- ধা | রা | বা | হি | ক স্মৃ | তি | প | ট
- নভেম্বর ১৩, ২০২৪
আমার বাবা । পর্ব ২
বাবা, তোমার ছুটন্ত পা দুখানি, দুটো হরিণ হয়ে আমায় ছোটাক মানুষের ভুবনে...

• পর্ব ২ •
• ৫ •
ভাড়াবাড়ির চারতলার ছাদে বউবরণ চলছে৷ দুপুরের কড়া রোদ৷ ছাদ এত গরম যে একবার এ পা, আরেকবার ও পা— এই করে যাচ্ছি৷ একঠেঙি বক হয়ে বুঝতেই পারছিলাম না বেগুনি বেনারসি পরা মোটা বউ কীভাবে দুপা ছাদে রেখেছে ! শাশুড়ি নেই বলে আমার মা দুধেআলতা পাত্র বউয়ের পায়ের কাছে রাখলেন৷ বউ গোলাপি দুধে পা ফেলল৷
— মা৷ ওমা ! হায় আমার সব মলটোভা বউকাকিমার পা খেয়ে নিল ! এ তোমার কাজ মা৷ তুমি চুরি করেছ আমার মলটোভা৷
নতুন বউ দুধ মাখা পা আর বাড়াতে পারেনি গো৷ হাঁ হয়ে শুনছে৷ মেয়ে মাকে চোর বলছে৷ ফিসফিস করে বলল— ও খুকু মাকে চোর বলে না৷ শুনে খুকু আরো হাঁ৷
চুরি তো একটা কাজ৷ ও কি অন্যায় যে মাকে চোর বলতে পারব না ! আমিও খাবার চুরি করি৷ তো আমার মাও চুরি করে৷ চোর মেয়ের মা আবার সাধু হয় কবে গা !
এমনই ভুলে ভরা শব্দ, শব্দের ভুল, ভুল জায়গায় ভুল শব্দের ব্যবহার আমার ছেলেবেলার ভাষার আকাশকে কী ভীষণ সত্য করে তুলেছিল ! সেদিন চোর মায়ের হাত ধরে চোর মেয়ে একতলায় নামল৷ পিছে বেগুনি বউ৷ রান্নাঘরে ঢুকল তিনজন৷ আমি কৌটোয় হাত ঢুকিয়ে একখাবলা মলটোভা দুধে গুলে ফেললাম নিজেই৷ চুমুক মারতে মারতে দেখলাম — পাশের বাড়ির নতুন বউ আমার ঠাকমার রান্নাঘরেই ভরা শস্যের ঝুড়ি, ওথলানো দুধ দেখছে তার যথাসম্ভব পূর্ণ চোখে৷ আমার চোখ কিন্তু তার পায়ে বারবার ফিরছিল৷ আলতা দুধে ভেজানো পা আর মলটোভা গোলা দুধ এক রঙের হয় কী ভাবে -এ প্রশ্ন আরো কবছর ভাবিয়ে গিয়েছিল আমায়৷
বাচ্চা ভাষার প্রোসোডি (prosody) বোঝে না৷প্র্যাগমাটিকস(pragmatics) বোঝে না৷ সে শুধু প্রকাশ করে৷তার ভেতর থেকে উৎসারিত মনের ভাবটুকু আমরা দেখি তার চোখে, কখনো চোয়াল কঠিন করে সে তার দাবিগুলো জানায় ! ভাষা ও ভাবের দূরত্ব যেমন ভীষণ কম তেমনি আরো কম মনোভাষা ও মাতৃভাষার পার্থক্য৷ শিশুর মনেই তো একজন মা বসে থাকেন অহরহ৷ বাইরের মা শিশুর ভাষাকে বাক্যে বাঁধে আর অন্তরের মা টা শিশুকে টুক করে আকাশে উড়িয়ে দেয়৷ কখনো সন্তানকে পাখি বানিয়ে গাছের ডালে বসিয়ে দেয়৷
বেলগাছিয়ার মাঠে সেদিন খুব কুয়াশা৷ তার মধ্যে খোলা মঞ্চে জুনিয়র পিসি সরকার জাদু দেখাচ্ছেন৷অভিনয় ও বাক্যজাদুতে সব্বাই আচ্ছন্ন৷ হঠাৎ আমার দিকে আঙুল তুলে বললেন —
— এসো মা৷ এসো আমার কাছে৷ ভয় নেই৷ তোমার পেট কাটব৷
ছোটবেলা থেকে গভীর নিষ্ঠায় খিস্তির প্রশিক্ষণ নিয়েছি৷ জাদুকরের কথা শুনে মনে মনে বললাম–
যাহ শালা ! মা ডেকে পেট কাটবে ! তবে যে নেপালি পাড়ার ছেলেগুলো বলে বাচ্চা পেটে এলে ডাক্তার একটা ঘরে লুকিয়ে লুকিয়ে মেয়েটার পেট কাটে !
