Advertisement
  • ক | বি | তা রোব-e-বর্ণ
  • অক্টোবর ২৭, ২০২৪

রাজস্থানের কবি প্রেমচন্দ-এর গুচ্ছ কবিতা

তমোজিৎ সাহা
রাজস্থানের কবি প্রেমচন্দ-এর গুচ্ছ কবিতা

চিত্রকর্ম: সতীশ গুজরাল । ক্যানভাসে অ্যাক্রেলিক

 
সমকালীন রাজস্থানি সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি প্রেমচন্দ গান্ধীর জন্ম ২৬ মার্চ, ১৯৬৭ তে। জয়পুরে। রাজস্থানি এবং হিন্দিতে সাহিত্যচর্চা করেন। কবিতার পাশাপাশি প্রবন্ধ, নাটকও লিখেছেন। সমকালীন সাহিত্য সংস্কৃতি ছাড়াও সামাজিক ঘটনাপ্রবাহের ওপর দৈনিক পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখেন। এপর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ ছয়। চার কাব্যগ্রন্থ, একটি গদ্য ও নিবন্ধ সংগ্রহ এবং একটি বিশ্ব প্রেমকাহিনির অনুবাদ সংকলন। কাব্যচর্চার জন্য সম্মানিত হয়েছেন একাধিক পুরস্কারে । তাঁর গুচ্ছ কবিতা, বাংলাভাষায় প্রথম অনুবাদ করলেন, প্রেমচন্দ-এর ভাষা শৈলী আর ভাবনার নির্মেদ অনুসারী, বরাক উপত্যকার সুপরিচিত কবি তমোজিৎ সাহা।

 

প্রে ম চ ন্দ  গা ন্ধী
তরজমা: তমোজিৎ সাহা

 
ওয়াঘা সীমান্ত অতিক্রম করতে গিয়ে

 
জানি না পৌরাণিক দেবতারা
তিনটি ধাপে গোটা পৃথিবীকে
সত্যি সত্যি পরিমাপ করেছিলেন কিনা
এখানে তো সত্যিই
তিনটি ধাপে পৃথিবী মাপা হয়
 
জানি না ঠাকুরদা
এই সীমান্ত তৈরি হওয়ার আগে
কীসের সাহায্যে এ পথে যাতায়াত করতেন
যা আমি পায়ে হেঁটে অতিক্রম করেছি
তাঁর মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী পর
যদি ঠাকুরদা পায়ে হেঁটে গিয়ে থাকেন
তাহলে মাতৃভূমি ভারতবর্ষ আমার পা যেন ঠিক ওখানেই পড়ে
যেখানে পূর্বপুরুষের পদচিহ্ন রয়েছে
ঠাকুরদার পায়ের উপর নাতির পা
বাস্তবে পড়ুক এক স্বপ্নীল পদচিহ্ন
 
হে আমার স্বদেশের মৃত্তিকা
বাস্তবে না হোক
এভাবেই মিলন হোক
নাতির সঙ্গে ঠাকুরদার
এপার-ওপারে বয়ে চলা বাতাসকে বলছি
প্রার্থনা করো
আগামী প্রজন্ম যেন
এভাবেই সীমান্ত পেরিয়ে যেতে পারে
যেভাবে পূর্বপুরুষরা যেতেন
পাসপোর্ট এবং ভিসা ছাড়া।
 

চিত্রকর্ম: সতীশ গুজরাল

মৃত্যু এবং প্রমাণপত্র
 
তিনি নেই
এর প্রমাণ কী
আমি বললাম
যেই তিনি গেলেন
বসন্তও চলে গেল
ওরা বললেন
প্রমাণ পেশ করো
শরৎ, শিশির, হেমন্ত এবং বর্ষাও নেই
এদের সকলের মৃত্যু-প্রমাণপত্র আমাদের চাই।
 

