির্ভরশীল অবস্থায় থাকে তখনই এসব বলা সুবিধের। কারণ সে তখন ক্ষমতাবান। সাবঅর্ডিনেটকেই মাননীয়-মাননীয়া সম্বোধনে চিঠি লিখতে হয়, কিন্তু তারা কাচের ঘরে বসে যা-খুশি বলতে পারে।

অবনী ঘোষ আসলে কেউ নেই। অন্তত যারা অবনী ঘোষের নামে ব্যবসা করে তাদের কেউই আসলে অবনী ঘোষ নয়, কেউ অবনী ঘোষকে চাক্ষুষ দেখেনি বা তার কাছ থেকে মাল কিনে, বেচে না। তবু প্রত্যেক বাজারের মোড়ে, লোকাল ট্রেনের কামরায়, গোটা রাজ্য জুড়ে ‘মারব এখানে, লাশ পড়বে শ্মশানে’ চলছে। ডায়েরিতে আমি যত্ন করে নোট রেখেছি এটা। আর বাজার ঘুরে জানা গেছে যে, ইঁদুরের কল আর বিষ ছাড়াও আঠা লাগানো একরকম প্যাড পাওয়া যায় এখন। যার ওপরে ইঁদুর এসে দাঁড়ালে আর পালাতে পারে না। প্রীতি সংসারে সর্বব্যাপিনী, কার যেন কথা কলেজে শুনেছিলাম! পিরিতি কাঁঠালের আঠা পুরো। বিষপ্রয়োগে অবলা জীবকে স্বহস্তে মারতে হয় না বলে সর্বব্যাপিনী পিরিতির আঠায় পাবলিকের মন সাফসুতরো থাকে। আঠা থেকে ছাড়িয়ে ইঁদুরকে রাস্তায় বা ছাদে গিয়ে ফেলে দিলেই হলো। কাকে ঠুকরে খেয়ে নেবে বা চিলে ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে। সেসব চোখে দেখতে হয় না। আটকাবে ঘরে, মরবে বাইরে। কোমলমতি পাবলিকের জন্য এই আঠা-প্যাড খুব জনপ্রিয় হয়েছে এমন তথ্যও আমি লিখে রেখেছি, কারণ বড়ো বড়ো কোম্পানি অহিংস এবং পলিটিক্যালি কারেক্ট পাবলিকের স্বার্থরক্ষায় এই ব্যবসায় নেমে পড়েছে। ব্র্যান্ডেড ইঁদুর-ধরা আঠা-প্যাড পাওয়া যাচ্ছে এখন। অবনী ঘোষ টাইপের ব্যাপার নয়। মাল্টিন্যাশনাল।

।। মধ্য ।।

রিসোর্স মবিলাইজেশন। এই কথাটা এখন আমাদের অফিসে খুব চলছে। অর্থাৎ তোমার যা সম্পদ আছে, যা তুমি এতকাল ব্যবহার করনি বা করার দরকার পড়েনি সেসব খুঁজে বের করো এবং ব্যবহার করো। এক কথায় বলতে গেলে, আমাদের অফিসের আগের অবস্থাটা তেমন খারাপ ছিল না কিন্তু নতুন কর্তারা কবছরে সব ফুঁকে দিয়েছে। এখন হাঁড়ির তলায় হাতা লাগছে বলে খোঁজ পড়েছে আরও চালডাল যদি কিছু থেকে থাকে। আমাদের সেকশনের কাজ তথ্য নিয়ে। আগে কটা ওয়ার্কশপ সেমিনার করে গুচ্ছের টাকা ব্যয় হয়েছে যে, তথ্যই আজকের সম্পদ। যার কাছে যত তথ্য সে তত ধনী। সেই তথ্যভাণ্ডার চেলে বেছে আমাদের সেকশন জানাবে যে কর্তাদের ফুঁকে দেওয়ার বাইরে আজও কি কি রয়ে গেছে। আমার আবার রোগ আছে যেটা করব সেটা তলিয়ে বুঝে নিয়ে করতে হবে। সে করতে গিয়ে বুঝলাম যে ব্যাপারটা জরুরি বটে, মানে ওই তথ্যকে কাজে লাগানো।