ততক্ষণে আমার শয়তান দয়াহীন মা আমাকে স্টেজে তুলে দিয়েছে৷ কাঁদো কাঁদো মুখে সুন্দর চেহারার জাদুকরটাকে জড়িয়ে ধরে বললাম – আমার বাচ্চা হবে নাকি গো ? তবে কেন পেট কাটবে আমার ! পেট খুব নরম আমার৷ দেখো হাত দিয়ে …৷ ফ্রক তুলে ফেলেছি প্রায়৷
সামনের রোয়ে বসে মহিলারা হাসছেন৷ সবাইকে একসঙ্গে কাকিমা বানিয়ে ফেললাম৷
— দেখো না কাকিমারা৷ ওটা আমার সৎ মা৷ বাবা কোথ থেকে বিয়ে করে এনেছে৷ একটা দুধের শিশু আমি ! আমাকে পেট কাটতে পাঠাল৷ আমি কোনো ছেলেকে চুমুও খাইনি যে বাচ্চা ঢুকে যাবে পেটে !
রাত হয়ে যাচ্ছে দেখে বাবা নিতে এসেছেন মা মেয়েকে৷ কুয়াশা কেটে গিয়ে আকাশে আধফালি চাঁদ ঘোরাফেরা করছে৷ আমার ফের অশান্তি৷ ফের প্রশ্ন৷ আরে বাবা ! প্রশ্ন না থাকলে ভাষা আসে কী করে ! উত্তরই তো নতুন শব্দ তৈরি করবে !
বলাবাহুল্য ছেলেকে চুমু খেলেই ভগবান বাচ্চা দিয়ে পেট ফুলিয়ে দেবেন – এই জ্ঞানও নেপালি খোকাকূলের আমাকে দিয়েছিল৷ আমিও প্রাণ দিয়ে তাদের সে সব অশ্লীল শব্দভরা জ্ঞান চেটে চেটে খেয়েছিলাম৷ আর ‘দুধের শিশু’, ‘সৎমা’ এ সব শব্দ রান্নাঘরের বাসিন্দাদের থেকে পেয়েছিলাম৷ খিস্তি যেমন করে গুরুমন্ত্রের মতো গ্রহণ করতাম, গেরস্থালির শব্দ পেতে তেমন উৎসুক ছিলাম না৷ তবু সংসারের শব্দ, আওয়াজ জিভে বসে যায়৷খিস্তি আর মিঠে বাংলার সুষম সমাহার আমাকে বারবার নিজেকে জীবন্ত ভাবতে শিখিয়েছে৷ কীভাবে, বলতে পারি না গো৷
হ্যাঁ, তো যে কথা হচ্চিল৷ জাদুকরের বাক্সে শুয়ে নিজের পেট কাটার শব্দ শুনছি৷ পেট কাটছে না৷ পেটে একফোঁটা রক্ত নেই।খোলে বাচ্চা নেই৷ অথচ ঘড়ঘড় ঘড়ঘড়৷ মাইরি ! করাত চালাচ্ছে নাকি ! ছুরি দিলে কাজটা ফট করে হয়ে যেত৷ এত যে জড়িয়ে মড়িয়ে ধরলাম ! জাদুকর তাও নিষ্ঠুর৷ খেলা শেষ৷হাততালি৷ অক্ষত পেট নিয়ে বেরিয়ে দেখলাম পিসবোর্ডের প্যাকিং দু ফাঁক৷আই বাপ৷ তার ভেতর আবার কাঠের বাক্স৷ তাহলে এটাই আমার কবর ছিল৷
জাদুকর জড়িয়ে ধরে বললেন — মা তোমার বাচ্চা হতে অনেক দেরি৷ কিন্তু ঠিক সময় যখন হবে তখন জন্ম দিতে হবে সব মানুষের বাচ্চা৷আমার স্টেজের এইসব কুকুর, সিংহ জন্ম দিলে খুব বকব৷
জাদুকর সে রাতে জাদুমা হলেন৷ শীতের বাতাসকে সঙ্গী করে আমার পাঁচ ছ বছরের বোঁটাহীন বুকে কি মাতৃকথা জন্ম নিল ?
