- গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
- ডিসেম্বর ২৯, ২০২৪
স্বপ্নের আসা যাওয়া

অলঙ্করণ: দেব সরকার
সে অনেক দিন আগের কথা। তখন সবে অনিমার জীবন সম্বন্ধে একটু একটু বোধ জন্মাচ্ছে। এক সন্ধ্যায় অনিমাকে চৌবাচ্চায় জল ঢোকা বেরনোর অঙ্ক বুঝিয়ে দিচ্ছিল অনিমেষ। আর সেখান থেকেই কথা প্রসঙ্গে অনিমা প্রশ্ন করেছিল অনিমেষকে।
…জীবন কাকে বলে ?
অনিমেষ একটু সময় নিয়েছিল উত্তর দিতে। তারপর বলেছিল, জীবন মানে ছোট বড় সমূহ ঘটনার সমাহার। তারপর যাবতীয় নদী দিয়েই অনেক জল বয়ে গেছে। তার মধ্যে ওদের কখনও টানা দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। আবার এমনও হয়েছে, পরস্পর দেখাই হয়নি অনেকদিন।
সেদিন এক প্রখর মধ্যাহ্নে পৃথিবী তখন জ্বলছে। পাড়ার রোড লেন গলি তস্য গলি সব শুনশান। সমস্ত দোকানপাট এমনকি পান সিগারেটের দোকান পর্যন্ত বন্ধ। একটা কুকুরও চোখে পড়ছে না রাস্তায়। স্বচ্ছল গৃহস্থ থেকে অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত সবার দরজা জানলা প্রাণপণে সাঁটা। সবার ঘরের সব জানলার পর্দাগুলো টানা। যাতে কিনা একটুও সূর্যের আলো প্রবেশ না করতে পারে ঘরে। এমন এক সময়ে বেশ কিছুক্ষণ তুমুল আলোড়ন শেষে শান্ত হয় দুজনেই। দুজন বলতে অনিমেষ ও অনিমা। পরিচয় তো তাদের অনেকদিনের। তবে এ পর্যন্ত পৌঁছোতে তাদের আরও অনেক অনে..ক দিন লাগল।
সে লাগুক। সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল আজকের এই ঘটনার পর তাদের সম্পর্কটাই সম্পূর্ণ একটা নতুন দিকে মোড় নিল। এতদিন যা ছিল তা তো রইলই। তাতে যুক্ত হয়ে পড়ল আরও আরও অনেক কিছু।
আসলে স্তন্যপায়ী মাত্রই মাকে রক্তাক্ত করে তার পৃথিবীতে আগমন। আর এই স্তন্যপায়ীদের মধ্যে মানুষই শ্রেষ্ঠ। তাই সে জানে, সে এসেছে বটে। কিন্তু আজ না হোক কাল, কাল না হোক পরশু সে নেই হয়ে যাবে।
অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ডাদেশ শিরোধার্য করেই তার পথ চলা। তবু সে স্বপ্ন বুকে নিয়ে। কল্পনাকে আশ্রয় করে, আশাকে সঙ্গে নিয়েই পথ হাঁটে। প্রথমে একটা লক্ষ্য স্থির করে জীবনে। তারপর তার জন্য প্রাণপাত পরিশ্রম করে সে পৌঁছোতে চায় লক্ষ্যাভিমুখে। কেউ সফল হয়। কেউ হয় না। আবার কারও সফলতা আংশিক। তবু সে শেষ পর্যন্ত পথ ছাড়ে না।
অনিমেষ ও অনিমা, ফারাক তাদের কুড়ি বছরের। কানে শুনতে পার্থক্যটা যথেষ্ট বেশি। অনেক। বিস্তর। মানে একজনের পাঁচ হলে আর একজনের পঁচিশ। পনেরো হলে পঁয়ত্রিশ। আবার কুড়ি হলে অন্য জনের ঠিক ডবল। মানে চল্লিশ।
এবার এদের যদি কেবল প্রাকৃতিক ভাবেই বিচার করি। মানে শুধুই তারা নারী ও পুরুষ। অথবা পুরুষ ও নারী। সেক্ষেত্রে কুড়ি-চল্লিশে পৌঁছে তাদের পরস্পর আকর্ষিত হতে বাধা কোথায় ? কোনও বাধা আছে কি ? নাকি সেটাই প্রাকৃতিক ধর্ম ?
