Advertisement
  • গ | ল্প
  • ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২২

অতীতের ইতিহাস, ভবিষ্যতের কথা

...ভাগ্যের কি পরিহাস । যেন একটা magic হইয়া গেল---সুভাষচন্দ্র বসু Tokyo-তে আসিয়াছেন এবং জাপানি কর্তাদের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধে কথাবার্তা কহিতেছেন এবং শীঘ্রই আমাদের জন্য  বক্তৃতা দিবেন ।

সাধন চট্টোপাধ্যায়
অতীতের ইতিহাস, ভবিষ্যতের কথা

চিত্র: ধীরাজ চৌধুরি

আচমকা স্মার্ট ফোনটি বেজে উঠতে ‘হ্যাঁ, বলছি! শুনে ও-প্রান্তের জবাব, ‘শিবেন শেঠ বলছি স্যার!’
ফোন বাজলেই ‘হ্যাঁ বলছি!’ দীনবন্ধু বসাকের ‘লব্জ প্রতিক্রিয়া’।
কি খবর তোমার ?
আপনার সঙ্গে একটু বসতে চাই !
কেন ?
খুব জরুরি।… গিয়ে বলব !
আজ ? এখনই ? দীনবন্ধু বসাকের গলায় সামান্য ইতস্তত ।
বৈঠকখানায় আজকের কাগজটা পড়ছিলেন। তাগিদ বুঝে ওয়ালক্লকটার দিকে আংশিক তাকালেন। ন’টা চল্লিশ। ওঃ! এরপর কখন নিত্যকৃত্য, চান, টিফিন, বাজার রওনা! প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা! নিছক বাজারেরই উদ্দেশ্য নয়, জনসংযোগটিই মুখ্য। তবু শিবেনের আজকেরই জরুরিতে দীনবন্ধু বসাক সামান্য উন্মুখ কৌতূহলী। উচিত ছিল ঘণ্টা দুই পড়ে আসতে বলা !
কে গো? কাকে আসতে বল্লে ?
শিবেন !
কোন শিবেন ? শিবেন রায় ? তার গ্রুপে তো ছিলাম! অনেক দিন ধরেই দলটা চালাচ্ছে । পুরনো! পাশের ঘর থেকে উমা । তার চা শেষ হয়ে গেছে । তবু কাগজে চোখ বোলানোর দায় মেটেনি । দু’দুটো দৈনিকের পাতা উল্টোপাল্টে দীনবন্ধু বাংলাটা ছেড়ে ইংরেজিটা খুঁটিয়ে দেখার ফাঁকতালে, ও-ঘরের বিছানায় বাংলাটা চালান গেলে, উমা চোখে চশমা চাপায় । শীতের সকাল, বছর চার-পাঁচ ধরে প্রায় পঙ্গু । উমা দাস বসাক সকালেই বিছানা ছাড়তে অক্ষম। তবু চারপাশের ঘটনাবলির ইতিহাসে জুড়ে থাকতে চায়।
না, না ! এ শিবেন শেঠ। সুখচরের… ওই দলটা তো পানিহাটির !
তাই ভাবলুম! …কতদিন শিবেনদাকে চোখে দেখি না। …গত বারও এসে বলে গেছেন ‘অন্তর্মুখ’ দুর্গাপুর থেকে প্রাইজ এনেচে ! দীপাদি ছেড়ে গেছে, আমিও প্রায় পঙ্গু… বলছিল দলই তুলে দেবে !
বৌমা কি ধারে কাছে ? কর্তার প্রশ্নে উমা বলে, এ সময় কি এখানে থাকে ওরা ? দোতলায় ব্যস্ত!…ছেলেমেয়েদের তৈরি করতে হবে না ? ক্লাস তো চলছে! … কেন ?
চা ।… টা-ফা থাকলে যেন পাঠায় ! শিবেন কিন্তু এই প্রথম বাড়িতে আসছে ?
উমা কাজের মেয়ে কল্যাণীকে ডেকে খবরটা দোতলায় পাঠান। সিঁড়ি মুছছিল। তারপর বৈঠকখানা, উমাদির ঘর সেরে কলতলায় বাসন নিয়ে বসবে।
তিন চার পুরুষের বাড়ি। পনেরো বিশ ইঞ্চি পুরু দেয়াল । এজমালি সম্পত্তি ভাগ হতে হতে । দীনবন্ধুর ভাগে বৈঠকখানা, উমার ঘর হিসেবে চিহ্নিত কড়ি-বর্গার প্রশস্ত একটি ঘর । সিঁড়ি । ওপর তলটি কিন্তু আধুনিক । বাইরের বহু পুরনো নিমগাছটা না কেটে ফেললে, দীনবন্ধু ছেলের জন্য দোতলাটা তুলতে পারতেন না । ছেলেকে ডাক্তারি পড়ানোর সময় ভেবে ছিলেন । ভবিষ্যতে নীচটা ডিসপেনসারি বানাবেন । প্রাইভেট প্র্যাকটিসিং । কিন্তু সুজন সরাসরি ডাক্তারদের শিক্ষক হবার উৎসাহী ছিল ।
একটা সাদা স্কুটার নিরীহ ভঙ্গিতে খানিক পরই সদর গেটে । জানলায় উঁকিয়ে, প্রীতির চোখমুখে দীনবন্ধু দরজা খুলতেই, শিবেন ছোট্ট চামড়ার ব্যাগটিসহ সৌজন্যে হাসি মাখিয়ে ঘরে ঢোকে ।
বসো ! বসো ! অধ্যাপক বসাক সোফাটাকে নির্দেশ করলেও শিবেন পুরনো সেগুন কাঠের চেয়ারটিতে বসল । ফুলপ্যান্ট, চটি, ফুল সোয়েটারের ওপর চাদর । মুখে আঁটা মাস্ক । বসতে বসতেই ঝুলিয়ে দিল থুথনিতে । বোঝা গেল পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সটি দাঁড়িয়েছে । গানে এখনও রোজকার ব্লেডের টান পড়েনি, থুতনিতে কিছু সাদা গোড়া উঁকি দিচ্ছে ।