ইঁদুরগুলোকে মেরে দিলে তো মারাই হয়ে গেল বরং ইঁদুরগুলোকে প্রয়োজনে কীভাবে কাজে লাগানো যায় যে তারা আমার জন্য কাজ করবে। রিসোর্স হিসেবে ওদের মবিলাইজ করতে হবে। ইঁদুরগুলোকে দুধেল গাই বানিয়ে তুলতে হবে। তার জন্য তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজন। আর এই কথাটাই আমার বউকে বলতে গিয়ে শুনলাম, পাগল! পাগলের গুষ্টি। আসলে ওর দোষ নেই। প্রথমত আমার টাইমিং-এর গণ্ডগোল, সেদিনই দুধের বাটি উলটেছে ইঁদুরে; বউয়ের মাথা এমনিই তাতে গরম ছিল আর দ্বিতীয়ত ওর কাছে তথ্যের অভাব। বউ ইঁদুর মারার কল বা বিষের কথা বলেছিল কিন্তু মাঝখানের এই রিসোর্স মবিলাইজেশনের কনসেপ্ট তো ওর কাছে ছিল না ফলে ওর প্রেশার কুকারে সিটি পড়া খুব আশ্চর্যের নয়। আমি তো ভগবানের মতো প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে পারফেকশনের সময় পাইনি ফলে আমার ভুলচুক হয় মাঝে মাঝে। সেদিন হলো।
ইঁদুর সম্পর্কে যে যে তথ্য আমার ডায়েরিতে লেখা হয়েছে–

৫। ইঁদুর র‍্যাটাস গণের একটি দন্তুর স্তন্যপায়ী প্রাণী।
৬। এরা দৈর্ঘ্যে ৪-৮ ইঞ্চি হয়। খুব দ্রুত চলাচল করে। সাধারণত মাটিতে গর্ত করে থাকে। এরা জমির ফসল, ঘরের আসবাব, কাপড় ও কাগজ কেটে নষ্ট করে।
৭। ইঁদুরের শরীরে এক রকমের ব্যাকটেরিয়া থাকে তার থেকে প্লেগ রোগ ছড়ায়।

এছাড়া ইঁদুর দমনের (এই দমন কথাটা লিখে বোধহয় ওদের অপরাধী বা দুষ্কৃতী বলে চিহ্নিত করা সহজ হয় তাই সংবাদপত্রে ঘরোয়া গৃহিণীদের জন্য বা কৃষিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে কৃষকদের জন্য এই দমন কথাটা লেখা হয়। ইতিহাস বইতে যেমন জনবিদ্রোহের ক্ষেত্রে লেখা হতো রাজা রানি বা শাসকেরা বিদ্রোহ দমন করতেন।) নানা ঘরোয়া পদ্ধতি যেমন, লবঙ্গ, তেজপাতা, লাল লঙ্কার ঝাঁঝ, পিপারমিন্ট বা বেকিং পাউডার ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে তেমনই ফসল বাঁচাতে মাঠে জিংক ফসফাইট, ল্যাসির‍্যাট, ব্রমাপয়েন্ট, ক্লের‍্যাট, অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইট ইত্যাদি মারাত্মক বিষের কথা বলা হয়েছে। প্রথমটা একটু শুনতে ভালো, ঘরে ইঁদুর ঢুকতেই দেব না। এমন পরিবেশ তৈরি করে রাখব যাতে ওরা ঢোকার সাহস বা পথই না পায়। আর ঘরে ঢুকতে না পেলে ওরা বাইরে থাকবে তখন মারাত্মক রাসায়নিক ছাড়া আর পথই বা কী! পথ অবশ্য আছে। কৃষি দপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতেই বলা হয়েছে, ইঁদুরের শত্রু যেসব প্রাণী যেমন বেড়াল, শিয়াল, পেঁচা, সাপ এগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার কথা।

ইঁদুর নিয়ে অবশ্য অনেক পুরনো কথা আছে। উপনিষদের গল্পে ছিল বোধহয়, এক মুনির আশ্রমে ইঁদুর বেড়ালকে ভয় পায় বলে মুনি মন্ত্রবলে তাকে বেড়াল বানিয়ে দেয়। এইভাবে বেড়াল থেকে কুকুর, কুকুর থেকে বাঘ হয়ে যখন সেই মুনিকেই খেতে যায় তখন মুনি তাকে পুনর্মূষিকভবঃ বলে আবার ইঁদুর বানিয়ে দেয়। তাছাড়া হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার গল্প আছে। সোমেন চন্দ্রের ইঁদুর নামে গল্প নাকি পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। স্পিগলম্যানের গ্রাফিক নভেল আছে। সেসব আমার কাছে তথ্য হিসেবে তেমন জরুরি নয়। কারণ এসব রিসোর্স মবিলাইজেশনে কাজে লাগবে না।

