- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- জুন ১২, ২০২২
দশ ইঞ্চি প্রজাপতি
পর্ব ৭

উ।প। ন্যা।স
যদুনাথ নিজেও অবগত, শখেরপুরের জেলখানা অঞ্চলটা নির্জন। একসময় সেখানে পাশের মিউনিসিপ্যালিটির জঞ্জাল ফেলবার মাঠ ছিল। সত্তরে নকশাল আন্দোলনের সময় কত যে বেওয়ারিশ লাশ মিলত ! নমঃশুদ্রদের একটি জবরদখল কলোনি ছাড়ি- অঞ্চলটায় লোকবসতিও বিরল। এখনও, শখেরপুরের অন্যান্য ওয়ার্ডের ঘিঞ্জি জনবসতির তুলনায়, এলাকাটায় জনসমগম কম।দুপুরের আলোচনার পর , সব্বাই চলে গেল, যদুনাথ পরিমলকে একটু থেকে যাওয়ার ইঙ্গিত করে। পরিমল-য়ের কাজই হচ্ছে দালালি করে অন্নসংগ্রহ। এ সব ঘাতঘোত কে সহজেই বুঝে ফেলে।
এরে তো ঠিকঠিক চিনলাম না?
কে ? আরে ও তো প্রশান্ত ! খোকা সাহা বসিয়েছে।
কোথাকার রত্ন ? আমাদের শখেরপুরের ?
না, না। শুনেছি শান্তিপুরের! … জেলফেল খেটেছে…শুনেছি পুলিশও খুন করেছে…কব্জিটা দেখলেন না? প্রশান্ত ওর ছদ্ম নাম!
না, না, ভালো ছেলে! …দেশের যা পরিস্থিতি সংসার নিয়া ভাবতে হবে তো !…তুমি ওরে দেখা করতে কইও, কেমন!
এর পরই যদুনাথ বুকের মধ্যে জমে থাকা পুরনো অসংগতি ও বেদনার কথা পরিমলের কাছে ফাঁকা করতে থাকে। বিশেষত, শখেরপুরের স্টেশন রোড-এর ব্যবসায়িক পরিস্থিতির ইতিহাস। আজ তো কোটি কোটি টাকার সাম্রাজ্য, ভুলু আইচ, খোকা সাহারা মধ্যমণি। যদুনাথ তিলে তিলে এর ভিত গড়েছে। সে নিজে মুর্খ, লেখাপড়া জানে না, কিন্তু পেটে ছলচাতুরির প্যাঁচ নাই। পাপ, অন্যায়, দুর্নীতি সে বহু করেছে– কেনো ভন্ডামির আড়াল ছিল না। সে হাফ-লেখাপড়া জানা ভুলু বা খোকার মতো ধূর্ত রং পাল্টানো গিরগিটি নয়। তাদের এখন কোটি কোটি টাকার ব্যবসা, বিভিন্ন শহরে ব্রাঞ্চ খুলছে। শুরুতে ব্যবসা করছিল? ভুলুর মাতব্বরি করতে পারত আজ ? যদুনাথের আজ কোটি টাকার সম্পত্তি – ওই স্টেশন রাস্তায় গান্ধী আশ্রমের কোনে বসে থাকত। পাড়ায় পাড়ায় টুল আর পিড়ি মাথায় নিয়ে ফেরি করেছে অতীতে। মা তারার আশীবার্দে আজ কোনো সম্পত্তি বৃদ্ধি করার নেশা নেই তার । তালে জমি কেনা-বেচার নেশা কেন? না, মনুষ্যজীবনের সংসারে আগমণ কেন? কর্ম ও ভক্তির জন্য। কর্ম করে যেতে হবে। কে আজ ফুটের মানুষগুলান ঐ-সব বড় বড় লিডারদের কাছে তো গেল না? কোনো দম্ভের কথা শুনাইনা, মা তারাই সব! হিংসা করিনা ওদের, মা ওদের সুমতি দিক!
