- দে । শ
- নভেম্বর ১৭, ২০২৪
কাটোয়ার ‘থাকা’ কার্তিক, শতবর্ষ প্রাচীন পরম্পরার কাহিনী

কাটোয়ার কার্তিক পুজোর জোড়া ঐতিহ্য। থাকা কার্তিক আর কার্তিক লড়াই। কার্তিক পুজোর পরদিন হয় বিসর্জন। শোভাযাত্রায় শহর প্রদক্ষিণ করে হয় বিসর্জন। একেই বলা হয় ‘কার্তিক লড়াই’। কাটোয়ার প্রাচীন ইতিহাস গবেষক রণদেব মুখোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, ‘বহুকাল আগে কাটোয়ার কার্তিক পুজোগুলির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন শহরের সম্পন্ন ব্যক্তিরা। তাঁদের বাবু বলা হত। শোভাযাত্রায় কার কার্তিক আগে যাবে, তাই নিয়ে বাধত ধুন্ধুমার লড়াই। সেই থেকেই কার্তিকের বিসর্জনের শোভাযাত্রা লড়াই হিসেবে খ্যাত।’ করোনার প্রকোপে গত ২ বছর শোভাযাত্রা হয়নি। এবার তাই শুক্রবার গোটা শহরজুড়ে বাড়তি উন্মাদনা। সকাল থেকেই লাগোয়া জেলাগুলি থেকে লোকজন আসতে শুরু করেছে। মোট ৮৩টি পুজো কমিটি শোভাযাত্রার অনুমতি পেয়েছে। শোভাযাত্রায় প্রাধান্য পায় থাকা কার্তিক।
বাঁশ কেটে পিরামিডের আকারে তৈরি করা হয় কাঠামো। উচ্চতা হয় মোটামুটি ৩০ থেকে ৩৫ ফুট। কার্তিক আর কাত্যায়নীকে মধ্যমণি করে সেই কাঠামোয় থাক থাক করে সাজানো হয় ৫০/ ৬০টি পুতুল। থাক থাক করে সাজানো, তাই এই ‘থাকা’ নামকরণ। থাকার পুতুলগুলি সবই পুরাণের চরিত্র। পুরাণের যে সমস্ত কাহিনীগুলি নিয়ে থাকা সাজানো হয়, সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কার্তিকের জন্ম, বকাসুর বধ, সতীর দেহত্যাগ, কংস বধ, কালীয়দমন, ঊষা-অনিরুদ্ধর বিয়ের মত বিভিন্ন কাহিনীই ‘থাকা’ কার্তিকের উপজীব্য। থাক থাক করে সাজানো হয় বলেই নাম ‘থাকা’ কার্তিক। আর এটাই কাটোয়ার কার্তিকের ঐতিহ্য।
কয়েকবছর ধরে সেই ঐতিহ্যই হোঁচট খাচ্ছে। থাকা কার্তিক বানানোর হ্যাপা পোয়াতে চাইছেন না বহু উদ্যোক্তা। থিম-আলো-বাজনার বাহারে দর্শক টানতে চাইছেন তাঁরা। তবু থাকা কার্তিকের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন হাতে গোনা গুটিকয় উদ্যোক্তা। তারমধ্যে বহুবার প্রশাসনের শ্রেষ্ঠ পুজো আয়োজনের তকমা পাওয়া ‘ঝঙ্কার’ ক্লাবের সভাপতি স্বপন নাগ, সম্পাদক কালীচরণ চট্টরাজদের বক্তব্য, ‘পুরনোকে টিকিয়ে রাখা কঠিন। কিন্তু বাংলার পার্বণের অন্যতম কাটোয়ার কার্তিকপুজোর সূচনাতো থাকা কার্তিকের কাঁধে চড়েই। শিকড়টা যাতে বর্তমান প্রজন্ম ভুলে না যায়, সেজন্যই কষ্ট করেও ঐতিহ্যটাকে টিকিয়ে রেখেছি।’ ঝঙ্কার ছাড়াও খড়ের বাজার, বড়বাজার, চুনারিপটি, পশারিপটি, কলাইপটি প্রভৃতি এলাকার উদ্যোক্তারা টিকিয়ে রেখেছেন ‘থাকা’ কার্তিকের গরিমা।
গবেষক রণদেববাবু বলছিলেন, ব্রিটিশ সৈন্যদের ছোঁয়া লাগা এলাকার মহিলাদের আর ঘরে ঠাঁই মিলত না। তখন তারা কাটোয়া শহরের ভাগীরথী লাগোয়া চুনারিপটি, লবণগোলায় ঘর বাঁধতেন। খাওয়া-পরা জুটত দেহ বেচে। ওই এলাকায় গড়ে ওঠা গণিকাপল্লী থেকেই কাটোয়ার কার্তিক পুজোর সূচনা হয়। কার্তিকের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন মূলত এলাকার জমিদার, ব্যবসায়ীরা। কার্তিকের আকর্ষণ বাড়াতে তাঁদেরই একজন অন্নদাপ্রসাদ সাহাচৌধুরি ওরফে পুটুবাবুর হাত ধরেই কাটোয়ায় ‘থাকা’ কার্তিকের পথ চলা। সময়টা আনুমানিক ১৯২০ সাল। পরবর্তী সময়ে অনেক উদ্যোক্তা কার্তিকের থাকায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পুরাণের চরিত্র সাজিয়ে বসিয়ে দিতেন। সেইসময় শহরের বারোয়ারিতলায় মেলা বসত। মেলা দেখতে ঘোড়ায় চড়ে হাজির হতেন খোদ মহকুমাশাসক। শোভাযাত্রা ঘিরে যাতে কোনওরকম অশান্তি না হয়, সে ব্যাপারে তৎপর পুলিশ। সবমিলিয়ে ১০০০ পুলিশকর্মী মোতায়েন করা হয়েছে। সিসিটিভিতে মুড়ে ফেলা হয়েছে গোটা শহর। শহরের ১০টি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসানো হয়েছে পুলিশি সহায়তা কেন্দ্র। পুরসভার পক্ষ থেকে নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দর্শনার্থীদের জন্য শহরের নানা প্রান্তে খোলা হয়েছে স্বাস্থ্য শিবির।
❤ Support Us