- খাস-কলম
- ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৫
বইমেলা বাড়ছে! সুনীলের হাতে হতাশার লিফলেট

স্টল নম্বর শূন্য – বইয়ের নাম ‘হাতছানি’। স্টল নম্বর মাইনাস ওয়ান – বইয়ের নাম ‘লোভ’। স্টল নম্বর মাইনাস টু– বইয়ের নাম ‘রিপু’। স্টল নম্বর মাইনাস থ্রি – বইয়ের নাম ‘সিঁড়ি’। স্টল নম্বর ফোর থেকে এভাবে ইনফিনিটিতে পৌঁছব। এই ইনফাইনাইট অস্তিত্বের ভিতরে কীভাবে লেখা হবে বই? কতদূর গেলে তার অশেষকে খন্ডন করা যাবে? ইনফিনিটি কি, ব্ল্যাক হোলের মতো একদিন আমাদের গ্রাস করে নেবে?
শুনতে পাই, পাঠ আর পাঠকের দূরত্ব কিলোমিটারে বাড়ছে। শুনতে পাই, বইয়ের ক্রেতা আর দর্শকের মধ্যে অবাক পৃথিবীর ব্যবধান। দেখতে পাই,আমরা ধীরে ধীরে ঋণাত্মক মঞ্চের দিকে এগোচ্ছি। আলো হালকা হতে হতে ইষৎ নীল। অন্ধকারের প্রাক মুহূর্ত, অথচ দিব্যি সবটাই দেখতে পাচ্ছি। ইষৎ গুঞ্জন, হাততালি, রসিকতা, পান বিড়ি সিগারেটের গন্ধ, ফিশফ্রাইয়ের গন্ধ, চাউমিনের গন্ধ, মোমোর গন্ধ আর স্তূপীকৃত ঠাণ্ডা কাগজের গন্ধ ইত্যাদি। চতুর্দিকে সেলফি ক্যামেরার ক্লিক। ফ্যাশন দুরস্ত রঙিন মডেল-সুলভ ভাইটাল স্ট্যাট-এর ক্যাটওয়ক নিয়ে স্টলের সামনে পরিশীলিত ভিডিও টেক। মনে রাখতে হবে, তিরিশ সেকেন্ড থেকে ষাট সেকেন্ডের বেশি মনোযোগকে সম্প্রসারিত করা দূরহ। স্মল ইজ বিউটিফুল। পড়ার জন্য উদ্বৃত্ত সময় কোথায়? ক্ষুদে একটা গল্পের বই দিতে পারেন? ছোট্ট আকৃতির ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্ট? অল্প একটু ভয়, অল্প একটু রোমান্স, অল্প একটু সমাজ… একটা টোটাল প্যাকেজ চাই।
পরাবাস্তব আলোর প্রতিফলনে, বইমেলা স্বপ্নময় হয়ে উঠেছে ঋণাত্মক অঙ্কে। শূন্য থেকে পিছনের দিকে যাওয়ার কথা বলেছিলেন সরস্বতী। সকালে ভরপেটে পাশের বাড়িতে অঞ্জলি দিতে দিতে বলেছি, আমার এই লেখকজীবনের প্রাসঙ্গিকতা কতখানি সৎ, জানিনা। কিন্তু সততা আমার মূল মেটেরিয়াল, সততা আমার কনটেন্ট, আমি সততারই ডিজিটাল অস্থিরতা চিত্রিত করি। এরকম ভর পেটে নিবেদিত অঞ্জলির ফুল ছুঁয়ে বলেছি, মিথ্যে আমি লিখি না, আঁকি না। মুচকি হেসে সরস্বতী বললেন, মিথ্যে সাহিত্যের প্রথা। তাকে প্রণাম করো। ব্যাক ক্যালকুলেশনের করো, পিছনে হাঁটো এবং দেখো, নিজেকে জানো। তোমার উপাসবিহীন অঞ্জলির ফুল গচ্ছিত রাখলাম। ফিরে আসিবার পর জানাইয়ো, ‘উহা ফেরৎ চাহো কি না?’
আমি পিছন দিকে চলতে চলতে শূন্য থেকে পিছনের দিকেই এসে পৌঁছলাম। নাটোরের বনলতা সেন পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে বললেন, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ দেখলাম পারদ ক্রমশ নিচের দিকে নামছে, চতুর্দিক হয়ে উঠছে অদ্ভুত, রহস্যময়, চেনা আর অচেনা মুখের সঙ্গম। শূন্য থেকে শুরু করে স্টলের সংখ্যা ক্রমশ নামছে। পাম অয়েলের গন্ধ ধীরে ধীরে ঘিয়ের দিকে ছুটছে। রঙিন দৃশ্য সাদা কালোর দিকে যাচ্ছে। ট্রামলাইনে দাঁড়িয়ে সবুজ সিগন্যালকে লাল করার চেষ্টা করছেন জীবনানন্দ। দেখলাম, মানিক একখানা ধাপির উপর বসে শশী আর কুসুমের কথোপকথন লিখছেন। রামকিঙ্কর ছবি আঁকছেন আর দৃশ্যের অন্ধকারের দিকে নির্দেশ করে বলছেন, পিছনে, আরও পিছনে ফিরে যাও! বহুদূরে দেখা যায়, স্তিমিত আলোকবিন্দু! তবে কি কলকাতা বইমেলা অতীতে ফিরে যেতে উদগ্রীব? নাকি দিকদর্শন করাতে চাইছে লেখক, পাঠক, সময় আর বোধসত্তাকে!
কোথা থেকে আসিয়াছ তুমি হে উর্বর? কেন সারণীর অলিগলি ঘুরে আজ উন্নত প্রযুক্তিবিলাসের স্রোতে ভাসছ? বই আর ক্রেতার পথে-পথে এত প্রশ্নময় সংশয় ! কেন এই ঘোর ডিক্টেটরশিপের উদ্বোধন আর অবক্ষয়?
কী লিখি তোমাকে তিলোত্তমা? রাশি রাশি বইয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হতাশার ছেঁড়াছেঁড়া লিফলেট বিলি করছেন প্রেমময় সুনীল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বলছেন, কেউ কথা রাখে না…।
বইমেলা বাড়ছে, এগিয়ে, আরো এগিয়ে।
আমি দ্রুত পায়ে সরস্বতীর দিকে ফিরে চললাম। আমার পদধ্বনিতে এ কী বিষন্নতা!
লেখক : কবি ও গদ্যকার। বেসরকারি সংস্থার বহুমুখী কর্মী।
❤ Support Us