চাপা, ফিসফাস কলঙ্ক রটে বটে– কে কার স্ত্রীকে নিয়ে দুদিন রিসর্টে কাটিয়েছে, কার মেয়ে বেরিয়ে গিয়ে বিয়ের দুমাস পর স্বীকৃতি লাভ করে বিরাট অতিথি আমন্ত্রণের ব্যবস্থা করেছে —মানুষের জিহ্বাকে তো ঠেকিয়ে রাখার উপায় নেই।
এসব ইতিহাস পরিমলও জানে। শখেরপুরের কলোনিপত্তনের আদি যুগে পরিমলের বাপ মন্ময় সরকার ছিলেন সুভাষপন্থী ফরোয়ার্ড ব্লকের।
এই স্টেশন রোডে পরিমলের নামকেওয়াস্তে একটি দোকান আছে। বেঁচে দিতে চেয়েছিল বহুকাল আগে। যদুনাথই ঠেঁকিয়ে রেখেছিল। সেই-সত্তরের ডামাডোলের বাজারে পরিমল নাকি আইন পাশ করেছে। ক্রিমিনাল উকিল হিসেবে হাইকোর্ট অঞ্চলে নাম না ছড়ালেও, স্থানীয় অপরাধজগতের অনেকেই পরিমলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। শখেরপুরের কোর্টে বার এ্যাসোসিয়েশনের মেম্বার। ‘মাতব্বর’ এখনও পরপর বিধায়ক হিসেবে নির্বাচন জিতে, কলকাতার বড় বড় অ্যাডভোকেট মহলে পরিচিত থাকলেও, তার পুরনো অপরাধ জীবনের আইনি পরামর্শদাতা ছিল পরিমল।
যদুনাথের সঙ্গে পরিমলের সুদূর একটি আনুগত্যের সম্পর্ক। দোকানটি যাহোক বেচে ওঠা হয়নি। প্রথম পর্যায়ের ভাঙচুরের সময়ে, যদুনাথ যখন নীলোৎপলা ফার্নিচারকে ব্যক্তিমালিকানার জমিতে সরিয়ে আনে, পরিমলের দোকানটিও সরিয়ে এনেছিল।আজ সেটি উৎসবে-অনুষ্ঠানে উপহার দেবার হরেক জিনিসের একটি দোকান। পরিমল-এর বসার সময় বা ইচ্ছা কই? ফর্সা মোটামতো এক মহিলা, কপালে চওড়া টিপ পরে, হাসিহাসি আপ্যায়নে বিকেলের দিকে বসে। কর্মচারিদের সামলায়। আর কচিৎ কখনও পরিমল তার মারুতি গাড়িটি নিয়ে হাজির হলে, মহিলা সঙ্গে বেরিয়ে যান।
যদুনাথ জানে, তাদেরই অবাসনের ফেজ-টু-এর হিমাংশু ভট্টাচার্যের স্ত্রী উনি। মহিলা খুবই সোশ্যাল। সকলে কাকলিদি নামে ডাকে। হিমাংশু ভট্টাচার্য একসময় রেলের কোনো সেকশন অফিসার ছিলেন, চাকরি অবস্থায় আকস্মাৎ স্নায়ুর দুরূহ ব্যাধিতে শয্যাগত– আজও গৃহবন্দি । এইটুকুর বেশি তথ্য নিয়ে আজ আর শখেরপুরের যদুনাথের আবাসন পরিমল -কাকলির সম্পর্ক নিয়ে উৎসুরিত হয় না।
গান্ধীআশ্রম আবাসনে রূপান্তরিত হলে, নানা অঞ্চল থেকে ভদ্র পরিবার বসতি গড়ে তুললেও, স্থানীয়দের একটা ভিন্নশক্তি থাকে। যদুনাথ ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি গুড় মজাতে দেয় না। চাপা, ফিসফাস কলঙ্ক রটে বটে– কে কার স্ত্রীকে নিয়ে দুদিন রিসর্টে কাটিয়েছে, কার মেয়ে বেরিয়ে গিয়ে বিয়ের দুমাস পর স্বীকৃতি লাভ করে বিরাট অতিথি আমন্ত্রণের ব্যবস্থা করেছে —মানুষের জিহ্বাকে তো ঠেকিয়ে রাখার উপায় নেই।