ঘোর সন্দেহ ইঁদুরগুলো নানাজনের সঙ্গে নানা সাঁটে আছে। লক্ষ করে দেখেছি যে রাতে ইঁদুরগুলো ঘরে লাস্যতাণ্ডব বেশিমাত্রায় করে তার পরের দিনই ওই অবনী ঘোষের বক্স লাগানো ভ্যান ঘুরতে থাকে পাড়ায়। যেদিন ইঁদুরগুলো নিচের ঘরের জলের পাম্পের লাইন কাটল, বাড়ি জুড়ে হুলুস্থুল অবস্থা সেদিনই দেখি মিস্তিরির ফোন? মিস্তিরি যখন টুলটা ঘরের সিঁড়ির নিচ থেকে বের করল তখন স্পষ্ট দেখলাম ইঁদুর আর মিস্তিরি দুজনের চোখেই একটা শয়তানি হাসি ছিল।

আমার ঘোর সন্দেহ ইঁদুরগুলো নানাজনের সঙ্গে নানা সাঁটে আছে। এই আইডিয়াটা অবশ্য আমার মাথায় এসেছে সেদিন বসে টিভিতে দা কিড সিনেমাটা দেখতে গিয়ে। ট্র্যাম্পের পালিত বাচ্চা ছেলেটা রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ঢিল ছুঁড়ে কাচ ভাঙে আর যখনই গৃহস্থ তা দেখতে যায় দেখে রাস্তা দিয়ে জানলার কাচ সারাইওয়ালা ট্র্যাম্প আসছে সারাইয়ের লটবহর নিয়ে। আমিও লক্ষ করে দেখেছি যে রাতে ইঁদুরগুলো ঘরে লাস্যতাণ্ডব বেশিমাত্রায় করে তার পরের দিনই ওই অবনী ঘোষের বক্স লাগানো ভ্যান ঘুরতে থাকে পাড়ায়। প্লাস্টিকের কৌটো বালতি গামলাওয়ালাকে দেখা যায় বেলার দিকে যেদিন ওরা ওসবে দাঁত বসায়। ইলেকট্রিক মিস্তিরি তিন সপ্তাহ ধরে ফ্যান অয়েলিং করতে নিয়ে রেখে দিয়েছে, ফোন করলে আসছি আসছি বলে কখনও কাটাচ্ছে আবার কখনও ফোনই ধরছে না। যেদিন ইঁদুরগুলো নিচের ঘরের জলের পাম্পের লাইন কাটল, জল নেই, বাড়ি জুড়ে হুলুস্থুল অবস্থা সেদিনই দেখি মিস্তিরির ফোন, দাদা বাড়ি আছেন? ঝুলিয়ে দিয়ে আসব নাকি? শুনে এমন রাগ হল যে বলে ফেললাম, হ্যাঁ নাইলনের দড়ি কিনে রেখেছি। ফাঁসটাও কি করে রাখব? মিস্তিরি ভ্যাবাচ্যাকা, না মানে ফ্যানটার কথা বলছিলাম।

