- কে | রি | য়া | র-ক্যা | ম্পা | স ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- জুলাই ২, ২০২৩
ধারাবাহিক আত্মকথা : আমাদের বিদ্যানিকেতন
বাঙালি মুসলিমরা বংশানুক্রমে কৃষক। চরাঞ্চলে, বনাঞ্চলে অনেকেই বাস করতেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দেশভাগজনিত সঙ্কট তাদের ধাওয়া করত। বাড়িতে গোয়ালপাড়িয়া কিংবা বাঙালি রীতিনীতি এবং বাড়ির বাইরে অসমিয়া পরিচিতি নিয়েও সন্দেহের শিকার

আমিত্বহীনতার বৃত্তান্ত
বয়স ৫৬+,দীর্ঘাঙ্গ, নির্মেদ পুরুষ । গুয়াহাটির এনইএফ গ্রুপ অফ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। ভারতের শিক্ষা মহলে, কর্মঠ আর প্রবল আত্মবিশ্বাসী বলে সুপরিচিত।
মাইনিং নিয়ে লেখাপড়া করতে গিয়েছিলেন হায়দ্রাবাদে । খুচরো বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে। কোর্স অসম্পূর্ণ থেকে গেল মাঝপথে। ভর্তি হলেন ওসমানি বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াশোনার বিষয় পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। এই বিষয় নিয়েই প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ। এটাই তাঁর একধরনের আত্ম অনুসন্ধান আর আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রাথমিক সিঁড়ি। এই সিঁড়ি বেয়েই অন্যরকম চিন্তা-ভাবনা শুরু। হায়দ্রাবাদ থেকে বদলে গেলেও গন্তব্য, কোকরাঝাড়ে বাড়ি যাওয়ার পরিবর্তে সোজা হাজির মহানগর গুয়াহাটিতে। লক্ষ্য স্পষ্ট, চাকরির পিছনে ছুটবেন না। শিক্ষার স্বাধীন পেশা অবলম্বন করে উপার্জনের ব্যবস্থা গড়ে তুলবেন। শুরু হল লড়াই আর আত্মত্যাগ, তাঁর বিরামহীন চেষ্টা আর নিষ্ঠার সংযোগে তৈরি হল গুয়াহাটির প্রথম কলেজ ফর করেসপণ্ডেন্স, সঙ্গী জনৈক বন্ধু, মূলধন আত্মবিশ্বাস আর লাগাতার চেষ্টা।
কালক্রমে বাড়ল তাঁর আত্মবিশ্বাসের মানচিত্র, গড়ে উঠল একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয় পর্বেও স্মৃতির ওই প্রাথমিক লড়াই, লড়াকুর স্বপ্ন, জীবন-দর্শন আর নিজের পারিবারিক কাহিনি শোনাচ্ছেন বহুমুখী বিদ্যানিকেতনের খ্যাতিমান স্থপতি ও চেয়ারম্যান জাকির। আমিত্বহীনতার এ এক অসাধারণ বৃত্তান্ত।সম্পাদক
২.০৭.২০২৩
• দ্বিতীয় পর্ব •
আমাদের গ্রামে লেখাপড়ার পরিবেশ ছিল না,আদিবাসী আর বাঙালি মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা, বঙ্গভাষী হিন্দুরও বসবাস বিস্তর। কোকরাঝাড় শহরের চিত্র অন্যরকম। বরো, কাছারি আর বাঙালির পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ বসবাসে চিড় নেই, কখনো জাতিগত বিদ্বেষ মাথাচাড়া দেয়নি। আশেপাশের বিস্তীর্ণ গ্রামীণ অঞ্চলে কৃষিজীবীরা থাকতেন, এখনো আছেন, শিক্ষার হার নগণ্য, প্রায় সবাই দরিদ্র।