ব্যাপারটা পুরোটাই স্বতঃস্ফূর্ত। আর যেখানে স্বতঃস্ফূর্ততা সেখানে সাতখুন মাপ। মানে সে সময়টা অমৃতযোগের। এবং অমৃতযোগে ঘটা সবকিছুই দোষমুক্ত। অর্থাৎ মনের মিলটাই শেষ কথা। আচ্ছা বলতো স্রেফ অধিকারের অছিলায়। সমাজের রক্তচক্ষুর ভয়ে। শুধুমাত্র অভ্যাসের অজুহাতে রোজকার ইল্লুতেপনার মধ্যে কোনো রোম্যান্টিকতা থাকে ?
সবকিছুর শেষে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বাথরুম হয়ে সোজা রান্নাঘরে চলে যায় অনিমা। কিছুক্ষণ পর ঘরে ঢোকে দুকাপ ধূমায়িত চা হাতে নিয়ে। বলা বাহুল্য অনিমেষও ততক্ষণে পুরোদস্তুর গুছিয়ে নিয়েছে নিজেকে। অনিমা ঢুকতে ঢুকতেই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয় অনিমেষকে, কীগো এত কি আকাশপাতাল ভাবছ ?
অনিমেষ চট করে উত্তর দেয় না । সে আরও কিছুক্ষণ নীরব থাকে। তাকে দেখে মনে হয় সে কোনো গভীর চিন্তায় মগ্ন।
না। সে চিন্তা কোনো অঘটন ঘটে যাওয়ার ভয়ে নয়। কেননা সেরকম কোনো কিছুর প্রশ্নই ওঠে না এখানে। তবু সে নিজেকে মৌন রাখল আরও কিছুক্ষণ। তারপর মুখ খুলে প্রথম যে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল অসীমাকে সেটা হল।
আচ্ছা আমাদের আলাপের বেশ কিছুকাল পরেও কি কোনোদিন মনে হয়েছিল যে, এরকম একটা দিন আসতে পারে আমাদের জীবনে ?
অনিমা ঠিক অনুধাবন করতে পারে না অনিমেষের প্রশ্নটা। তাই সে চায়ের কাপটা ঠোঁট পর্যন্ত নিতে নিতেও মাঝপথেই নামিয়ে রাখে। তারপর তার গভীর দৃষ্টিতে অনিমেষের চোখে চোখ রেখে বলে, কী বলতে চাইছ তুমি ? আমাদের মধ্যে এই যে ঘটনাটা ঘটল। না ঘটলেই ভালো হত সেটা ?
কই না তো। আমি তো সেরকম কিছু মিন করিনি। আমি বলতে চাইছি যে, এই যে একটা জার্নি কমপ্লিট করলাম আমরা। এর কি কোনো পূর্বাভাস তুমি আমার আচরণে আগাম অনুভব করেছিলে কখনও ?
কেন আজ হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন ? তাছাড়া তোমার যদি এ প্রশ্ন থাকে। তাহলে তো আমার দিক থেকেও একই প্রশ্ন করা যেতে পারে তোমাকে। কি ঠিক বললাম? হ্যাঁ? নাকি না ?
ঠিকই বলেছ অনিমা। একদম যথার্থ বলেছ। আর ঠিক এই জায়াগাটাতেই লুকিয়ে আছে যাবতীয় রহস্য ! আজকের ঘটে যাওয়া ঘটনার বৈধতা অবৈধতা। ঠিক বেঠিক। পাপ পুণ্য। সব সবকিছু।
একদম তাই। পৃথিবীতে আর কেউ জানুক বা না জানুক। ঠিক এই ব্যাপারটাই সে মানুষদুটোকে কুরে কুরে খায়। কি ঠিক কিনা ?