ওদের সবকিছুতে চাই
মূল মৃত্যু-প্রমাণপত্র
কোনও প্রতিলিপি চলবে না
 
ব্যাঙ্ক, বিমা, পেনশন, জল, বিদ্যুৎ, টেলিফোন
পুরসভা, আবাসন মণ্ডল
সকলের চাই
মূল মৃত্যু-প্রমাণপত্র
 
আমি বলতে চাই
প্রথমবার তাঁর মৃত্যু হয়েছিল
যখন তাঁকে স্কুলে ভর্তি করা হয়নি
তাঁর জাতিগত পরিচয়ের কারণে
প্রথম মৃত্যুর এই চিহ্ন
সারাজীবন আঁকা ছিল তাঁর আত্মার উপর
দ্বিতীয়বার তাঁর মৃত্যু হয়েছিল তখন
যখন সবচেয়ে ভালো নম্বর পেয়ে
প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও
তাঁকে সারা গ্রামে অপমানিত করা হয়
দ্বিতীয় মৃত্যু তাঁকে নিয়ে এল শহরে
শহরে তাঁকে ধীরে ধীরে মেরে ফেলা হয়
প্রথমে ভালো কলোনিতে
ভাড়াবাড়ি থেকে বঞ্চিত রেখে মেরে ফেলা হয়
দফতরে জলের আলাদা মটকা রেখে মারা হয়
বেশি কাজ করার পরেও
অন্যদের ভাগের কাজ চাপিয়ে দিয়ে মারা হয়
ধর্মীয় শোভাযাত্রার জন্য চাঁদা না দেওয়ায়
তাঁর দেরাজে-আলমারিতে
অদৃশ্য রঙে ডোবানো
টাকা রেখে মেরে ফেলা হয়
তাঁকে পদোন্নতির জন্য
অযোগ্য বলে মেরে ফেলা হয়
ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা
আর ঘরের জন্য
তাঁকে ঋণ দেবার মতো অপাত্র মেনে নিয়ে মারা হয় অবসরের ঠিক আগে
তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত বসিয়ে মেরে ফেলা হয়
আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে মেরে ফেলা হয়
ঝানু উকিলের জেরায়
তাঁকে লাঞ্ছিত করে মারা হয়
প্রায় প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তের এই মৃত্যু থেকে
শান্তি প্রদানকারী
তাঁর অল্প মদ্যপানকে
গান্ধীবাদ ও মদ্যনিষেধের নামে
দাম বাড়িয়ে বাড়িয়ে তাঁকে মেরে ফেলা হয়
 
তাঁর বহু কষ্টের সত্তর বছরের জীবনে
দশহাজার বার মৃত্যু হয়েছিল
কী করব হুজুর
এই মৃত্যুগুলোর কোনও প্রমাণ নেই
তাঁর এই শেষ মৃত্যুটি ছিল প্রাকৃতিক
ব্যাস শুধুমাত্র এর পঞ্জিকরণ করা গেছে
যার নথিপত্রর
এই মূল মৃত্যু-প্রমাণপত্র।
 

অশ্রুজলে লীন প্রার্থনাগুলি
 
কণ্ঠ যেন এতটা শুকিয়ে না যায়
অনন্তবিস্তারী বালির বুকে বাতাস
দেহের উপর এঁকে দেয় নিজ হস্তাক্ষর
শ্বাস চলুক এমনভাবে
রুক্ষ মাটির পাপড়া পাতার ঠোঁটে যেভাবে বেঁচে থাকে
বৃষ্টি আর শিশিরের সঙ্গে মিলনের ইচ্ছাটুকু
চোখে যেন বেঁচে থাকে এইটুকু ঝিলিক
হাসিমুখে চাঁদ যেখানে
দেখতে পাবে নিজের প্রতিবিম্ব কখনও কখনও
 
দেহে যেন বেঁচে থাকে এইটুকু শক্তি
নিরুদ্দেশে যাত্রার জন্য
যে কোনও সময় বেরিয়ে পড়তে পারি
ঠোঁটে যেন বেঁচে থাকে এইটুকু রস
প্রিয়তমের অধরের সঙ্গে মিলনে দেখা দেবে
প্রেমের সুষুপ্ত নির্ঝর।
 

