- খাস-কলম
- জুলাই ১৯, ২০২১
এভাবেই মাথা তুলে দাঁড়াতে হয়

ইংল্যান্ডের সাদাম্পটন এখনও অনেক মানুষকে বহু পুরনো একটা ক্ষতচিহ্নের কথা মনে করিয়ে দেয়! ওই সাদাম্পটনের বন্দর থেকেই টাইটানিক জাহাজ ১৯১২ সালের ১০ এপ্রিল প্রথমবারের জন্য যাত্রা শুরু করেছিল। তখন কে জানত যে টাইটানিকের প্রথম যাত্রাই চূড়ান্ত অভিশপ্ত হয়ে উঠবে! প্রথম যাত্রাতেই টাইটানিকের সলিল সমাধি ঘটবে! হ্যাঁ, ১৯১২ সালের ১৫ এপ্রিল টাইটানিক হিমশৈলে ধাক্কা খেয়ে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবে যায়। প্রায় ১৫০০জন যাত্রী মারা যান। এবং ওই সাদাম্পটনেই মুম্বইয়ের থেকেও কম জনসংখ্যা-বিশিষ্ট নিউজিল্যান্ডের কাছে হেরে যাওয়ায় ভারতের প্রথম বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার স্বপ্নেরও’সলিল সমাধি’ ঘটে গিয়েছে।
তবু সাদাম্পটনেই ক্রিকেটের এক নতুন রূপকথার জন্ম হয়েছে। ভদ্র কিউইরা ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেটের কঠিনতম টুর্নামেন্ট প্রথম বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের খেতাব এই অভিশপ্ত বন্দর-শহরের ক্রিকেট স্টেডিয়াম ‘দ্য রোজ বোল’-এ জিতেছে। এই কথা তো বারবার ওঠে যে বর্তমান সময়ে ক্রিকেট খেলা আর “জেন্টেলম্যান’স গেম” নেই। কারণ ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে খেলোয়াড়রা প্রচুর গালাগালবা স্লেজিংয়ের বন্যা বইয়ে দেন। লড়াইটা আর ব্যাট-বলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনা, ‘ভার্বাল অ্যাবিউজ’ই দিব্যি মান্যতা পেয়ে যায়। এবং এখানেই নিউজিল্যান্ডের ‘জেন্টলম্যান’ খেলোয়াড়রা বাজিমাত করলেন। ওঁরা খেলার আগে এবং খেলা চলাকালীন ভদ্রতা বজায় রেখে বিপক্ষ দলের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন। সবথেকে বড় কথা হল, ওঁরা খেলার স্পিরিটটা অক্ষুণ্ন রেখেছেন। এরপরেও চ্যাম্পিয়ন হয়ে কিউইরা প্রমাণ করে দিয়েছেন যে”নাইস গাইজ অলওয়েজ ফিনিশ লাস্ট” কথাটা ভুল।
প্রথম বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ তো শেষ হয়ে গিয়েছে। তাহলে টেস্ট ক্রিকেট ভালভাবে বেঁচে থাকবে, এই ভরসা কি আমরা পেলাম? এটা প্রমাণিত যে ক্রিকেটের জন্মস্থান ইংল্যান্ডে টেস্টের মর্যাদা ছিল, আছে এবং থাকবে। কিন্তু অন্যান্য ক্রিকেট খেলিয়ে দেশগুলির ক্ষেত্রে এই কথাটা এত সহজে বলা যায় না। পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ কিংবা জিম্বাবোয়ের মতো দেশে টেস্ট কতটুকুই বা গুরুত্ব পায়? এখন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের যুগ।টি-টোয়েন্টিকে কেন্দ্র করে বিজ্ঞাপনদাতারা তাঁদের পকেটকে উপুড় করে দিচ্ছেন। ক্রিকেট-বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে টি-টোয়েন্টি লিগগুলোতে খেলার জন্য বহু ক্রিকেটারই ছটফট করেন। কারণ ফ্র্যাঞ্চাইজি-ভিত্তিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলে চটজলদি প্রচুর টাকা রোজগার করা যায়।আইপিএল খেলেই তো বেশ কিছু ক্রিকেটার ইতিমধ্যেই কোটিপতি হয়ে গিয়েছেন। এইসব ক্রিকেটারদের অনেকেই টেস্ট ম্যাচ খেলেন না বা খেলার সুযোগ পান না। এঁরা যেহেতু আইপিএল কিংবা অন্যান্য টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট খেলেই সচ্ছল কেরিয়ার তৈরি করতে পারছেন তাই টেস্ট খেলারও এঁদের তেমন কোন উদ্যোগ নেই।