তারপর ? দীনবন্ধু বলতেই, কল্যানী দ্রুত ন্যাতাজলের কাজ সেরে উমার ঘরে ঢুকে পড়ল ।
কল্যাণীকে বলতে হল না। ছ’সাত বাড়ির ঠিকেকাজে জরুরি পরিস্থিতি আন্দাজ করতে জানে।
ও ঘরে ঢুকে পড়তেই উমার আঙুলের ভাষায় পর্দাটা টেনে দিল।
কে রে ? চোখের জিজ্ঞাসায় কল্যাণী ফিসফিসিয়ে বলে, শেঠদের বাড়ির । আমাদের সুখচরের । আরও বল্লে , সুখচরের শেঠদের চেন না ?…পাঁচ ভাই তারা … এ বড়তরফের সেজ ছেলে কাকিমা! …ইঞ্জিনিয়ার ।
শেঠবাড়ির কথা উমাও জানে । কারও রেশন দোকান, কোনো ভাইয়ের লেদ কারখানা, কারও বা বিটি রোডের বাজারে তেলকল ।
হঠাৎ দোতলা থেকে ডাক পড়লে, শাড়িতে জল-হাত মুছে সিঁড়ি দিয়ে দুমদুমিয়ে উঠে গেল । ফিরল ছোটো ট্রে-তে কাপ ও টা-এর প্লেট নিয়ে ।
দীনবন্ধুর বাড়িটা গঙ্গার ধারে পানিহাটির পুরনো অঞ্চলে । দুটো পুরনো অঞ্চলের মধ্যে বহুকালের নানা সামাজিক জটিল সম্পর্ক থাকলেও পারস্পরিক জানাচেনা হয়ে যায়।
শিবেনের কথাবার্তা, অভিব্যক্তির মধ্যে একটু শিষ্টতাও সমীহতার ছায়া।
রিটায়ার করেছেন ?
অনেকদিন !
বাষট্টি পেয়েছিলেন ?
কপালে আঙুলের ডগা ঠেকিয়ে দীনবন্ধু , ৬ মাসের জন্য মিস করেছি ভাই !
শিবেনের সহানুভূতিতে ফের বল্লেন, না, না ভালো হয়েছে ! …মুক্তি পেয়েছি !…নাও হাত লাগাও !
কাপ ও প্লেট নিজেই এগিয়ে দিতে দিতে বল্লেন, উঁহু ! …তা বললে চলবে না!…প্রথম এলে এ- বাড়ি !’
শিবেন মিটিমিটি উপভোগ করছিল, দুই পুরনো অঞ্চলের বসাক বা শেঠ পরিবারের মধ্যে টান-টেক্কার সম্পর্ক থাকলেও ইতিহাসের অধ্যাপক দীনবন্ধু বসাক সফল কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার শেঠ পরিবারের বড় শরিকের সেজ ছেলেটিকে যথার্থ মান দিতে কার্পণ্য করছেন না । কোনো সংকীর্ণতায় শিবেনেরও আস্থা নেই ।
ওয়ালক্লকটা নিঃশব্দে আবার কর্তব্যে ব্যস্ত । দীনবন্ধু গোপনে চাউনি দিতেই, শিবেন বুঝে নিল । কাজের কথাটি পাড়া দরকার ।
সুখচরের নন্দীআলয় চেনেন তো?
দীনবন্ধু মুখোমুখি তাকালেন ।
হয়তো দেখেচি ! …কেন বলো তো ?
ঠিক ঠিক সনাক্ত করতে পারছেন না বুঝে শিবেন বলে, ‘আপনি আমাদের যে-লঞ্চঘাটা থেকে কলেজে যেতেন…সেই পাশেই তিন মাথা মোড়টাতেই।’
ধনেখালি কলেজে ছিলাম যখন … তারপর তো কল্যাণী ইউনিভার্সিটিতে …তা যাককে যাক ! তখন ট্রেন !
স্টেশন যেতে হত ! তা হবে ! নন্দীআলয়ে কি হয়েছে ?
ডাক্তার বিভূতি নন্দীর বাড়ি ওটা । …উনি নেই যদিও … তিন শরিক এখন…আচ্ছা বিটি রোড
বাজারের ভেতরে জগৎগৌরি ক্লিনিকের কথা মনে আছে্ ? এক টাকায় রুগি দেখা হত ?
সে তো ক—বেকার কথা !
হ্যাঁ, হ্যাঁ, সত্তর বাহাত্তর সালে উঠে গেছে । ঐ বিভূতি নন্দী বসতেন সম্পক্কে আমার মেসো ছিলেন ।
অরিজিন্যালি ওরা হুগলির মানুষ । জগৎগৌরি বংশগত বিগ্রহ ওদের …বড় মাসিও চলে গেলেন গত মাসে । সেঞ্চুরি হাঁকতে আটমাস বাকি ছিল…তো মেসোর পুরনো আলমারি ঘেঁটে একটা শিশি পাওয়া গেছে…স্যার সে ব্যাপারেই আপনার কিছু পরামর্শ…!
কী যেন হঠাৎ মনে পড়তেই, দীনবন্ধু ‘একটু খানি !’ পর্দাটা দুলিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লেন । মৃদু অনুযোগে ‘বলবে তো’ বলে, চোখের মূল্যবান ড্রপটা নিয়ে ‘কই দেখি ‘! বলে স্ত্রীর মুখোমুখি । উমা চশমা খুলে তাকাতেই ফোলা আইবল দুটোর পাতা সরিয়ে এক এক ফোঁটা দিয়ে দিলেন ।
‘কিছু ফিল করছ ওষুধটায় ?’ ডাক্তারবাবু তো পনেরো দিন দেখতে বলেছিলেন ।
উমা হাসে । কি আর হবে দেখে !’ নার্ভ শুকোচ্ছে শুকোক ! …না হয় বাকি দিনগুলো অন্ধ হয়ে কাটাব । ‘
সংসারে সবাই অন্ধ আমরা !