আমার মা গোয়ালপাড়া জেলার বৈঠামারি অঞ্চলের অসমিয়া পরিবারের সন্তান, তাঁদের এলাকায়ও শিক্ষা দেরিতে প্রবেশ করে, তবে বাঙালি মুসলিমদের চেয়ে অবস্থা উন্নততর, স্থায়ী চাষবাস, জমিজমা নিয়ে অনেকের দিন কাটত।রাস্তাঘাট বলতে কাঁচা মাটির সড়ক। চারপাশে জঙ্গল, জলাভূমি, অদূরে ব্রহ্মপুত্র। তখনকার গোয়ালপাড়ার সবকটা গ্রামেই দারিদ্র্য আর নিরক্ষরতা পাশাপাশি বিরাজ করত। শিক্ষাগ্রহণ তখন প্রায় অধরা স্বপ্ন। ব্যতিক্রম ছিল না, তা নয়, তবে মেট্রিকুলেট ও গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা হাতে গোনা। রাজবংশী, বরো, কোচদের অবস্থা আরো শোচনীয়। এরকম পরিবেশে যার জন্ম, যার পরিবারে বিশ শতকের গোড়ার দিকে শিক্ষা প্রবেশ করে, চাষবাস আছে, আর্থিক অবস্থানে মধ্যবিত্ত, শিক্ষার হাতছানিতে তার বিশেষ আগ্রহ থাকাটাই স্বাভাবিক।
লেখাপড়ায় ভালো ছিলাম। আমার স্কুল শিক্ষক আব্বা আমাকে স্থানীয় রাজবংশী গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি করে দিলেন। সহপাঠীদের মধ্যে আদিবাসী ও জনজাতির সংখ্যা নেহাৎ কম নয়, পাঠশালা পাশ করেই অনেকের প্রথাগত পড়াশুনো শেষ; এটাই নির্বিশেষের ছবি, মুসলিম-অমুসলিম সকলের।
অবিভক্ত গোয়ালপাড়া ছিল প্রান্তিক জেলা। বন্যা আর ভাঙন তাড়িত। খুবই দরিদ্র। কৃষিব্যবস্থাই জীবিকার প্রধান উৎস। কৃষকদের বড়ো অংশ মুসলিম। দুর্যোগ তাদের জীবনসঙ্গী। আদিবাসী আর জনজাতিরা চা-শ্রমিক কিংবা খুদে চাষি। শিক্ষাহীন, অর্থহীন। বরো-রাজবংশীদের চাষের জমি যৎসামান্য কিংবা ভিটে বাড়ি আছে, কিন্তু চাষবাসে উৎসাহ নেই।
বাঙালি মুসলিমরা বংশানুক্রমে কৃষক। চরাঞ্চলে, বনাঞ্চলে অনেকেই বাস করতেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দেশভাগজনিত সঙ্কট তাদের ধাওয়া করত। বাড়িতে গোয়ালপাড়িয়া কিংবা বাঙালি রীতিনীতি এবং বাড়ির বাইরে অসমিয়া পরিচিতি নিয়েও সন্দেহের শিকার। রাজনীতি তাদের ভাগ্যকে অনেকসময় বিড়ম্বিত করে দিত। কঠিন পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করত সমাজ। চেষ্টায় গাফিলতি ছিল না, তবু নিয়তির হাত থেকে নিস্তার ছিল না।
শৈশবেই সমাজ চেতনা আমাকে ভাবিয়ে তোলে, মুক্তির উপায় কী, অবগত নই, বুঝতাম আমাকে লেখাপড়া শিখে স্বাবলম্বী হতে হবে। আব্বা-আম্মার ইচ্ছায়ও সেরকম। প্রাইমারি পাশ করলাম। ভালো রেজাল্ট। আব্বা খুব খুশি। বাড়ি থেকে দু ‘কিলোমিটার দূরের এমই স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হল। গ্রামীণ বিদ্যালয়। স্কুলঘর, স্কুলের আসবাব সবই সেকেলে। শিক্ষকের অভাব, ছাত্রদের উপস্থিতির হারও অনিয়মিত। আসা-যাওয়ার রাস্তায় বর্ষায় কাদা, হেমন্তে ধুলো আর ধুলো।
এমই পাশ করে ওখানকার হাইস্কুলেই ভর্তি হতে হল। ম্যাট্রিকে প্রথম বিভাগ।