- Uncategorized
- জানুয়ারি ২৬, ২০২১
ডুগি তবলা

চিত্র: করবিস
সাইকেলটা রাখতেই মোহন কাকু খেঁকিয়ে উঠলেন,‘তোমার আক্কেলটা দিন দিন কোন দিকে যাচ্ছে অরূপ, কখন আসতে বলেছি আর কখন এলে নিজেই দ্যাখো।আমাকে বাধ্য হয়ে তোমাকে ছাড়াই অনুষ্ঠান আরম্ভ করতে হল।রানীদি তো রেগে চলেই গেলেন।
অরূপ কোনও দিকে চোখ না দিয়ে সাইকেল থেকে আস্তে আস্তে ডুগি আর তিনটে তবলা নিয়ে মঞ্চে এসে বসে পড়লেন। একজন মহিলা গান আরম্ভ করেছিলেন।অরূপকে দেখে গান থামিয়ে বেশ জোরেই বলে উঠলেন,‘মোহন কাকু, দিন দিন আপনার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।একে তো এত দেরি করে তবলা নিয়ে এলেন, তারপর কোথায় দেবাশিসদা বা সুব্রতদাকে বলবেন….’
– কোন স্কেলে গাইবেন ?
ভদ্রমহিলাকে থামিয়ে অরূপ জিজ্ঞেস করতেই ভদ্রমহিলা উত্তর দিলেন,‘একটা লোকগীতি আছে, সি’তে বাঁধা কিছু আছে? এই তো খোল তবলাটা এনেছেন দেখছি।এটাই বাজান।খুব অসুবিধা হলে প্লেন ঠেকা দিয়ে দিন।’
অরূপ কোন কথার উত্তর না দিলেও গানটা শেষ হবার পর অনেকেই অরূপের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,‘আপনাকে আমাদের সংগঠনে এর আগে তো দেখিনি, বেশ ভালো বাজালেন তো।গান তো তবলা ছাড়া এক্কেবারে জমে না।’
মোহন কাকু অরূপের উত্তর দেবার আগেই বলে উঠলেন,‘ও আমাদের সংগঠনের অনেক পুরানো সদস্য।ওর বাবাও এখানে নিয়মিত আসতেন।তবে তবলা নিয়ে ও এখানে এই প্রথম।আমার তো আজকের প্রোগ্রামে তবলার কথা খেয়াল ছিল না।সুব্রত, দেবাশিস কাউকেই বলতে পারিনি।শেষ কালে অরূপের কথা মনে হল।যাই হোক ও এক কথাতে রাজি হয়ে চলে এল, সেটাই একটা ভরসার জায়গা।এমনিতে ও ভালোই বাজায়।’অনুষ্ঠানে এসে অরূপ ভালো করে শ্বাস পর্যন্ত নিতে পারে নি।একটু ভয় ছিল, কে’জানে বাবা মোহন কাকু সকালে ফোন করে বলেছিলেন,‘খুব বড় বড় গায়ক গায়িকারা আসছেন।এই শহরের সব নামি দামি গায়ক গায়িকা, ওঁদের সাথে বাজাতে পারলেই তোর ভাগ্য বদলে যাবে।’
‘কী আর হবে?’ অরূপ একটু আমতা আমতা করে বলে উঠল, ‘কাকু, যাতায়াতের খরচ বাবদ কিছু যদি দেন……’
–তুমি এসো, ও’সব হবে ।প্রতিদিনই সন্ধ্যার সময় কয়েক জনের বাড়িতে গানের সাথে সঙ্গতের জন্যে যায়।সেদিনও একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে তবলার সঙ্গতে গিয়েছিল।তার আবার পড়ানোর স্যার ছাড়তে একটু দেরি করেছিল।অরূপেরও দেরি হল।তবলার এই টিউসন আর পুজো করা, এই করেই তো সংসার চলছে।এমনিতে প্রায়ই এ’পাড়া সে’পাড়া অথবা পার্টির কিছু না কিছু অনুষ্ঠান থাকে।সবাই অরূপকে ডাকলেও পয়সা তো দেয় না।এই যে মোহন কাকু ডাকলেন ফোনে পয়সার কথা শুনে নিজের থেকেই বললেন,‘সে দেখা যাবে।’