চিত্রকর্ম: সতীশ গুজরাল, ১৯৫৩

তোমার শহরে
 
যখনই আমি এই শহরে প্রবেশ করি
তোমার কথা খুব মনে পড়ে
তোমার ওই ময়ূরপঙ্খী নীল স্যুট
চোখের সামনে আকাশের মতো ছড়িয়ে যায়
 
ওই দিনগুলো এখনও মনে পড়ে
যখন তোমার হাসিতে
চাঁদের প্রতিবিম্ব উজ্জ্বল হয়ে উঠত
আর তোমার কন্ঠস্বরে শোনা যেত পাখির গান
 
তোমার সেই সবুজ নকশিআঁকা স্যুট
ছিল এক সবুজাভ বাগান
যা পরলে তোমার দেহ হয়ে উঠত অলৌকিক
 
যখন তুমি আমাকে বকুনি দিতে
আমি শিশু হয়ে যেতাম
আবার তুমি অভিমান করলে
আমাকে অভিভাবক হতে হত
 
সেইসব দিন আর ফিরে আসবে না মম্মো
কিন্তু আমি
বারবার ফিরে আসি এই শহরে
জানি না আর কখনও আমাদের দেখা হবে কিনা
জানি না এই বিশাল শহরের কোন কোনার অন্তরালে
তুমি তোমার ঘরকন্নায় মজে আছ
আর দেখো আমি এখনও
অবকাশে রাস্তায় ঘুরে বেড়াই
খুঁজে বেড়াই
সেই ময়ূরপঙ্খী নীল এবং সবুজ নকশিআঁকা স্যুট।
 

আমাদের গ্রাম
 
গ্রামটির বসতি ছিল পাহাড়ের পাদদেশে
গ্রামের মধ্যে আমরা বসতি গড়তে পারিনি
তাই আমাদের সেখানে থাকতে দেওয়া হল
যেখানে ছিল গ্রামের সবচেয়ে বেশি বিপদ
 
যেমন এদিক দিয়েই গ্রাম আর পাহাড়ের জল নেমে যেত নিয়মিত
নীচের দিঘিতে
এই পথ দিয়েই
বন্য পশুরা আসা-যাওয়া করত
আর বলতে গেলে আমাদের ঘরের পরে আর কোনও ঘর ছিল না
বর্ষাকালে পাহাড়ের জল
আমাদের ঘরে দুর্যোগ বয়ে আনত
গ্রামের জল আমাদের রাস্তা আটকে দিত
দিঘি মানেই তো বিপদঘণ্টি
বর্ষা প্রতিবার আমাদের আরও একটু বিপন্ন করে যায়
প্রতিবছর আমাদের কিছু শিশু এবং গবাদি পশু
তুলে নিয়ে যায় বন্য পশুরা।
আর বানররা তো কখনোই আমাদের ওপর কৃপা করেনি
 
আমরা ক্ষত্রিয় ছিলাম না
প্রজন্মের পর প্রজন্ম গ্রামের জন্য লড়াই করেছি
সেই গ্রামের জন্য
যেখানে কুয়োর পাশে যাওয়াও আমাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল
মন্দিরকেও আমরা দূর থেকেই প্রণাম জানিয়েছি
তাও আবার দরজা বন্ধ হওয়ার পর
 
আমরা গ্রামের গবাদি পশুর সঙ্গে একই জলাশয় ব্যবহার করেছি
গ্রামের গবাদি পশুকেও আমরা ছুঁতে পারতাম না
তাদের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত
 
এভাবেই গ্রামের কৃষিখেতে
সারাজীবন খেটে মরেছে আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম
এভাবে খাটতে খাটতে এসে গেল স্বাধীনতা
আমাদের গুরুজনেরা আজও জানেন না স্বাধীনতার অর্থ
 

♦•♦–♦•♦♦•♦–♦•♦


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!