আমার ওপর পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের সুনজরে আরো বেশি আলো পড়ল। রীতিমতো আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছি। উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরিধি বাড়ছে। কোকরাঝাড় কলেজে ভর্তি হলাম। শহরে থাকার জায়গা নেই। স্থানীয় একটি মসজিদের পাশে ঘরভাড়া করে থাকি। সায়েন্সের ছাত্র। মন দিয়ে পড়াশুনো করি। বাসনা, ইঞ্জিনিয়ার হব। উচ্চমাধ্যমিকেও রেজাল্ট ভাল হল। আসাম ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ভর্তি পরীক্ষায় বসেই প্রথম জোর ধাক্কা। আশাহত। কী করব, উপায় খুঁজছি, কলেজে সায়েন্স স্ট্রিমে ভর্তি হব- মনে প্রশ্ন জাগছে। হতাশার দেওয়ালও ভাঙছে, আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছি। জেদ বাড়ছে। মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে ডিপ্লোমা করব ভেবে অন্ধ্রপ্রদেশের এক কলেজে দরখাস্ত করলাম। সুযোগ এসে গেল। হায়দ্রাবাদে চলে গেলাম। অজানা পরিবেশ। স্থানীয় ভাষা জানিনা, ইংরেজিতে সড়গড় নই, দক্ষিণে হিন্দি অচল। পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময় লাগছে। ক্যাম্পাসের বাইরে যাওয়ার অবকাশ নেই। ঘোরাঘুরির আয়তন সীমাবদ্ধ, কলেজ আর বাসস্থানেই আমি বন্দী।
দুবছরের কোর্স। থিওরিতে মসৃণ রেজাল্ট। প্র্যাক্টিকেলে পাঠানো হল। বুঝতে পারলাম, আমার মাইনিং নিয়ে পড়াশুনো হবে না, খামোকা সময় আর অর্থ খরচ হল, কয়েকদিন আক্ষেপ চেপে ধরল, মন ভার। অস্থিরতা কাটাতে হায়দ্রাবাদের ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। এক্সটার্নাল ছাত্র হিসেবে। সঙ্গী হল নিষ্ঠা। পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিয়ে বি.এ-এম.এ পাশ করলাম।
হায়দ্রাবাদ আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়েছে। ব্যর্থতা আর সাফল্য ছুঁয়ে ভবিষ্যতের দিশা খুঁজে পেলাম,ওখানেই। চাকরি নয়, স্বাধীন শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে থাকার ইচ্ছা জাগল। চাকরির সন্ধানে ছুটলে হবে না। জানতাম, হয়রানি আর হতাশা ঘিরে ধরবে। অতএব, শিক্ষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অভিনব অভিমুখ খুঁজে পেলাম। হায়দ্রাবাদ থেকে ফেরার পথে ঠিক করলাম, আপাতত বাড়ি ফিরব না। সোজা গুয়াহাটি চলে আসব। যাপনের রাস্তা খুঁজব।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান শহর হলেও গুয়াহাটি তখন আয়তনে এত প্রশস্ত নয়। নানা জাতি, উপজাতি আর সম্প্রদায়ের বসবাস বাড়ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যে অগ্রগণ্য। মেঘালয়, মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যাণ্ডের বাসিন্দারা নির্বিঘ্নে এখানে এসে বাস করতেন, লেখাপড়া করতে পাহাড়ি রাজ্যের ছাত্ররা দলে দলে আসে। তারা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে থাকে। তখনো বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছড়াছড়ি নেই। শহর বড়ো হচ্ছে, দ্রুত খানাপাড়া থেকে বরঝাড়, পান বাজার থেকে দিসপুর ও চান্দমারির প্রান্তিক এলাকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। জনসংখ্যাও বাড়ছে। প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, বেসরকারি আইন কলেজ একটিও নেই। সরকারি স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রভর্তির প্রবল চাপ। উচ্চবিত্ত পরিবারের বিশেষ আকর্ষণ শুধু কটন, বি বরোয়া, প্রাগ্ জ্যোতিষপুর, সন্ধিকৈই কলেজ, গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়, অসম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও মেডিক্যাল কলেজ। মেধার ভিত্তিতেই ভর্তি আর হস্টেলে থাকার ব্যবস্থা ।