রাত হয়ে যাচ্ছে দেখে বাবা নিতে এসেছেন মা মেয়েকে৷ কুয়াশা কেটে গিয়ে আকাশে আধফালি চাঁদ ঘোরাফেরা করছে৷ আমার ফের অশান্তি৷ ফের প্রশ্ন৷ আরে বাবা ! প্রশ্ন না থাকলে ভাষা আসে কী করে ! উত্তরই তো নতুন শব্দ তৈরি করবে !
বাবাকে জ্বালানো শুরু ৷
— বাবা পেট কাটা চাঁদ থেকে কি এখন বাচ্চা চাঁদ বেরোবে ?
— এই আমি কলেজ থেকে ফিরে কিছু খাইনি৷ এখন প্রশ্ন করলেই মার খাবি৷
— না না প্রশ্ন করব কেন বাবা ! ওই একটু জিজ্ঞেস করলাম৷ আচ্ছা ওই ইয়ে …চাঁদ যে আবার জোড়া লেগে গোটা হয়— ওটা কি এই পি সি সরকারই করে গো বাবা ?
— কাল তোর উইকলি না ? রাতদুপুর অব্দি মাঠে বসে আছিস ?
— কী করি বাবা ! যেমন মা তেমনি মেয়ে ! তবে আমার কী মনে হয় জান বাবা৷ চাঁদ শালা নিজেই জাদুকর৷ ও শালা নিজেই নিজের আলো বাড়ায়৷
— গালু …এবার দেব একটা৷
— আচ্ছা বাবা এটা লাস্ট গো৷ চাঁদ গোটা হলে
কী হয় ?
— কাকজোছনা৷
— সে কী বাবা ?
— সে জোছনায় এত আলো কাক ভাবে ভোর হয়েছে৷
— কাকটা গাধা বাবা ৷ মানুষ কি কখনো রাতের ফালতু আলোকে দিনের সূর্য ভাবতে পারে …!
মায়ের টানে পাতলা চুলের বেণী খুলে গেল৷ সাদা ফিতে হাতে পাকাতে পাকাতে —
আচ্ছা এবার পুরো লাস্ট বাবা৷চাঁদের অল্প আলো এখন কেন ভালো লাগতে শুরু করল ?
মাঠ শেষ হচ্ছিল৷ স্কুলের নিউকাট, মোজা ভিজে ভিজে লাগছিল৷ কুয়াশা কি সেদিন ঘাসের ডগায় একটু করে জল জমিয়ে রাখছিল প্রশ্নকর্তা ও উত্তরদাতাকে একসঙ্গে অন্তহীন করবে বলে !
আবার প্রশ্ন৷
• ৬ •
Dear বাবা, deer বাবা ….মহালয়ার তিল জলমাটি পেয়ে গেছে বাবা …এবার তো কিনে দাও পুজোর দু দশটা জামা … পাঁচ চারটে জুতো …
ঠাসস …
— বাবার সঙ্গে কথা হচ্ছে আমার ! ফট করে হাত নিয়ে ঢুকে গেলে কেন মা ? এত ফর্সা মেয়ে তোমার ! তার
গাল দুটো জবা করে দিতে পারলে মা ? পারলে ..
