- পা | র্স | পে | ক্টি | ভ
- ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২২
বসন্ততলার বহুরূপী
আদিম পেশা ছিল পাখি শিকার, এখন রঙিন সাজে নিজেদের ঢেকে ফি দিন বেড়িয়ে পরেন জনচিত্ত জয়ে

চিত্র: দেব সরকার ।
মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে, ভাগীরথীর পশ্চিমপাড়ের বসন্ততলা পরিচিত বহুরূপী গ্রাম নামে ।বংশ পরম্পরায় এই পেশার সঙ্গে যুক্ত গ্রামের অধিকাংশ মানুষ । শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের ‘ছিনাথ বহুরূপী’ নয়, বাস্তবের বহুরূপীদের আজও খোঁজ পাওয়া যায় এই প্রাচীন গ্রামটিতে। বসন্ততলা গ্রামটির স্থানীয় নাম ‘পাখরেপাড়া’। নামটি পাখি – মারা থেকে উদ্ভব হয়েছে । পাখি শিকারিদের আবাস, সেখান থেকেই গ্রামের এমন নামকরণ।এখন অবশ্য শিকারের কাজে যুক্ত নয় কেউই ।
বহুরূপী গ্রাম বসন্ততলার কমল বিশ্বাস, সুব্রত রায়, লক্ষ্মণ মণ্ডল প্রমুখ বহুরূপী শিল্পী প্রতিদিনই বাঘ, সিংহ, হনুমান ,রাম, রাবণ, দুর্গা, কালী প্রভৃতি পৌরাণিক চরিত্রের সাজপোশাক পড়ে উপার্জনের আশায় ,কলকাতা, শিলিগুড়ি, দুর্গাপুর -আসানসোল ,বর্ধমান প্রভৃতি বড় শহরে ট্রেনে,বাসে চেপে চলে যান । দৈনিক উপার্জন- তিন চার কেজি চাল, আর নগদ একশো দুশো টাকা । দিনের আলো ফুটলেই গ্রামের পথে কখনও কালী, কখন শিব, কখনও হনুমান কখন নারদ সাজে খঞ্জনী হাতে আবার কখন নুপূরের ধ্বনি তুলে মেঠো পথে এগিয়ে চলেন ।
প্রতি বছর বর্ষায় বহুরূপীদের সমস্যা বাড়ে । বৃষ্টির জন্য, জল কাদায় ডুবে যাওয়া প্রত্যন্ত গ্রাম গঞ্জের রাস্তাঘাট দিয়ে যাতায়াত করা কষ্টকর । তাই বর্ষার দু’তিন মাস রুটি রুজিতে টান পরে বহুরূপী শিল্পীদের। বর্ষার শেষে শরতে আগমনীর সুর বেজে ওঠে আকাশে-বাতাসে। মা আসার প্রতীক্ষায় দিন গোনেন শহরতলীর মানুষ। চারদিকে খুশির ঝলক । ঠিক তখনই বহুরূপীদের ঘরেও আনন্দের বান ডাকে। কারণ দুর্গা পুজোর সময়েই সবচেয়ে বেশি রোজগার হয় বহুরূপী শিল্পীদের ।
দিনের আলো ফুটলেই পৌরাণিক চরিত্রের সাজপোশাক পড়ে গ্রামের পথে কখনও কালী, কখন শিব, কখনও হনুমান কখন নারদ সাজে খঞ্জনী হাতে আবার কখন নুপূরের ধ্বনি তুলে মেঠো পথে এগিয়ে চলেন।দৈনিক উপার্জন- তিন চার কেজি চাল, আর নগদ একশো দুশো টাকা ।
বহুরূপী সাজের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণ বাঘ, সিংহ, হনুমান আর মা কালীর বলে জানালেন বহুরূপী শিল্পী কমল বিশ্বাস । তিনি স্ত্রী পুত্র সমেত বহুরূপী সেজে বেরিয়ে পড়েন আজও বিভিন্ন শহর গ্রাম গঞ্জের পথে। তাঁর গলায় আক্ষেপের সুর । কথা বলতে বলতে তাঁর চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল । সময় বদলেছে । শহরবাসীর পাশাপাশি গ্রামে-গঞ্জেও বিনোদনের উপকরণ বদলেছে। মুঠোফোনে বদ্ধ যাপন। তার ওপর আবার গত দু-বছরে করোনা আবহে গ্রাম বাংলার এই লোকায়ত শিল্পীদের রুটি-রোজগার প্রায় বন্ধ । নবীন প্রজন্মের কেউই আর এই পেশায় যুক্ত হতে চাইছেন না।
প্রসঙ্গত, মুর্শিদাবাদ জেলার বসন্ততলা ছাড়াও বীরভূমের লাভপুরের বিষয়পুর , চারকল , হুগলির তারকেশ্বরের জোতশম্ভু গ্রামে বহুরূপী শিল্পীর বাস ছিল। লাভপুরের বিষয়পুরের প্রবীণ বহুরূপী শিল্পী আনন্দ চৌধুরী বলেছেন —এই গ্রামের বহুরূপী শিল্পীরা স্বাধীনতার আগে মুর্শিদাবাদের বসন্ততলা থেকে লাভপুরের বিষয়পুরে এসেছিলেন । তাঁদের পূর্বপুরুষেরা নবাবি আমলেও বহুরূপীর সেজে জীবিকা নির্বাহ করতেন। বাংলার বিখ্যাত বহুরূপী শিল্পী প্রয়াত সুবল দাস বৈরাগ্যও বীরভূম জেলার চারকল গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। পূর্ববর্ধমান এবং নদীয়া জেলাতেও কয়েকঘর বহুরূপী শিল্পী রয়েছেন । তবে বর্তমানে বাংলার এই প্রাচীন লোকায়ত ধারাটি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে । বাস্তবের ছিনাথ বহুরূপীদের দিন গুজরান এখন প্রতিদিনই কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
১৯৮৮সালে বহুরূপী শিল্পীদের সমস্যা নিয়ে বহরমপুরের রবীন্দ্রসদনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম বহুরূপী রাজ্যসম্মেলন । সে সম্মেলনে বহুরূপীদের দাবি তুলেছিলেন, তাঁদের এই শিল্পকে লোকশিল্পীর স্বীকৃতি দিক সরকার । সরকারি সাহায্যের সুযোগ পেলে দুস্থ-অসুস্থ বহুরূপী শিল্পীরা আবার বুক ভরে শ্বাস নিতে পারবেন ।
এই দাবির প্রেক্ষিতে নব্বই দশক থেকে কোনও কোনও বহুরূপী শিল্পী মাসে এক হাজার টাকা করে ভাতা পান। এই সামান্য টাকায় অনেকেরই নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। আবার অনেকে এই যৎসামান্য অর্থও পান না। তাই অনেক প্রবীণ বহুরূপী শিল্পীরই গলায় রয়েছে আক্ষেপের সুর – কতদিন আর দারিদ্রতার মধ্যে দিয়ে এই লোকায়ত শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন তাঁরা ?
❤ Support Us