শেষ পর্যন্ত কী করেন সেটাই দেখার।তার অবস্থার কথাও সবাই জানে।পার্টির অনুষ্ঠানে সব সময় টাকা না দিলেও বাকি সব অনুষ্ঠান মাত্রই অন্তত একটা পাঁচশ টাকা দেয়।তার সাথে ভালো টিফিন তো থাকেই, গরিবের বাড়িতে সেটাও তো কম কিছু নয়। তবে পার্টির অনুষ্ঠানে না করা যায় না।
একটা লম্বা শ্বাস ফেলে অরূপ।এবার বয়স হচ্ছে।একটা ডুগি আর তিন চারটে তবলা বেঁধে সাইকেল চালিয়ে আসতে বেশ হাঁপ ধরে যাচ্ছে।অবশ্য অনুষ্ঠান ছাড়া সেই ভাবে এত ডুগি তবলা নিয়ে যেতে হয় না।এখনকার গার্জেনরা খুব সচেতন, হারমোনিয়ামের সাথে তবলা বাঁয়াও কিনে নেয়।কয়েকটা গার্জেন আবার অ্যাডভান্সে পেমেন্টও দেয়।তবে সবাই এরকম হলে অরূপদের মত মানুষদের আর সংসার চালানোর কোন চিন্তা থাকত না।
– কী অরূপ, অত কী ভাবছো, চা নাও। সিঙারা মিষ্টি একটু পরে হবে।
টানা তিন ঘন্টা ধরে বাজাচ্ছে।এক কাপ চা আর একটা সিঙারা, মিষ্টিটা খায়নি।সুগার এখন এক্কেবারে বটম লাইনে।
মোহন কাকু ছাড়া এখানে আর কেউ সেরকম ভাবে চেনে না।শুভাশিসদাকে বেশ কয়েকটা অনুষ্ঠানে দেখেছে, বাকি সব কী রকম যেন অন্য গ্রহের মানুষ জন।এখানে অন্য লোকেরা এসে তবলা বাজাত।ওদের সাথে গায়ক বিশেষ করে গায়িকাদের বেশ সম্পর্ক। সেটা এঁদের আচার আচরণ দেখেই বোঝা যায়।অরূপকে দেখে গায়িকাটি খুব একটা পছন্দ করেনি।পরে অবশ্য হোয়াটস্অ্যাপ নং চান।অরূপের এখনো স্মার্ট ফোন নেই। ছেলেটাকেও একটা ফোন কিনে দিতে পারে নি। ফোনের জন্যে কলেজের ক্লাস করতেও পারছে না।কয়েকদিন আগে একটা পুরানো ফোন দেখতে গিয়ে ছিলেন। সেটাও সেই হাজার তিন দাম।টাকার জোগাড় হলেও হঠাৎ করে ঘরের চাল থেকে জল পড়তে আরম্ভ করে।সেটা ঠিক করতে করতেই জমানো টাকার দফা রফা। দিন দিন জিনিস পত্রের যা দাম বাড়ছে তাতে সরকারি চাকুরেরাই কুলিয়ে ওঠাতে পারছে না, অরূপ তো একটা সাধারণ তবলা বাজিয়ে।
মাঝে মাঝে নিজের উপর খুব রাগ হয়। সংসার, পরিবার এসব অরূপদের মত মানুষের জন্যে নয়।বাবা মাকে একথা বলেও ছিল।কিন্তু ওঁরাই বা শুনবেন কেন।বোনের বিয়ে হয়ে যাবার পর ঘরের কাজ কর্মের জন্যেও তো লোকের দরকার হয়ে যাচ্ছিল।মায়ের বয়স বাড়বার সাথে কাজের গতিও কমতে আরম্ভ করেছিল।বাবা মায়ের সাথে পরিবারের লোকজনরাও বেশ জোর করতে আরম্ভ করে দিল।ওরাও সেই আগেকার দিনের ধ্যান ধারণাতেই বিশ্বাস করে বলে উঠত,‘আরে ছেলেদের কি আর এই সব টাকা পয়সার হিসাব করতে আছে।বিয়ে করলে ঈশ্বর নিজেই সব কিছু করে দেবেন।’
সেটা অরূপ বিয়ে হয়ে যাবার পরে প্রতি মুহূর্তে বুঝতে পারে।অষ্টমঙ্গলার সময় শ্বশুর বাড়ি যেতেই সবাই যখন জামাইয়ের কাছে খাসির মাংস খাবার জন্যে বায়না করে তখনই অরূপ দু’চোখে অন্ধকার দেখে।এরপর বিভিন্ন অনুষ্ঠান তো আছেই।সব মিলিয়ে সে এক ভয়ঙ্কর অবস্থা।তাও যতদিন বাবা বেঁচে ছিল ততদিন সংসারের ব্যাপারে সেরকম চিন্তা ভাবনা করতে হয় নি।