আমার নেকি যাত্রাটিক সংলাপে মায়ের মার আরো বাড়ত —
কেবল নিজের জামার জন্য বাবাকে ধরলে হবে বদমাশ ! এতগুলো কাকা …ছোট্ট ছোট্ট পিসি এতগুলো …ওদের লাগবে না জামা ! তোমার তিন ঠাকুরদা …তাদের লাগবে না নতুন জামা …
নতুন গন্ধ সম্পর্কে অদ্ভুত এক দর্শন ছিল আমার দার্শনিক বাবা মনোজের৷ বাবা বলতেন, পৃথিবীতে নতুনের কোনো নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা হয় না৷ শুধু সে এলে বোঝা যায়, আগে সে ছিল না
মায়ের কথায় বাবার চোখ স্বপ্নময় হত৷ গভীর চোখে মোটাসোটা বউটার দিকে তাকিয়ে থাকতেন সাতের দশকের সেরা নাটককার মনোজ মিত্র৷ বাবার থেকে পুজোয় কেবল একটিই শাড়ি নিতেন মা ৷ রঙ নির্দিষ্ট ছিল না, তবে বউয়ের শাড়ি যে সবসময় গাঢ় কোনো রঙের হবে এমনটাই নাকি স্থির করে রেখেছিলেন বাবা৷ বাড়িতে তখন একটাই বউ৷ ঠাকুরদা অশোক ও ঠাকুমা রাধারাণীর পছন্দ করা বড় সাধের বউ আমার মা আরতি৷ রাধারাণীর মোটে পছন্দ ছিল না, বউকে এই কোনোরকমে একটা মাত্তর শাড়ি কিনে দেওয়া৷ মা গল্প করেছেন, তাঁর চাকুরীজীবী শ্বশুড়মশাই ডালহৌসি থেকে ফেরার সময় আরতির জন্য নিয়ে আসতেন খাঁটি সিল্কের শাড়ি৷ ঠাকুরদার অভিনব রঙবোধ৷ পরবর্তীতে ঠাকুরদার মাকে দেওয়া দুটি শাড়ি আমার হাতে আসে৷ একটিতে গোলাপী আর নেসকফি মিশেছিল৷ আর একটি বেগুনি রঙের, টকটকে লাল পাড়৷ বেগুনি শাড়িটি যতদিন অটুট ছিল, প্রতি অষ্টমীতে নিয়ম করে পরতাম৷ বেলগাছিয়া সার্বজনীন পুজো প্যান্ডেলের যুবকরা জমা হত আমার চারপাশে৷ নিজেকে গৌরী লাগত৷ পুরোনো শাড়িতে তখন নতুন গন্ধ বাসা বেঁধেছে৷
নতুন গন্ধ সম্পর্কে অদ্ভুত এক দর্শন ছিল আমার দার্শনিক বাবা মনোজের৷ বাবা বলতেন, পৃথিবীতে নতুনের কোনো নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা হয় না৷ শুধু সে এলে বোঝা যায়, আগে সে ছিল না৷ ইতিহাসের ছাত্রী হয়েও যখন ধীরে ধীরে দর্শনশাস্ত্রেও সমান আগ্রহী হয়ে উঠলাম তখন একবার তর্ক শুরু করেছিলাম—
অতএব …অতএব যাহা আগে দেখা যায় নাই তাহাই
নূতন ! তোমার কথা অনুযায়ী নতুনের তো এই ব্যাখ্যাই দাঁড়ায় বাবা !
ধরিত্রীর ও ধরিত্রীপুত্রদের অত্যন্ত কাছ ঘেঁষে থাকা নাট্যকার কি এত সরলীকরণে সন্তুষ্ট হতে পারেন !
উত্তরে অদ্ভুত সত্য, সেদিন আমায় দেখিয়েছিলেন বাবা —
তুমি কি জন্ম থেকে আজ অব্দি আকাশের সব কটি তারাকে আলাদা করে দেখেছ ? না দেখা সম্ভব ! আরে ভাই ! আমি তুমি, গোটা আকাশটাই তো কখনো দেখিনি ! আমাদের আকাশ মানে তো দুই দুই চার চোখের পথে যতটুকু আকাশ পড়ে থাকে, ততটুকু৷ তবু কি ভিন্ন কোনোদিন কোনো ভিন্ন দেশে পৌঁছে তোমার মনে হয়, এহে তারাগুলো নতুন হয়ে গেল !