সাঁট তো আছে বটেই। মিস্তিরি যখন টুলটা ঘরের সিঁড়ির নিচ থেকে বের করল তখন টুলের তলা থেকে একটা ইঁদুরও হুড়মুড় করে ঘরের মাঝখান অবধি চলে এসে মিস্তিরির দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি স্পষ্ট দেখলাম ইঁদুর আর মিস্তিরি দুজনের চোখেই একটা শয়তানি হাসি ছিল। আর টুলের পায়াও ওরা ক্ষয়িয়ে দিয়েছে দাঁতের শানে। হয়তো কাঠের মিস্তিরি এলে দেখব তার সঙ্গে সালাম নমস্কার হ্যান্ডশেক করছে আমার ইঁদুর! মোট কথা ইঁদুরগুলোকে আমার চারপাশের লোকজন কাজে লাগাচ্ছে আমারই গাঁটকাটার জন্য। কিন্তু কথা হলো, কী করে, কীসের বিনিময়ে! খেতেটেতে দিচ্ছে কিছু! আর আমি কীভাবে ওদের নিজের কাজে লাগতে পারি যাতে বউ বেশি কিচকিচ থুড়ি খিচখিচ না করে! এসব কথা অবশ্যই বউকে বলিনি কারণ ও বুঝবে না, বিশ্বাসও করবে না। উল্টে আমাকে আবার পাগলের গুষ্টি বলবে। আমি পাগল নই, আমি আসলে একটু বেশি দূর দেখতে পাই। আমার কথাবার্তা শুনে মনে হতে পারে যা মুখে আসে তাই বলি, তবে যে একথা বিশ্বাস করে তার থেকে বড়ো গাধা দুনিয়ায় নেই। আসলে যা বলি খুব ভেবেচিন্তে সময় বুঝে বলি, আলফাল কথাও। মূল কথা হলো টাইমিং। ভগবানের সেটা অনেক কালের প্র্যাকটিস থাকতে পারে আমার এই পাঁচ-দশকেই অনেকটা আয়ত্ত। কখন কোনটা বলতে হবে সেটা জানা। নেহাত সন্তানাদি নেই নয়তো তাকে শিখিয়ে যেতাম এই বিদ্যেটা। ভাইপো একটা আছে। আজকাল আর বেশি আসে না, ওকেও শেখাতে পারতাম। সব তো ওই পাবে। নয়তো আর আমার আছে কে!

কিন্তু ওই যে কভি কভি লাগতা হ্যায় কে আপুন হি ভগবান হ্যায়। উপনিষদের মুনির ইঁদুরকে কোনোমতেই বাড়তে দেওয়া যাবে না, কোনো ক্ষমতা দেওয়া যাবে না, ওদের ইঁদুর বানিয়ে রেখেই ব্যবহার করে নিতে হবে কেবল। রিসোর্স মবিলাইজেশন। যেভাবে অবনী ঘোষের নামে ক্যানভাসার করছে; ও দিদিভাই, ও বউদিমণি, যা নেবেন তিরিশ যা নেবেন একশো, বলে প্লাস্টিকের কৌটোওয়ালা করছে; যেভাবে ইলেকট্রিক মিস্তিরি ওদের দিকে চোখ টিপে হাসছে সেভাবেই ওদের ব্যবহার করতে হবে। ইঁদুর পোষ মানে। ওদের পোষ মানাতে হবে। খেতে দিতে হবে। ইঁদুরগুলোকে খেতে দেব কিন্তু এমন প্যাঁচে ফেলে খেতে দেব যাতে আমার হয়ে কাজ করা ছাড়া ওদের আর কোনো পথ না থাকে।