আজ কারোর গৃহ প্রবেশ, কাল কারোর শ্রাদ্ধ, পরশু শান্তি, এই সবের সাথে শিষ্য যজমানদের বাড়িতে গিয়েও টুকটাক ভালোয় চলে যেত। অরূপ তো আর বাবার কাছে এত সব কাজ শেখেনি।ওই কোন রকমে কয়েকটা পুজো শিখে চালিয়ে যাচ্ছিল।বাবা একটা নারায়ণ মন্দিরের নিত্য পূজারি ছিলেন।সেখানেই খোল বাজাতে বাজাতে তবলায় হাতে খড়ি। খুব যে বড় মাস্টারের কাছে নাড়া বেঁধে ঘটা করে শিখেছিল এমন নয়, ঐ কোন রকমে দু’বছর বছর শিখেছিল।তবে সব ঠেকাগুলো তাড়াতাড়ি শিখে নেওয়ার জন্যে মোটামুটি কাজ চালাবার মত গানে ঠেকা বাজাতে পারত।তারপর কিছু অভিজ্ঞতা আর কয়েক বছরের বিভিন্ন জায়গায় ছোট বড় অনুষ্ঠানের হাত ধরে শহরে এই কোণে অরূপ মাস্টার বলে একটা পরিচিতি পাওয়ার মাঝেই সংসারে একটা বড় রকমের অদল বদল হয়ে গেল। বাবা মা মারা গেল। একটা ছেলের পরে একটা মেয়েও সংসারের নতুন সদস্য হয়ে চোখের সামনে বড়ও হয়ে যেতেই অরূপকে বিয়ে ও পড়াশোনার মধ্যের একটা ঢেঁকিতে চাপিয়ে দিতে হল।শুধু বুঝতে পারল না কোথায় বেশি চাপ দেওয়া উচিত।এর মাঝে আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সাথে বাড়ির লোকদের শরীর খারাপ ভালো সব কিছুই আছে।সাইকেল নিয়ে এ’প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার সুব্রত বা দেবাশিসদের মত এই শহরের এলিট তবলা বাদকদের যারা রাখতে পারেন না অথচ ছেলে মেয়ে বা বউকে গান শেখান তারাই শখে অরূপকে রাখেন। বদলে এই মাসের পেমেন্ট ওমাসে, ওমাসের পেমেন্ট আরো কয়েকমাস পরে এই রকম ভাবেই সব কিছু চলতে থাকে।কয়েকটা অনুষ্ঠানে সুব্রত ও দেবাশিস বাবুদের দেখেছে।দুজনায় চারচাকা চালিয়ে আসেন।গাড়িতে লম্বা খোল, পাঁচ থেকে ছটা তবলা সব মিলে একটা অন্য রকমের ব্যাপার।সাইকেলে কোমর ঠেকিয়ে কতবার এদের দেখে নিজের প্রতি ঘেন্না এসে গেছে।এই শহরে তৃতীয় শ্রেণির তবলা বাদক হয়ে বেঁচে থাকবার মধ্যে আর যাই হোক শ্বাস থাকে না।
– কী রে অরূপ, তুই তো দেরির কারণটা জানালি না।মোহনকাকু কথাগুলো এখনো ভোলেননি, শুধু তুমি থেকে তুইতে নেমে গেছেন।মঞ্চে তখনো কয়েকজন বসে ছিলেন।একজন আবৃত্তি করছিলেন।গলাটা কেমন যেন করে উঠতেই নিচে গিয়ে একটা বিড়ি ধরাতে যাবে এমন সময় পিছন থেকে মোহনকাকু জিজ্ঞেস করেন।অরূপ মুচকি হেসে উত্তর দেয়,‘রোজই তবলার টিউসন থাকে।সেই সব সারতে দেরি হয়ে গেল।’
– এত বড় মঞ্চে তবলার সঙ্গত করতে পারা কি কম গর্বের। আজ কাদের সাথে বাজালি বলতে পারবি?এরা এই শহরের সব নামি শিল্পী।সবাই একটা গান গাইতে গেলেও টাকা নেয়।নেহাৎ এটা একটা বড় প্ল্যাটফর্ম, সারা ভারতের যেখানে বাঙালি আছে সেখানেই আমাদের সংগঠনের একটা শাখা আছে। সেই সম্মানে আমাদের থেকে কোন টাকা নেয় না।তোর বাজনাও সবার ভালো লেগেছে।দেখবি আগামী দিনে এরাই তোকে সঙ্গতের জন্যে চাইছে।অরূপের অবশ্য এইসব লোকেদের এক্কেবারে ভালো লাগে না।