— কখনো কখনো তো মনে হয় বাবা …
— yes ..yes ..যেদিন মনে হয় সেদিন সে নতুন৷ আর শোনো হে পাগল মেয়ে…এই মনে হওয়া তোমার বাড়ির ছাদে রোজই ঘটতে পারে৷
আর পুজোর বাজারের সময়, বাবার এই নতুনের ব্যাখ্যা প্রসারিত করতেন মা ৷ ধরুন, আর একমাস বাকি বাকি পুজোর৷ সব ফ্ল্যাটের পুজোর বাজার শেষ৷ আমি কাঁদছি, আমার ছোট্ট ছোট্ট পিসিরা মুখ শুকিয়ে বসে আছে৷ মা ফিক ফিক করে
হাসছেন৷ পদ্য পড়ার মতো সুর করে বলছেন—
আরে নতুন জামা গায়ের চামড়ায় ছোঁয়াছুঁয়ি হলেই তো সেটা পুরোনো হয়ে গেল ! আর পুরোনো হয়ে গেলেই নতুন পোশাক পরার আনন্দটাও হুশ ৷ তার চে …
কথা শেষ করতে দিতাম না —
হ্যাঁ হ্যাঁ … তার চে জামাগুলো দোকানে থেকে অনন্ত নতুন হোক ! আমরা বিশ্বকর্মার ঘুড়ি উড়িয়ে যাই৷ আমাদের তো মা দুগ্গা নেই৷ কেবল একটা “কলের মিস্ত্রী ভগবান ” আছে !
সত্যি সত্যি দুমদুম পা ফেলে ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে৷ বিশ্বকর্মার ঘুড়ি উড়ত৷ রাগের চোটে ওড়াটাকে দেখতে পেতাম না৷ খালি মনে হত, ঘুড়ির লাটাইবাসা ভেঙে দিয়েছে শালা নিকম্মা৷ নেপালি বস্তি ছিল আমাদের ভাড়াবাড়ির কাছে৷ আর সে পাড়ার ছেলেরা ছিল আমার মনের ফ্রেন্ড৷ ফলে খিস্তি শিখেছিলাম খুব৷ পুজোর বাজার দেরি হওয়ায় একটা আকাশ আর একদল ঘুড়ি আমার কাছে যে কী গালাগাল খেয়েছে !
ধীরে ধীরে বাবা মাকে চিনলাম৷ প্রতিটি পুজোর বাজার এই দম্পতিকে আবিষ্কার করতে শেখাত আমাকে৷ বুঝতে পারছিলাম, আমার বাবা মায়ের পুজোর বাজারের সঙ্গে ‘ সবাই ‘ শব্দটা অমোঘ সত্য হয়ে জুড়ে গিয়েছে৷ পরিবারে তখন কুড়ি পঁচিশ জন৷ তার সঙ্গে আনাগোনা আরো অনেকের৷ তখনো বাঙালি ভদ্রলোক অতিথিকে ঘরের লোক মনে করত৷ বিশ্বকর্মা পুজোর পর থেকে যে সব অতিথি আসতেন, তাঁরা হয়ত পুজো অব্দি থেকে যেতে যেতেন৷ তখন তো আর অতিথি, একদিনের হত না৷ যে বাড়িতে অতিথি একদিন থেকে পালাতেন, সে বাড়ির কর্তা গিন্নিদের খুব নিন্দে হত৷
বাবা মা গ্রাম ও পূববাংলা থেকে আসা দূরসম্পর্কের আত্মীয়দের জন্য আগে জামা শাড়ি কিনতেন৷ তারপর আমার, মায়ের৷ শ্যামবাজারের ইয়ংবেঙ্গল ছিল বাবার পছন্দের দোকান৷ এখান থেকে মা, ঠাকুমা, মাসি, পিসিদের কাপড় কেনা হত৷ ধনেখালি। তবে পাড় খুব চওড়া৷ না মানালেও বাবার আবদারে মা চিরকাল চওড়া পাড় ও চড়া রঙ পরেছেন৷ বাবার হয়ত কষ্ট হত …মাও তো তখন নতুন ! দশ বছরের বিয়ে করা বউয়ের গায়ে তখনকার বরেরা নতুন গন্ধই পেত ৷ আরেকটা শাড়ি কিনতে চাইতেন বাবা ! কতবার দেখেছি, বাবার বাড়ানো হাত চেপে ধরেছেন মা৷ হয়ত ফিসফিস করে বলতেন—
তোমার দেওয়া একটা নতুনই থাক৷ গতবছরের শাড়ি আছে তো ! ইয়ংবেঙ্গল থেকেই কিনে দিয়েছিলে ! মনে নেই তোমার ! ওগুলোকে নতুন ভাবব ৷ অনেক নতুন হলে, ‘অনেক’ হয় শুধু৷ নতুন আর থাকে না৷

