- এই মুহূর্তে দে । শ
- ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২৫
কংগ্রেসকে নিশানা করে তীব্র সমালোচনা প্রধানমন্ত্রীর, দিলেন ‘তুষ্টি-সন্তুষ্টি’ তত্ত্ব। সবে তো ট্রেলার বিকশিত ভারতের লক্ষ্যে দীর্ঘ কাজ বাকী — লোকসভা ভাষণে নরেন্দ্র মোদি।

চলতি বাজেট অধিবেশনে মঙ্গলবার সংসদে দীর্ঘ বক্তৃতা করেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। গরিবি হটাও স্লোগান দিইনি, কাজে করে দেখিয়েছি’, বিরোধীদের আক্রমণ মোদির। কেউ কেউ জাকুজি, শাওয়ারে ফোকাস রাখেন, আমরা রাখি হর ঘর জল-এ’, নাম না করে কেজরিকে খোঁচা প্রধানমন্ত্রীর। নিশানা থেকে বাদ পড়েননি দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং সনিয়া গান্ধীও।
সংসদে বাজেট অধিবেশন চলছে । চড়ছে বাদানুবাদের পারদ। রাষ্ট্রপতির ভাষণের পরে, নির্মলা সীতারমণ গত ১ ফেব্রুয়ারি সংসদে বাজেট পেশ করেছেন। তারপর থেকেই সংসদের ভিতরে বাইরে চলছে রাজনৈতিক তরজা। এবারের কেন্দ্রীয় বাজেট মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত আপামর জনসাধরণের কথা ভেবে করা হয়ে দাবি এনডিএ সরকারের নেতামন্ত্রীদের। বিরোধীরা তুলেছেন একাধিক অভিযোগ। রাহুল গান্ধীর ভাষণ নিয়ে লোকসভা স্পিকারের কাছে অভিযোগ জমা পড়েছে। এমত অবস্থায় আজ সংসদে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ। শুরু থেকেই নিজস্ব স্টাইলে বিরোধীদের একহাত নিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বিশেষ করে কংগ্রেস ও রাহুল গান্ধীকে তীব্র আক্রমণ করলেন তিনি। সংসদে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর বক্তৃতার পরে সনিয়ার মন্তব্যের জেরে ইতিমধ্যেই স্বাধিকার ভঙ্গের নোটিস দিয়েছে বিজেপি। প্রাক্তন কংগ্রেস সভানেত্রীর নাম না করে মোদী বলেন, ‘‘এক মহিলা আমাদের মাননীয় রাষ্ট্রপতিকে অপমান করেছেন।’
একসময় দেশ জুড়ে কেবল ‘গরিবি হটাও’ স্লোগান শোনা যেত , কাজের কাজ কিছু হয় নি। বিজেপি সরকারেই ২৫ কোটি ভারতীয়কে দারিদ্রসীমা থেকে মুক্তি দিয়েছে। — মন্তব্য প্রধানমন্ত্রীর। কংগ্রেসকে ইতিহাসের কথা মনে করাতে গিয়ে তুললেন ইন্দিরা গাঁন্ধীর সমকালের কথা। ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীর প্রসঙ্গ, তিনি তখন বলেছিলেন, ‘দিল্লির সরকার যদি মানুষের কল্যাণে ১ টাকা বরাদ্দ করে, শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, গরিব মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে মাত্র ১৫ পয়সা।’ সেই সূত্র ধরে রাষ্ট্রপতির বক্তৃতা নিয়ে আলোচনার জবাবি বক্তৃতায় কংগ্রেসকে নিশানা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘তখন তো দিল্লি থেকে পঞ্চায়েত পর্যন্ত এঁদেরই রাজত্ব ছিল। বাকি পয়সা কোথায় যেত?’’ প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছেন তিনি নিজেই— ‘‘ভুল হাতে যেত।’’ সেই ‘হাত’ যে কংগ্রেসের, সে দিকে ইঙ্গিত করে এর পরেই তাঁর মন্তব্য— ‘‘আমি হাতের কথা বলেছি। কার হাত বলিনি।’’ সমালোচনা থেকে বাদ পড়েন নি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুও। সরকারের বিদেশনীতি সম্পর্কে রাহুলের সোমবারের বক্তৃতার পাল্টা জবাবে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে আমেরিকার সাথে বিদেশনীতি নিয়ে নেহেরুর সমালোচনায় মুখর মোদি। কেনেডি ও পণ্ডিত নেহেরুকে নিইয়ে একটি বইয়ের উল্লেখ করে, সবাইকে সেটি পড়বার অনুরোধ করলেন তিনি। তাঁর মন্তব্য, ‘‘বইটি পড়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন, দেশ যখন নানা সমস্যায় জর্জরিত, তখন বিদেশনীতি নিয়ে কোন খেলাটা চলছিল।’