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু ছাত্র মেসে থাকত। মহানগরে কলেজে পড়ার সুযোগ না পেয়ে অনেকেই দিল্লি, ব্যাঙ্গালোর, চেন্নাই ও হায়দ্রাবাদে চলে যেত। তখনো ডিসটেন্স এডুকেশনের ধারণা গড়ে ওঠেনি।
গুয়াহাটিতে আমার এক বন্ধুর বাড়ি। আমরা এক সঙ্গে হায়দ্রাবাদে মাইনিং নিয়ে পড়াশুনো করতাম। অসমে আমরা কী করতে পারি, কী করা উচিত, দুজনেই চিন্তা-ভাবনা শুরু করি। সিদ্ধান্ত নিলাম, ডিস্টেন্স এডুকেশন সেণ্টার চালু করব, যৌথ মালিকানায়। খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারি, শূন্যমাঠ। আমরাই প্রথম প্লেয়ার।সফল হলে হয় গোল পোস্ট ক্রস করব, নয় তো ব্যর্থতা নিয়ে ভিন্ন রাস্তা খুঁজব। দুজনেরই পকেট শূন্য। অভিজ্ঞতা নেই। বাড়িতে টাকা চাইব, সঙ্গতি নেই।
আমার বন্ধু মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। সেও তার অভিভাবকদের কাছে টাকা চাইতে পারল না। অর্থের সংস্থান কিংবা থাকার ঠিকানা মিলছে না। কোথায় অনাগত শিক্ষাকেন্দ্র শুরু করব–সে রকম জায়গার সন্ধানে প্রতিদিন ছুটছি তো ছুটছি।
মাঝি যখন নৌকা চালায়, তার একটি অপরিহার্য দিশা থাকে। যাঁরা দাঁড় টেনে এগিয়ে যান, তাঁদেরও ঝড়ঝাপটা, অনুকূল-প্রতিকূল হাওয়া সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে হয়। বিনীতভাবে বলছি, মাঝির দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠার অভাবকে কখনো প্রশ্রয় দিই না। আমার সহযোগীরাও নিজ নিজ কাজ সামলে নেওয়ার মতো যোগ্য আর দক্ষ
হায়দ্রাবাদ থেকে ফিরে প্রথমে আমি একটি ছোট্ট হোটেলে উঠি। পকেটের টাকা-কড়ি ফুরিয়ে আসছিল। গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন জালুকবাড়িতে এক কামরার একটি ঘর ভাড়া নিলাম। দিনভর পরিশ্রম করতে হয়। রান্নাবান্না নিজেই করি। জালুকবাড়ি থেকে বিভিন্ন এলাকায় ছুটে বেড়াই। কোথাও উপযুক্ত বাড়ির সন্ধান মিলছে না। কেউই দুই বেকারকে ঘর ভাড়া দিতে আগ্রহী নয়, সালামি চায়, অ্যাডভান্স ভাড়া দাবি করে। আমরা, নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত, ঠিক করলাম, বর্ধিষ্ণু জালুকবাড়ি এলাকায় দূরশিক্ষার পাঠক্রম চালু করব। সরঞ্জাম নেই। শিক্ষাদাতা মাত্র দুজন। বিশেষ সাড়া মিলল না; ব্যর্থতা অতিক্রম করতে ব্যস্ত। জেদ আর পরিশ্রমটাই সম্বল।