যথাস্থানে টিউবটা রেখে অধ্যাপক স্ত্রীর মুখে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন । উমা প্রসঙ্গ বদলে ফেলল ।
সুখচরের বিভূতি ডাক্তারকে, ওদের বাড়িটা চিনতে পারলে না ?…শিবেন রায় বলেছিলেন ও বাড়ির এক শরিকের নীচ তলাটায় আমাদের দলের মহলা ঘর হওয়ার কথা ছিল । …পানিহাটির কিছু মানুষের আপত্তিতে হল না …ডাঃ নন্দী শুনেছি আইএনএতে যোগ দিয়েছিলেন…লালকেল্লায় বন্দিও ছিলেন। দীনবন্ধু কল্যাণীকে একবার বৈঠকখানায় আসতে বলে, বিছানাটা পেরিয়ে আস্তে বল্লেন, হ্যাঁ, জগৎগৌরি ক্লিনিকের কথা মনে আছে ।
উমা চুপ । জোড় হাতে, শিরদাঁড়া সোজা, দুফোঁটা ড্রপের প্রভাবে চোখবুজে ।
কল্যাণী কাপ-প্লেট চাপিয়ে ট্রে-টা নিয়ে গেল । শিবেনও বাকি জরুরি কথাগুলো সেরে উঠতেই, দীনবন্ধু দরজা অবধি এগিয়ে দেন । বাইরে যৌথপরিবারের পুরনো রক্-প্রথার চিহ্ন এবং বহুদিনের কাঠচাঁপা গাছটা আজও বর্তমান । শিবেন একঝলক জরিপ করে নিল চারপাশটা । টের পেল সুখচরের তুলনায় এদিকে নব্যরুচি ও ভাঙাভাঙি অনেক বেশি থাবা বসাচ্ছে ।
স্কুটারে বসবার আগে ফের একবার তালে স্যার ও কথাই রইল, বলতেই দীনবন্ধু গোপনীয়তার ভঙ্গিতে’ ‘একটা সাজেশন কিন্তু…!
বলুন !
তুমি-আমি ছাড়া তৃতীয় কেউ খবরটা জানবে না। সিক্রেট! …পুরোটা কপি করে ফেলব…
ডিটিপি হয়ে গেলে ফোন করো আমায় ।


জাপানিরা বলতে লাগলো বৃটিশরা তাহাদের শত্রু, ভারতীয়দের সঙ্গে তাহাদের কোনো শত্রুতা নেই । তাহারা আমাদের বন্ধু । বৃটিশদের তাড়াইবার জন্য তাহারা ভারতবর্ষের ভিতরে প্রবেশ করিবে ।


সহমত হয়ে দ্বিচক্রযানটা চলে গেল । একঝলক বাতাস এল । দমকায় কাঠচাপার পুরনো হলদে একটা পাতা কাঁধে ঠক্ করে পড়তেই, দীনবন্ধু বসাকের মনে হল, বিকেলে আজ তাপমাত্রাটা আরও নামবে । উমার জন্য দুশ্চিন্তা হয় । রাতে বড্ড কষ্ট পাচ্ছে বেচারি !
এরপর, অধ্যাপকমশাই ঘরে ঢুকে কয়েকটা জরুরি ফোন ল্যান্ড থেকে এবং গত পরশুর কাগজটা থেকে কালি দাগানো কয়েকটি অংশ কাঁচি-কাঁটা ও নির্দিষ্ট ফাইলে ভরে, বিশেষত পরিচিত অঞ্চলের খনন কার্যবিষয়ক একটি চিঠি—এ-ঘরে ঢুকে দেখতে পেলেন উমা কষ্টকর পরিস্থিতিতেই, নিত্যকর্ম সেরে ফের বিছানায় । কানে এল, পুত্রবধূ বলছে, ‘টিফিনটা করে নাও মা ! এক্ষুনি ম্যাসাজ মাসি এসে পড়বে !
উমা বল্ল, হ্যাঁ গো, শিবেন শেঠ তোমার কাছে হঠাৎ?
এর কী জবাব হয় ! দীনবন্ধু বুঝে ওঠেন না ।
ওই একটা… ও তো, জানো, এলাকার পুরনো কাল নিয়ে…
উমা উকিলের চালে জিজ্ঞেস করল, ডায়রির ব্যাপারটা না হয় বোঝা গেল ! …তোমার ভূমিকা কী ?
একটু প্যাঁচে পড়ে গেলেন। নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পেলেন না । জিজ্ঞেস করেও রাখেননি ।
জয়া হেসে বলে, বাবা এতটা ভাবেন নি ! তাই না?
তোদের মা পলিটিক্স করলে নাম করতে পারত । বলেই উমার উদ্দেশে, ‘আমি জানি শিবেন কে, শিবেনও বোঝে আমার ইন্টারেস্ট কোথায় ! …সব ব্যাপারে কারণ থাকতেই হবে, না ?

রাতে খাওয়ার পর, মা-বাবার ঘরে পারিবারিক আড্ডা বসে । রেওয়াজ । ছেলে দোতলায় ডিনার সেরে এখানে রোজকার নানা তথ্য শোনায় । হাসপাতাল, ব্যাধি, রাজনীতি, দেশ-বিদেশের নতুন কোনো খবর বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা হয় না, এমন সব ঘটনা । সুজন ডাক্তারি পড়লেও অজ্ঞাত শক্তির অস্তিতে বিশ্বাসী । জয়াও যোগ দেয় মাঝেমধ্যে ।
প্রসঙ্গত, জয়ার মুখে সকালের ঘটনাটা শুনে আশ্চর্য হল সুজন ।
শিবেন দা এসেছিলেন? কেন?
