Advertisement
  • খাস-কলম
  • আগস্ট ৭, ২০১৯

একা না দোসর

শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী
একা না দোসর

সেদিন কফিশপে একাএকা কাপে চুমুক দিতে দিতে কান পেতে ইভসড্রপ করলাম নির্লজ্জের মতো । আমার পাশের সোফাতে বসে দুই মাঝবয়সী ভদ্রলোক তর্ক করছেন। তর্কের বিষয়,পরিবারে এক সন্তান থাকা উচিত না দুটি?প্রথম জনের যুক্তি, একজন সন্তানের জীবনে দুর্ঘটনা ঘটলে আরেকজন তো রইল। স্টেপনি টায়ারের মতো। আরেকজনের যুক্তি, একজন সন্তানের বিকল্প কোনও বাপমায়ের কাছে কি আরেক সন্তান হতে পারে?

 জীবনে বিকল্পের প্রয়োজন অবশ্যই আছে। কেন এবং কখন,তা নিয়ে নাহয় পরের কিস্তিতে লিখবো। আজ বরং খতিয়ে দেখি,সত্যিই কি এক সন্তানের বাবা মায়ের মনস্তাত্ত্বিক গঠন দুই বা তার বেশি সংখ্যক সন্তানের বাবা মায়ের থেকে আলাদা হয়? ২০১৭ সালে চীনে বাবা মায়েদের নিয়ে একটি সমীক্ষা এটাই জানাচ্ছে যে বাবা মা ও দুটি সন্তান সবচেয়ে ভারসাম্যযুক্ত পরিবার। তার আগে সরকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে পরিবার পিছু একটিই সন্তান রাখা বাধ্যতামূলক করেছিল। ছোটবেলায় ছেলেমেয়েদের লালনপালনে যাতে পক্ষপাত না থাকে,অনুজের প্রতি অগ্রজের  স্নেহ ও দায়িত্ব  আর অগ্রজের প্রতি অনুজের শ্রদ্ধা, জেনারেশন গ্যাপকে ব্রিজ করবার সম্ভাবনা, বাবামায়ের স্নেহবন্টনের সমতা,এইসব ছিল এই সমীক্ষার পক্ষে যুক্তি । একটা সময়ের পর ছেলেমেয়েদের একাকিত্ব ঘিরে ধরে। আসতে থাকে অবসাদ। বয়োসন্ধির সময় এই সম্ভাবনা বেশি থাকে। সেই সময় দ্বিতীয় সন্তানের উপস্থিতি সেই একাকিত্ব অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে বলে যুক্তি দিয়েছেন কেউকেউ।

২০১০ সালের একটি সমীক্ষা অবশ্য ঠিক এর বিপরীত তথ্য দিচ্ছে । তাঁরা বলছেন পরিবারে একটি সন্তানই কাম্য। তাতে বাবা মায়ের স্নেহের বন্টন হবার সম্ভাবনা কমে আসে। পরবর্তীতে সন্তানদের মধ্যে রেশারেশির সম্ভাবনাও থাকে না। শাসন আর সোহাগের মিশ্রণ(অথরিটেটিভ) অভিভাবককে করে তোলে শিশুব্যক্তিত্বের শ্রেষ্ঠ রূপকার।

২০১৮ সালের একটি সার্ভে জানাচ্ছে শতকরা ২৪ শতাংশ মহিলা দ্বিতীয় সন্তান চান না, কারণ তাদের মনে হয় দুটি সন্তান থাকলে তাঁরা তাঁদের স্নেহের সমবন্টন করে উঠতে পারবেন না। তবে এই প্রসঙ্গে একটা কথা ভুললে চলবে না,এই সমস্যা ভারতীয় সমাজে কিন্তু আগে ছিল না। তার অন্যতম কারণ হলো যৌথপরিবারের গঠন। রবীন্দ্রনাথের “ছেলেবেলা” ভাবুন। সমবয়স্ক ছেলেমেয়েরা কেমন একসঙ্গে বড় হয়ে উঠছে। অথচ বাবামায়ের স্নেহ ছাড়াও সেখানে বাড়তি পাওনা কাকা জ্যাঠা জ্যেঠিমা মাইমা দাদু ঠাকুমা দিদিমার উপস্থিতি। এখনও কোনও কোনও যৌথপরিবার টিকে আছে আমাদের দেশে। তাদের পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে সেখানে শৈশব এক অদ্ভুত সহনশীলতা শিখিয়েছে। শিখিয়েছে সকলে মিলে কোনও জিনিস ভাগ করে খাবার প্রবণতাও।

যৌথ ভেঙে আণবিক,আর আণবিক ভেঙে পারমাণবিক হয়ে যাওয়ার পরই বিচ্ছিন্ন শৈশব ও কৈশোর তার শূন্যতা পূরণ করতে বেছে নিয়েছে মোবাইল গেম, কার্টুন আর হরর সিনেমা আর একাকিত্বকে। এর যোগ্য ওষুধ হল ছেলেমেয়েদের মিশতে দেওয়া, তাদের স্বাবলম্বী হতে শেখানো,পরিবারের মধ্যে বাঁধন আরো অটুট করা। কফিশপের তর্কের পরিণতি সেদিন কী হয়েছিল আমার জানা নেই,তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় এই সমস্যার সমাধান লুকিয়ে আছে এখানেই।


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!