অসমে তখন অগপ সরকার। রাজ্যের নানা প্রান্তে মাথা তুলছে দৌরাত্ম্য। দিল্লিতেও ব্যাপক অস্থিরতা, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়াস চালাচ্ছে বিরোধী শক্তি। অগপও ঐক্যের শরিক হতে চাইছে। তাদের ওপর প্রবল ত্রিমুখী চাপ। আপার অসমে স্বাধীন অসমের দাবিদার আলফার, নিম্ন অসমে বরো জঙ্গিদের। দিল্লি অগপ শাসকের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত। সাধারণ মানুষকে তাড়া করছে আতঙ্ক আর সন্দেহ। অচেনা মুখ মানেই ভুল গতিবিধি! অপরিচিত যুবক দেখলেই স্থানীয় অবিশ্বাস ধেয়ে আসে। বাড়িওয়ালারা ঘর ভাড়া দিতে চায় না। আধা সেনাও গোল গোল চোখে তাকিয়ে থাকে।
অনেক ধরাধরির পর, অবশেষে, বরা সার্ভিসের কাছে একটি ঘরের সন্ধান মিলল, আর এই বাড়িতেই ১৯৮৯ সালে ন্যাশনাল কলেজ ফর করেসপন্ডেন্স পাঠক্রম চালু করি। ওই বন্ধু তখনও আমার সহযোগী। সে অতৃপ্ত। আমি ধৈর্যের পরীক্ষায় অবতীর্ণ। আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতা একবছরেই শেষ। তবু, আমি নিঃসঙ্গ নই, একক লড়াকু। বিরামহীন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কুল্লে ১৮০০ টাকার মূলধন আর দুঃসাহসী স্বপ্ন আমার সঙ্গী।
গতি শ্লথ, আমাদের শিক্ষাকেন্দ্র ক্রমশ পরিচিত হয়ে উঠছে। বাড়ছে আমার উৎসাহ। মাসান্তে একটু একটু সঞ্চয় হচ্ছে। শুধু করেসপন্ডেন্স কোর্স নিয়ে সন্তুষ্ট নই। অন্যান্য শিক্ষার চাহিদা অনুভব করছি। ভাবছি, আরো বড়ো ক্যানভাসে ভিন্নতর প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার। প্রাসঙ্গিক জ্ঞানার্জনও জরুরি। কেবল সংগঠন গড়লে হবে না, উদ্যোগের পাশাপাশি প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থা খতিয়ে দেখে নতুন সুযোগ খুঁজতে হবে।
আমি নিজেকে যথাসম্ভব তৈরি করতে থাকি। নতুন সম্ভবনাও খুঁজে বেড়াচ্ছি। গুয়াহাটিতে উচ্চশিক্ষার বেসরকারি বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের ঘর তখন শূন্য। সহমর্মীদের পরামর্শে ঝুঁকি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। পরিকাঠামো নেই, অর্থবল জনবল কিছুই নেই। শিক্ষাদাতা নেই। এতসব নেই-এর সংসারে আমার অ্যাকাডেমিক ধ্যান-ধারণাও সীমিত। দেশ-বিদেশের পাঠক্রম খতিয়ে দেখে নিজেকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করছি। রাত জেগে প্রায় নিয়মিত শিক্ষা বিষয়ক বই পড়ি। কোথায়, বেসরকারি উদ্যোগে, কী কী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে, খবর নিচ্ছি । এভাবে ধারণা নির্মিত হচ্ছে। বুঝতে পারছি, চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। যা এ যাবৎ হয়নি, সেটাই আমাকে করতে হবে। দায় বাড়বে, পরিশ্রম বাড়বে, একাগ্র নিষ্ঠা নিয়েই গড়তে হবে নতুন প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৩ সালে একক প্রয়াসে গড়ে উঠল এনইএফ জুনিয়র কলেজ। বরা সার্ভিসের কাছে, একটি ভাড়া বাড়িতে। তখন আমিই কর্মী, আমিই সংগঠক, আমিই আমার প্রতিষ্ঠানের প্রচারক। স্থির করলাম, শিক্ষা নিয়ে নিছক ব্যবসা নয়, উপযুক্ত বিদ্যা জোগাতে হবে, আধুনিক পাঠক্রম তৈরি করতে হবে এবং সবদিক থেকে আমাদের শিক্ষা নিকেতন যেন বিদ্যা অর্জনের অন্যতম সেরা আর আদর্শ প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে।