।। অন্ত্য ।।

তথ্য। তথ্যই সম্পদ। এর পরে চলল আমার দীর্ঘ ও অনুপুঙ্খ তথ্য সংগ্রহের কাজ। প্রথমেই রাতে আলো নিভিয়ে আমি খাওয়ার ঘরে একটা চেয়ারে পা তুলে টর্চ হাতে বসে রইলাম। বউ যথারীতি বলল, পাগলের গুষ্টি! মাঝরাত্তিরে আলো নিভিয়ে বসে ইঁদুর নিয়ে রিসার্চ হচ্ছে। যত ন্যাকামো! ব্যাপারটা আমারও সুবিধের লাগছিল না। বিশেষত চারপাশ দিয়ে ইঁদুরের পড়িমরি দৌড়ের আওয়াজ, বাক্সপ্যাটরার মধ্যে খড়খড় আওয়াজ, খবরের কাগজের মধ্যে খসখস শব্দ, এদিকে চেয়ারের ওপরের থেকে তাক করে টর্চ জ্বালালেই কিছু নেই। নেমে পড়ব কিনা ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্কভাবে পা নামাতেই একটা ইঁদুর পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করতে এল। আমি ভয় না পেলেও ব্যাপারটা ঠিক জুত করতে পারিনি। আমার ডায়েরির তথ্য বলছে, ইঁদুর কামড়ালেও জলাতঙ্ক হয়। অ্যান্টি র‍্যাবিস না নিলে সাক্ষাৎ মৃত্যু। ছ-ছটা ইঞ্জেকশন। ঢের দাম। ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে আবার এদের ষড় নেই তো!
এভাবে হবে না। পরের দিন আমি আমার আর বউয়ের দুটো ফোনের ক্যামেরা চালু করে রান্না ঘরের বেসিনের কাছে সেট করে রেখে ঘুমতে গেলাম। তাতেও ছবি কিছুই উঠল না। আমি আফিসে কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে সাউন্ড পুরো বাড়িয়ে শোনার চেষ্টা করছিলাম ছবি না হোক শব্দ কিছু ধরা পড়েছে কিনা, দেখি আমার আশেপাশে ভিড় জমে গেছে। সেয়ানা পাগল, অতীব খচ্চর অর্থাৎ আমি এই বয়েসে কানে প্লাগ গুঁজে ফোনে কী দেখছে সেই আগ্রহ মেটাতে। আমি যেন কাউকে দেখতেই পাইনি এমন মুখ করে ঘুটঘুটটি কালো ভিডিওটা ফার্স্ট ফরোয়ার্ড করে দেখে গেলাম। ওরা বেদম বোকা বনে যাওয়ায় সেদিন থেকে অফিসে আমার নতুন নাম হলো হারামির হাতবাক্স। তারপরের রাতে ঘরের আলো জ্বালিয়ে ফোন রাখলাম। অফিসে বসে ওটা দেখতে দেখতে শুনলাম, এ তো ওদেরই বাড়ি। মালটা বোধহয় এখন বউদিকে সন্দেহ করছে। আজব চিজ মাইরি! যদিও বউয়ের ফোনে তো কিছুই ওঠেনি আমার ফোনে একটা চলন্ত ইঁদুরের লেজের ডগা আর গোঁফের লোম একবার করে দেখা গেছে।

এভাবে হবে না। আপুন হি ভগবান হ্যায়। তবু সবকিছু যে একবারে ঠিকঠাক হবে তার কোনো মানে নেই। প্র্যাক্টিস মেকস ম্যান পারফেক্ট। নেতানেত্রীদের মতো, অফিসের বসের মতো, সেলসম্যানের মতো ওই বুকঠুকে, চোখের পলক না ফেলে ডাহামিথ্যে বলার স্কিলও একদিনে আসেনি।
আপুন হি ভগবান হ্যায়। বউ ডালের বড়া করবে বলে মিক্সিতে ডাল বেটেছিল, আমি তার থেকে খানিকটা নিয়ে রাতে বউ শুয়ে পড়ার পর খয়েরি একটা লোমশ চাদর দিয়ে গামাথা ঢেকে বাকি চাদরটা দিয়ে একটা গার্ডার বেঁধে একটা লম্বা লেজ বানিয়ে বেসিনের কাছে ফিসফিস করে বললাম, আমি তোমাদেরই লোক। আমি তোমাদেরই লোক। বলে ওদের দেখিয়ে দেখিয়ে একটা ডালের বড়া খেলাম। তোমাদের মধ্যে যে সবচেয়ে ধার্মিক আজ রাতে তার জন্য তিনটে ডালের বড়ি থাকবে ড্রেনের পাশে। যে সবচেয়ে ধার্মিক সে কেবল দেখতে পাবে বড়িগুলো। সেই পথে গেলে তোমরা তোমাদের প্রতিশ্রুত ভূমি ফিরে পাবে। আমি তোমাদের পথ দেখাব। খড়খড় করে আওয়াজ হলো পিছনের বাসনের তাকে। এই তো হচ্ছে! আমার গলা কাঁপেনি। চোখের পলক পড়েনি।

আমাদের ড্রেনের মুখ থেকে পাশের বাড়ির দিকে রাতে তিনটে বড়ি দিলাম যাতে ওরা ওদের বাড়িতে যায়। পাশের বাড়ির বুড়ি ছুতোয়নাতায় ঝামেলা করে। যাক ইঁদুর ওদের বাড়িতে। প্রথম দুদিন যেমন কে তেমন পরে রইল। ওরা কি আমায় বিশ্বাস করছে না! চতুর্থ রাতে আবার সেজেগুজে আমি বললাম, আমি তোমাদের লোক। এই দেখ আমার মুখ লোমশ। আমার লেজ। এই দেখো। সেদিন আমি পাশের ড্রেনের মুখে ছঁড়ে দিলাম আটার গুলি। তার পর থেকেই আমাদের বাড়িতে রাতে খড়খড়, খুটুস খুটুস যেন কম শোনা গেল। আমি নিয়ম করে আটার গুলি, ডালের বড়া, বাসি আলুর চপ এমনই সব লোভ সরবরাহ করে গেলাম দরজার বাইরে সব ধার্মিক ইঁদুরদের জন্য। রাতের আওয়াজ আরও কমে এল।