উমা হাসিহাসি চোখে দীনবন্ধুর মুখে তাকায়, জয়া হেসেই ফেলে । সুজন কিছু রহস্যের সূত্র খোঁজ করে ।
হাসছ যে ? শিবেনদা হঠাৎ আমাদের বাড়ি ?
উমা বলে, কেন, বাপির কাছে অনেকেই আসে তো!
তা আ-সে! সুজন প্রসঙ্গান্তরে বলল, শেঠদের ফ্যামিলিতে শিবেন দা ব্যতিক্রম । …যাই বলো না কেন… কম্পিউটার লাইনে নামডাক আছে !…সরকারি বেসরকারি নানা প্রোগ্রামিং-এ ডাক আসে…কেন, এলাকার হিস্ট্রি নিয়ে ডিজিটাল আর্কাইভ করেছে না ? …তুমি তো দেখেছ বাপি !
শুনেছি !
হেরিটেজ কমিটির বড় একজন উদ্বোধনে এলেন না ?
ব্যাপারটা সামলাতে দীনবন্ধু বললেন, হ্যাঁ, জানি!…সেবার আমি দিল্লি ছিলাম… কোনো একটা সেমিনার -টেমিনার ছিল মনে হচ্ছে !
এরপর, স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই আবহাওয়া, করোনার দৈনিক সংক্রমণ, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, ওয়েবমিনার হয়ে শরিক কোনো জ্যাঠার ঘরের দাদা গোপনে কোয়ারাইনটাইন -যে আছে—নৈশ আড্ডাটি শেষ ।
হপ্তাখানেক বাদে হঠাৎই উমার সামনে ‘ব্যাপারটা মন্দ বলোনি, হঠাৎ শিবেন ডাক্তারবাবুর ডায়রির প্রসঙ্গটা জানতে এখানে কেন উজিয়ে এল’ শুনিয়ে সাড়া না মেলায় চেপে গেলেন। বেলা বাড়লে গেলেন ব্যাংকে। নমিনি সংক্রান্ত কিছু কাগজপত্তর নিয়ে । এখন পরিবহন কিছুটা স্বাভাবিক হতে, দীনবন্ধু মাস্ক-স্যানিটাইজার নিয়েই দু-চাকায় কাজ সারেন কিনা ! যে-হারে পেট্রল-ডিজেলের দাম চড়ছ, আর সুমনের হাসপাতালটি কাছে, আওতার মধ্যেই, তাই চারচাকায় যায় বলেই দু-চাকাটা যখন তখন ব্যবহারযোগ্য ।
দুপুরের পর আচমকাই আকাশটা ঘোলা, পশ্চিমকোণে যেন ধুলো জমেছে রোদটা মরে যেতেই জানলার বাইরে দীনবন্ধুর চোখ। ছিটেফোঁটা ঝরছে যেন? এক পশলা ঝমঝমাবে? খনার প্রবাদ নিজেকে জোরে জোরে শুনিয়ে দিল, যদি বর্ষে মাঘের শেষ/ধন্যি রাজার পু্ণ্যি দেশ! জয়া ধারে কাছে কোথাও ছিল।
এখন স্যাটেলাইটের যুগ বাবা ! …ছড়া ফরা অচল !’…মেঘটা কাটতেই জাকিয়ে ঠান্ডা পড়বে ! হাসতে হাসতে বলে।
আধাখ্যাঁচুড়ার যুগ বলে ।…সেটেলাইটটাকে পুরো মানলেও বুঝতেস! …ভন্টু কি কচ্ছে?’
‘ওপারে ! ক্লাশ চলছে! ‘
এই এক জ্বালা ! অন লাই-ন ! কিসসু হয় না !
নিয়েই ফের দীনবন্ধু বল্লেন ‘ক র বে ও বা কি !
বিকেলে সত্যিই পশ্চিম আকাশে মেঘের ফাঁকফোকড় দিয়ে ম্লান আলোর দেখা মিলল । পুরনো ঘরবাড়ি, গলিগুলো তেমন অধিক স্যাঁতসেঁতে । একটা গোপনীয়তা যেন সব কিছু মুড়ে দিতে চাইছে কে ।
বেরিয়ে আসি বাপু ! …বহুদিন পরিচিত পথ-ঘাট পা ফেলেন না দীনবন্ধু । জন্মপরিচয়ের দু-চারজন বৃদ্ধ মুখোমুখি ‘দানু না ?’ বললে দাঁড়াতে হয় । ‘ডুমুরের ফুল হয়ে গেলে যে বাপু ।…কলেজ চলচে ? এ্যাঁ রিটেয়ার ? কবে ?’ বছর ডেড়েক হল ! ‘এই তো সে দিন গো! পেন্টুল পড়ে ঘুড়ি ওড়াতে দেখতুম তোমায়! দীনবন্ধুকে হেসে মন্তব্য করতে হয়, তাই তো কাবুল জ্যাঠা, এবার ঘুড়ি কাটবার পালা ।
গঙ্গার ধারে ঐতিহাসিক বটগাছটার বাঁধানো চত্বরে বিশ্বাস বাড়ির কাবুল বিশ্বাসকে দেখা গেল লাঠি সামলে, দিব্যি সেজেগুজে বসে আছেন।
তোমায় তো দেখতে পাইনে এখানে ?
সময় পাইনে জ্যাঠা। …আপনি রোজ আসেন ?
খাটো গলায় কাবুল জ্যাঠা একবার রাধা গোবিন্দকে নমস্কার ঠুকে চলে যাই…এখানে বসবে যে, উপায় আছে ? দেখছ না ? …দাঁড়িয়ে কেন, এসো, বসো !