এখানেই ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা আইসিসি এবং বিভিন্ন দেশের ক্রিকেট বোর্ডকে একসঙ্গে উদ্যোগ নিতে হবে। টেস্ট বারবার প্রমাণ করে দিয়েছে যে তার মধ্যে গুণমান এবং টানটান উত্তেজনার যাবতীয় সুস্বাদু মশলা মজুত রয়েছে, যা ক্রিকেটপ্রেমীদের রসনা-তৃপ্তির পক্ষে একেবারে আদর্শ। তাই টেস্টকে যদি আইসিসি এবং বিভিন্ন ক্রিকেট বোর্ডের কর্তারা বিপণনযোগ্য করে তুলতে পারেন তাহলে বিজ্ঞাপনদাতা বা স্পনসররা টাকা ঢালতে নিশ্চয়ই পিছপা হবেন না। সেক্ষেত্রে খেলোয়াড়রাও টেস্ট খেলতে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই দর্শকদের আগ্রহও উপচে পড়বে। তখন টেস্ট ম্যাচও দিব্যি বেঁচে থাকতে পারবে।ক্রিকেট-অর্থনীতির ‘উর্বর জমি’তে টি-টোয়েন্টির ‘চাষ’ খুব স্বাভাবিক, এর সঙ্গে টেস্টের কোন বিরোধ নেই। এছাড়া অবিলম্বে বর্ণবিদ্বেষের বিষাক্ত কাঁটা যেভাবেই হোক উপড়ে ফেলতে হবে।বর্তমান সময়ের অত্যন্ত প্রতিভাধর কৃষ্ণাঙ্গ ইংরেজ ক্রিকেটার জোফ্রা আর্চারকেও তো বর্ণবাদের’ গুলিতে ঝাঁঝরা’ করে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে। মাইকেল হোল্ডিং, নাসের হুসেনের মতো প্রাক্তন দিকপাল ক্রিকেটার তথা বিশেষজ্ঞরা বর্ণবৈষম্যের ওপর অনেক কথা বলেছেন।এখন তো উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার সময়।
যে ব্রিটিশ ভূমি কোহালির টিম ইন্ডিয়াকে এবার খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে, সেই প্রসারিত ময়দানের অন্য এক অংশে (ব্রিস্টল) ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দল নিজেদের জন্য আবার নতুন করে এক গৌরব-গাথার জন্ম দিয়েছে।ব্রিস্টলে ইংরেজ মেয়েরা ভারতের বিরুদ্ধে একমাত্র টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৩৯৬ রান তুলে ফেলেন। বিরাট কোহালি-রবিচন্দ্রন অশ্বিন-রোহিত শর্মারা ঘনঘন টেস্ট ম্যাচ খেলার সুযোগ পেলেও মিতালি রাজ-হরমনপ্রীত কৌর-ঝুলন গোস্বামীরা সাত বছর পরে আবার টেস্ট খেলার সুযোগ পেলেন! দীর্ঘদিন বাদে খেললে যা হয়, ভারতীয় মেয়েরা প্রথম ইনিংসে ভাল রান তুলতে না পেরে ফলো-অন করতে বাধ্য হলেন।ভারতীয় মেয়েদের টেস্ট খেলায় ‘জং’ ধরে গিয়েছে – ইংরেজদের মধ্যে এই ভাবনা তাঁদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছিল। ওদিকে ম্যাচের শেষ দিনে (১৯ জুন, ২০২১) যখন দীপ্তি শর্মা, স্নেহ রানা কিংবা তানিয়া ভাটিয়া দলের হার বাঁচাবার জন্য বুক চিতিয়ে ব্যাট হাতে লড়াই করছেন তখন অনেক দর্শকই বিরাট কোহালির ভারতের সঙ্গে কেন উইলিয়ামসনের নিউজিল্যান্ডের দ্বৈরথে চোখ রেখেছিলেন। বস্তুত অনেকেই ভাবেন যে মেয়েরা জোরে শট খেলতে পারে না এবং আস্তে বল করে। অবশ্য কে কী ভাবলেন, এই বিষয়টা নিয়ে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটাররা কোনদিনই গুরুত্ব দেননি। তাই দুর্দান্ত লড়াই করে দীপ্তি-স্নেহ-তানিয়ারা সসম্মানে দলকে বিপন্মুক্ত করলেন। অভিষেক টেস্টের দুই ইনিংসেই অনবদ্য ব্যাট করে শেফালি বর্মা ম্যাচের সেরা নির্বাচিত হয়ে ‘ভারতপথিক’ রাজা রামমোহন রায়ের প্রয়াণ-ভূমিকে (ব্রিস্টল) ঋদ্ধ করেছেন। ভারতীয় মেয়েদের এই লড়াইকে অনেক বিশেষজ্ঞই জয়ের সমতুল্য মনে করছেন। মনে রাখতে হবে যে লাল বলে টেস্ট খেলা হয়, অনেক ভারতীয় মহিলাই সেই লাল বলে পর্যাপ্ত প্র্যাকটিস পান না! এছাড়া ওঁদের নানান সমস্যার মধ্য দিয়েই খেলাটাকে চালাতে হয়।
তবে কেন উইলিয়ামসনের কিউইদের সঙ্গে মিতালি রাজের ভারতীয় মহিলা দলের একটা জায়গায় দারুণ মিল রয়েছে।বিশ্ব-ক্রিকেটের আন্ডারডগ এবং ভদ্রবাহিনী নিউজিল্যান্ড এবং অবশ্যই ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দল শেষ পর্যন্ত সগৌরবেই মাথা তুলে খেলার মাঠে দাঁড়িয়েছে।
❤ Support Us