নিজের সরকারের কৃতিত্ব সম্পর্কে সবিস্তার আলোচনাতেও বিরোধীদের নিশানা করেব মোদি। তিনি বলেন যে কাজ ৪০-৫০ বছর আগে হওয়ার কথা ছিল, তা তাঁর সরকারকে এখন করতে হচ্ছে। একদিন আগে লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গাঁধী ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র ব্যর্থতা নিয়ে সরকারকে নিশানা করেন। আজ জবাব দিতে গিয়ে মোদি বলেন, ‘ আমরা গরিব মানুষের জন্য কী করেছি, তা রাষ্ট্রপতি নিজের ভাষণে বলেছেন। যাঁরা কুঁড়েঘরে গিয়ে ছবি তোলেন, গরিব মানুষকে নিয়ে আলোচনা হলে তাঁদের একঘেয়ে লাগে।’ একাধিক প্রকল্পর সফালতার কথা তুলে ধরেছেন দীর্ঘ ভাষণে, সরকারি আবাসন প্রকল্পে চার কোটি বাড়ি নির্মীত হয়েছে, ১২ কোটি শৌচাগার তৈরি হয়েছে বলে জানান তিনি। পরিকাঠামো উন্নয়নে ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষে র থেকে বহুগুণ খরচ করে চলেছে তাঁর সরকার, সরকারি অপব্যবহার বন্ধ করে তাঁর সরকার ৩ লক্ষ কোটি টাকা সাশ্রয় করেছে বলেও দাবি প্রধানমন্ত্রীর। সময় পেরিয়ে গেলেও পদের অতিরিক্ত সময় লাভের নিয়মকে কাজে লাগিয়ে চলতে থাকে ভাষণ। দিল্লিতে মেট্রোর পথ দ্বিগুণ হয়েছে, কেন্দ্রের অর্থে কয়েক হাজার দূষণমুক্ত ইলেকট্রিক বাস চলাচল শুরু হয়েছে বলে দাবি করলেন তিনি। দেশে নারীদের দ্রুত এগিয়ে চলা, সেলফ হেলফ প্রকল্পের আওয়ায় ‘লাখপতি দিদি’র কথা বলেছেন। বিকশিত ভারত স্বপ্ন – সরকারের স্বপ্ন নয়, দেশের স্বপ্ন। কৃষি ও বানিজ্যে ভারত বিশ্বে গুরুত্বপুর্ণ স্থান অধিকার করতে চলেছে। ভারতের চা, কফি, হলুদ। প্রোসেস সি ফুড, বিহারের মাখানা রপ্তানি হবে। শ্রী অন্ন’ও পৃথিবী কাঁপাবে বলে মত প্রধানমন্ত্রীর। ই-শ্রম পোর্টালে গিগ ওয়ার্কারদের নথিভুক্তিকরণের মাধ্যমে তাঁদের আয়ুষ্মান ভারত যোজনার লাভ দেওয়া হবে। দেশে এমএসএমি সেক্টরে বিস্ফোরণ ঘটছে – প্রচুর কাজ, অপার সম্ভাবনা।
২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেই ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’ স্লোগান তুলেছিলেন মোদী। এদিন তাঁর গলায় শোনা গেল ‘তুষ্টি-সন্তুষ্টি’ তত্ত্বের কথা। মোদীর দাবি, বিরোধীরা তুষ্টিকরণের রাজনীতি করছেন, আর তাঁর সরকার চাইছে সন্তুষ্টিকরণ— জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেক ভারতবাসীর উন্নয়ন। রাহুলকে নিশানা করে মোদীর মন্তব্য, ‘‘যাঁরা সংবিধান বুকে নিয়ে ঘোরেন তাঁরা মুসলিম মহিলাদের দুর্দশা দেখতে পেতেন না। আমরা তিন তালাক প্রথা বাতিল করে মুসলিম মহিলাদের স্বস্তি দিয়েছে। আমরা সংবিধানের আদর্শে বাঁচি, কেবল মুখে সংবিধান সঙ্গবিধান বলিনা। এটা আজকাল ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মহাত্মা গান্ধীর উদ্ধৃতি দিয়ে বললেন, ‘যাঁরা পিছিয়ে রয়েছে, তাঁদের দিকে প্রথমে নজর দিতে হবে।’ বিজেপি ‘ঘৃণার রাজনীতি’ করে না বলেও দাবি করেছেন তিনি। উঠে এসেছে বাবাসাহেব আম্বেকরের জলস্বপ্ন প্রকল্পের কথা। ‘বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে ১০ কোটি ভুয়ো সুবিধাভোগীদের চিহ্নিত করে বাদ দেওয়া থেকে মানুষের অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা জমা দিয়ে তাঁর সরকার নজির গড়েছে, তাঁর “আমাদের নীতি হল, ‘সঞ্চয়ও, উন্নয়নও’ । মানুষের পয়সা, মানুষেরই কাজে ব্যবহার। সরাসরি মানুষের কাছে সুবিধা পৌঁছে দিয়েছি আমরা। সরাসরি মানুষের অ্যাকাউন্টে ৪০ লক্ষ কোটি টাকা জমা করেছি।’ আরো খতিয়ান দিতে গিয়ে এসেছে জম্মু-কাশ্মীর, তিন তালাক, ৩৭০ ধারা অবলুপ্তি প্রসঙ্গ। তুলে ধরেন এআই নিয়ে তাঁর সরকারের নানান পদক্ষেপের কথা। তারই মাঝে জানান, কীভাবে সরকারি দফতরগুলি থেকে ফেলনা আবর্জনা সরিয়ে কেন্দ্রের ‘পরিচ্ছন্নতা অভিযান’কে এগিয়েও নিয়ে যাওয়া হয়েছে, আর সেই ফেলনা বিক্রি করে তা থেকে টাকাও এসেছে সরকারের ঘরে। ‘ক্যানসার দিবস’ কে মাথায় রেখে মোদী তাঁর ভাষণে, ১২ লাখ পর্যন্ত আয়কর ছাড় সহ সরকারের একাধিক পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্প নিয়েও বক্তব্য রাখেন, গ্রামীণ এলাকায় কয়েক হাজার নতুন হাসপাতাল তৈরি হয়েছে বলে দাবি করেন। দলিত-আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের জন্য একাধিক আইটাই, স্কুল, কলেজ তৈরি হয়েছে উল্লেখ করেন তিনি।
তবে তাঁর ভাষণ জুড়ে বিরোধিদের নিশানা করতে ছাড়েন নি দুঁদে রাজনীতিবিদ। শুধু রাহুল গান্ধি নন, মোদির নিশানায় ছিলেন আম আদমি পার্টির প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়ালও। মোদির দাবি, কিছু নেতা ‘জাকুজি’, আধুনিক শাওয়ারকে প্রাধান্য দেন। তাঁর সরকার প্রত্যেক ঘরে জলের সংযোগ পৌঁছে দেওয়াকে গুরুত্ব দিয়েছে। মানুষের টাকায় শিশমহল গড়ার পক্ষপাতী নন বলেও মন্তব্য করেন মোদি। অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে নিশানা করেই এমন মন্তব্য বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ এবারের দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে ‘শিশমহল’ বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়েছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে কেজরিওয়াল মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন সাজান বলে অভিযোগ।
উল্লেখ্য, দিল্লি ভোটের প্রচার সোমবার বিকেলে শেষ হয়েছে। এদিকে, মঙ্গলবার নরেন্দ্র মোদীর ভাষণে মহারাষ্ট্র, হরিয়ানার ভোটে তাঁদের সরকারের কৃতিত্ব ঘিরে বক্তব্য তুলে ধরতেই বিরোধীরা সরব হন সংসদে। ভাষণ দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, ‘আমরা ক্ষমতায় আসার আগে, এলইডি বাল্ব ৪০০ টাকায় বিক্রি হত। বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা দাম কমিয়ে ৪০ টাকা করতে সক্ষম হয়েছি।’ নরেন্দ্র মোদী বলেন, ‘এলইডি বাল্বগুলি শক্তি সংরক্ষণে সাহায্য করেছে, যার ফলে দেশের মানুষের জন্য প্রায় ২০,০০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে।
ভাষণের শেষে, বিরোধিদের কাছে অনুরোধ করে বলেন — সবার আগে দেশ, এমন কিছু করবেন না বা বলবেন না যাতে দেশের ক্ষতি হয়। যে কথা আর্বান নক্সালরা বলে, তা আপনাদের বলা সাজে না। বিকশিত ভারতের লক্ষ্যে সবাই সরকারের সহযোগিতা করুন। এরপরই মজার ছলে মোদি বলেন – এই তো সবে তৃতীয় মেয়াদ চলছে, দেশের জন্য আরো অনেক বছর আমি কাজ করবো, নিশ্চিন্ত থাকুন।’
❤ Support Us