দীনবন্ধু দেখলেন বাঁধানো বেদিগুলোতে সিগারেট, ছেলেমেয়ের জোড়া, মোবাইলে ছবি তোলার আদিখ্যেতা । এ-সব দেখে তাঁর কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না । বৃদ্ধের সম্মানার্থে বলে, কত বয়স হল ?
গত নভেম্বরে বিরানব্বইতে পোল্লুম !
এরপর কাবুল জ্যাঠাই বকবক করতে থাকেন। দীনবন্ধু দু-চারটে কথায় সায় দিয়ে বাকি সময় নিজের ভাবনাতেই । বটগাছের নীচে রাধাগোবিন্দের মন্দিরটি প্রায় দুশো বছরের । পুরনো জমিদারদের শেষ চিহ্ন হিসেবে এখন ট্রাস্টির অধীন ।
‘জ্যাঠা আপনি নন্দী ডাক্তারকে দেখেছেন ? সুখচরেব ?’
বিভূতি নন্দী ? কেন দেখব না ? মিলিটারিতে ছিলো, যুদ্ধে জয়েন করে সিঙ্গাপুর কি বার্মার দিকে জাপানিদের হাতে পড়ে, আইএনএতে যোগ দিয়েছিল… লাল কেল্লায় বিচার হয়… শেষে সুখচরে আসে …
অরিজিনালি হুগলির লোক…ওরা জাতে তিলি… চাটুজ্যে পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করেছিল ভাই !
‘কর্নেল ছিলেন না ? দীনবন্ধুর ভুল শুধরে, কাবুল জ্যাঠা গলায় জোর দিয়ে বল্লেন, নো !… লেফটেন্যান্ট কর্নেল হয়েছিল আইএনএতে। ওই নন্দীআলয়ের জমিটা চাটুজ্জে পরিবারের এক শরিকের !’
‘সবই দেখছি আপনার স্মরণে আছে ?’
কাবুল বিশ্বাস শ্লাঘা বোধ করলেন। শুধু তাই ! বি টি রোডের বাজারে ডিসপেনসারিটা খুলেছিল ৪৭-এর ১৫ আগস্ট। ঠিক স্বাধীনতার দিন।
ডাক্তারবাবুর এক বোনের বিয়ে হয়েছিল সুখচরের শেঠ পরিবার’!
বৃদ্ধ হেসে বল্লেন, শিবেনের আপন মামা ! সব জানিরে লাট্টু!’
হারিয়ে যাওয়া ডাকনামটি শুনে মনে হল আচমকা কে যেন ঘুম থেকে ডেকে তুলল ।
কাবুল বিশ্বাস ফের একবার, শেঠদের তিন পুরুষের ব্যবসা । শুনিচি, শিবেনই দৈত্যকুলের পোহ্লাদ !’
দৈত্যকুল মানে? দীনবন্ধু মুচকি হাসলেন।
ওরা মা লক্ষ্মীরই কিরপা পেয়েছিল, ও বংশে সরস্বতী উঠোন পেরোননি !…শুনিচি, বাপ-ঠাকুরদ্দাদের কাছে , দুগ্গা পিতিমের ভাসানে লাঠালাঠি চলত সুখচরের পেনেটির মধ্যে ! …শেঠরাই পেছন থেকে তেল জুগিয়ে দিত ! …শিবেন বড় ইঞ্জিনিয়ার …শুনিচি এলেকার ইতিহাসও ঘাটাঘাটি করে ।
যেন রহস্যের সমাধান পেয়েছেন বুড়োর কাছে জানতে চাইলেন, ডা. নন্দী বেঁচে থাকলে এখন বয়স কত হোত ? এবছর কি শতবর্ষ ?
কাবুল জ্যাঠা এর ঠিকঠিক হিসেব দিতে পারলেন না ।
মাস দেড়েকের মাথায় সকালের দিকে শিবেনের ফোন । যা যা বলেছিলেন, হয়ে গেছে !…একবার স্যার যাব ? …ডি টি পির ফাইনালটা নিয়ে ?’
আজ সচেতন ভঙ্গিতেই দীনবন্ধু বসাক কৌতূহল প্রকাশ করলেন, আজই ? ক’টার মধ্যে ?
দশ থেকে পনেরো মিনিটের মধ্যে ।
এসো ! …সাড়ে দশটায় কিন্তু একবার বেরুতে হবে আমায় !’
ঠিকঠাক ঘড়ি মেপেই শিবেন হাজির । দীনবন্ধু আজ বৈঠকখানায় সাজিয়েগুছিয়ে শব্দের অপেক্ষায় । অথচ কিছুই টের পেলেন না । বাইরে কোনো দুচাকার আওয়াজ শুনলেন না । শিবেন সোজা সদর দিয়েই ঢুকে পড়েছে। দেয়ালে তাকিয়ে সময়ের অনুবর্তিতায় দীনবন্ধু অবাক।
স্কুটার কোথায় ?
চারচাকায় এসেছি… গলির মুখটাতে আছে !
আজ অ্যাপায়নে আনুষ্ঠানিকতা কম ছিল । শিবেন নিজেই চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল । নিজেই ঘরের দেয়ালে সময় দেখে নিয়ে সাইডব্যাগ থেকে একস্তূপ ডিটিপি কাগজের ফাইলটা বার করতে করতে বলে, ডায়রির পুরোটাই হাতে কপি করে, টাইপ করিয়ে নিয়েছি !
আচ্ছা শিবেন ?
বলুন হাতটা গুটিয়ে সোজা স্যারের মুখে তাকাল ।
এটা কি বিভূতি ডাক্তারের শতবর্ষ ?
কেন বলুন তো ? সামান্য হেসে, একটু থেমে বলে, চার বছর আগে হয়ে গেছে !…উনিশশো সতেরোয় জন্ম ওনার …শতবর্ষে ডায়রির সন্ধান পেলে তো ভালোই হত !
ফের শিবেন হেসে, শতবর্ষের প্রসঙ্গ তুললেন কেন ?