এখানে তিনপ্রকারের বাসিন্দা, মেলামেশারও তিন তিনটে শ্রেণী, সরকার আশ্রমটা কিনে, সাজানো, সুন্দর একতলা বানিয়ে ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দিয়েছে— বলা হত এম.আই.জি.ব্লক। অর্থাৎ মিডল ইনকাম গ্রুপ এর। যে-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অর্থনৈতিক অবস্থান মধ্যবর্তী। আজকের মাপকাঠিতে নয়। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে। মূল্য ছিল বত্রিশ হাজার। এই সংখ্যাটি আজকের তুলনায় হবে হবে না । সরকারি কেরানিকুল ভাবতেই পারত না। তাদের জন্য চারতলা ফ্ল্যাট — আটটি ফ্যামিলির জন্য।একটি বেড রুম, ছোট্ট একটি ড্রয়িং, রান্না ঘরও একটি বাথরুম। ভাড়া মাসিক আটচল্লিশ টাকা। প্রথম দফায় গড়ে উঠেছিল, বলা হয় ফেজ এক।পরে একটু বড় পরিবারের কথা ভেবে দু-দুটি বেডরুম, অপেক্ষাকৃত চওড়া ড্রয়িং, কিচেন এবং বাথরুম —ভাড়াও ডবল—বলা হত ফেজ দুই। আর ব্যতিক্রমী কিছু – যারা আশ্রমের বাকি জমিতে – কেউ বলে লাগোয়া জমিতে ফ্ল্যাট তুলেছে— যেমন যদুনাথরা—আবাসনিক সমাজের অন্তর্ভূক্তি হয়ে পড়েছিল। পরে অবশ্য, এম.আই.জি. হস্তান্তরিত হয়ে, চারপাঁচতলার বিলাসী ফ্ল্যাট পরিকল্পনায় পরিণত হয়েছিল, যা মূল্যের বিচারে তিরিশ লক্ষ থেকে শুরু হত। ডাঃ দাশগুপ্ত রবিশেখরকে তথ্য দিয়েছিলেন, সরকারি উদ্যোগে গান্ধীআশ্রম পাল্টে ফ্ল্যাটচরিত্রে রূপান্তর পশ্চিমবঙ্গে প্রথম— লবনহৃদ সবে তখন গঙ্গার পলিবাহিত বালিমাটিতে ভেড়ির মালাগুলো ধূ ধূ ডাঙায় পরিণত। উল্টোডাঙা বিধাননগর হয়নি। ছোটখাট শেডের স্টিম ইঞ্জিনের স্টেশন। চারপাশ শুনশান। ছোটছোট জলাধার। ধোপার পাটপাতা আর মাথার ওপর থেকে কাপড় আছড়াবার হাঃ হাঃ মিলিত শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। খাস কোলকাতার অসংখ্য ডাইং এন্ড ক্লিনিং এর শত শত পরিস্কারখানা।
ক্রিমিনাল জগৎকে নিয়ে পরিমলের রন্ধনশাল। সব ইতিহাস জানে সে এবং যদুনাথও। শহরের পুব এলাকায় জেলখানাটি —বিশাল উঁচু পাঁচিল ঘরের বাইরের ছড়ানো ছিটন কিছু বসত। মাঝেমধ্যে রহস্যে ঘেরা দু-একটি বাগান বাড়ি। মালিক থাকে না।আবার গঙ্গার ধারে, পুরনো অঞ্চলে কোর্ট। শ্যামলা গায়ে উকিল, হলফনামা লেখানোর পার্টি পকড়াতে মুহুরিয়া ভনভন উড়ছে। পুরনো টাইপরাইটারগুলোর ধাতবশব্দ । চা- ঘুঘনির টেবিল-চেয়ার, ঝুপড়ি। গারদের আশপাশ থেকে মলমুত্রের গন্ধ । ভদ্দরগুন্ডাদের মুখোশ এঁটে আনাগোনা। কুকুর, ছাগল আর বেওয়ারিশ ষাঁড়। ইদানীং আটো হয়েছে। আর শখেরপুর শহরটার শ্মশান যেখানে বস্তিধরণের ঘরবাড়ি, ভাং-গাঁজা-চুল্লু আর খেয়াঘাট ও পুরনো যুগের শ্রীহারানো কিছু বাগান বাড়ি।
সব দলের ছোটখাট নেতা, কবি-লিখিয়ে, একটু আধটু নাটকচর্চা করে , ডাক্তার , বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের ছাত্রছাত্রী, গেরস্ত বৌ-মেয়ে, বিশেষ তিথি ও নক্ষত্রের যোগ থাকলেও তো কথা নেই, স্টেশন রোডের ব্যবসা কেন্দ্রকে ঘিরে নিজেদের ব্যস্ত রাখতে ভালোবাসে। এখানে প্রতিমুহূর্তে খবর তৈরি হয়। যেমন কয়েক দশক আগের ঘটনা — দোকানদারদের সমিতিগুলো অতিষ্ঠ। গণশা মন্তানের তোলাবাজি, লুঠপাট, চমকানো খবর হয়ে উঠল উঠতি মস্তান তখন গণশা। পুরনোরা অবধি সামলে চলছে। যে-দোকানে দলবল ঢোকে — দামি প্যান্টের পিস পছন্দ হল, নিয়ে বেরিয়ে যায়। কে মূল্য চাইবে? খাওয়ার দোকানে ঢুকে ইচ্ছেমতো খায়— দোকানদার ভয়ে পেমেন্ট চাইতে পারে না। তখনও ভুলু আইচ, খোকা সাহারা — তাদের যার যার প্রতিষ্ঠানকে ইদানিংকার পর্যায়ে নিতে পারে নি, আঞ্চলিক দোকান হিসেবে সুনাম কুড়িয়ে চলেছে। যদুনাথ তখন সমিতির অন্যতম মাথা। ফর্সা দামি কাপড়ের হাফ পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা ও সোনালি ব্যান্ডের একটা ঘড়ি— এটাই তার পেটেন্ট ড্রেস। নিয়মিত একটি চন্দনের ফোটা থাকে কপালে । ফিটফাট যদুনাথকে দেখলেই মনে হয়, সদ্য যেন স্নান করে উঠেছে। সত্যিই দু-তিনবার সে স্নান সারে— আজও।
অঞ্চলটা যেন জ্যামে বোতলের গলা হয়ে উঠত। সেই প্রথম ফুটের দোকানগুলো ভাঙ্গা পড়েছিল। যাদের দোকান ভাঙা পড়ল, সকলকে লটারির মাধ্যমে বসানো হয়েছিল ফ্লাইওভারটার তলায়। তখন শখেরপুরে লাল জমানা।
বুঝলা কিনা পরিমল, অনেক রাতে ভুলু গাড়ি পাঠাইয়া নিয়া গেল…গিয়া দেখি, ওর তিনতলার ঘরে খোকা, আমাদের বেঙ্গল শাড়ির হরিদাস, হরিয়ানা হ্যান্ডলুমের ওমপ্রকাশ-ওই বছরেই দোকান পেয়েছে। আমাগো ‘মাতব্বর’
পরিমল বলে, তখনও মাতব্বর হয়নি।
না, না ! সবে যুব কংগ্রেসে ঢুকেছে…কিন্তু কাটা দিয়া কাটা না তুললে হয় না… আমাকে দেইখা গদগদ হয়ে বলে দাদা ! …সম্পর্কে তো দাদা হই, বুঝলানা ? …তো, ভালোমন্দ খাওয়া হইল… একটুআধটু চলত তখন … ভুলুর ড্রয়ারে দামি বিলাতি …মাতব্বররে বল্লাম লজ্জা নাই, খা যত পারিস, তর সঙ্গে কথা কব পড়ে । …তারপর, ওদের মুখে সব শুইনা স্রেফ বল্লাম, কী চাও? পষ্ট বলবা ! …কাঁটা সরাইতে চাও? ওরা দেখলাম কাঁইকুঁই না কইরা, সারা দিল। …খানিক চিন্তা করলাম…তপেশকে বল্লাম, সাইডিংয়ে তোর কাজ চলে ? গোরুচোরের মতো বল্ল, কেন দাদা? …গণশা আসে ? না ! সে ওপথে চলে না। বুঝলাম, গণশা শেয়ানা। দাগা কলোনির উঠতি মাল…নইলে রেলপুলিশ দিয়া কাজ সারতাম…যাক, ভেবে বল্লাম, কত খরচ করবা ?…সুপারি দিতে হবে। …আমিতো তখন জমির ব্যবসায় ওএ-সব শব্দ শুইনা ফেলছি। …ভুলুকে বল্লাম, যদি চাও, পেশাদার খুনি দিয়া করাবা …টাকা দিতে হবে। দেখলাম, দু-একজন একটু কেমন কেমন করে…বল্লাম বুকের পাটা ঠিক কর…হাজার দশেক চাঁদা তোল…দেখি তারপর। …বুঝলা পরিমল, সাতহাজার আটশ উঠল …তাও কথা…তখনতো স্টেশনে রাস্তার ব্যবসার স্বার্থে কোনো দিকে তাকাই না…আমার পকেট থিকা অনেক গেল…তপেশ তো শিয়ালের মতো ধূর্ত…অত গিলেও নেশা হয় না…আমার সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ রইল… আমিও ওই জগতের খবর নিলাম ওর কাছ থেকে…ওর স্বার্থ ছিল…গণেশ চ্যালেঞ্জ হইয়া উঠেছে।
পরিমল বলে, তখন আমি ইলেভেনের ছাত্র …দুপুরে হোটেলে খেতে ঢুকেছে গণেশ…
যদুনাথ হাতের পাঁচ আঙুল তুলে বলে, পাঁচ পাঁচ দিন তারা সময়টা ফলো করেছিল…তবে, ওর ডেড বডি নিয়ে পরদিন যে মিছিল দেখছিলাম …একটু ভয় লাগছিল আমারও…শখেরপুরের আগামী দিনে এরা উঠে আসবে? …ছাড়ো এইসব কথা এখন। …বুঝলা পরিমল, আজ টের পাই, জীবনে শেষমেশ এগুলার উত্তেজক আগুন ছাড়া এক পয়সা দাম নাই। …সুখে বাচতে গেলে তারা মা ছাড়া উপায় নাই ! ভক্তিতেই তুমি একমাত্র শান্তি পাবা। …পাপের মূল্য একজীবনে তোমাকে চুকাইতে হবে!
