- ব | ই | চ | র্যা রোব-e-বর্ণ
- জুলাই ১০, ২০২২
ইতিহাস চেতনার যুক্তিময় উচ্চারণ
মইনুলের দৃষ্টিপাত চিন্তার পূর্বায়নকে অতিক্রম করে নবায়নের দিকে, যুক্তিচর্চার দিকে, বাঙালি মুসলমানের মুক্তচিন্তার সূচনার আর বিস্তারের দিকে ফিরে তাকানোর ডাক দেয়

রাজ্যসভা আর লোকসভার প্রাক্তন সদস্য মইনুল হাসান রাজনীতির বাইরে দাঁড়িয়ে কখনও নৈর্ব্যক্তিক ভঙ্গিতে, কখনও একাত্ম হয়ে, আবেগদীপ্ত, যুক্তিময় উচ্চারণে শতবর্ষের শ্রদ্ধা জানালেন জমিয়তে উলামা, সত্তগাত পত্রিকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, খিলাফত আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’-কে। মইনুল সুবক্তা সুলেখক সুরসিক হিসেবে সুপরিচিত। তাঁর লেখালেখির বিষয় প্রধানত ইতিহাস আর বৃহত্তর সমাজবিজ্ঞান। ইতিহাসের প্রচলিত প্রবাহে যে বিষয় অনেকটা অনুক্ত, অনুচ্চারিত, সে-সবকে ভিন্ন চোখে, ভিন্নতর বিশ্লেষণে দেখার অভ্যাস তাঁর বহুদিনের। এখানে তিনি সাবালটার্ন ইতিহাস চর্চার আরেক নিবিড় পাঠক, গবেষক হয়ে ওঠেন। তার সদ্য প্রকাশিত ‘শতবর্ষের স্মরণ’ বইটিতেও একইভাবে মইনুল হাসান-এর অন্তরাত্মার পর্যবেক্ষণ ভেসে উঠল। জমিয়তের উলামা হিন্দ যে একটি সর্বভারতীয় সংগঠন, ব্যপ্তি তার গণমুখী, সমাজমুখী এবং দেশাত্মবোধে প্রাণিত, এ চর্চা বাংলা ভাষায় বিরল। ইতিহাস চর্চার প্রধান স্রোত কেন জানি জমিয়তের উত্থান আর দেশপ্রেমের নির্মাণকে এড়িয়ে যায়।
মশিরুল হাসান-কে বাদ দিলে, অন্য কোনো বরেণ্য ইতিহাস বেত্তা জমিয়তের উদারতাকে দেশ ভাগ বিরোধিতাকে, সহিষ্ণুতাকে গভীরভাবে খতিয়ে দেখেন নি। বাংলা ভাষায় জমিয়ত-চর্চার চিত্র আরো বেশি করুণ। অবিভক্ত বঙ্গ আর আসামে ইতিহাস ছোঁওয়া সংগঠনটির সামাজিক আনন্দোলনের বৃত্তান্ত বিলকুল অবজ্ঞার বিষয় নয়। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে, জমিয়তের সঙ্গে সংযুক্ত উলামাদের সংগ্রাম আর ত্যাগের সত্যকাহন আমাদের ভাবিয়ে তোলে। মইনুল হাসানের চোখ আর ভাবনা অর্ন্তভেদী। শতবর্ষের জমিয়তকে তাঁর নির্মাণকে, স্বাধীনতার আগে পরে তার অপ্রতিরোধ্য গতিকে যে ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন প্রকারান্তরে জমিয়ত নিয়ে আমাদের সেকাল আর একালের ভাবনাচিন্তা বদলের দাবি জানিয়েছেন— তা বিবেক আর যুক্তিকে নাড়িয়ে দেবার এবং ভাবনার অন্যরকম অভিমুখ হতে পারে। শতবর্ষের সও পত্রিকা আর তার প্রতিষ্ঠাতা নাসিরুদ্দিনকে ঘিরেও মইনুলের দৃষ্টিপাত চিন্তার পূর্বায়নকে অতিক্রম করে নবায়নের দিকে, যুক্তিচর্চার দিকে, বাঙালি মুসলমানের মুক্তচিন্তার সূচনার আর বিস্তারের দিকে ফিরে তাকানোর ডাক দেয়।১৬৭ পাতার বইটি বিভিন্ন কারণে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনলগ্নে, কলকাতার একাংশ নাগরিকের বিরোধিতা, সংকীর্ণতার রটনা আর গুজবকে নস্যাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথের গণসংবর্ধনা, সংবর্ধনা সভায় কবির অর্ন্তদৃষ্টির সংশয়হীন, সংযত বর্হিপ্রকাশকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন মইনুল।
খিলাফত আন্দোলন (১৯১৯-১৯২৪) কংগ্রেসের গণসংযোগ গড়ে তোলার প্রয়াসের সঙ্গে সরাসরিভাবে যুক্ত। এ আন্দোলনের প্যান ইসলামি কর্মসূচি কীভাবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী হয়ে উঠল, কোন পরিস্থিতিতে আন্দোলনের নেতৃত্ব বুঝতে পারল যে, কংগ্রেসের সঙ্গে সহযোগিতা গড়ে তুলে, ব্রিটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের শরিক হয়ে ওঠা দরকার। এই বিশ্লেষণেও মইনুল হাসানের পর্যবেক্ষণ ভাবিয়ে তোলে আমাদের।
শতবর্ষের বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নিজের আলোড়ন, বাংলাদেশের উত্থানপর্বে তাঁর বালক বয়সের ভাবাবেগ এবং সপরিবারে মুজিব হত্যার ভীবৎসতায় তাঁর অশ্রুসিক্ত বেদনায় বয়ান লিখেছেন মইনুল। নিবন্ধটি ব্যক্তিকতার পরিসর ছেড়ে, ক্রমান্বয়ে সমষ্ঠির হয়ে ওঠে। পুস্তিকার শেষ লেখার বিষয় কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’কে নিয়ে ব্যক্তি আর সমষ্ঠির ভাবনা। এক্ষেত্রেও ব্যক্তিকতা আর নৈর্ব্যক্তিকতার দর্শন ও সমাজতত্ত্ব একে অন্যের পরিপূরক হয়ে ওঠে। মইনুল এই সময়ের নিরপেক্ষ দর্শক। দৃষ্টি তাঁর দিশাহীন বা ছত্রহীন নয়। ইতিহাসের ব্যক্ত-অব্যক্ত বিষয়কে দূর থেকে দেখতে তিনি অভ্যস্ত । অতীতের সঙ্গে বসবাস নয়, অতীতকে একাল আর আগামীর চোখে দেখতে দেখতে প্রয়োজনীয় আয়োজনকে গুরুত্বময় করে তোলবার দক্ষতা তাঁর প্রশ্নহীন। প্রসঙ্গত, একটি জরুরি কথা বলা দরকার । বইটির অঙ্গশোভা, ছাপা চমৎকার। তবু কিছু প্রশ্ন ঝুলে রইল।
শতবর্ষে স্মরণ : মইনুল হাসান
মূল্য: ২২৫ টাকা
প্রকাশক: উদার আকাশবা.উ
❤ Support Us