তা নয় ! ঠিক ঠিক কি চাইছ আমার কাছে, একটু বলবে ?
শিবেন গম্ভীর, খানিকপর ধীরে-সুস্থে বলে, আমার সম্পাদনায় বই বেরুবে ।… আপনি যদি মুখবন্ধ হিসেবে কিছু লিখে দেন… ইতিহাসের তো ভবিষ্যত থাকে ! … আর আমার সম্পর্কে আপনি জানেন… পুরোটা’ পড়ে দেখুন ।
এখানে ভাষায় সাধু চলিতে গন্ডগোল, বাক্যগঠনেও কিছু কিছু …ভাবছি ঠিক ও ভাবেই রেখে দেব… যদি স্বাধীনতার ৭৫ বছরে প্রকাশ করা যায় ।
আজ চায়ের প্রস্তাবটি শিবেনই ফিরিয়ে দিল । তারও ব্যস্ততা আছে । পেছন পেছন গিয়ে সদূরে দাঁড়িয়ে দীনবন্ধু বলেন, কথা দিচ্ছি না আজ !…একটু ভাবি । …পড়ে দেখি!
ফের হেসে, যদি আমার পক্ষে কাজটা fools rush … Angels fear to treat-এর মতো না হয় … ফোনে কথা হবে !’
কবে নাগাদ জানব ?
ধর one week !
এ-ঘরে ঢুকতেই উমা, বলেছিলাম কিনা?… কারণ ছাড়া কিছু হয় ?
দীনবন্ধু বলেন, তুমি যে-ভাবে বলেছিলে ঘাবড়ে গেছিলাম ! ক্রিমিনাল কিছু যেন !… এটা তো fair প্রস্তাব ! ’
উমা বাধা দেয়, fair বা unfair তো বলিনি আমি ?… খারাপ সন্দেহও করিনি ।’
দেখো আমার ওপর আস্থা রেখেছে, ভাবতে ভালো লাগছে না ?
যুক্তিটা সেখানে ছিল না ।
পরের চার পাঁচ দিন দীনবন্ধু বসাক সম্পূর্ণ চুপচাপ । বোঝা গেল না শিবেন শেঠ নামক কেউ কোনো সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে । কিংবা ফাইলটা খুলে খুঁচিয়ে দেখা দরকার।
একদিন বিকেলে বি টি রোডের পুরনো বাজারটার কাছে গিয়ে দেখতে পান, প্রশ্রস্ত এলাকা জুড়ে ভাঙচুর, খনন ও গাছ কাটাকাটি চলছে ।
ফুটের ভুট্টাবাজার পুরনো লোকটা জানায়, হাঁ বাবু, বড়িয়া পার্টি !… মল হবে !
জমির মালিকানা ছিল তো সুখচর গঙ্গার ধারের টুলি ঘোষদের । হারু ঘোষ, বদি ঘোষ —পাঁচ-পাঁচটি ভাই ওরা।
খুব পুরনো পরিবার । পুরনো যুগের দেববাহাদুরদের এস্টেটের আমল থেকে বসতি। দেববাহাদুরদের সঙ্গে পানিহাটির জমিদারদের রেষারেষি আজ ইতিহাস । দুঅঞ্চলের সীমারেখায় একটা প্রাচীন মস্ত অশ্বত্থ গাছ ছিল । গত আয়লায় উল্টে গেছে ।
মাঝে একদিন সকালে হঠাৎই শিবেনের তাগাদা, সময় পেলেন স্যার ? চোখ বুলিয়েছেন ? শুনে দীনবন্ধু বসাকের দায়িত্ববোধে একটি সতর্কতা ঘা দিল।
আর দিন দু-তিন ! … চাপে ছিলাম কিনা!
শিবেনের তরফে তাগাদাটুক শিষ্টাচারে ঢাকা থাকলেও, কেন জানি দীনবন্ধুর মধ্যে কোথায় যেন হীনম্মন্যতার টোকা ।
পরদিন রাত এবং পরের সারা দুপুর ধরে ফাইলটা শেষ করে, অবসর প্রাপ্ত ইতিহাস শিক্ষকটির মনে হল, সিংহাসন, ক্ষমতা ও যুদ্ধের চাইতে, কিছু কিছু অখ্যাত মানুষের আত্মজবানিতে অনেক বেশি উত্তেজনা । শিবেন ঠিকঠাক কর্তব্যটিই হাতে নিয়েছে । এখানে জড়াতে পারলে মন্দ কি? কিন্তু ফাইলটা শেষ করে বুঝলেন খুব সহজসাধ্য কাজও নয় । তালে, কি প্রলোভন দেখিয়ে, সুখচরের শেঠ পরিবারের সদস্যটি পানিহাটির সম্মানীয় অধ্যাপকটিকে উন্মোচিত করে দিতে চায় ? লেখাটাতে পাকাপাকি থেকে যাবে ! সকলেই পড়বে !
নাঃ ! সরাসরি এ ব্যাপারে উমার পরামর্শ নিলে চলবে না। আঙুল বাঁকিয়ে ঘিটুকু তুলতে হবে। নীচ থেকে পুত্রবধূকে ডাকলেন ।
‘কিছু বলবেন ?’
হ্যাঁ !
যা-চ্ছি !
উমার ঘরে তখন ম্যাসেজের মহিলাটি জানলা দরজায় পর্দা টেনে দিয়েছে। পেছন বারান্দা ধরে জয়া ‘বলুন’ বলে দাঁড়াল।
সন্ধেতে আজ ঘরে থাকবে তো ?
হ্যাঁ কেন ?
তোমার তো আবৃত্তির ওভ্যেস ছিল, কিছু পড়ে শোনাবে ? আজকাল নিজে পড়ার চাইতে কেউ শোনালে চট করে ধরতে পারি !
ফের দীনবন্ধু একটু হেসে ভাবছ বাবা সম্পত্তির দলিল-টলিল পড়িয়ে নিচ্ছে ?