ময়ূরী মিত্রের ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত
এসব কথার বেশিরভাগই শুনতে পাইনি সেদিন ৷ ঠাকুমা বলে দিয়েছিলেন — তুমি এখন বড়ো হচ্ছ সোনা ৷ বাবা মা আস্তে কথা বললে একটু সরে দাঁড়াবে৷ হ্যাংলার মতো বাবা মায়ের কথা শুনো না৷
পুজোর বাজার যেদিন হবে ঠিক হত, ভীষণ উত্তেজনা চাইতাম আমি৷ গোবিন্দভাত ( গোবিন্দভোগ চালের ভাত ), ঘি, আলু সেদ্ধ , আর একটা ছোট্ট কাঁচালঙ্কা৷ বেলা এগারোটার মধ্যে খেতে বসে পড়তাম—
বাবা আমার সঙ্গে তুমিও বসে যাও গো ৷ এই ..এই …যারা আমার সঙ্গে পুজোর বাজার করতে যাবে, সবাই বসে যাও খেতে৷ সারা দুপুর ধরে বাজার হবে৷ সবাই একটা করে ফোল্ডিং ছাতা নাও …ব্যাগের বাকি জায়গা ফাঁকা রাখো ! বাবা কুইক৷ কেন এত দেরি করছ! বাবা তুমি আমার হরিণ …হরিণ বেগে ছুটব হাতিবাগান …শ্রী মার্কেট …উত্তরা …
তখন কলকাতায় দোতলা মার্কেটও হতে শুরু করেছে …উত্তরা সিনেমাহলের পাশের গলিতে দেড়তলায় একটা দর্জির দোকান৷ শুধুমাত্র দেড়তলায় লাফিয়ে উঠব বলে পাড়ার দোকান অঙ্গশোভা ছাড়লাম একদিন৷ ওড়নার দুদিকে দুটো ব্রোচ সেফটিপিন৷ জুতো একজোড়া৷ স্কুলের নিউকাট৷ আলাদা জুতো কেনা হত না৷ আর তাতে একটুও কষ্ট হত না আমার৷ আমি তো প্রতি পুজোয় আমার নতুন বাবা মা পেয়ে যেতাম, যাঁরা সংখ্যা নয়, নতুন খুঁজতে শিখিয়েছিলেন৷
বাড়ি ফিরে পুজোর জামা দেখাতাম রামু জমাদার, প্যাঙা বাসনবিক্রেতাকে …
রামুদা তোমার নতুন লুঙ্গি এনেছে মা৷প্যাঙা …এই নাও ফতুয়া …নাম্মা ( ঠাকুমা ) বলে দিয়েছিল তাই এনেছি ! নইলে নামের যা ছিরি তোমার ..কিছু আনতাম না৷ পরের পুজোর আগেই আমার মায়ের কাছ থেকে নতুন নাম নিয়ে নেবে৷ ফান্টাস্টিক জামা দেব৷
পারুলদি…মেনকামাসির …দুটো করে শাড়ি৷ একটা সম্বৎসরের আর একটা ভালো কাপড়৷
জামা কাউন্ট করে আলমারিতে ঢোকাচ্ছি ! আগের বছরেরগুলোকে মিলিয়ে কত্ত জামা হবে গো ! ওমা আলমারি ফাঁকা৷ আগের বছরের জামা নিয়ে ছুটছেন মা …বস্তির মেয়েদের দেবেন !
— মা সেই একই সংখ্যা হয়ে গেল আমার জামাগুলোর ! আবার তুমি গত বছরের জামা দিয়ে দিলে মা ! দেখো শয়তানগুলো কীভাবে আমারই জামা পরে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে !
এস না …এস একবার…মায়ের কাছে এগরোলের পয়সা চাইতে… থাপ্পড়ের পর থাপ্পড় দেব তোমাদের৷
প্রতিবার ভাবি সংখ্যা বাড়বে জামার৷ তোদের জ্বালায় বাড়ে আর না৷
চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদি —
ও মা ! এ সাপ মইয়ের খেলা আর খেলতে পারি না মা৷
আজো তো কাঁদি —
মা তোমার ওই সাপটা থাক আমার বুকে৷ ও গেরস্তের মঙ্গলসাপ গো৷ সন্ধের শঙ্খের মতো তার হিসধ্বনি৷
আর বাবা, তোমার ছুটন্ত পা দুখানি, দুটো হরিণ হয়ে আমায় ছোটাক মানুষের ভুবনে৷
·•··•··•· ·•··•··•·
ক্রমশ…
প্রথম পর্ব পড়ুন: আমার বাবা
❤ Support Us