আমি যখন ইঁদুরদের রাজ্যে নিজেকে নতুন মসিহা বলে ভাবছি সেদিনই দেখি বাঙ্কারের ওপরে খুটখুট আওয়াজ। ওখানে আমাদের লেপ কম্বল তোলা থাকে। লেপ গায়ে দেওয়ার মতো ঠান্ডা পরে না বলে আমি শখ করে দামি একটা হালকা কম্বল কিনেছিলাম। ওটাও ওখানে রাখা। আপুন হি ভগবান হ্যায়। মাথাটা কেমন চড়াং করে গরম হয়ে গেল, হারামজাদাগুলোকে আমি খেতে দিয়েছি আর ওরা ওখানে উঠেছে! আমি বউকে বললাম, লাঠি আনো। শিগগির। একটা চেয়ার টেনে লেপের বস্তা কম্বলের ব্যাগের এপাশ ওপাশ দিয়ে খোঁচাতে লাগলাম। আমার মাথায় তখন আমিই চেপে বসেছিলাম। আমি, আমি! যে আমি সর্বশক্তিমান, যে আমি অনেকদূর দেখতে পাই। আমি একদম নিশ্চিতভাবে লাঠি দিয়ে ঠেসে ধরলাম ইঁদুরটাকে। তাড়া, ঠেলা, গুঁতো খেয়ে কিচকিচ করতে করতে বাঙ্কারের একেবারে ধারে এসে যেই দাঁড়িয়েছে ইঁদুরটা আমি এক লাথির বাড়িতে ওটাকে ওপর থেকে নিচে ফেলে দিলাম। কী আজব! ইঁদুরটা ওখানে পড়ে কোথায় দৌড়ে পালাবে, তা না! ওখানেই মরে গেল। মেঝেতে ওর মুখের কাছে খানিকটা রক্ত ছেৎড়ে ছিল। বউ এসে বলল, এ বাবা এভাবে মারলে! আমি নির্বিকার মুখে বললাম, আমি মারিনি, ওটা পালাতে গিয়ে ওপর থেকে পড়ে মরে গেছে। বউ ওঘরে যেতেই আমি মরা ইঁদুরটার লেজ ধরে বারান্দা দিয়ে ছুঁড়ে রাস্তায় ফেলে দিলাম। পাঁচিলের বিড়ালটা লোম ফুলিয়ে লাফ দিয়ে রাস্তায় নামার আগে আমাকে একটা চোখ মেরে গেল। পায়ের হাওয়াই চটি দিয়ে রক্তটা মুছে বাথরুমে ঢুকে গেলাম।

অদ্ভুত তীব্র একটা আনন্দ হচ্ছিল। চূড়ান্ত নেশার মতো। আপুন হি ভগবান হ্যায়। আমার গলা দিয়ে একটা ঘড়ঘড় আওয়াজ বেরচ্ছিল। যৌন উত্তেজনার তীব্রতম মুহূর্তের মতো। আমি ওদের মসিহা। বাঁচালে ওদের আমিই বাঁচাবো, আমার বিরুদ্ধে গেলে আমিই মেরে দেব। আমি, আমিই শেষ কথা। চিৎকার দিয়ে ফেলছিলাম আরেকটু হলে। আমি তাড়াতাড়ি কল খুলে দিলাম। বউ কী ভাববে লোকটা এই বয়েসে হঠাৎ বাথরুমে গিয়ে…! ভুল বুঝবে কারণ ওর কাছে তথ্য নেই। তথ্যই সম্পদ এখন। এই সেয়ানা পাগল, অতীব খচ্চর, হারামির হাতবাক্স আগামীকাল থেকে ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্টের সেকশন ইনচার্জ। ওরা কাল থেকে আমার নতুন রূপ দেখবে। সেয়ানা পাগল নয়, অতীব খচ্চর নয়, হারামির হাতবাক্স নয়, আমি সাক্ষাৎ শয়তান। আমি বউকে না, আমি সবাইকে সন্দেহ করি। নিজের ছায়াকেও বিশ্বাস করি না। আমি জানি সবাই আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে পারে। কীভাবে পারে তাও আমি জানি। কারণ তার সব পথঘাট আমার ঘোরা।