হঠাৎ কেন জানি পরিমলের বুকে মোচড় দিয়ে উঠল। কেন ? এ-সব তো পঞ্চাশ-ষাট বছরের শখেরপুরের ইতিহাস। পরিমলের বয়স বেড়েছে। সে আজ স্টেশন রাস্তার একটু ভেতরে মহামিলন হিন্দু মন্দিরের একজন কর্মকর্তা। ব্যবসায়ীদেরই কারও কারও উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল— আজ এখনকার আধ্যাত্মিক জীবনের অনেকেরই কেন্দ্র স্থল। সকাল-বিকেল অনেকেই নিবেদন করবে। আসে। পরিমলের উপহারের দোকানটি আছে; ওটি এখন মোবাইলের দোকান। চার পাঁচটি ঝকঝকে ছেলে-মেয়ে কাজ করে। কাকলিদি নেই। তাঁর ওই চটুল শরীরে রক্তের এত উচ্চচাপ লুকিয়েছিল— পরিমল সংসারে আইনের কোনো জরুরি সম্মেলনের কথা জানিয়ে, দুদিন রিসর্টে কাটানোর সময়— টেরই পেতনা। দুম করে, জীবন একটা ফাটকাবাজির মতো মহিলা চলে গেল ।
শখের পুর মহকুমা শহর হতেই, লেবেল ক্রসিং সরিয়ে উড়াল পুল হয়। নইলে, অঞ্চলটা যেন জ্যামে বোতলের গলা হযে উঠত। সেই প্রথম ফুটের দোকানগুলো ভাঙ্গা পড়েছিল। তখন পৌরপ্রধান মনোরঞ্জন মণ্ডলের পূর্বতন চিত্তরঞ্জন সেন। যাদের দোকান ভাঙা পড়ল, সকলকে লটারির মাধ্যমে বসানো হয়েছিল ফ্লাইওভারটার তলায়। তখন শখেরপুরে লাল জমানা। চিত্তরঞ্জন সেন পার্টির সদস্য হলেও, পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। জানতেন, এ-ভাবে উড়ালপুলের তলায় বসিয়ে, পুলের আয়ু সংক্ষিপ্ত করার মানে নেই। দলের মধ্যে বিরোধিতা করেছিলেন। চাপ সইতে পারেননি। প্রকৃতির বিরুদ্ধতায় ধীরে ধীরে তাঁর শরীরে ক্ষয় ধরতে থাকল। নিঃশব্দ ঘাতকের হাতে বলি হলেন। তার চেয়ারেই বসানো হয়েছিল মনোরঞ্জন মণ্ডলকে। তখন ভুলু আইচ, খোকা সাহারা দলের সমর্থক। যদুনাথ জমি কেনাবেচায় মশগুল। স্টেশন ব্যবসায়ীদের সমস্যার ধরি মাছ না ছুঁই পানি। তবে, এ-দলের প্রকাশ্য বিরোধিতা করে গেছে। তা শুধু নির্বাচনগুলোয় ভোট দানে।নইলে লালা পার্টির জনপ্রতিনিধিও আবাসনে থাকতেন। মুখোমুখি হলেই যদুনাথ নমস্কারের ভঙ্গিতে একটা আঙুল কপালে ঠেকিয়ে হেসে বলত, আমাদের দেখবেন স্যার। টিকে থাকতে পারি যেন !
গোপালশঙ্করও বুদ্ধিমান। হেসে বলতেন, আমরা কে যদুনাথদা? …মা তারাই সব !
যদুনাথ বলতেন, আপনারা বিশ্বাস করেন?
হাসতে হাসতেই গোপালশঙ্কর, জনগণ বিশ্বাস রাখলেই খুশি। আমাদের কাছে জনগণই শেষ কথা, যদু দা!
ক্রমশ…
চরিত্র এবং ঘটনা কাল্পনিক । বাস্তবের সাথে এর কোন মিল নেই, কেউ যদি মিল খুঁজে পান তাহলে তা অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয় ।
❤ Support Us