২০২৩ , দেশের সেরা ১০০ আইন মহাবিদ্যালয়ের স্বীকৃতি প্রদান অনুষ্ঠানে সম্মানিত এনইএফ আইন কলেজ
আমি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। দিবাস্বপ্ন নয়। বাস্তবের চিত্র আঁকি। ভাবাবেগে যুক্তির সঙ্গে বুদ্ধির সমন্বয় তৈরিতে অভ্যস্ত। সম্ভবত, এ কারণে এনইএফের প্রতিটি শাখায়, পরিকাঠামো নির্মাণে, ফ্যাকাল্টি নির্বাচনে, সিলেবাস তৈরিতে আবেগ, যুক্তি আর সামাজিক দায়বদ্ধতার সংযোগ কখনও উপেক্ষিত হয়নি। আশা করি, ভবিষ্যতেও হবে না।
মাঝি যখন নৌকা চালায়, তার একটি অপরিহার্য দিশা থাকে। যাঁরা দাঁড় টেনে এগিয়ে যান, তাঁদেরও ঝড়ঝাপটা, অনুকূল-প্রতিকূল হাওয়া সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে হয়। বিনীতভাবে বলছি, মাঝির দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠার অভাবকে কখনো প্রশ্রয় দিই না। আমার সহযোগীরাও নিজ নিজ কাজ সামলে নেওয়ার মতো যোগ্য আর দক্ষ।
শুরুর দিকে অনেক সময় খাবার জুটত না। আমি তখন সঞ্চয়ের আকর্ষণে ব্যস্ত। সঞ্চয় বাড়ল। স্বাবলম্বী হয়ে উঠছি। প্রতিষ্ঠানের বিস্তার ঘটছে। নাম-ডাক ছড়াচ্ছে। একদিন বাড়ি গিয়ে আব্বাকে বললাম, পুরনো ঘরের খড়ের ছাউনিতে টিন লাগিয়ে দিই। শুনেই আব্বা বললেন, আগে বাড়ির কাছের মসজিদটি নতুন করে নির্মাণ করো।তাঁর নির্দেশে বাড়ি-সংলগ্ন মসজিদের আরসিসি বিল্ডিং তৈরি হল। এখনো এ মসজিদের খরচ যুগিয়ে আমি আনন্দ পাই।
নেক ইনসান ছিলেন আমার আব্বা । পরোপকারী। পরধর্ম সহিষ্ণু দেশপ্রেমিক। অতীতের দিকে তাকাতেন না। বর্তমানের সঙ্গে বসবাস করতেন। তাঁর কয়েকটি উপদেশ স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বলেছিলেন, ১. ধর্ম নিয়ে কখনো তর্ক-বিতর্ক করবে না। ২. কোনো সামাজিক সংগঠনের ক্যাশিয়ার হবে না। ৩. নিজেকে কখনো ছোটো ভাববে না।
আমি আব্বার আদর্শ মেনে চলি। অনেক সময় সামাজিক কাজের দায়িত্ব নিতে হয়। প্রান্তিক মানুষের কাছে দাঁড়াবার চেষ্টা করি। কিন্তু ক্যাশিয়ার হওয়ার প্রসঙ্গ এলে নিজেকে সামলে নিই।
আব্বা ছিলেন, দীর্ঘাঙ্গ দীর্ঘায়ু । তাঁকে শয্যাশায়ী হতে দেখিনি। কঠোর পরিশ্রম করতেন। তর্ক-বিতর্ক এড়িয়ে চলতেন। ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। নিয়মিত নামাজ-রোজা করতেন। বিশেষ কোনো রোগ ছিল না। শতায়ু-পেরিয়েও দিব্যি হাঁটাচলা করতেন। গম্ভীর ব্যক্তিত্ব, ঠোঁটে ছিল অফুরন্ত হাসি । একদিন মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়ে এসে ঘুমিয়ে পড়লেন, আর জাগলেন না, ঘুমন্ত অবস্থায় চিরনিদ্রায় প্রবেশ করলেন। তখন তাঁর বয়স ১০১। এরকম ক্লেশহীন (!) মৃত্যু, সচরাচর দেখা যায় না।
আমার যা কিছু সাংগঠনিক অর্জন, প্রেরণার দিক থেকে তার অনেকটারই উৎস ছিলেন আব্বা। ত্রিকালদর্শী যুগপুরুষ, সুখে-দুঃখে হামেশা আমার সঙ্গী আর অদৃশ্য উপদেষ্টা।
ক্রমশ…
আরো পড়ুন⇒ প্রথম পর্ব
❤ Support Us