একবার এই রকম একজন অরূপকে সঙ্গতের জন্য ডাকে।মাস পাঁচ গেছিল।তার মধ্যে একমাসের মাইনে না দিয়ে বেমালুম বলে দেয়, ‘আপনাকে তো টাকা দিয়েছি।’ একটা ডায়রি বের করে বলেন,‘এই যে আমি লিখে রেখেছি।’ অরূপ তার পরের মাস থেকে আর যায় নি।
বিড়িটাও পুরোটা খেতে দেয় না।অমনি মোহন কাকু ডেকে নেয়,‘কই’রে আর কয়েকজন আছে, একটু বাজিয়ে দাও।’
– টানা তিন ঘন্টা ধরে বাজাচ্ছে।এক কাপ চা আর একটা সিঙারা, মিষ্টিটা খায়নি।সুগার এখন এক্কেবারে বটম লাইনে।একটা রক্তদান শিবিরে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে প্রেসারের সাথে সুগারও টেস্ট করে।রিপোর্টটা ওই শিবিরে আসা সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার দিদিকে দেখাতেই উনি খাবার দাবার একটু নিয়ন্ত্রণ করতে বলেন।সেখানেও টানা দু’আড়াই ঘন্টার অনুষ্ঠান হয়।এখন একসাথে এতক্ষণ বাজাতে কষ্ট হয়।আজও হচ্ছে।হাঁপ ধরে যাচ্ছে।কিন্তু কিছু তো করার নেই।মোহন কাকুর কথা ফেলতে পারে না।আস্তে আস্তে অনুষ্ঠান শেষের পথে।গায়ক গায়িকারা সবাই চলে গেছেন।শেষে একজন বুড়ো নিজের মত করে কী সব গেয়ে গেলেন।এই সব অনুষ্ঠানে কোন দর্শক থাকেন না।সবাই কিছু না কিছু করে।মোহন কাকু অরূপের সামনেই কাউকে বললেন, ‘এই ভদ্রলোককে প্রতিবার ডাকতে হয়।এই যে টিফিন, তার সব খরচ উনি দেন।গাড়ি নিয়ে আসার সময় কয়েকজন সদস্যকে তুলে আনেন।সংগঠন চালাতে গেলে এই সব তো করতে হবে।মাইকের খরচটাও এক জনকে বলেছি।’ অরূপ কথাগুলো শুনে নিজের ব্যাগের ভিতর ডুগি ও তবলাগুলো ভরতে ভরতেই মঞ্চ এক্কেবারে ফাঁকা হয়ে গেল।মোহন কাকু মাইকের ছেলেটাকে পেমেন্ট করেন।অরূপ তখনও দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখতে থাকে।মোহন কাকুর চোখে চোখ পড়তেই উনি জিজ্ঞেস করেন, ‘কী রে কিছু বলবি?’
অরূপ একটু আমতা আমতা করেই বলে,‘কাকু আমাকে তো কিছুই দিলেন না, দেখবেন বলেছিলেন..?’
মোহন কাকু হেসে উঠলেন। তোকে পয়সা দেব কী রে? তোর বাবা এ সংগঠনের লাইফ মেম্বার ছিলেন।প্রতি বছর এই সংগঠনের সরস্বতী পুজোতো তোর বাবাই করতেন।তার ছেলে হয়ে….’অরূপ কথাগুলো শুনলেও কী উত্তর দেবে বুঝতে পারে না।মাইকের ছেলেটা ততক্ষণে তার সব জিনিস পত্র নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।অরূপের কানে তখন মোহন কাকুর বলা কথাগুলো ভাসছে।সত্যি তো সংগঠনের সদস্য বলে খাওয়া দাওয়া ওষুধ পত্রের কোন খরচ লাগেনা।সাইকেলের তো আর কোন তেলের খরচ নেই।গাড়ি করে এলে তখন না হয় তেলের জন্যেও কিছু টাকা চাওয়া যেত।কথাগুলো মনে এলেও একটা কথাও বলল না।এক পা একপা করে সাইকেলের কাছে এসে ডুগি আর তবলা কয়েকটা তুলে অন্ধকারে মধ্যে এগিয়ে যেতে আরম্ভ করে।পিছনে পড়ে থাকে মোহন কাকু আর সারা ভারতবর্ষ ব্যাপী ছড়িয়ে থাকা সংগঠনের এই শহরের শাখার শূন্য মঞ্চটা।
❤ Support Us