পরের দিন অফিস থেকে ফিরতেই বউ বলল, এই দেখো সারা ঘরে ইঁদুর পচা গন্ধ। কোথায় নতুন সেকশন ইনচার্জের দিন কেমন কাটল তা নয়। ইঁদুর পচা গন্ধের কথা বলছ! আমি বললাম, তুমি ভালো কিছু দেখতে পাও না, না! সারাদিন শুধু খারাপ দেখা তোমার স্বভাব হয়ে গেছে। এই যে আজ তোমার জন্য পয়লা বৈশাখের একটা শাড়ি এনেছি দেখ। আমার বউটা বোকার হদ্দ। তবু বলে, গন্ধে তো ঘরে টেকা যাচ্ছে না! নতুন শাড়ি পরে বাইরে ঘুরে আসি চল। বললাম, যাব তুমি আগে চা বসাও। রান্না ঘরে গিয়েই বউয়ের চিল চিৎকার, দেখে যাও! এই পিসবোর্ডের বাক্সটার ভেতরে কতগুলো খচমচ করছে! শান্তভাবে বউকে বললাম, তুমি চা বসাও। তারপর উঁকি দিয়ে দেখলাম বাক্সের ভিতরে আমারই দেওয়া বাসি আলুর চপ নিয়ে কামড়াকামড়ি করছে দুটো ধেড়ে। দুটো বাচ্চাসহ বাক্সের কোনায় আরও কটা বসে আছে। আমি তাড়াতাড়ি সেলোটেপ দিয়ে বাক্সের মুখটা আটকে দিলাম। বউয়ের চা হতে ধীরেসুস্থে একটা কেরোসিনের ডিব্বা নিয়ে ছাদে গেলাম। আজ খুব মনোরম পরিবেশ। এমন সন্ধেবেলা কোনোদিন ছাদের ওঠা হয় না। আমি ওদের তিষ্ঠতে দেব না। ধীরে ধীরে চায়ে চুমুক দিয়ে সিগারেট ধরাই। বন্ধ বাক্সে কেরোসিন তেল ঢালি। ওপর থেকে সোহাগ করে বলি, কী গো তোমার শাড়ি পরা হলো ! আজ বাইরে খেয়ে ফিরব। কী ভালো হওয়া ছেড়েছে আজ। খাবার যা আছে সব ফ্রিজে ঢোকাও। আমি দেশলাই জ্বালি। কোথায় পালাবে ওরা!

♦–♦♦–♦♦–♦

গল্পকারের পরিচিতি: লেখাপড়া হেয়ার স্কুল, যাদবপুর ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।নয়ের দশকে কবিতা চর্চার শুরু। সাহিত্য ও সমাজ-রাজনৈতিক প্রবন্ধ লিখলেও, মূলত তিনি গল্পকার। প্রমা পত্রিকা ও প্রতিদিন সংবাদপত্রে গদ্য লেখার শুরু। মহাশ্বেতা দেবীর ‘বর্তিকা’ ছাড়াও ‘পরিচয়’সহ অন্যান্য পত্রিকায় লেখেন।২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় ‘ছোট্টো রাজকুমার’, আঁতোয়াঁ দ্য স্যাঁৎ একজুপেরির ল্য পেতি পঁস-এর অনুবাদ। ‘কৃষ্ণগহ্বরের স্মৃতিফলকেরা’ ছোটোগল্পের সংকলন (২০১৭)। এই গল্প সংকলন ‘মনোতোষ বিশ্বাস স্মৃতি গদ্য পুরস্কার ২০১৯’ দ্বারা সম্মানিত। গল্প সংকলন ‘বাংলার ত্রস্ত নীলিমায়’।
চিত্রি পরিচিতি:  আলোকচিত্রি, কলমবাজ চিত্রকর দেব সরকার আরম্ভ প্রকাশনার একনিষ্ঠ সহযোগী। বারুইপুরের বাসিন্দা।

গল্পের সমস্ত চরিত্র এবং ঘটনা কাল্পনিক । বাস্তবের সাথে এর কোন মিল নেই, কেউ যদি মিল খুঁজে পান তাহলে তা অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয় ।



❤ Support Us
error: Content is protected !!