সারা শরীর কাঁপিয়ে জয়া হেসে উঠল।
সন্ধ্যার পর টিভির সিরিয়াল বন্ধ রেখে একটা চেয়ার টেনে এনে কয়েকটা টাইপট কাগজ তুলে দিয়ে দীনবন্ধু বল্লেন দ্যাখো , লাল কালির টিক দেওয়া আছে… পুরোটা পড়তে হবে না ।
উমা অনুমানেই ধরে ফেলতে জানে ।
শিবেনের ডায়রিটা ?
বিভূতি ডাক্তারের … শিবেন তো নিমিত্ত !
ফলে, ঘরের আবহাওয়া একটু কৌতূহলের বাতাসে ঘন হয়ে ওঠে । জয়া লাল টিকটির আশেপাশে উল্টেপাল্টে দেখে, সিঙ্গাপুরে ভারতের ব্রিটিশ সৈন্যরা জাপানিদের হাতে ধরা পড়ে গেছে ।
‘…এদিকে জাপানিরা আমাদের বড় বড় officer দের নিয়ে বক্তৃতা পরামর্শ শুরু করলেন । জাপানিরা বলতে লাগলো বৃটিশরা তাহাদের শত্রু, ভারতীয়দের সঙ্গে তাহাদের কোনো শত্রুতা নেই । তাহারা আমাদের বন্ধু । বৃটিশদের তাড়াইবার জন্য তাহারা ভারতবর্ষের ভিতরে প্রবেশ করিবে । আমরা ভারতবাসী prisoner না থাকিয়া যদি ভারত হইতে বৃটিশদের তাড়াইবার জন্য যাইতে ইচ্ছা করি, যাইতে পারি এবং জাপানিরা বৃটিশদের তাড়াইয়া ভারতবর্ষে রাজত্ব করিবার  কোনো অভিসন্ধি নাই । ভারবর্ষ ভারতবাসীর হাতে দিয়া তাহারা চলিয়া আসিতে চায় । … যাহা হউক কয়েক দিন ধরিয়া বক্তৃতা ইত্যাদি হওয়ার পর আমাদের মধ্যে কিছু লোক INA formation -এ volunteer করিল, কিছু লোক যোগ দিল না । none voluntree হইতে চাইল । যাহারা Non volunteer হইল তাহাদের prisoner of war এর camp-এ একসঙ্গে জড়ো করা হইতে লাগিল।…আমাদের যাহারা volunteer হইলাম সকলেরই নুতন uniform, badge ইত্যাদি তৈয়ারি হইল’ জাপানিরা আমাদের তখন হইতে equal status diclare করিয়া দিল । পরস্পর পরস্পরকে সম্মান ও খাতির করিতে লাগিল । জাপানি officer-রা আমাদের সৈন্যদের training দিতে লাগল । jungle warfare-এ জাপানিরা খুব পারদর্শী । …আমাদের জাপানি শিখবার জন্য হৈ চৈ পড়িয়া গেল । class হইতে লাগিল । আমরা তিনমাস class করিয়া জাপানি বেশ একটু আধটু শিখিয়া লইলাম । …আমাদের Badge যা হইল তাহাতে Indian National Flag অনুযায়ী তিন রঙ এর border দেয়া সব badge তৈয়ারী হইল।…’
আমাদের অনেক লোক volunteer করিয়াছিল, প্রায় ৬০/৬৫ হাজার লোক। জাপানিরা প্রথমে হাজার ১৫ লোককে training দিতে শুরু করিয়াছিল। সকলকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়াছিল। আমরা officer, আমাদের revolver দেওয়া হইয়াছিল। … ইতিমধ্যে যুদ্ধে তখন জাপানিরা British-দের Burma হইতে তাড়াইয়া দিয়াছে । ভারতবর্ষে ঢুকিবে, সব ready আমাদের order হইল ভারতবর্ষে জাপানিরা যাইতেছে আমাদেরও বার্মা যাইবার জন্য এবং ওখান থেকে India-তে যাবার জন্য প্রস্তুত হইতে বলিল । তখন আমাদের মধ্যে নানান রকম কথাবার্তা হইতে লাগিল। সকলে বলিতে লাগিল জাপানিরা তো মাত্র ১৫ হাজার লোককে অস্ত্রশস্ত্র দিয়া লইয়া যাইতেছে। বাকী লোককে নিরস্ত্র রাখিয়া Singapore-এই যদি রাখিয়া দেয় তাহা হইলে ভারতবর্ষে গিয়া আমরা
১৫ হাজার লোক কী করিব! জাপানিরা আমাদের পুতুল খেলার মতো খেলিতে পারিবে । আমরা চাইলাম আমাদের সকলকেই যাহারা volenteer করিয়াছে অস্ত্রশস্ত্র training দেওয়া হোক, নচেৎ আমরা বার্মার জন্য রওনা হইব না । … জাপানিরা কিন্তু বলিতে লাগিল —না তাহাদের কোন দুরভিসন্ধি না ই। ভারতবর্ষ তাহারা শাসন করিতে চায় না।…আর যদি না যাই সকলকে Prisoner of war করিয়া fatigue করিতে পাঠাইবে ইত্যাদি, ইত্যাদি। তখন camp-এ camp-এ আমাদের General Mohan Singh-আমাদের officer দের বক্তূতা দিতে আসিল । কথা হইল জাপানিদের সঙ্গে আমরা বার্মা যাইব না, যদি আমাদের সকলকে অস্ত্রশস্ত্র না দেওয়া হয় । আমরা আমাদের badge, record ইত্যাদি পুড়াইয়া দিয়া P.O.W হইয়া যাইব । General চলিলেন এই খবর শুনিলে নিশ্চয়ই জাপানিরা তাহাতে গ্রেপ্তার করিবে । …তাহাই হইল … গ্রেপ্তারের খবরের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের instruction দিলেন, আমাদের badge, record সব পুড়াইয়া দিতে, আমরা তাহাই করিলাম। …