ঠিক। একশ ভাগ ঠিক। আর সে প্রেক্ষিতে আমি আমার উপলব্ধিটা বলতে পারি এখানে।
বলো দেখি। শুনি।
অনিমা এবার আরাম করে চায়ের কাপে চুমুক দেয়। তারপর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে অনিমেষের উত্তরের।
আমার উপলব্ধি হল আমাদের এই ব্যাপারটা পুরোটাই স্বতঃস্ফূর্ত। আর যেখানে স্বতঃস্ফূর্ততা সেখানে সাতখুন মাপ। মানে সে সময়টা অমৃতযোগের। এবং অমৃতযোগে ঘটা সবকিছুই দোষমুক্ত। অর্থাৎ মনের মিলটাই শেষ কথা। আচ্ছা বলতো স্রেফ অধিকারের অছিলায়। সমাজের রক্তচক্ষুর ভয়ে। শুধুমাত্র অভ্যাসের অজুহাতে রোজকার ইল্লুতেপনার মধ্যে কোনো রোম্যান্টিকতা থাকে ? নাকি থাকার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা থাকে ? অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেইরকম স্পষ্ট অস্পষ্টকে তো বয়ে নিয়ে যেতে হয় আজীবন।
একদম ভুল বলোনি কথাগুলো। বরঞ্চ…
কথাটা শেষ করতে পারে না অনিমা। আলোচনাটা আরও কিছুক্ষণ চলত। কিন্তু ঠিক তখনই অনিমার মোবাইলে ফোন এসে যায়। ফোনটা যে দেবদত্তর সেটা বুঝতে একটুও অসুবিধে হয় না অনিমেষের। সেদিনের মতো তাদের কথোপকথনে ছেদ ঘটে। প্রসঙ্গ ঘুরে যায় তাদের। তারও কিছুক্ষণ পর পথে নেমে আসে অনিমেষ।
সন্ধে নেমেছে বাইরে। দুপুরের জ্বালা ধরানো উত্তাপ এখন উধাও। দখিনা বাতাস বইছে মাঝে মধ্যে। অদ্ভুত এক ভালো লাগায় ভরে উঠছে অনিমেষের দেহ মন। আবার লোকজন নেমে এসেছে রাস্তায়। পথআলো দোকানের আলো সবমিলিয়ে আবার সেজে উঠেছে কল্লোলিনী তিলোত্তমা। শুক্লপক্ষের দ্বাদশীর চাঁদ উঠেছে আকাশে। একবুক প্রশান্তি নিয়ে ধীর গতিতে হেঁটে চলে অনিমেষ…
না। আপাতত তার কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই…
উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে থাকে অনিমেষ। আর সেই হাঁটার সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করে আজকের এই প্রশান্তিটুকুকে, জীবনের ফেলে আসা স্মৃতি বা ঘটনার সঙ্গে মেলাতে। বেশ কিছুক্ষণ পথ পরিক্রমার পর তার মনে পড়ে যায় একটা দুপুরের কথা।
বেশ জ্বর তার সেদিন। স্কুলে যেতে পারেনি। ওষুধ পথ্য সবই পড়েছে। জ্বরটা চলে গিয়েও ফিরে এসেছে আবার। ঠিক সেই সময় মা এসে ঢুকেছিল ঘরে। মা কপালে হাত দিয়েই বুঝে যায় আবার গা গরম হয়েছে অনির। মানে আবার ফিরে এসেছে জ্বরটা।
এই দেখে আর একটুও সময় নষ্ট করে না মা। দ্রুত বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। তারপর একবাটি জল, পাতলা ন্যাকড়া আর একটা হাতপাখা সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসে ঘরে। অনির মাথার কাছে গিয়ে বসে।
এর কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে অনিমেষের। স্বপ্নের দেশে পাড়ি জমায় সে…!
♦–♦♦–♦ ♦–♦♦–♦ ♦–♦♦–♦
লেখক কলকাতার বাসিন্দা । বেসরকারি সংস্থার কর্মী
❤ Support Us