ইতিমধ্যে গলা শুকিয়ে যাওয়ার জয়া উঠে গেল বোতলটার জন্য । উমা ও দীনবন্ধু —কেউই কোনো মন্তব্যে গেল না । মনের ভেতর কী যেন সিমেন্ট-পাথর কুচিতে মিশে কংক্রিট হয়ে চলেছে । জয়া ফিরে আসে । স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দুর্বোধ্য দূষ্টিবিনিময় হল । দীনবন্ধু এবার টয়লেট ঘুরে এলেন ।
…জাপানিরা ভীষণ মুশকিলে পড়ল । তাহারা প্রথম প্রথম আমাদের খুব ভয় দেখাতে লাগিল। এই রকম revest করার জন্য, আবার ভালো কথাও বলিতে লাগিল। জাপানিরা তখন Tokyo হইতে Rash Bihari Bose-কে লইয়া আসিলেন সিঙ্গাপুরে, আমাদের বোঝাইবার জন্য । রাসবিহারী বোস আমাদের বক্তৃতা ইত্যাদি দিয়া বোঝাইতে লাগিলেন —জাপানিদের উদ্দেশ্যে কোনো খারাপ না ইত্যাদি । সুতরাং INA Reform করিবার জন্য বলিলেন। আমরা কিন্তু রাসবিহারী বোসকে খুব ভালোভাবে নিতে পারিলাম না। কেননা উনি অনেকদিন ভারত হইতে জাপানে চলিয়া গিয়াছেন, জাপানে আছেন, জাপানি বিবাহ করিয়াছেন। জাপানি regiment-এ তাহার ছেলে আছেন, সুতরাং তিনি জাপানীদের কথায় সায় দিয়ে চলিতে বাধ্য। …
আমরাও এদিকে নাছোড়বান্দা—জাপানিরাও দেখিনি আমাদের ছাড়া ভারতবর্ষে প্রবেশ করা তাহাদের পক্ষে অনেক প্রকার শক্ত হইবে আর আমরা সঙ্গে থাকিলে তাহাদের কাজ অতি সহজ হইয়া পড়িবে। আমরা এদিকে সুভাষ বসুকে আমাদের কাছে না আনিলে INA reform করিতে রাজি নই, এই দেখিয়া জাপানিরা রাজি হইল এবং বলিল তাহারা চন্দ্র বসুর সঙ্গে জার্মানিতে contact করিবেন এবং চন্দ্র বসুকে সম্ভব হইলে সিঙ্গাপুরে আনিবেন। …
…ভাগ্যের কি পরিহাস । যেন একটা magic হইয়া গেল—সুভাষচন্দ্র বসু Tokyo-তে আসিয়াছেন এবং জাপানি কর্তাদের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধে কথাবার্তা কহিতেছেন এবং শীঘ্রই আমাদের জন্য  বক্তৃতা দিবেন । একদিন সন্ধ্যার সময় খবর হইল জাপান হইতে সুভাষ চন্দ্র আমাদের বক্তৃতা দিবেন। আমরা বিশ্বাসই করিলাম না। …তবু জাপানিরা আমাদের শোনাইবার জন্য radio-র বন্দোবস্ত করিয়াছে, সে কি উৎসাহ সকল group-এর। আগে সব লোকে সুভাষ চন্দ্রের radio broadcast শুনিল। কেহ বলিল এ সুভাষ এর গলা নয়, এ অন্যলোক। আমাদের মিথ্যা কহিয়া, সুভাষচন্দ্রের নাম দিয়া অন্য লোক বক্তৃতা দিল ।…
…কিন্তু বাস্তব সত্যে পরিণত হলো, আমরা সব Neesoon Camp-থেকে বিদ্যাধরী camp এ গেলাম। বৈকাল বেলায় সুভাষ বসুকে দেখবার জন্য এবং তাঁর বক্তৃতা শোনবার জন্য। সে কি উৎসাহ ! …শুধু মনে আছে তিনি বলিলেন ভারতবর্ষের মধ্যে থাকিয়া তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়িয়াছেন, কিন্তু নানা বাধা বিপত্তির মধ্য দিয়া —তাঁহাকে জেল হইতে পলাইয়া বাহিরে যাইতে হইয়াছিল এবং তিনি দেখিলেন ভারতের ভিতর হইতে ইংরাজদের সহিত লড়াই করিয়া ইংরেজকে তাড়াইয়া দেশ স্বাধীন করা একপ্রকার অসম্ভব । সেই জন্যই তিনি ভারতের বাহির হইতে সুযোগ করিতেছিলেন দেশ স্বাধীন করিবার জন্য। সময় ও সুযোগ ছাড়িতে নাই…। এরপর থেকে তাঁহাকে ‘নেতাজী’ বলিয়া সম্বোধন শুরু হইল। ‘
জয়া থামল। তাকিয়ে টের পেল, এ পর্যন্তই। একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ। স্ত্রীর সঙ্গে চোখাচুখি হতেই উমা বলল, ‘সব তো ঘটে গেছে! …অতীত! তুমি নতুন কি যোগ করবে এতে ? ‘
দীনবন্ধু নীরবে তাকান।
উমা ফের, ভবিষ্যতে কী ঘটবে আন্দাজে কিছু লেখা যায় ? …শিবেনের ভেন্ন কোনো মতলব আছে! দেখে নিও।’
অধ্যাপক দীনবন্ধু বসাক ঘাবড়ে গেলেন । ইতিহাস কি পুরনো ঘটনা শুধু ? ভবিষ্যতের কোনো ইঙ্গিত করা যায় না ইতিহাসে?
আস্থা ও অনাস্থার আলোছায়ায় এই মুহূর্তে শিবেন শেঠ, অধ্যাপকের কাছে অর্ধনারীশ্বর হয়ে উঠল ।

♦—♦


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!